‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ by আলমগীর সাত্তার
১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার বাবা মারা যান। তখন আমার বয়স দশ বছর। ১৯৫০ সালে আমি বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলায় আমার মামার বাড়ি সুটিয়াকাঠি গ্রামের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হই। এর আগে আমি কোন স্কুলে পড়িনি। বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে পড়েছি। ১৯৫১-৫২ সালের কথা।
পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার মানুষদের মনে অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের অংশ হওয়ার কুফল বাঙালীরা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে।
১৯৪৮ সালেই জিন্নাহ সাহেব পূর্ববাংলায় এসে ঘোষণা করলেন, উর্দু কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বিষয়টা বাঙালীরা ভালভাবে মেনে নিতে পারেনি।
জিন্নাহ সাহেবের ছবি দেখলে সেই ছোটবেলায়ও আমার মনে তেমন ভক্তিভাবের উদ্রেক হতো না। মনে হতো কেমন যেন বেঢপ চেহারার মানুষ। যক্ষ্মা বা ওই ধরনের রোগের কারণে তার দেহ-কাঠামো কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিল। পায়জামা এবং আচকান পরা দীর্ঘ এবং শীর্ণ দেহের মুখাবয়বও শেষ বয়সে আর সুদর্শন ছিল না। তার ওপর তিনি আবার চোঙ্গা বা ডোঙ্গা আকৃতির টুপি পরতেন মাথায়। যক্ষ্মা রোগের কারণে তার ফুসফুসদ্বয়ের একটি নাকি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম বয়সে তিনি সুদর্শনই ছিলেন। পরতেন খুব আধুনিক পোশাক-পরিচ্ছদ। ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। শেষ বয়সে দৈহিক এবং মানসিকভাবে তার পচন ধরেছিল।
জিন্নাহ সাহেব ছেলেবেলা থেকে কেমন মেধাবী এবং বুদ্ধিমান ছিলেন সে সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ আমাদের পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করা হয়েছিল।
জিন্নাহ সাহেব তখন কেবল স্কুলছাত্র। ওই সময় একদিন তারা কয়েক বন্ধু দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। সব বন্ধু যে দিকে দৌড়াল, বালক জিন্নাহ দৌড়ালেন তার উল্টো দিকে। অন্যরা তার এই উল্টো দিকে দৌড়ানোর কারণ জিগ্যেস করলে, তিনি উত্তর দিলেন, তোমরা তো বলনি, কোন দিকে দৌড়াতে হবে?
শেরোয়ানি পরা শুরু করার পর থেকে আমার মনে হয় জিন্নাহ সাহেব কেবল উল্টো পথেই দৌড়িয়েছেন। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে তিনিই হলেন, এই উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রধানতম নেতা।
সেই ১৯৫১-৫২ সালে বাঙালীরা যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে উঠছে, তা পাকিস্তান সরকারও বুঝতে পারছিল। তারা মনে করল, বাঙালী মুসলমানরা খুবই নির্বোধ! আমরা পশ্চিম পাকিস্তানীরা তো সৈন্যসামন্ত নিয়ে এসে পূর্ববাংলা দখল করিনি! ওই নির্বোধরাই ভারত এবং হিন্দু বিদ্বেষের কারণে স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে যোগ দিয়েছে। এখন যদি আবার সেই ভারত এবং হিন্দু বিদ্বেষের উন্মাদনা সৃষ্টি করা যায়, তবে বাঙালীদের বোকা বানিয়ে নির্বিঘেœ শাসন-শোষণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া যাবে। এই শাসন-শোষণ প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলেও বোকা বাঙালীরা