একাত্তরে গো আযম বাংলাদেশের হিটলার ॥ জেরায় সুলতানা কামাল- যুদ্ধাপরাধী বিচার
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তৃতীয় সাক্ষী মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল জেরায় বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার যা করেছেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমি মনে করি গোলাম আযম সে রকমই করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে গোলাম আযমের ভূমিকা হিটলারের সমতুল্য। মতিউর রহমান নিজামী আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন এবং শান্তিকমিটি, রাজাকার আলবদর, আলশামস- এই ৪টি সংগঠন তৈরি করতে গোলাম আযম মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। হিটলার যেমন নাৎসি বাহিনীর প্রধান ছিলেন না, এমনকি সদস্যও ছিলেন না। কিন্ত তিনি ছিলেন নাৎসি বাহিনীর মূলনায়ক। তেমনি যদিও গোলাম আযম উল্লিখিত ৪টি সংগঠনের প্রাতিষ্ঠানিক মুখ্য নেতা ছিলেন না। কিন্তু এই সব সংগঠনই তার নির্দেশে ও নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আসামি পক্ষের আইনজীবীর জেরায় এ কথা বলেছেন।
তৃতীয় সাক্ষী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল জেরায় আরও বলেছেন, ‘গোলাম আযম যদিও শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নেতা ছিলেন না, এর পরও তাঁর নির্দেশ ও নেতৃত্বে এসব সংগঠন পরিচালিত হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যা করেছেন, আমি মনে করি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গোলাম আযম তেমন কাজই করেছেন।’ আসামি পক্ষের আইনজীবী কফিলউদ্দিন চৌধুরী সাক্ষীকে বলেন, গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধকালে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নেতা ছিলেন না। এর উত্তরে সাক্ষী সুলতানা কামাল এসব কথা বলেন। এ সময় প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও সৈয়দ হায়দার আলী সাক্ষীকে সহায়তা করেন। চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু উপস্থিত ছিলেন।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে তাঁকে জেরা শুরু হয়। পরে বিকেল সোয়া চারটার দিকে জেরা শেষ হয়। এ সময় গোলাম আযম ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত থাকলেও দুপুর ১২টার দিকে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারাকক্ষে ফিরিয়ে নেয়া হয়। মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ করা হবে রবিবার।
সুলতানা কামালের জেরার অংশ বিশেষ নিম্নে দেয়া হলো-
প্রশ্ন : হিটলার জার্মানি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তৎকালীন গবর্নর ছিলেন টিক্কা খান। হিটলারের অবস্থানে গোলাম আযম ছিলেন না। কাজেই তার সঙ্গে তুলনা উদ্দেশমূলক অস্বাভাবিক।
উত্তর : ইহা সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনার এই বক্তব্যসমূহ রাজনৈতিক অবস্থান এবং জামায়াতের গোলাম আযমের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত।
উত্তর : ইহা সত্য নয়।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধারাই দুষ্কৃতকারী এ সংক্রান্ত গোলাম আযম কোন বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছিলেন সেই মর্মে পাওয়া পত্রিকার কাটিং দেখাতে পারবেন? তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়েছিলেন?
উত্তর : দেখাতে পারব। নিজের সংরক্ষণে আছে। কিছু কিছু তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়েছি।
প্রশ্ন : প্রথমে শান্তি কমিটি গঠনের তৎপরতা চালায়। শান্তিকমিটি তে ভয়ভীতি চাপ সৃষ্টি করে করা হয়েছে এমন কাটিং দেখাতে পারবেন?
উত্তর : কাগজপত্র আমার কাছে আছে। এমন কাটিং দেখাতে পারব। তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়েছি। তবে এখানে আনিনি।
প্রশ্ন : এই ধরনের খবর যুদ্ধকালে দেশী বা বিদেশী কোন পত্রিকার এই নিউজ সম্বন্ধে আছে কিনা।
উত্তর : যুদ্ধকালে ঐ বক্তব্য সংবলিত দেশী বা বিদেশী কোন পত্রিকা আপতত আমার সংরক্ষণে নেই।
প্রশ্ন : আমরা এও জানতে পারি গোপন কিলার বাহিনী গঠন করা হয়েছে। এবং বিষয়টি দেশী বা বিদেশী পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে।
উত্তর : জবানবন্দীতে প্রদত্ত আমার বক্তৃতা ‘গোপন কিলার ফোর্স তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে’Ñ এই মর্মে তারা গোপনে কাজগুলো করবে মর্মে জেনেছিলাম। সে ব্যাপারে যুদ্ধকালে দেশী বা বিদেশী কোন পত্রিকা আমি এখন দিতে পারব না। তবে এই খবর যে সব মুক্তিযোদ্ধা দেশের অভ্যন্তরে থাকতেন এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে আবার ভারতে যেতেন তাদের মধ্যে অনেক বন্ধুও ছিল। তাদের কাছ থেকে আমরা জেনেছি।
প্রশ্ন : কখন পেলেন?
