প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পীর শাহ আবদুল মতিন (রহ) by অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম
যশোরের খড়কী শরীফের পীর হযরত মওলানা শাহ সূফী মোহাম্মদ আবদুল মতিন রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি ছিলেন বর্তমানকালের একজন শ্রেষ্ঠ সূফী। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর এই মহান সূফী প্রায় নব্বই বছর বয়সে লাখো মুরীদ ও ভক্ত রেখে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু আল্লাহ জাল্লা শানুহুর মহান দরবারে প্রত্যাবর্তন করেন।
তাঁর পবিত্র দেহ যখন কবর নিবাসে রাখা হয় দখন ভীষণ প্রকম্পনে প্রকম্পিত হয় পৃথিবীর বক্ষ। আর সেই ভূমিকম্প বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী কয়েকটি দেশেও অনুভূত হয়। আল্লাহর ওলীগণের কারামত সত্য, সে সত্য কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক ঘটনার সত্যতা সবাই টের পায়।
খড়কী শরীফের পীর পরিবারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই পরিবারের এক বুযুর্গ পূর্বপুরুষ ইয়ামেন থেকে তদানীন্তন হিন্দুস্তানে ইসলাম প্রচারের জন্য আগমন করেন সুলতানী আমলে। এই বংশেরই সৈয়দ সুলতান (রহ.) মুঘল সেনাপতি রাজা মানসিংহের সঙ্গে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে তদানীন্তন যশোর আগমন করেন। রাজা প্রতাপাদিত্যের বাহিনীর সঙ্গে মুঘল বাহিনীর ভীষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে প্রতাপাদিত্য পরাজিত হন। ফিরে যাবার পথে যশোরের চাঁচড়ার রাজা শুকদেব সিংহ রায় রাজা মনিসিংহের নেতৃত্বে পরিচালিত এই বাহিনীকে বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। সৈয়দ সুলতান এখানকার মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে অভিভূত হয়ে যান। তিনি এখানে থেকে যান ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে।
রাজা শুকদেব সিংহ রায় তাঁকে রাজবাড়ীর খিড়কীর দিকে বেশকিছু নিষ্কর জমি দিয়ে দিলেন। সৈয়দ সুলতান এখানে একটা খানকা স্থাপন করে বাস করতে লাগলেন। তিনি ইসলাম প্রচার ও তাসাওউফের তা’লীম দেবার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। শত শত মানুষ তাঁর সান্নিধ্যে এসে সত্য-সুন্দরের আলোয় উদ্ভাসিত হলো এবং মানবতার শিক্ষা লাভ করতে লাগল। সৈয়দ সুলতানের বংশধারায় পরম্পরাগতভাবে বহু আল্লাহর ওলীর আবির্ভাব ঘটে। ইতোমধ্যে খিড়কী জনপদ খড়কী নামে পরিচিত হয়েছে। সৈয়দ সুলতানের উত্তর পুরুষ হযরত মাওলানা শাহ্ মোহাম্মদ আবদুল করিম রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি এই সিলসিলার ব্যাপক প্রসার ঘটান। বাংলা ভাষায় তাসাওউফ চর্চার পথ সুগম করে দেন। তিনিই বাংলা ভাষায় সর্ব প্রথম মৌলিক, নির্ভরযোগ্য এবং প্রামাণিক তাসাওউফ গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থের নাম এরশাদে খালিকীয়া বা খোদা প্রাপ্তি তত্ত্ব। এখনও এই গ্রন্থ পাঠক সমাদৃত রয়েছে। বাংলা ভাষায় এই গ্রন্থের মতো সংস্করণের পর সংস্করণ অন্য কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয় বলে আমাদের জানা নেই। এই গ্রন্থ সম্পর্কে সৈয়দ আলী আহসান ও মুহাম্মদ আবদুল হাই যৌথ গ্রন্থনায় প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বলা হয়েছে : শাহ মোহাম্মদ আবদুল করিম ছিলেন নক্শবন্দিয়া তরীকার একজন কামেল সূফী সাধক। নিজের জীবনে সূফীতত্ত্বের আমল করেছিলেন বিধায় দুরূহ সূফী তত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। প্রথম থেকে চতুর্থ অধ্যায় তিনি তাছওয়াফের জটিল দার্শনিক তত্ত্বের মনোজ্ঞ ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং পঞ্চম থেকে নবম অধ্যায়ে সূফী সাধনার নক্শবন্দিয়া, কাদেরীয়া এবং চিশ্তীয়া তরিকার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। দশম বা শেষ অধ্যায় তিনি বেদ-পুরাণাদির প্রচলিত দার্শনিক বিষয়বস্তুর তত্ত্ব উদঘাটন করে ইসলামী সূফী মতবাদের সঙ্গে তার একটি তুলনামূলক সমালোচনা করেছেন। শাহ্ মোহাম্মদ আবদুল করিমের খোদা প্রাপ্তি তত্ত্বের মত বাংলায় তাছওয়াফ সম্পর্কিত বই আর দ্বিতীয় দেখা যায় না। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ২য় সংস্কারণ পৃ. ১৫৩)।
