ভবিষ্যতের খাবার ॥ মাংসের বদলে পোকামাকড় by এনামুল হক
বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না খাদ্য উৎপাদন। ফলে দুইয়ের মধ্যে একটা ব্যবধান একটু একটু করে বাড়ছে। খাদ্যদ্রব্যের দামেরও কোন স্থিরতা থাকছে না। আগামীদিনে জনসংখ্যা ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা এক গুরুতর দ্বন্দ্বের মুখে পড়বে।
খাদ্যের ভবিষ্যত নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান তাঁরা বলেনÑআগামীতে আমরা কি খাব তা নতুন করে ভেবে দেখতে হবে। এমনও হতে পারে যে তখন আমাদের পাত থেকে মাংস বিদায় নেবে; সে জায়গায় স্থান পাবে কীটপতঙ্গ।
বিশ্বব্যাপী বিশেষত পাশ্চাত্যে মাংসের দাম আহার্য তালিকার ওপর বিরাট প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। খাদ্য শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কারও কারও হিসেবে ব্রিটেনে আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে মাংসের দাম দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। ফলে মাংস তখন বিলাস সামগ্রীতে পরিণত হবে।
পাশ্চাত্যের অনেকে শৈশব থেকে সস্তা ও পর্যাপ্ত পরিমাণে মাংস খেয়েই বড় হয়ে উঠেছে। তারাই আজ দেখতে শুরু করেছে যে দাম বেড়ে যাওয়ায় মাংস আজ মহার্ঘ্য বস্তুতে পরিণত হতে চলেছে। ফলে লোকে আজ মাংসের ঘাটতি পূরণের নতুন উপায়ের সন্ধান করছে। ভাবছে যে আমাদের উদরপূর্তির ব্যবস্থা কি দিয়ে হবে? কিভাবেই বা হবে?
খাদ্যের ভবিষ্যত বিশেষজ্ঞ মর্গেইন গায়ে এক অদ্ভুদ সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আমাদের প্রধান খাদ্য হয়ে দাঁড়াবে কীটপতঙ্গ বা পোকামাকড়। তখন এগুলো মিনি লাইভস্টক বা ক্ষুদে গবাদিপশু হিসাবে পরিচিত হবে। এতে সব কুল রক্ষা পাবে। সাধারণ মাংসের যে পরিমাণ পুষ্টিগুণ আছে পোকামাকড়ও সেই পরিমাণ পুষ্টিমান যোগাবে। নেদারল্যান্ডসের একদল গবেষকের মতেÑপোকামাকড় হবে প্রোটিনের এক বিরাট উৎস। গবাদিপশু পালনে যে খরচ পোকামাকড়ের পেছনে তার চেয়ে খরচ হবে অনেক কম। এরা পানিও খাবে কম। তাছাড়া এদের থেকে কার্বন নিঃসরণও অনেক কম হবে। পৃথিবীতে ১৪শ’ প্রজাতির কীটপতঙ্গ বা পোকামাকড় আছে, যা মানুষের খাওয়ার উপযোগী।
গায়ে যা বলেছেন তার মানে অবশ্য এই নয় যে, কীটপতঙ্গ বা পোকামাকড় জ্যান্ত ধরে প্লেটে করে আমাদের সামনে হাজির করা হবে এবং আদিবাসীদের মতো আমরা তা ধরে গপ গপ করে খাব। না, তা নয়। সব কিছুই ঠিক থাকবে। শুধু উপকরণ হিসেবে মাংসের স্থান গ্রহণ করবে কীটপতঙ্গ। তখনও বার্গার ও সসেজ পাওয়া যাবে। তবে সেগুলো হবে কীটপতঙ্গের পুর দেয়া। দেখতে একই রকমের। শুধু স্বাদটাই আলাদা। ঝিঁঝিঁপোকা ও ফড়িং মেরে সেগুলো বার্গারের উপকরণ হিসেবে কাজে লাগানো হবে। ওলন্দাজ সরকার কীটপতঙ্গকে আহার্যের মূল ধারায় নিয়ে আসার জন্য গুরুত্বের সঙ্গে অর্থ বিনিয়োগ করছে। সম্প্রতি এই সরকার এ সংক্রান্ত গবেষণার কাজে ও কীটপতঙ্গের খামার পরিচালনার আইন প্রণয়ণ করতে ১০ লাখ ইউরো বিনিয়োগ করেছে।
বিশ্বের জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশ ডায়েটের নিয়মিত অংশ হিসেবে আগে থেকেই কীটপতঙ্গ গ্রহণ করে আসছে। শুঁয়াপোকা ও পঙ্গপাল আফ্রিকায় জনপ্রিয়। জাপানে বোলতা একটা রুচিকর খাবার। থাইল্যান্ডের মানুষ ঝিঁঝিঁ পোকা খেয়ে থাকে। তবে গায়ে মনে করেন যে, খুঁতখুঁতে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ও উপাদেয় হতে গেলে কীটপতঙ্গের ইমেজ ঢেলে সাজানোর দরকার হবে। একটা উপায় হলো নাম বদলে ফেলা। কীটপতঙ্গ শব্দটা তুলে ফেলে সে জায়গায় মিনি-লাইভস্টকের মতো কোন কিছু ব্যবহার করা গেলে সেগুলো তখন জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