উত্তর : আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে।
প্রশ্ন : অংশ্রু প্রু চৌধুরী পাকিস্তানের এমপিএ হয়েছিলেন?
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : উনি ঐ এলাকার প্রতিনিধিত্ব করতেন।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি সম্পাদক কে ছিলেন?
উত্তর : ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি ছিলেন আমার মা বেগম সুফিয়া কামাল। সম্পাদক ছিলেন মালেকা বেগম। সেই সংগঠন স্বাধীনতার পরবর্তীতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নাম নিয়ে এখন কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় মূলধারার রাজনীতি সঙ্গে কাজ করেছেন। সেই মূলধারার রাজনীতি নেতৃত্বে কোন দল ছিল।
উত্তর : আমার জবানবন্দীতে মূলধারার রাজনীতি বলতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বুঝিয়েছি।
প্রশ্ন : স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আপনার মা বাবা বড় ভাই ধানম-ির বাসায় ছিলেন।
উত্তর : ছিল।
প্রশ্ন : আপনার মা যে সমস্ত সরকারী বেসরকারী পদক পেয়েছেন তা ১৯৬১, ৭২, ৬৬, ৭৭, ৮২, ৯৫ ও ৯৬ সালে।
উত্তর : হতে পারে। অসংখ্য পদক পেয়েছেন, কোন্ সাল বা তারিখ এই মুহূর্তে মনে নেই।
প্রশ্ন : মাহে-নও পত্রিকায় আপনার মা লিখতেন। যার সম্পাদক ছিলেন কবি আব্দুল কাদের।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : সেটা মাসিক পত্রিকা ছিল?
উত্তর: জি।
প্রশ্ন : আপনার অপর বোন যিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি জীবিত আছেন।
উত্তর : আছে।
প্রশ্ন : আপনার ভাই যার কাছ থেকে ইনফরমেশন পেতেন, তিনি জীবিত আছেন।
উত্তর : আছেন। তিনি এখনও আমেরিকা তে আছেন।
প্রশ্ন : আপনার ভাই যে খবরাখবর পাঠাতেন সেই চিঠিপত্র আছে।
উত্তর : চিঠিগুলো সংরক্ষণ করতে পারিনি।
প্রশ্ন : ঐ চিঠিগুলোতে গোলাম আযম সম্পর্কে কোন বক্তব্য না থাকায় গোপন করেছেন।
উত্তর : ইহা সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি আইন সালিশ কেন্দ্রের শীর্ষ নির্বাহী পরিচালক।
উত্তর : প্রধান নির্বাহী পরিচালক।
প্রশ্ন : সেখান থেকে আপনি মাসিক বেতন পান।
উত্তর : জি, সম্মানী পাই।
প্রশ্ন : ১৯৮৪ সালে কোথায় থাকতেন।
উত্তর : সিলেটে থাকতাম। তখন ফ্রিল্যান্স কনসালটিং করতাম।
প্রশ্ন : ওখানে কত বছর ছিলেন?
উত্তর : ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত একটানা থেকেছি।
প্রশ্ন : ঐ সময় কনসালটিং করতেন?
উত্তর: জি।
প্রশ্ন: আপনি বার কাউন্সিলের সদস্য। সিনিয়রকে ছিলেন।
উত্তর : জিতেন্দ্র নাথ দে।
প্রশ্ন : ওখানে কয় বছর ছিলেন।
উত্তর : লাইসেন্স পাবার জন্য যত দিন আদালতে যাওয়া দরকার ততদিন ছিলাম।
প্রশ্ন : কোন প্রাকটিস করতেন?