পাকিস্তান প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকবে। এ ব্যাপারে পাকিস্তানী শাসকদের চিন্তা একেবারে ভুল ছিল বলা যাবে না। আমার ছেলেবেলা অতিক্রান্ত হয়েছে ৬০-৬২ বছর আগে। এখনও দেখছি, আমাদের দেশের যথেষ্ট লোকের মাঝে ভারত বিদ্বেষের কমতি নেই। আর এই ভারত বিদ্বেষভাবকে মূলধন করে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তার স্ত্রী একই ফর্মুলা অনুসরণ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এই একই ফর্মুলা অনুসরণ করে তিনি যে আবার ক্ষমতাসীন হতে পারেন সে সম্ভাবনাও আছে।
১৯৫১-৫২ সালের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা পূর্ববাংলায় তাদের শাসন-শোষণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাঙালী মুসলমানদের মাঝে ভারত বিদ্বেষভাবটা চাঙ্গা করতে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করল। তারা প্রচার করতে শুরু করল, ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। আমাদের দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানী ব্রাদারদের উচিত হবে ভারতীয় এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা। তাছাড়া কাশ্মীর সম্পর্কে পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদ মিডিয়া ছিল খুবই সরব। তাদের বক্তব্য ছিল, কাশ্মীর রাজ্যের অধিকাংশ অধিবাসী মুসলমান। তাই সকল মুসলমানের কর্তব্য কাশ্মীর রাজ্যকে ভারতের কাছ থেকে দখলমুক্ত করা। বাংলা ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কাশ্মীর যে পাকিস্তানের অংশ হওয়া উচিত এ ব্যাপারে বাঙালীরাও পাকিস্তানীদের সঙ্গে সহমত পোষণ করত।
১৯৫১ বা ’৫২ সাল। পূর্ব পাকিস্তান সরকার এক আদেশ জারি করল, বাংলাদেশে যাদের একনলা বা দোনলা বন্দুক আছে তাদের সবাইকে নিকটতম মফস্বল শহরে গিয়ে আনসার এ্যাডজুট্যান্টদের অধীনে এক সপ্তাহের জন্য কুচকাওয়াজ এবং বন্দুক ও রাইফেল থেকে গুলি ছোড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। ব্যাপারটা ছিল পাকিস্তান সরকারের এক রকমের বড় ধরনের শঠতা। ভাবখানা ছিল এমন যে, ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান দখল করার জন্য আক্রমণ করে তবে আমরা বাঙালীরা একনলা আর দোনলা বন্দুক দিয়ে তা ঠেকিয়ে দেব।
সুটিয়াকাঠি গ্রামের বেশ কয়েক জনের বন্দুক ছিল। একে তো সন্ধ্যা নদীর তীরের গ্রাম। আর গ্রামের বেশিরভাগ লোকই ছিল অবস্থাপন্ন। তাই ডাকাতের ভয়ে অনেকেই বাড়িতে বন্দুক রাখত। গ্রামের লোকদের মাঝে যাদের কাছে বন্দুক ছিল, তাদের মাঝে একজনের নাম ছিল মোদাচ্ছের আলী। তিনি সম্পর্কে আমার নানা হতেন। তিনি নামের শেষে ‘এমইউবি’ লিখতেন। ব্যাপারটা যেন তার উপাধি। এমইউবি-এর অর্থ হলো, মেম্বার অব ইউনিয়ন বোর্ড। সবাই তাকে মোদাচ্ছের আলী এমইউবি বলেই সম্বোধন করত। তিনি ছিলেন বেশ ভাল মানুষ এবং একই সঙ্গে যথেষ্ট অর্থশালীও বটে। সুটিয়াকাঠি গ্রাম সংলগ্ন ইন্দুর হাট বন্দরে তার বেশ বড় একটি দোকান ছিল।
মোদাচ্ছের আলী এমইউবি অন্যদের সঙ্গে পিরোজপুর শহরে গিয়ে সাত দিনের ট্রেনিং নিয়ে এলেন। তখন তার বয়স প্রায় ৪০ বছর। শারীরিকভাবে তিনি একটু দুর্বল ছিলেন। ট্রেনিং নিয়ে এসে তিনি মহাখুশি। পাকিস্তানী যোশে তিনি তখন টগবগ করছিলেন। মনে হতো দোনলা বন্দুকটি নিয়ে বুঝি তিনি কাশ্মীর জয় করতে যাবেন।