শাহ মোহাম্মদ আবদুল করিম রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর ইন্তিকাল করলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত মওলানা শাহ মোহাম্মদ আবু নইম রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি পিতার কায়েম মকাম বা সাজ্জাদানসীন হন। তিনি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্তিকাল করেন। তাঁর স্থলভিষিক্ত হন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা হযরত শাহ আবুল খায়ের রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি। তিনি ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুলাই ইন্তিকাল করেন। তাঁর স্থলভিষিক্ত হন মওলানা শাহ্ মোহাম্মদ আবদুল করিম রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হির পৌত্র ওলীয়ে মাদারজাদ কুত্বে যামান হযরত মওলানা শাহ্ সূফী আবদুল মতিন রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি। তিনি সাজ্জাদানসীন তথা খড়কী শরীফের গদ্দীনসীন পীর হন। তিনি আবির্ভূত হন তাসাওউফ আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। তিনি অচিরেই কুত্্বিয়াতের উচ্চ মাকামে অধিষ্ঠিত হন। নবউদ্যমে খড়কী দরবার শরীফ জেগে ওঠে।
শাহ্ মোহাম্মদ আবদুল মতিন রাহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি ছিলেন নক্শীবন্দীয়া তরীকার পীর। এই তরীকা ওকুফে কল্বী, ওকুফে আদাদী, ওকুফে জামানী, হুশদরদম, নযর বরকদম, সফর দরওয়াতন, খিলাওয়াত র্দ আঞ্জুমান ইয়াদ কর্দ, বাজা গশ্ত, নিগা দাশুত, ইয়াদ দাশ্ত প্রভৃতি সবকের মধ্য দিয়ে আগুয়ান হন। এগুলো রপ্ত করতে গভীর পরিশ্রম করতে হয়। এই তরীকার ব্যাপক প্রসারে খড়কী দরবারের অবদান সর্বজনবিদিত। শাহ মোহাম্মদ আবদুল মতিন রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর বহু মুরীদকে এই তরীকার তা‘লীম দিয়ে সার্থক মঞ্জিলে নিয়ে যান। তাঁকে খিলাফতের নিদর্শনস্বরূপ টুপী ও পাগড়ী পরিয়ে দেন সারাগোদার গদ্দীনসীন পীর প্রফেসর খাজা হাফেজ মোহাম্মদ আহ্মদ। সেই সময়কার অনুভূতি সম্পর্কে তিনি বলেছেন : যখন আমার মাথায় খিলাফতের পাগড়ী পরিয়ে দেয়া হচ্ছিল তখন আমি শুনলাম বিশ্বজগতের সর্বত্র উচ্চস্বরে আল্লাহ্র যিক্র হচ্ছে এবং আমার চারদিকে একটা উজ্জ্বল বৃত্ত সৃষ্টি হয়েছে।। হযরত মওলানা শাহ্ মোহাম্মদ আবদুল মতিন রহমতুল্লাহি ‘আলায়হি ছিলেন বর্তমান কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কামিল পীর। বাংলাদেশের বাইরেও তাঁর মুরীদ সংখ্যা অনেক। ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর এলাকাসহ বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই তাঁর মুরীদ ও ভক্ত রয়েছেন। তিনি ছিলেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সুন্নাতের অনুসারী। তিনি খুবই সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। সাদা পোশাক পরিধান করতেন। উচ্চস্বরে কথা বলতেন। তাঁর চেহারা মুবারকে মুচ্কি হাসির রেখা দেদীপ্যমান থাকত। তাঁর সান্নিধ্যে যাঁরাই এসেছেন তাঁরাই মুগ্ধ হয়ে গেছেন তাঁর অমায়িক ব্যবহার দেখে। প্রত্যেকের মনে হতো হুযূর আমাকেই বেশি ভালোবাসেন। তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল ছিলেন। তাঁকে রাগান্বিত হতে দেখা যায়নি।
