ব্যথিতই হই শুধু লাঞ্ছিতই হই লাঞ্ছিতই হই শুধু লজ্জিত হই by রণজিৎ বিশ্বাস

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ওরা, ওই কুলাঙ্গাররা দেশের শুধু নয়, বিশ্বের ইতিহাসকে মসিলিপ্ত করার আগে যার মুখে শুনেছিল-তোমরা জুনিয়ররা যদি পারো, করে ফেলো, আমার আপত্তি নেই এবং যার হাতে পরে তারা সম্মান পুনর্বাসিত হয়ে একটি অকৃতজ্ঞ দেশ ও জাতির প্রতিনিধিত্ব করেছিল পরমানন্দে ও চরম পরিতৃপ্তিতে; যে মানুষটি দেশের পবিত্র


সংবিধানে সবার আগে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নামে দেশের একাট্টা মানুষকে কেটে দোফালা করে দিয়েছিল, সে মানুষটি কেমন মানুষ সারাবছর ভাবি; এদিন সারাদিন সারারাত খুব বেশি করে ভাবি।
গত প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর ধরে, আমি মানুষটির নাম মুখে আনতে চাই না। তার নাম মুখে তোলার কাজটি আমি বার বার এড়িয়ে চলি। এমন কেন কর?! বান্ধবরা আমাকে প্রশ্ন করে। আমি তখন কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকি, মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে পায়ের আঙ্গুল দলতে থাকি, তারপর দুটো কাজ করি। ছোট একটি বাক্যে বলি সব নাম শুদ্ধ নয়, সব নাম পবিত্র নয়, সব নাম মুখে আনা যায় না। সব নাম উচ্চার্য নয়। তারপর তাদের পাল্টা একটি প্রশ্ন করিÑখুব করে ভেবে বল দেখি, কার হাতে এদেশের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে? যার হাতে হয়েছে সে কি কোন ভয়াবহ পাকিস্তান সেবক, কোন রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তাদের ধর্মগুরু কিংবা কর্মগুরু? নাকি অন্যকিছু নাকি অন্য কোন পরিচয়ের লোক?! তারা বলে নামটা জানি, কিন্তু বলবো না, রুচিতে বাধে, বিবেক বড় লজ্জা পায়।
তখন ক্রুদ্ধ হই, হতাশা হই, পরিতাপে ভুগি, যখন দেখি পরাজিত শত্রুর আদর্শের ধ্বজাধারী এই মানুষটির পেছনেও সংখ্যায় যত অল্পই হোক, কিছু মানুষ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ছে, নিষ্ঠুরতা, অকৃতজ্ঞতা, কৃতঘœতা এবং সাম্প্রদায়িকতা ও ছদ্ম সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন করে বেড়াচ্ছে, তার অশুভ ছায়াকে অনুসরণ করতে করতে গলিত বিগলিত হচ্ছে, জাতির সবচেয়ে শোকের দিনে ঘরের কোণে পড়ে থেকে সরে থেকে ও মরে থেকে পারিবারিক জীবন ভোগ-উপভোগ করছে অথবা একটি বাড়িতে কারও স্বনির্বাচিত জন্মদিনে অতিকায় পিষ্টকের বুকে ভোজালি চালাবার উল্লাস করছে কিন্তু একবারের জন্যও ভাবছে না-ওই লোকটির কারণে এ দেশটি স্বাধীন না হলে এ জীবন, এ আনন্দ ও এ উল্লাস কোথায় যেত। কোন বঙ্গোপসাগরে সব ডুবে মরতো। ভাবতে গেলেই বিস্ময়ের ঘোরে চক্করে হাবুডুবু খেতে হয়-মানুষ কী করে এত পারভার-সিভ হতে পারে। মানুষ কী করে নিজের বর্ণ এমন চুরি করতে পারে। মুক্তিযোদ্ধার চর্মাবরণে একজন অতি সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান সেবক কেমন করে এমন শৈল্পিক কুশলতায় এত বছর লুকিয়ে থাকতে পারে। তার প্রতিকার ও নিষ্ঠুরতার প্রশংসা না করেও পারা যায়। কিন্তু, তাতে বড় অন্যায় হয়। নিয়তির বিচার নিয়তি করে বটে, আমাদের বলার শুধু এই- মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি তার বিরূপ ‘শ্রদ্ধাশীলতা’, সাম্প্রদায়িকতার প্রতি তার বিপুল অনুরাগ ও দেশের জেনুইন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার আচরণ আমাদের শুধু ব্যথিতই করে, লাঞ্ছিতই করে আর লজ্জিতই করে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.