১৯৭১ সালে আমি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিলাম। ওই সময় একদিন গেলাম প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয়ে। ওখানে গিয়ে সুটিয়াকাঠি অঞ্চলের অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। তাদের কাছে শুনলাম, পাক বাহিনীর গুলিতে মোদাচ্ছের আলী এমইউবি নিহত হয়েছেন। একাত্তরের জুন মাসের একদিন পাকবাহিনী গানবোটে করে এসে অতর্কিতে ইন্দুরহাটের ওপর আক্রমণ চালায়। ওই বর্বর বাহিনী বাজারের সব দোকানপাট আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। একই সঙ্গে গুলি চালিয়ে দুই থেকে তিন শ’ লোক হত্যা করে। পাকবাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিতে মোদাচ্ছের আলী এমইউবিও নিহত হন।
কিছুদিন আগে মামার বাড়ি সুটিয়াকাঠি গ্রামে গিয়েছিলাম। শুনলাম, মোদাচ্ছের আলীর ছেলে এখন বিএনপি দলের স্থানীয় একজন নেতা এবং পাকিস্তান সমর্থক।
আমার পৈতৃক নিবাস মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলায়। গ্রামের নাম গোপালপুর। ওই গ্রামে আমার বাবার জ্ঞাতি ভাইরা এবং আত্মীয়স্বজন থাকেন। তাদের মাঝে বাবার এক ফুফাত ভাইয়ের নাম ছিল মাহমুদ আলী। ১৯৫২ সালে তার বয়স ছিল ৩০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে। তাকে আমি মাহমুদ আলী চাচা বলে ডাকতাম। তিনি মাদারীপুর গিয়ে তিন সপ্তাহের আনসারের প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলেন। তিনিও অহরহ কাশ্মীর নিয়ে বকবক করতেন। অথচ কাশ্মীরের ভৌগোলিক অবস্থানের বিষয়টা সম্ভবত তিনিও আমাদের মতোই জানতেন না।
মাহমুদ আলী চাচা পাকিস্তানের প্রতি এমন অনুগত ছিলেন যে, গোপালপুর হাট সংলগ্ন মাঠে গ্রামের যুবকদের একত্রিত করে তিনি প্যারেড করাতেন। উদ্দেশ্য ছিল, ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেয়ার চেষ্টা করে তবে আমাদের তো প্রতিহত করতে হবে। ওই প্যারেডে আমিও অংশগ্রহণ করেছি।
মাহমুদ আলী চাচা বলতেন, আনসারের ট্রেনিংয়ে এমন নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হয় যে তা বলার নয়। মাদারীপুরে ট্রেনিং করতে গিয়ে তিনি পরনের জামা খুলতে লজ্জা পাচ্ছিলেন বলে একটু দেরি হচ্ছিল। এতে করে আনসারের এ্যাডজুডেন্ট তার নিতম্বে তিনবার বেত্রাঘাত করেছিলেন। জমিদার পুত্র হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার কাল্পনিক প্রস্তুতি হিসেবে ট্রেনিং নিতে গিয়ে তাকে যে নিতম্বে বেত্রাঘাত সহ্য করতে হয়েছিল এ কথা তিনি বেশ গর্বভরেই বলতেন।
এবার আর ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ নয়। সপ্তাহখানেক আগে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ছিলাম। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ১৯৫১ সালে স্টীমার থেকে নেমে নৌকাযোগে তিনি গোপালগঞ্জের বাড়ি যাচ্ছিলেন। ওই সময় খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল। তখন আবার জিন্নাহ ফান্ড নাম দিয়ে- প্রত্যেক গ্রামবাসীর কাছ থেকে মাথাপ্রতি এক টাকা চাঁদা আদায় করা শুরু হয়। এছাড়া নৌকাওয়ালা এবং বন্দুকওয়ালাদের কাছ থেকে বাড়তি চাঁদা আরোপ করা হয়েছিল। গবর্নর জেনারেল গোপালগঞ্জ আসবেন সেই উপলক্ষে মহকুমা প্রশাসক এমন আদেশ জারি করেছিলেন। যে চাঁদা আদায় করা হবে, তার একটা অংশ নাজিম উদ্দিন সাহেবকে উপঢৌকন হিসেবে দেয়া হবে। বাকি অংশ যাবে জিন্নাহ ফান্ডে। নৌকার মাঝি বঙ্গবন্ধুকে এসব তথ্য দিলেন। তারপর বললেন, তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ। তাই তাদেরকে পাঁচ টাকা চাঁদা দিতে হবে। মাঝির দৈনিক উপার্জন ছিল দেড় থেকে দু’টাকা। সে কেমন করে পাঁচ টাকা চাঁদা দেবে? তা না দিতে পারায় গ্রামের দফাদার মাঝির দাদার আমলের পিতলের বদনাটা জোর করে নিয়ে যায়।