উত্তর : সিভিল।
প্রশ্ন : বার কাউন্সিলের সদস্য আছেন।
উত্তর : সিলেট বারের সদস্য পদ আছে। তবে আদালতে যাই না।
প্রশ্ন : আপনি যে এফিডেভিড করেছিলেন, যাতে কোন ব্যবসা করতে পারবেন না এমন দিয়েছিলেন?
উত্তর : আমি আমার বার কাউন্সিলে লাইসেন্স পাবার জন্য যে এফিডেভিড দিয়েছি তাতে বলেছি কোন কাজে কর্মরত নাই।
প্রশ্ন : আপনি জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র পড়েছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সদস্য হওয়া বা বাতিল হওয়া সম্পর্কে জ্ঞান নেই?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি চিপে বলেছেন, তখন ফলাও করে পত্রপত্রিকায় আসতো সেগুলো কি কি?
উত্তর : পূর্বদেশ, আজাদ।
প্রশ্ন: সেই পত্রিকায় কোন মাসে খবর আসে?
উত্তর: আজাদ পত্রিকায় একাত্তর সালে ৫ এবং ৭ এপ্রিল এই খবর আসে।
প্রশ্ন: ওখানে আপনার বর্ণিত মতে গোলাম আযমের ভূমিকার কথা লেখা নেই?
উত্তর : ছিল। ইহা সত্য নয়।
প্রশ্ন : দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ৬ এপ্রিল ১৯৭১ খবর প্রকাশিত হয়েছে। পিডিবির নুরুল আমিন সাহেব নেতৃত্বে খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক এর সাথে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য সাহায্য-সহযোগিতার কথা বলা হয়। সেখানে গোলাম আযমের নেতৃত্বে কথা বলা হয়নি।
উত্তর : এর উত্তরে সাক্ষী বলেন যে, সত্য হতেও পারে। তবে ঐ সময় দৈনিক পূর্বদেশে গোলাম আযমের কথা বলা হয়েছে । শান্তিকমিটি গঠনের ব্যাপারে তার মুখ্য ভূমিকার কথাও বলা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমারা দেখেছি মিছিল মিটিং হয়েছে। বক্তৃতা বিবৃতি দেয়া হয়েছে এমনকি গোলাম আযমের দস্তখত সংবলিত এক টাকা দামের টিকিটও বিক্রি হয়েছে।
প্রশ্ন: এ কথাগুলো বললেন, গোলাম আযমের মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন কোন পত্রিকায় উঠেছে।
উত্তর : গোলাম আযম শান্তি কমিটি গঠন করার সে কথাগুলো দৈনিক পূর্বদেশে ৫/৭ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন: নুরুল আমিনের নেতৃত্বে দেখা করার পরে শান্তি কমিটি গঠিত হয় ১১ এপ্রিল আজাদে প্রকাশিত হয়েছে।
উত্তর : নুরুল আমিনের নেতৃত্বে সামরিক আইন প্রশাসকের সাথে দেখা করার পরে শান্তি কমিটি ১১ এপ্রিল একাত্তরে আজাদে প্রকাশিত হয়েছে তা আমি জানি না।
প্রশ্ন : এই শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন খাজা খয়েরউদ্দিন। তিনি মুসলীম লীগ করতেন। ঐ কমিটি ১৪০ সদস্যের ছিল ।
উত্তর : ১৪০ সদস্যবিশিষ্ট ছিল কিনা জানা নেই।
প্রশ্ন : ঐ নিউজে প্রথমেই লেখা ছিল ‘নাগরিকদের প্রাত্যহিক জীবনে স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির এবং জনমনে অহেতুক ও ভিত্তিহীন শঙ্কা দূর করার উদ্দেশে এই কমিটি গঠন করা হয়।
উত্তর : ইহা সত্য নয়। তবে ঐ সময়ে জনগণকে হত্যা করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এবং লোকদের নির্বিচারে হত্যা ও উচ্ছেদ করা হচ্ছে। সেই সময় এ ঘটনাগুলোকে অহেতুক ভিত্তিহীন ও শঙ্কা বলে প্রকাশ করে তারা নিজেরাই নিজেদের দোষসমূহকে ঢাকার অপচেষ্টা করে তাদের মানসিক এবং অপরাধের প্রতি সমর্থকে প্রকাশ করেছে।
প্রশ্ন : রাজাকার আলশামস ছিল সহযোগী বাহিনী ।
উত্তর : গঠনতন্ত্র মতে শান্তিকমিটি ছিল সামাজিক শক্তি। রাজাকার, আলশামস অক্সিলারি শক্তি ছিল।
প্রশ্ন : এই বাহিনী বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বিলুপ্ত হয়।
উত্তর : স্বাধীন হবার পর এগুলো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন : গোলাম আযম কোন কমিটিতে আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন না।
উত্তর : ইহা সত্য নয়।
এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আরও দু’জন সাক্ষী তাদের জবানবন্দী পেশ করেছেন। তারা হলেন বিশিষ্ট গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ও মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম (এসপি মাহাবুব)। ১ মে সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। পরে ৫ জুন তার বিরুদ্ধে (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণের কাজ শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-১।