মানুষ তো কত রকম খাবার খেতে অভ্যস্ত। যুগে যুগে দেশে দেশে মানুষের খাবারের উপকরণ পাল্টেছে, ধরন বদলেছে। প্রাচীন গ্রীসে মানুষের ব্রেকফাস্ট ছিল মদে চুবানো রুটি। প্রাচীন রোমের মানুষ গারুম নামে এক জাতীয় খাবার বেশ পছন্দ করত। এটা একটা সসবিশেষ যা মাছের নাড়িভুঁড়ি নিয়ে তৈরি এবং দীর্ঘক্ষণ রোদে রেখে গাজিয়ে নেয়া। টিউডরদের যুগে খাবারের তালিকায় ছিল ডলফিনের রোস্ট। রাজা অষ্টম হেনরির ভোজসভায় থাকত ময়ূর, বক, শুশুক ও শঙ্খচিল।
যুগের পরিবর্তন ও খাদ্যের যোগানে রূপান্তর আসার পর যদি দেখা যায় কীটপতঙ্গ ভালভাবেই মানুষের আহার্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। প্রোটিনের বেশ ভাল উৎস হতে পারে কীটপতঙ্গ। যেমন শুঁয়াপোকায় প্রোটিন আছে ২৮.২ গ্রাম, আয়রন আছে ৩৫ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম। ফড়িংয়ে প্রোটিন ২০.৬ গ্রাম, ক্যালশিয়াম ৩৫.২ মিলিগ্রাম ও আয়রন ৫ মিলিগ্রাম। ডাং ব্রিটলে ১৭.২ গ্রাম প্রোটিন, ৩১ মিলিগ্রাম ক্যালশিয়াম ও ৭.৭ মিলিগ্রাম আয়রন।
শব্দ স্বাদকে প্রভাবিত করে
স্বাদের ওপর শব্দেরও একটা প্রভাব আছে। এ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্র প্রসারিত হচ্ছে। দেখা গেছে যে, কয়েক ধরনের টোন বা শব্দ খাবারের স্বাদের পরিবর্তন আনতে পারে। খাবার আরও মধুর লাগতে পারে কিংবা উগ্র মনে হতে পারে। লঘুমাত্রার সঙ্গে খাবারের স্বাদ আরও কটু লাগতে পারে। পিয়ানো বা বেলে বাজানো চড়া লয়ের শব্দে স্বাদ আরও মধুর হয়ে ওঠে।
ব্রিটেনের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক চার্লস স্পেন্স এক গবেষণা চালিয়ে দেখতে পান যে, নেপথ্য সঙ্গীতের লয় বা গ্রামের মাত্রার পরিবর্তন ঘটিয়ে খাবারের স্বাদের হ্রাস-বৃদ্ধি করা যায়। জোন্স বলেন, মস্তিষ্কে কি ঘটে সে ব্যাপারে এখনও আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত নই। তবে কিছু একটা যে ঘটে সেটা সত্যিই বেশ রোমাঞ্চকর।
টেস্টটিউব বার্গার
এ বছরের গোড়ার দিকে ওলন্দাজ বিজ্ঞানীরা সাফল্যের সঙ্গে ইনভাইট্রো মিট বা কালচারকৃত মাংস উৎপাদন করেছেন। তাঁরা গরু থেকে নেয়া স্টেমসেল ব্যবহার করে কয়েক স্ট্রাইপ পেশী টিস্যু জন্মিয়েছেন যা দেখতে কার্লামারির মতো। তাঁরা আশা করেন যে, এ বছরের শেষ নাগাদ তাঁরা বিশ্বের প্রথম টেস্টউিটব ‘বার্গার’ তৈরি করতে পারবেন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, গরু-ছাগল জবাই করে মাংস সংগ্রহ করার চাইতে ল্যাবে মাংস তৈরি করা অনেক লাভজনক। এতে গ্রীনহাউজ গ্যাস উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমবে। জ্বালানি ও পানির ব্যবহারও যথেষ্ট হ্রাস পাবে। ল্যাবে মাংস উৎপাদনের জন্য জমিও লাগবে সামান্য। গবাদিপশু পালনের জন্য যে পরিমাণ জমি লাগে তার অতি সামান্য অংশ লাগবে। তাছাড়া ল্যাবের মাংসে চর্বি উপাদান বাদ দিয়ে অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যোগ করা যেতে পারে।
তবে এখন পর্যন্ত যেহেতু এ জাতীয় মাংসের অস্তিত্বই নেই; তাই এ ধারণা গ্রহণ করা মানুষের জন্য কঠিন হবে। কিন্তু ওলন্দাজ বিজ্ঞানী দলের প্রধান অধ্যাপক মার্ক পোস্ট বলেনÑল্যাবের মাংস ও প্রকৃত মাংসের মধ্যে পার্থক্য টানাই যাবে না। তবে দেখতে হয়ত দুটো জিনিস সম্পূর্ণ আলাদা লাগবে।
এ্যালজি
খাদ্য চক্রের একেবারে নিচে অবস্থান হলেও এ্যালজি খাদ্য সমস্যাসহ বিশ্বের সবচেয়ে জটিল কিছু সমস্যার সমাধান দিতে পারে। মানুষ ও জীবজন্তুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তাছাড়া এ্যালজি থেকে পাওয়া যেতে পারে বায়োফুয়েল।
সমুদ্র শৈবাল
বিশ্বে ১০ হাজার রকমের সমুদ্র শৈবাল আছে যার মধ্যে ১৪৫ প্রজাতির লাল, বাদামি বা সবুজ শৈবাল খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কারো কারো মতে এ্যালজি ফার্মিং বিশ্বের বৃহত্তম ফসল শিল্পে পরিণত হতে পারে। অবিশ্বাস্য হারে বৃদ্ধি পাওয়া এই শৈবাল আগামী দিনে আমাদের খাদ্য সঙ্কট মেটাতে দারুণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
No comments