নৌকার মাঝি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, পাকিস্তানের কথা তো আপনার কাছে থেকে শুনেছি। এখন ওই দেশটির জন্য আমার পিতলের বদনাটা হারাতে হলো। এর অর্থ পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটির চেয়ে মাঝির কাছে পিতলের বদনাটির মূল্য ছিল অনেক বেশি। আমার বিশ্বাস, পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্মের জন্য বঙ্গবন্ধু যথেষ্ট করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার দু’এক বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুও উপলব্ধি করেছিলেন, বাঙালীদের কাছে ওই রাষ্ট্রটির মূল্য একটি বদনার সমানও ছিল না।
আমাদের মনে রাখতে হবে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইখানা বঙ্গবন্ধু কারাবন্দী থাকা অবস্থায় লিখেছেন। তাই বইখানায় যথেষ্ট আন্ডার স্টেইটমেন্ট আছে। বইখানা লেখা হয়েছে, খুব সহজবোধ্য ভাষায়। বইয়ের অন্যত্র বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, আমাদের দেশের কমিউনিস্টরা কথার উড়োজাহাজে ঘুরে বেড়ায়। বইখানায় আর একটা বিষয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বঙ্গবন্ধু কথার মাঝে যে কুইপস (য়ঁরঢ়ং) ব্যবহার করতেন, তা বইয়ে অনুপস্থিত। বঙ্গবন্ধুকে আমি ঘনিষ্ঠভাবে চিনতাম। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসলে তিনি পাইপের তামাক খোঁচাতেন আর সবার বলা কথা শুনতেন। তারপর কুইপস্্ ধরনের ছোট একটি মন্তব্য করে সবাইকে ভ্যাঁবাচ্যাকা খাইয়ে দিতেন। কুইপস শব্দের সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে অনেক না বলা কথার আভাস আছে, কিন্তু কোন ধোঁয়াশা নেই। আমার বিশ্বাস, বড় বড় প-িতরাও ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে এমন সহজ করে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারতেন না। আমি বলব বহু বছর হয় এমন সুন্দর কোন বই আমি পড়িনি।
সবশেষে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে এই লেখাটি শেষ করতে চাই।
১৯৭২ সালে একদিন ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দিন বীর উত্তম, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ বীর উত্তম এবং আমি গেলাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকারের বাসায়। তিনি আমাকে নির্দিষ্ট করে বললেন, সাত্তার, আমরা এক বিচিত্র দেশে বাস করছি। তোমরা এই দেশে অনেক অঘটনের ঘটনা দেখতে পারবে।
একে খন্দকার সাহেব বলছিলেন, তোমাদেরকে নামটা বলব না। বললে, অবশ্যই তোমরা তাকে চিনতে পারবে। তিনি মুসলিম লীগের একজন প্রখ্যাত নেতা। থাকেন ধানম-ির অভিজাত এলাকায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে পাকবাহিনীর লোকজন তার বাসায় আসা-যাওয়া করত। একদিন ওই নেতার বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে কয়েক পাক সেনা তার চোখের সামনেই তার স্ত্রী এবং কন্যাকে ধর্ষণ করেছে। এরপরও তিনি পাকিস্তানপন্থী রয়ে গেছেন।
