জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়লেই কি মানুষ ভালো থাকবে? by আলাউদ্দীন মোহাম্মদ
গেল অর্থবছর শেষ হয় হয় সময়ে যে বিতর্কটি অনেক জোরেশোরেই হয়েছে তা হল আসলেই বাংলাদেশ কত শতাংশ জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে বা করতে যাচ্ছে। বিবিএস মানে আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাথে সাথে বিশ্বব্যংক কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) বেশ গুরুত্বের সাথেই সভা সেমিনার করে এগুলো প্রকাশ ও প্রচার করে থাকে।
যদিও জিডিপি ফিগার নিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটোর নিজস্ব হিসাব-নিকাশ বিবিএসের চেয়ে ভিন্নতা রয়েছে। আবার বাংলাদেশের প্রাক্তন গভর্নর বা আমলাদেরও বিবিএসের এর প্রকাশিত জিডিপি ফিগার নিয়ে ইদানিং অবিশ্বাস তুলতে দেখা গেছে। বরাবরের মত এবারও ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ শতাংশ স্থির করেছে। দুনিয়াজুড়েই পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে, গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠান বা কোন রাষ্ট্র অর্থব্যবস্থার সাফল্য বা ব্যর্থতা সবই জিডিপি নামের এক সূচকের উঠানামা দিয়ে মাপতে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে জিডিপি দিয়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতি মাপার প্রবণতাকে প্রশ্ন করা এবং পরিবর্তিত বিশ্বে ভালো থাকা বা well being-এর সাথে জিডিপির সম্পর্ক খুঁজে দেখার চেষ্টাই এই প্রবন্ধের আলোচ্য।
জিডিপি কতটুকু বাড়ল সে মাপামাপি এখনকার সময়ে প্রতিটি সমাজের অগ্রগতির সাধারণ মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, যদিও এখন পর্যন্ত এটা না অগ্রগতির নির্দেশ করার উপযুক্ত না এটা সে কাজের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল; বরং এর একটা ভালো বিকল্প বের করার সময়ও অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে।
জিডিপি বা জাতীয়ভাবে উৎপাদনের হিসাব নেওয়ার এই পদ্ধতি চালুর অন্যতম স্থপতি সাইমন কুজনেৎস সেই ১৯৩৩ সালে আগেই পরিস্কার করে বলে রেখেছিলেন যে, “জাতীয় আয় মাপা থেকে একটি জাতির কল্যাণমূলক সুযোগসুবিধা (ওয়েলফেয়ার) কতটা বাড়বে বা কমবে সে বিষয়ে খুব সামান্যই আন্দাজ করা যায়।”
তার মানে, জিডিপি পরিমাপ চালু করার উদোক্তাদেরই একজন যখন কখনো মনে করেননি যে জাতীয় আয় দ্বারা জাতির ওয়েলফেয়ার মাপা যায়, সে প্রেক্ষাপটে জিডিপি কিভাবে আসলে ওয়েলফেয়ারের সমার্থক হয়ে গেল? এর উত্তর সম্ভবত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে।
বোঝাই যায়, যুদ্ধ এগিয়ে চলার সাথে সাথেই যুদ্ধাস্ত্রের উৎপাদন এবং এর যোগানকে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়া যুদ্ধ-উদ্যোগের একটি প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। আর সেই প্রেক্ষাপটেই জন ম্যানার্ড কেইনস জাতীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব কি করে নেয়া যায় এর উপায় খুজছিলেন; ফলে এই ধরণের এক হিসাব কাঠামোর চালু হয়ে যায়। এর ভিতরে যুদ্ধকালীন সেই অবস্থাটাই ধরা পরে আছে।
ঐ যুদ্ধের পরপর আক্ষরিকভাবেই বিধ্বস্ত দেশগুলো পুনর্গঠন-র্নিমাণ জরুরি হয়ে পড়েছিল। ফলে আবার সেই নতুন করে উৎপাদন তুঙ্গে নিবার প্রশ্ন জণগণের বস্তুগত সুযোগসুবিধা বাড়ানোর সাথে শক্তভাবে জড়িয়ে যায়। ঘটনা যাই হোক, উৎপাদন মাপার উপর দাঁড়ানো জিডিপি পদ্ধতি ওদিকে জাতিসংঘের ‘জাতীয় আয়-উন্নতির হিসাব রাখার পদ্ধতি’র ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। এর মানে হল সরাসরিভাবে সুযোগসুবিধা এবং সামাজিক অগ্রগতির পরিমাপের বিষয়টা পুরোপুরি অবজ্ঞা করা হয়ে গেছে এতে।