১ জুন পাঁচ ধরনের ঘটনায় ৬২টি অভিযোগের মধ্যে মোট ৬১টি ঘটনার ভিত্তিতে অভিযোগ গঠন করা হয় জমায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে। তার আগে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯১ পৃষ্ঠার অভিযোগ উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন পক্ষ। ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার পর গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজনসেলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।
তৃতীয় সাক্ষী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল জেরায় আরও বলেছেন, ‘গোলাম আযম যদিও শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নেতা ছিলেন না, এর পরও তাঁর নির্দেশ ও নেতৃত্বে এসব সংগঠন পরিচালিত হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যা করেছেন, আমি মনে করি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গোলাম আযম তেমন কাজই করেছেন।’ আসামি পক্ষের আইনজীবী কফিলউদ্দিন চৌধুরী সাক্ষীকে বলেন, গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধকালে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নেতা ছিলেন না। এর উত্তরে সাক্ষী সুলতানা কামাল এসব কথা বলেন। এ সময় প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও সৈয়দ হায়দার আলী সাক্ষীকে সহায়তা করেন। চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু উপস্থিত ছিলেন।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে তাঁকে জেরা শুরু হয়। পরে বিকেল সোয়া চারটার দিকে জেরা শেষ হয়। এ সময় গোলাম আযম ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত থাকলেও দুপুর ১২টার দিকে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারাকক্ষে ফিরিয়ে নেয়া হয়। মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ করা হবে রবিবার।
সুলতানা কামালের জেরার অংশ বিশেষ নিম্নে দেয়া হলো-
প্রশ্ন : হিটলার জার্মানি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তৎকালীন গবর্নর ছিলেন টিক্কা খান। হিটলারের অবস্থানে গোলাম আযম ছিলেন না। কাজেই তার সঙ্গে তুলনা উদ্দেশমূলক অস্বাভাবিক।
উত্তর : ইহা সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনার এই বক্তব্যসমূহ রাজনৈতিক অবস্থান এবং জামায়াতের গোলাম আযমের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত।
উত্তর : ইহা সত্য নয়।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধারাই দুষ্কৃতকারী এ সংক্রান্ত গোলাম আযম কোন বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছিলেন সেই মর্মে পাওয়া পত্রিকার কাটিং দেখাতে পারবেন? তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়েছিলেন?
উত্তর : দেখাতে পারব। নিজের সংরক্ষণে আছে। কিছু কিছু তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়েছি।
প্রশ্ন : প্রথমে শান্তি কমিটি গঠনের তৎপরতা চালায়। শান্তিকমিটি তে ভয়ভীতি চাপ সৃষ্টি করে করা হয়েছে এমন কাটিং দেখাতে পারবেন?
উত্তর : কাগজপত্র আমার কাছে আছে। এমন কাটিং দেখাতে পারব। তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়েছি। তবে এখানে আনিনি।
প্রশ্ন : এই ধরনের খবর যুদ্ধকালে দেশী বা বিদেশী কোন পত্রিকার এই নিউজ সম্বন্ধে আছে কিনা।
উত্তর : যুদ্ধকালে ঐ বক্তব্য সংবলিত দেশী বা বিদেশী কোন পত্রিকা আপতত আমার সংরক্ষণে নেই।
প্রশ্ন : আমরা এও জানতে পারি গোপন কিলার বাহিনী গঠন করা হয়েছে। এবং বিষয়টি দেশী বা বিদেশী পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে।
উত্তর : জবানবন্দীতে প্রদত্ত আমার বক্তৃতা ‘গোপন কিলার ফোর্স তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে’Ñ এই মর্মে তারা গোপনে কাজগুলো করবে মর্মে জেনেছিলাম। সে ব্যাপারে যুদ্ধকালে দেশী বা বিদেশী কোন পত্রিকা আমি এখন দিতে পারব না। তবে এই খবর যে সব মুক্তিযোদ্ধা দেশের অভ্যন্তরে থাকতেন এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে আবার ভারতে যেতেন তাদের মধ্যে অনেক বন্ধুও ছিল। তাদের কাছ থেকে আমরা জেনেছি।
প্রশ্ন : কখন পেলেন?