আমার মনে হয় যারা বিভিন্ন দল-ছুতা এবং কু-যুক্তি তর্কের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে, তারা সেই প্রখ্যাত মুসলিম লীগ নেতারই সমগোত্রীয় মানুষ। তাদের মা-বোনকে পাকবাহিনীর লোকরা ধর্ষণ করে থাকলেও তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করবে। একে খন্দকারের বলা কথাই সঠিক। আমরা এক বিচিত্র দেশে বাস করছি।
লেখক : সাবেক বৈমানিক
১৯৪৮ সালেই জিন্নাহ সাহেব পূর্ববাংলায় এসে ঘোষণা করলেন, উর্দু কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বিষয়টা বাঙালীরা ভালভাবে মেনে নিতে পারেনি।
জিন্নাহ সাহেবের ছবি দেখলে সেই ছোটবেলায়ও আমার মনে তেমন ভক্তিভাবের উদ্রেক হতো না। মনে হতো কেমন যেন বেঢপ চেহারার মানুষ। যক্ষ্মা বা ওই ধরনের রোগের কারণে তার দেহ-কাঠামো কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিল। পায়জামা এবং আচকান পরা দীর্ঘ এবং শীর্ণ দেহের মুখাবয়বও শেষ বয়সে আর সুদর্শন ছিল না। তার ওপর তিনি আবার চোঙ্গা বা ডোঙ্গা আকৃতির টুপি পরতেন মাথায়। যক্ষ্মা রোগের কারণে তার ফুসফুসদ্বয়ের একটি নাকি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম বয়সে তিনি সুদর্শনই ছিলেন। পরতেন খুব আধুনিক পোশাক-পরিচ্ছদ। ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। শেষ বয়সে দৈহিক এবং মানসিকভাবে তার পচন ধরেছিল।
জিন্নাহ সাহেব ছেলেবেলা থেকে কেমন মেধাবী এবং বুদ্ধিমান ছিলেন সে সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ আমাদের পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করা হয়েছিল।
জিন্নাহ সাহেব তখন কেবল স্কুলছাত্র। ওই সময় একদিন তারা কয়েক বন্ধু দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। সব বন্ধু যে দিকে দৌড়াল, বালক জিন্নাহ দৌড়ালেন তার উল্টো দিকে। অন্যরা তার এই উল্টো দিকে দৌড়ানোর কারণ জিগ্যেস করলে, তিনি উত্তর দিলেন, তোমরা তো বলনি, কোন দিকে দৌড়াতে হবে?
শেরোয়ানি পরা শুরু করার পর থেকে আমার মনে হয় জিন্নাহ সাহেব কেবল উল্টো পথেই দৌড়িয়েছেন। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে তিনিই হলেন, এই উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রধানতম নেতা।
সেই ১৯৫১-৫২ সালে বাঙালীরা যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে উঠছে, তা পাকিস্তান সরকারও বুঝতে পারছিল। তারা মনে করল, বাঙালী মুসলমানরা খুবই নির্বোধ! আমরা পশ্চিম পাকিস্তানীরা তো সৈন্যসামন্ত নিয়ে এসে পূর্ববাংলা দখল করিনি! ওই নির্বোধরাই ভারত এবং হিন্দু বিদ্বেষের কারণে স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে যোগ দিয়েছে। এখন যদি আবার সেই ভারত এবং হিন্দু বিদ্বেষের উন্মাদনা সৃষ্টি করা যায়, তবে বাঙালীদের বোকা বানিয়ে নির্বিঘেœ শাসন-শোষণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া যাবে। এই শাসন-শোষণ প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলেও বোকা বাঙালীরা পাকিস্তান প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকবে। এ ব্যাপারে পাকিস্তানী শাসকদের চিন্তা একেবারে ভুল ছিল বলা যাবে না। আমার ছেলেবেলা অতিক্রান্ত হয়েছে ৬০-৬২ বছর আগে। এখনও দেখছি, আমাদের দেশের যথেষ্ট লোকের মাঝে ভারত বিদ্বেষের কমতি নেই। আর এই ভারত বিদ্বেষভাবকে মূলধন করে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তার স্ত্রী একই ফর্মুলা অনুসরণ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এই একই ফর্মুলা অনুসরণ করে তিনি যে আবার ক্ষমতাসীন হতে পারেন সে সম্ভাবনাও আছে।