অবজ্ঞা করা হয়েছিল কিন্তু পুরোপুরি যে ভুলে যেতে পারেনি তা বোঝা যায়, ১৯৬৮ সালের মার্চে অর্থাৎ জাতিসংঘের এই গাইডলাইনটা প্রথম প্রকাশের মাত্র কুড়ি বছর পর, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাপার সীমাবদ্ধতা নিয়ে কানসাস রাজ্যের সিনেটর রবার্ট ক্যানেডির (এখন বিখ্যাত হয়ে গেছে এমন) একটা বক্তৃতা ছিল এরকমঃ
“জিডিপি হিসাব গুণাগুণির করার সময় বায়ু দূষণ এবং সিগ্রেটের বিজ্ঞাপন এবং আমাদের মহাসড়কে হতাহত বয়ে বেরানোর এম্বুলেন্সের পরিমাণ -সবই এর ভিতরে অন্তর্ভুক্ত করে হিসাব করা হয়। এটি আমাদের দরজার বিশেষ তালাগুলো যারা ভাঙ্গে সে লোকজনকে রাখার জেলখানার পরিমাণও গোণায় ধরে। এটি রেডউড কাঠের ধ্বংস গণনা করে এবং আমাদের প্রাকৃতিক আশ্চর্যগুলোর বিশৃংখলভাবে ভেঙ্গে পড়ারও গোণার ভিতর ধরে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি আমাদের বাচ্চাদের স্বাস্থ্য, তাদের স্কুলের শিক্ষার মান কিংবা তাদের খেলার আনন্দকে গোনায় ধরে না”।
“এটি আমাদের কবিতার সৌন্দর্য কিংবা বিয়ে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত শক্তির দিক, গণ-বিতর্কের মধ্যে প্রকাশিত বুদ্ধিদীপ্ততা কিংবা সরকারী কর্মকর্তাদের কর্মনিষ্ঠাকে গোনায় ধরতে জানে না। এটি না আমাদের মশকরা করার মজা মাপে, না আমাদের সাহস, না আমাদের প্রজ্ঞা না আমাদের শেখা, না আমাদের সহমর্মিতার আবেগ না আমাদের দেশভক্তি কিছুকেই গোনায় ধরতে জানে না; শুধুমাত্র জীবনকে যেগুলো মূল্যবান করে তুলে সেগুলো ছাড়া এটা সবকিছুই খাবলা খাবলা করে একটু মাপে”।
এরপর থেকে, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা কিছু মৌলিক পরিবর্তনের দেখা পাই, বিশেষ করে স্নায়ু যুদ্ধের অবসান, চীনের উত্থান, ইন্টারনেটের আবির্ভাব, চিকিতসা সেবায় অগ্রগতি, বর্ধিত বহুসংস্কৃতিময়তা এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন হবার বিপদকে স্বীকৃতি। তারপরও কেটে গেছে আরো ৪০ বছর, তবু এখনো জিডিপি কেন্দ্রিক মাপকাঠিতে সামাজিক অগ্রগতি মাপার মধ্যেই আমরা আটকে আছি।
অগ্রগতির মাপকাঠি যেভাবে বিকশিত হচ্ছে
কেনেডির এই বক্তৃতার পর থেকেই জিডিপি ধারণা সমালোচিত হয়ে আসছে অবশ্যই। এখন এর সীমাবদ্ধতাগুলোর তালিকাও বেশ লম্বা। জিডিপি শুধুমাত্র “খারাপগুলো” যেমন - স্বাস্থ্যগত সমস্যা, দুর্ঘটনা, পরিবারের ভাঙ্গন, অপরাধ এবং দূষণ – এগুলোর দায় অন্তর্ভুক্ত করে তাই নয়, বরং এটা “ভালোগুলোকেও” বাদ দেয়, যেমন- বাচ্চা মানুষ করার মত বিনা-বেতনের কাজ, সংসার চালানো, বন্ধু এবং প্রতিবেশীকে সাহায্য করা, দাতব্যসেবা ও স্থানীয় সামাজিক রাজনীতির মত কর্মকাণ্ড।
এসবই বাজারের বাইরে ঘটা কর্মকাণ্ড। কিন্তু এগুলোই আমাদের অর্থনীতির মূল শাঁস অংশ। আমাদের অর্থনৈতিক জীবনের যেসব দিকগুলোর মূল্য পরিমাপ সবচেয়ে বেশি যায় আসে তা যথারীতি এড়িয়ে গিয়ে জিডিপি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সামাজিক এবং পরিবেশগত মুল্যকে হিসাবের মধ্যে ধরে না। যেমন উদাহরণ হিসেবে, যা সম্ভবত সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী ফল-প্রভাব রাখে সেই জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলা যায়; অর্থনীতিবিদ নিকোলাস স্টার্নস এটাকে আখ্যা দিয়েছেন, “বাজার ব্যবস্থায় এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় এবং সীমাহীন ব্যর্থতা।”
সবদিক বিচারে, জিডিপিকে অগ্রগতির নির্ভরযোগ্য কিংবা কাঙ্ক্ষিত পরিমাপ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। অধিকন্তু, জাতির সম্পদের সঞ্চয়ের সাথে নাগরিক সুখ-শান্তির যদি কোন সম্পর্কই নেই, তাহলে কেন এই জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিমাপ?
ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের যুক্তি দেখানোর একটা প্রবণতা আছে এই রকম যে, এমনকি জিডিপি যদি প্রগতির কোন ভালো পরিমাপ নাও হয় তাতে কোন সমস্যা নেই, যদি এর বৃদ্ধি কোনভাবে আপনা আপনি ওয়েলবিয়িং বা ভাল থাকাকে ত্বরান্বিত করে। সার করে বললে, তাঁরা যা বলেন এর পেছনের অনুমান বা পূর্বশর্তগুলোই এমন যুক্তি হাজির করার কারণ।
গোঁড়া অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুমান করে নেয় যে, যেখানে মানুষের যুক্তিবুদ্ধি খাটানোর এবং সুস্থির পরিস্থিতিতে যাচাই-বাছাই করে মানুষের চাওয়া-পাওয়াগুলো বাস্তবে হাজির পাবার সুযোগ আছে, যেখানে নিজেদের সন্তুষ্ট করার সর্বোচ্চ সুযোগ আছে সেখানেই তাদের ওয়েল বিয়িং বা ভাল থাকার সুযোগ সবচেয়ে বেশি হবে। তাই বেছে নেবার বেশি সুযোগ সবসময়ই ভালো এবং অধিক আয় বেছে নেবার সুযোগ বাড়িয়ে দেয়, তাই জীবনমান ভালো করার উপায় হলো মানুষের আয় বাড়ানো।
এটা একটা সবভালা তত্ত্ব ও ভালো, কিন্তু আসলেই কি তা সত্য?
একটু পেছন ফিরে সত্তরের দশকের শুরুতে গেলে দেখতে পাবো যে ক্যালিফোর্নিয়ার একজন অর্থনীতিবিদ রিচার্ড এস্টার্লিন, নতুন এক ধরনের বৈষয়িক ভাল-থাকার পরিমাপকের মাধ্যমে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং ভাল-থাকার মধ্যকার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছিলেন। এই বৈষয়িক পরিমাপে ব্যাপকভিত্তিক জরিপে পাওয়া ডাটা ব্যবহার করা হয়েছিল যেখানে অংশগ্রহণকারীদের নিজেদের জীবনের সন্তুষ্টি এবং সুখকে ‘রেটিং’ করতে বলা হয়েছিল।
সহজ হবার কারণে এই মাপামাপিকে নির্ভরযোগ্য বলে হাজির হয় এবং গবেষণায় তারাই বেশি ‘স্কোর’ করেছিল যাদের আগে থেকেই চেনা-পরিচিত এমন লোকজনের চোখে হাসিখুশি ঠেকেছিল ও তাঁদের সুখী বলে রেটিং দিয়েছিল।
এস্টার্লিন কি পেয়েছিলেন? নিঃসন্দেহে একটা প্যারাডক্স, গোলকধাঁধা! একটি নির্দিষ্ট দেশে ও নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষিতে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, সেখানে সর্বোচ্চ আয়কারী ব্যক্তিরা নিজেদের সর্বাধিক সুখী এবং ভাল আছেন। একইসাথে [এই সর্বোচ্চ আয়কারীদের কারণে] মাথাপিছু জিডিপি বেড়ে চলা ঐ সমাজের গড় ভাল-থাকাকে বাড়িয়েছে এমন কোন প্রমাণ তিনি পাচ্ছেন না। বরং গড় ভাল-থাকার মাত্রা যেমন ছিল তেমনই আছে।
যেকোন ধরে নেওয়া সময়ে, তাই যখন তুলনামূলক-ধনী ব্যক্তিরা যদি বেশি সুখী থাকেন, তখন আমরা সামগ্রিকভাবে ধনী হলেও সবাইকে সুখী হিসেবে পাব না।
এই দুমুখো ফলাফল অর্থনৈতিক সাহিত্যে “ইস্টার্লিন প্যারাডক্স” বা ‘ইস্টার্লিন ধাঁধা’ হিসেবে পরিচিতি।
টাকা সুখ কিনতে পারে না