তিনি কুরআন, হাদীস, ইলমে ফিক্হ ও আকাইদ বিষয়ে গভীর পা-িত্যের অধিকারী ছিলেন। বাংলা ও ইংরেজী ছাড়াও আরবী, উর্দূ, র্ফাসী ভাষার উপর তাঁর পূর্ণ দখল ছিল। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করে তিনি শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। ঢাকা থেকে বিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। খুলনা তেরোখাদা হাইস্কুল থেকে তাঁর শিক্ষকতা জীবন শুরু হয়। তারপর যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি যশোর শহরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী হাইস্কুল মুসলিম একাডেমীর হেড মাস্টার হন। এই সময়েই তিনি খড়কী দরবারের কায়েম মকাম ও সাজ্জাদানসীন পীর হিসেবে অভিষিক্ত হন। মুসলিম একাডেমী তাঁর পরিচালনায় বাংলাদেশের অন্যতম সেরা স্কুল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। শিক্ষকতা করা কালেও তিনি মুরীদদেরকে তা‘লীম তালকীন দিয়েছেন নিয়মিত। তাঁর দরবারে মানুষের ভিড় লেগেই থাকত।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে হযরত মওলানা শাহ সূফী মোহাম্মদ আবদুল মতিন রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার অন্তর্গত ঐতিহ্যবাহী মায়াহাটি কাজী মহল্লার মশহুর সৈয়দ পরিবারের কন্যা সৈয়্যেদা যায়েদা খাতুনের সঙ্গে শাদী বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের প্রথম সন্তান আলহাজ্জা মাহামুদা বেগম মায়ার শাদী হয় বৃহত্তর যশোরের মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী দ্বারিয়াপুর শরীফের ঐতিহাসিক পীর পরিবারের সন্তান অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূমের (বর্তমান লেখক) সঙ্গে, যিনি বর্তমানে দ্বারিয়াপুর শরীফের গদ্দীনসীন পীর। হযরত শাহ্ আবদুল মতিন (রহ.)-এর দ্বিতীয় সন্তান আলহাজ্জ আবুল হাসনাত পিন্টু ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি ইন্তিকাল করেছেন। তৃতীয় সন্তান আবু সাঈদ বাবলু ছিলেন প্রিমিয়ার ব্যাংকের এসভিপি। তিনিও ইন্তিকাল করেছেন। চতুর্থ সন্তান মঈনুল হাসান লাবলু ছাত্রাবস্থায় ইন্তিকাল করেন। পঞ্চম সন্তান আহসান হাবিব মনি বর্তমানে প্রাইম ব্যাংকের এসএভিপি, ষষ্ঠ সন্তান নাসরিনা বেগম নীলা স্বামী-পুত্র-কন্যা নিয়ে ঘরসংসার করছেন। সপ্তম সন্তান জাহিদ হাসান খুশ বর্তমানে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের যশোর শাখার ম্যানেজার, অষ্টম সন্তান কামরুল হাসান হাসু পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। তিনিই বর্তমানে খড়কী শরীফের গদ্দীনসীন পীর সাহেব। তাঁর বড় নাতি আরিফ বিল্লাহ মিঠু ছড়াকার ও ব্যাংকার।
হযরত মওলানা শাহ্ সূফী মোহাম্মদ আবদুল মতিন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে চার একর জমির ওপর আঞ্জুমানে খালেকীয়া নামে একটি অত্যাধুনিক ইয়াতীমখানা গড়ে তোলেন। চারতলা বিশিষ্ট এই ইয়াতীম খানার ইয়াতীমরা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষার পাশাপাশি জেনারেল ও বিজ্ঞান প্রযুক্তিগত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। ইতোমধ্যেই এখানকার বেশকিছু ইয়াতীম উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে চাকরীতে উচ্চপদে আসীন হয়েছে।
তাঁর আদেশ ও যতেœ বেশকিছু মূল্যবান গ্রন্থ খড়কী দরবার শরীফ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজেও কয়েকটি উর্দু গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : সন্ধানে, মীনারে নয়, আওলিয়া সংলাপ, নূর-ই খড়কী হেলালে মারেফত, মাকতুবাতে খাজা মোহাম্মত আহমদ খান, লামাতে কাদেরীয়া প্রভৃতি ।
তিনি খড়কী দরবার শরীফের প্রাচীন মসজিদটিকে ব্যাপক সংস্কার করে এর নামকরণ করেন বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আম্মার রাদি আল্লাহু তা‘আলা আন্হুর নামে মসজিদে আম্মার।
হযরত মওলানা শাহ্ সূফী মোহাম্মদ আবদুল মতিন রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি যুগশ্রেষ্ঠ আল্লাহ্র ওলী ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে তালীম গ্রহণ করে বহু লোক সূফী জীবন লাভ করেছেন।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
No comments