১৯৫১-৫২ সালের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা পূর্ববাংলায় তাদের শাসন-শোষণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাঙালী মুসলমানদের মাঝে ভারত বিদ্বেষভাবটা চাঙ্গা করতে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করল। তারা প্রচার করতে শুরু করল, ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। আমাদের দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানী ব্রাদারদের উচিত হবে ভারতীয় এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা। তাছাড়া কাশ্মীর সম্পর্কে পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদ মিডিয়া ছিল খুবই সরব। তাদের বক্তব্য ছিল, কাশ্মীর রাজ্যের অধিকাংশ অধিবাসী মুসলমান। তাই সকল মুসলমানের কর্তব্য কাশ্মীর রাজ্যকে ভারতের কাছ থেকে দখলমুক্ত করা। বাংলা ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কাশ্মীর যে পাকিস্তানের অংশ হওয়া উচিত এ ব্যাপারে বাঙালীরাও পাকিস্তানীদের সঙ্গে সহমত পোষণ করত।
১৯৫১ বা ’৫২ সাল। পূর্ব পাকিস্তান সরকার এক আদেশ জারি করল, বাংলাদেশে যাদের একনলা বা দোনলা বন্দুক আছে তাদের সবাইকে নিকটতম মফস্বল শহরে গিয়ে আনসার এ্যাডজুট্যান্টদের অধীনে এক সপ্তাহের জন্য কুচকাওয়াজ এবং বন্দুক ও রাইফেল থেকে গুলি ছোড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। ব্যাপারটা ছিল পাকিস্তান সরকারের এক রকমের বড় ধরনের শঠতা। ভাবখানা ছিল এমন যে, ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান দখল করার জন্য আক্রমণ করে তবে আমরা বাঙালীরা একনলা আর দোনলা বন্দুক দিয়ে তা ঠেকিয়ে দেব।
সুটিয়াকাঠি গ্রামের বেশ কয়েক জনের বন্দুক ছিল। একে তো সন্ধ্যা নদীর তীরের গ্রাম। আর গ্রামের বেশিরভাগ লোকই ছিল অবস্থাপন্ন। তাই ডাকাতের ভয়ে অনেকেই বাড়িতে বন্দুক রাখত। গ্রামের লোকদের মাঝে যাদের কাছে বন্দুক ছিল, তাদের মাঝে একজনের নাম ছিল মোদাচ্ছের আলী। তিনি সম্পর্কে আমার নানা হতেন। তিনি নামের শেষে ‘এমইউবি’ লিখতেন। ব্যাপারটা যেন তার উপাধি। এমইউবি-এর অর্থ হলো, মেম্বার অব ইউনিয়ন বোর্ড। সবাই তাকে মোদাচ্ছের আলী এমইউবি বলেই সম্বোধন করত। তিনি ছিলেন বেশ ভাল মানুষ এবং একই সঙ্গে যথেষ্ট অর্থশালীও বটে। সুটিয়াকাঠি গ্রাম সংলগ্ন ইন্দুর হাট বন্দরে তার বেশ বড় একটি দোকান ছিল।
মোদাচ্ছের আলী এমইউবি অন্যদের সঙ্গে পিরোজপুর শহরে গিয়ে সাত দিনের ট্রেনিং নিয়ে এলেন। তখন তার বয়স প্রায় ৪০ বছর। শারীরিকভাবে তিনি একটু দুর্বল ছিলেন। ট্রেনিং নিয়ে এসে তিনি মহাখুশি। পাকিস্তানী যোশে তিনি তখন টগবগ করছিলেন। মনে হতো দোনলা বন্দুকটি নিয়ে বুঝি তিনি কাশ্মীর জয় করতে যাবেন।
১৯৭১ সালে আমি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিলাম। ওই সময় একদিন গেলাম প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয়ে। ওখানে গিয়ে সুটিয়াকাঠি অঞ্চলের অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। তাদের কাছে শুনলাম, পাক বাহিনীর গুলিতে মোদাচ্ছের আলী এমইউবি নিহত হয়েছেন। একাত্তরের জুন মাসের একদিন পাকবাহিনী গানবোটে করে এসে অতর্কিতে ইন্দুরহাটের ওপর আক্রমণ চালায়। ওই বর্বর বাহিনী বাজারের সব দোকানপাট আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। একই সঙ্গে গুলি চালিয়ে দুই থেকে তিন শ’ লোক হত্যা করে। পাকবাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিতে মোদাচ্ছের আলী এমইউবিও নিহত হন।