প্রভাব-ফেলা বছরগুলোর একই সময়ের যখন নতুন আন্তর্জাতিকভাবে পাওয়া তথ্য নিয়ে এই “প্যারাডক্স”-কে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে তখনও এটা একেবারেই স্পষ্ট দেখা গেছে যে সুখের পরিমাণের বৃদ্ধি কার্যতই খুব অল্প। অনেক দেশই, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যে, যেখানে গত কয়েক দশক ধরেই উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে সেখানেও একই সময়ে জাতীয়ভাবে ভাল-থাকার তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বৃদ্ধি হয়নি। এটা শুরুর দিকের যে ‘হাইপোথিসিসের’ নির্দেশ করে তা হল, যখন মাথাপিছু জিডিপি একটি নির্দিষ্ট পর্যায় অতিক্রম করে মোটামুটি ১৫ হাজার মার্কিন ডলার, তখন ভাল-থাকার মান উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে শুরু করে।
এই আউলাঝাউলা ফলাফল কেন- তা নিয়ে ভাবতে এক মিনিট দম ধরে বসে ফিরে দেখতে পারলে তা কাজের হবে।
এগুলো আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুর একটি ভুল যুক্তিকে সরাসরি উদোম করে তুলে ধরে। আমরা আমাদের আধুনিক সমাজকে সুখ খোঁজার একটি বিশেষ মডেলের মাধ্যমে সাজিয়েছি। আমাদের ব্যবসার মডেল বড় প্রেক্ষিত থেকে দেখা স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপ যেমন স্থানীয় সমাজ, শ্রম-কর্মচারী এবং যোগানদাতার স্বার্থের দিক--এগুলোকে বিবেচনায় না নিয়ে পুরোপুরিভাবে শেয়ারহোল্ডারদের চোখ ফেলে কেবল মুনাফা সর্বোচ্চ বাড়ানোর দিকে করে সাজানো।
এর মধ্যে, লোকজন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, যতই খরচ করার মত আয় [ট্যাক্স বাদে আয়] বেশি থাকবে, ততই তাঁরা বেশি খরচ করতে পারবে, এবং এটাই সুখের সোজা পথ। ঘটনা হলো এখানে সহজেই আগাম অনুমান করে নেওয়া হয়েছে যে, অর্থনৈতিক উৎপাদন বেশি হওয়া মানেই সোজাসাপ্টা জীবনযাত্রার মান বেড়ে যাওয়া। কাজেকাজেই মানুষের ভাল-থাকা ও সুখ বেড়ে যাওয়া – কিন্তু এই অনুমান আদতে সত্য নয়।
শুধুমাত্র জিডিপি নির্ভর উন্নয়ন চিন্তা যে মানুষের ভাল-থাকা মাপতে অদক্ষ তাই নয়, বরং আমরা পরিবেশের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাবকেও হিসাবের মধ্যে নিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হই।
আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব যে এই ২১ শতকের সবচেয়ে জটিল চ্যালেঞ্জ এভাবে মানুষের কর্মকাণ্ড তৎপরতা দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারবে-- টিকে থাকার দিককে উপেক্ষা করে দাঁড়ানো এই ‘প্রগতি’ পরিমাপের কোন মানে হয় না, ফলে একে সিরিয়াসভাবে নেয়া যায় না।
তবে এখন অনেক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যে, অর্থনীতিকদের সাথে সাথে রাজনীতিকরা এই ইস্যুটিকে সামনে আনার চিন্তা শুরু করেছেন এবং হয়ত পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করবে। গত বছরের শেষে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা দিয়েছিল যে তাঁরা ভাল-থাকার একটা জাতীয় নির্ণায়ক তৈরি করতে যাচ্ছেন এবং কি কি সেখানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে তা ঠিক করতে জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর একটা জাতীয় বিতর্ক শুরু করেছেন।