উত্তর : আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে।
প্রশ্ন : অংশ্রু প্রু চৌধুরী পাকিস্তানের এমপিএ হয়েছিলেন?
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : উনি ঐ এলাকার প্রতিনিধিত্ব করতেন।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি সম্পাদক কে ছিলেন?
উত্তর : ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি ছিলেন আমার মা বেগম সুফিয়া কামাল। সম্পাদক ছিলেন মালেকা বেগম। সেই সংগঠন স্বাধীনতার পরবর্তীতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নাম নিয়ে এখন কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় মূলধারার রাজনীতি সঙ্গে কাজ করেছেন। সেই মূলধারার রাজনীতি নেতৃত্বে কোন দল ছিল।
উত্তর : আমার জবানবন্দীতে মূলধারার রাজনীতি বলতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বুঝিয়েছি।
প্রশ্ন : স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আপনার মা বাবা বড় ভাই ধানম-ির বাসায় ছিলেন।
উত্তর : ছিল।
প্রশ্ন : আপনার মা যে সমস্ত সরকারী বেসরকারী পদক পেয়েছেন তা ১৯৬১, ৭২, ৬৬, ৭৭, ৮২, ৯৫ ও ৯৬ সালে।
উত্তর : হতে পারে। অসংখ্য পদক পেয়েছেন, কোন্ সাল বা তারিখ এই মুহূর্তে মনে নেই।
প্রশ্ন : মাহে-নও পত্রিকায় আপনার মা লিখতেন। যার সম্পাদক ছিলেন কবি আব্দুল কাদের।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : সেটা মাসিক পত্রিকা ছিল?
উত্তর: জি।
প্রশ্ন : আপনার অপর বোন যিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি জীবিত আছেন।
উত্তর : আছে।
প্রশ্ন : আপনার ভাই যার কাছ থেকে ইনফরমেশন পেতেন, তিনি জীবিত আছেন।
উত্তর : আছেন। তিনি এখনও আমেরিকা তে আছেন।
প্রশ্ন : আপনার ভাই যে খবরাখবর পাঠাতেন সেই চিঠিপত্র আছে।
উত্তর : চিঠিগুলো সংরক্ষণ করতে পারিনি।
প্রশ্ন : ঐ চিঠিগুলোতে গোলাম আযম সম্পর্কে কোন বক্তব্য না থাকায় গোপন করেছেন।
উত্তর : ইহা সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি আইন সালিশ কেন্দ্রের শীর্ষ নির্বাহী পরিচালক।
উত্তর : প্রধান নির্বাহী পরিচালক।
প্রশ্ন : সেখান থেকে আপনি মাসিক বেতন পান।
উত্তর : জি, সম্মানী পাই।
প্রশ্ন : ১৯৮৪ সালে কোথায় থাকতেন।
উত্তর : সিলেটে থাকতাম। তখন ফ্রিল্যান্স কনসালটিং করতাম।
প্রশ্ন : ওখানে কত বছর ছিলেন?
উত্তর : ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত একটানা থেকেছি।
প্রশ্ন : ঐ সময় কনসালটিং করতেন?
উত্তর: জি।
প্রশ্ন: আপনি বার কাউন্সিলের সদস্য। সিনিয়রকে ছিলেন।
উত্তর : জিতেন্দ্র নাথ দে।
প্রশ্ন : ওখানে কয় বছর ছিলেন।
উত্তর : লাইসেন্স পাবার জন্য যত দিন আদালতে যাওয়া দরকার ততদিন ছিলাম।
প্রশ্ন : কোন প্রাকটিস করতেন?
উত্তর : সিভিল।
প্রশ্ন : বার কাউন্সিলের সদস্য আছেন।
উত্তর : সিলেট বারের সদস্য পদ আছে। তবে আদালতে যাই না।
প্রশ্ন : আপনি যে এফিডেভিড করেছিলেন, যাতে কোন ব্যবসা করতে পারবেন না এমন দিয়েছিলেন?