কিছুদিন আগে মামার বাড়ি সুটিয়াকাঠি গ্রামে গিয়েছিলাম। শুনলাম, মোদাচ্ছের আলীর ছেলে এখন বিএনপি দলের স্থানীয় একজন নেতা এবং পাকিস্তান সমর্থক।
আমার পৈতৃক নিবাস মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলায়। গ্রামের নাম গোপালপুর। ওই গ্রামে আমার বাবার জ্ঞাতি ভাইরা এবং আত্মীয়স্বজন থাকেন। তাদের মাঝে বাবার এক ফুফাত ভাইয়ের নাম ছিল মাহমুদ আলী। ১৯৫২ সালে তার বয়স ছিল ৩০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে। তাকে আমি মাহমুদ আলী চাচা বলে ডাকতাম। তিনি মাদারীপুর গিয়ে তিন সপ্তাহের আনসারের প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলেন। তিনিও অহরহ কাশ্মীর নিয়ে বকবক করতেন। অথচ কাশ্মীরের ভৌগোলিক অবস্থানের বিষয়টা সম্ভবত তিনিও আমাদের মতোই জানতেন না।
মাহমুদ আলী চাচা পাকিস্তানের প্রতি এমন অনুগত ছিলেন যে, গোপালপুর হাট সংলগ্ন মাঠে গ্রামের যুবকদের একত্রিত করে তিনি প্যারেড করাতেন। উদ্দেশ্য ছিল, ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেয়ার চেষ্টা করে তবে আমাদের তো প্রতিহত করতে হবে। ওই প্যারেডে আমিও অংশগ্রহণ করেছি।
মাহমুদ আলী চাচা বলতেন, আনসারের ট্রেনিংয়ে এমন নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হয় যে তা বলার নয়। মাদারীপুরে ট্রেনিং করতে গিয়ে তিনি পরনের জামা খুলতে লজ্জা পাচ্ছিলেন বলে একটু দেরি হচ্ছিল। এতে করে আনসারের এ্যাডজুডেন্ট তার নিতম্বে তিনবার বেত্রাঘাত করেছিলেন। জমিদার পুত্র হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার কাল্পনিক প্রস্তুতি হিসেবে ট্রেনিং নিতে গিয়ে তাকে যে নিতম্বে বেত্রাঘাত সহ্য করতে হয়েছিল এ কথা তিনি বেশ গর্বভরেই বলতেন।
এবার আর ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ নয়। সপ্তাহখানেক আগে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ছিলাম। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ১৯৫১ সালে স্টীমার থেকে নেমে নৌকাযোগে তিনি গোপালগঞ্জের বাড়ি যাচ্ছিলেন। ওই সময় খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল। তখন আবার জিন্নাহ ফান্ড নাম দিয়ে- প্রত্যেক গ্রামবাসীর কাছ থেকে মাথাপ্রতি এক টাকা চাঁদা আদায় করা শুরু হয়। এছাড়া নৌকাওয়ালা এবং বন্দুকওয়ালাদের কাছ থেকে বাড়তি চাঁদা আরোপ করা হয়েছিল। গবর্নর জেনারেল গোপালগঞ্জ আসবেন সেই উপলক্ষে মহকুমা প্রশাসক এমন আদেশ জারি করেছিলেন। যে চাঁদা আদায় করা হবে, তার একটা অংশ নাজিম উদ্দিন সাহেবকে উপঢৌকন হিসেবে দেয়া হবে। বাকি অংশ যাবে জিন্নাহ ফান্ডে। নৌকার মাঝি বঙ্গবন্ধুকে এসব তথ্য দিলেন। তারপর বললেন, তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ। তাই তাদেরকে পাঁচ টাকা চাঁদা দিতে হবে। মাঝির দৈনিক উপার্জন ছিল দেড় থেকে দু’টাকা। সে কেমন করে পাঁচ টাকা চাঁদা দেবে? তা না দিতে পারায় গ্রামের দফাদার মাঝির দাদার আমলের পিতলের বদনাটা জোর করে নিয়ে যায়।