যুক্তরাজ্য সরকারের একটা ভাল-থাকার নির্ণায়ক বের করার আগ্রহ বিচ্ছিন্ন কিছু নয়; বরং তা সরকারি ও আন্তর্জাতিক এজেন্সিগুলোর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের ওপর দাঁড়ানো। ইউরোপিয়ান কমিশন সিরিজ সেমিনার আয়োজন করেছে, যেখানে টেকসই উন্নয়ন পরিমাপের পদ্ধতি এবং ভাবনাচিন্তাকে জিডিপির বাইরে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। ইইউর পরিসংখ্যান দপ্তর ‘ইউরোস্ট্যাট’ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভাল-থাকার মাপকাঠি তৈরিতে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা বা ওইসিডি ( (কার্যত সম্পদশালী দেশগুলোর একটা গ্রুপ ) সামাজিক অগ্রগতি পরিমাপে পুরোদমে উঁচু মানের গবেষণা ও সভা সেমিনার শুরু করে দিয়েছে।
সম্ভবত ফ্রান্স সরকারই সবচেয়ে সামগ্রিক দিক থেকে নিয়ে এই কাজ শুরু করেছে।
একটা কাজের কাজ শুরু হয়েছে ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতি মাপার একটি বিশেষ কমিশন গঠন করার জন্য প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ এবং অমর্ত্য সেনকে নিয়োগ দিয়েছেন। যখন তাঁরা কাজের কাঠামো ও সুযোগগুলোকে চিহ্নিত করতে শুরু করলেন, কমিশনাররা তখন কি কি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতেঁ যাচ্ছেন তা টের পেয়েছিলেনঃ
“আর্থ-সামাজিক চলকগুলো [ভেরিএবলস] যেমন- প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, অসাম্য ইতাদির মান পরিমাপের সাথে আমাদের ছড়ানো-ছিটানো ধারণার বিস্তর ফারাক রয়েছে। আমাদের পরিসংখ্যান উপকরণ, যেগুলো নিকট অতীতে আমাদের ভালোই সাহায্য করেছে তা খুব সুক্ষ যাচাইয়ের দরকার আছে।”
পরিসংখ্যান উপকরণগুলোকে আবার সূক্ষ যাচাইয়ের দরকার বিষয়ে তাঁদের স্বীকৃতি – এই একই প্রতিধ্বনি আমরা অনেকদিন ধরেই পাচ্ছিলাম দি নিউ ইকোনমিক ফাউন্ডেশন বা এনইএফের (লন্ডন ভিত্তিক এক থিঙ্কট্যাঙ্ক) কাছ থেকে। সম্প্রতি ইউ বিতর্ক থেকে পাওয়া ওদের রিপোর্ট “আমাদের অগ্রগতি মাপতে” পরামর্শ রাখা হয়েছে-
- একটা সফল সমাজ তাকেই বলব যা তার নাগরিকের জন্য লম্বা সময় ধরে টেকসই এমন উঁচু ও স্থায়ীমানের ভাল-থাকা যোগায়।
- টেকসই ভাল থাকা ও অগ্রগতি মাপতে সরকারের এক নতুন শিরোনাম চালু করতে হবে যেন তা জাতীয় সফলতার ভিশনকে অঙ্গীভূত করে।
- এই নতুন মাপকাঠি তৈরি তখনই কাজে আসবে যদি তা সত্যিই সরকারি নীতি নির্ধারণে প্রভাব রাখতে পারে।
অগ্রগতির নতুন পরিমাপক তৈরি করা কাজটা পরিসংখ্যানগত এবং রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জের হবে। কিন্তু যদি আমরা ভাল সুখ, পরিচ্ছন্ন ও টেকসই এক জগৎ তৈরি করতে চাই তাহলে সত্যি সত্যি আমাদের দ্রুত একটা জিডিপির বিকল্প খুঁজে বের করা জরুরি। আর আমাদের (বাংলাদেশের) মতো অর্থনীতিগুলোকেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি মানবউন্নয়ন সূচক কিংবা অন্যান্য কোয়ালিটেটিভ অগ্রগতির দিকে নজর দেওয়া জরুরি।
তথ্যসূত্রঃ লন্ডনভিত্তিক “নিউ ইকোনোমিক ফাউন্ডেশন” এর ওয়ার্কিং পেপার।
লেখক: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি
alauddin0112@gmail.com
No comments