নৌকার মাঝি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, পাকিস্তানের কথা তো আপনার কাছে থেকে শুনেছি। এখন ওই দেশটির জন্য আমার পিতলের বদনাটা হারাতে হলো। এর অর্থ পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটির চেয়ে মাঝির কাছে পিতলের বদনাটির মূল্য ছিল অনেক বেশি। আমার বিশ্বাস, পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্মের জন্য বঙ্গবন্ধু যথেষ্ট করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার দু’এক বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুও উপলব্ধি করেছিলেন, বাঙালীদের কাছে ওই রাষ্ট্রটির মূল্য একটি বদনার সমানও ছিল না।
আমাদের মনে রাখতে হবে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইখানা বঙ্গবন্ধু কারাবন্দী থাকা অবস্থায় লিখেছেন। তাই বইখানায় যথেষ্ট আন্ডার স্টেইটমেন্ট আছে। বইখানা লেখা হয়েছে, খুব সহজবোধ্য ভাষায়। বইয়ের অন্যত্র বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, আমাদের দেশের কমিউনিস্টরা কথার উড়োজাহাজে ঘুরে বেড়ায়। বইখানায় আর একটা বিষয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বঙ্গবন্ধু কথার মাঝে যে কুইপস (য়ঁরঢ়ং) ব্যবহার করতেন, তা বইয়ে অনুপস্থিত। বঙ্গবন্ধুকে আমি ঘনিষ্ঠভাবে চিনতাম। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসলে তিনি পাইপের তামাক খোঁচাতেন আর সবার বলা কথা শুনতেন। তারপর কুইপস্্ ধরনের ছোট একটি মন্তব্য করে সবাইকে ভ্যাঁবাচ্যাকা খাইয়ে দিতেন। কুইপস শব্দের সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে অনেক না বলা কথার আভাস আছে, কিন্তু কোন ধোঁয়াশা নেই। আমার বিশ্বাস, বড় বড় প-িতরাও ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে এমন সহজ করে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারতেন না। আমি বলব বহু বছর হয় এমন সুন্দর কোন বই আমি পড়িনি।
সবশেষে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে এই লেখাটি শেষ করতে চাই।
১৯৭২ সালে একদিন ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দিন বীর উত্তম, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ বীর উত্তম এবং আমি গেলাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকারের বাসায়। তিনি আমাকে নির্দিষ্ট করে বললেন, সাত্তার, আমরা এক বিচিত্র দেশে বাস করছি। তোমরা এই দেশে অনেক অঘটনের ঘটনা দেখতে পারবে।
একে খন্দকার সাহেব বলছিলেন, তোমাদেরকে নামটা বলব না। বললে, অবশ্যই তোমরা তাকে চিনতে পারবে। তিনি মুসলিম লীগের একজন প্রখ্যাত নেতা। থাকেন ধানম-ির অভিজাত এলাকায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে পাকবাহিনীর লোকজন তার বাসায় আসা-যাওয়া করত। একদিন ওই নেতার বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে কয়েক পাক সেনা তার চোখের সামনেই তার স্ত্রী এবং কন্যাকে ধর্ষণ করেছে। এরপরও তিনি পাকিস্তানপন্থী রয়ে গেছেন।
আমার মনে হয় যারা বিভিন্ন দল-ছুতা এবং কু-যুক্তি তর্কের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে, তারা সেই প্রখ্যাত মুসলিম লীগ নেতারই সমগোত্রীয় মানুষ। তাদের মা-বোনকে পাকবাহিনীর লোকরা ধর্ষণ করে থাকলেও তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করবে। একে খন্দকারের বলা কথাই সঠিক। আমরা এক বিচিত্র দেশে বাস করছি।
লেখক : সাবেক বৈমানিক
No comments