উত্তর : আমি আমার বার কাউন্সিলে লাইসেন্স পাবার জন্য যে এফিডেভিড দিয়েছি তাতে বলেছি কোন কাজে কর্মরত নাই।
প্রশ্ন : আপনি জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র পড়েছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সদস্য হওয়া বা বাতিল হওয়া সম্পর্কে জ্ঞান নেই?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি চিপে বলেছেন, তখন ফলাও করে পত্রপত্রিকায় আসতো সেগুলো কি কি?
উত্তর : পূর্বদেশ, আজাদ।
প্রশ্ন: সেই পত্রিকায় কোন মাসে খবর আসে?
উত্তর: আজাদ পত্রিকায় একাত্তর সালে ৫ এবং ৭ এপ্রিল এই খবর আসে।
প্রশ্ন: ওখানে আপনার বর্ণিত মতে গোলাম আযমের ভূমিকার কথা লেখা নেই?
উত্তর : ছিল। ইহা সত্য নয়।
প্রশ্ন : দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ৬ এপ্রিল ১৯৭১ খবর প্রকাশিত হয়েছে। পিডিবির নুরুল আমিন সাহেব নেতৃত্বে খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক এর সাথে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য সাহায্য-সহযোগিতার কথা বলা হয়। সেখানে গোলাম আযমের নেতৃত্বে কথা বলা হয়নি।
উত্তর : এর উত্তরে সাক্ষী বলেন যে, সত্য হতেও পারে। তবে ঐ সময় দৈনিক পূর্বদেশে গোলাম আযমের কথা বলা হয়েছে । শান্তিকমিটি গঠনের ব্যাপারে তার মুখ্য ভূমিকার কথাও বলা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমারা দেখেছি মিছিল মিটিং হয়েছে। বক্তৃতা বিবৃতি দেয়া হয়েছে এমনকি গোলাম আযমের দস্তখত সংবলিত এক টাকা দামের টিকিটও বিক্রি হয়েছে।
প্রশ্ন: এ কথাগুলো বললেন, গোলাম আযমের মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন কোন পত্রিকায় উঠেছে।
উত্তর : গোলাম আযম শান্তি কমিটি গঠন করার সে কথাগুলো দৈনিক পূর্বদেশে ৫/৭ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন: নুরুল আমিনের নেতৃত্বে দেখা করার পরে শান্তি কমিটি গঠিত হয় ১১ এপ্রিল আজাদে প্রকাশিত হয়েছে।
উত্তর : নুরুল আমিনের নেতৃত্বে সামরিক আইন প্রশাসকের সাথে দেখা করার পরে শান্তি কমিটি ১১ এপ্রিল একাত্তরে আজাদে প্রকাশিত হয়েছে তা আমি জানি না।
প্রশ্ন : এই শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন খাজা খয়েরউদ্দিন। তিনি মুসলীম লীগ করতেন। ঐ কমিটি ১৪০ সদস্যের ছিল ।
উত্তর : ১৪০ সদস্যবিশিষ্ট ছিল কিনা জানা নেই।
প্রশ্ন : ঐ নিউজে প্রথমেই লেখা ছিল ‘নাগরিকদের প্রাত্যহিক জীবনে স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির এবং জনমনে অহেতুক ও ভিত্তিহীন শঙ্কা দূর করার উদ্দেশে এই কমিটি গঠন করা হয়।
উত্তর : ইহা সত্য নয়। তবে ঐ সময়ে জনগণকে হত্যা করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এবং লোকদের নির্বিচারে হত্যা ও উচ্ছেদ করা হচ্ছে। সেই সময় এ ঘটনাগুলোকে অহেতুক ভিত্তিহীন ও শঙ্কা বলে প্রকাশ করে তারা নিজেরাই নিজেদের দোষসমূহকে ঢাকার অপচেষ্টা করে তাদের মানসিক এবং অপরাধের প্রতি সমর্থকে প্রকাশ করেছে।
প্রশ্ন : রাজাকার আলশামস ছিল সহযোগী বাহিনী ।
উত্তর : গঠনতন্ত্র মতে শান্তিকমিটি ছিল সামাজিক শক্তি। রাজাকার, আলশামস অক্সিলারি শক্তি ছিল।
প্রশ্ন : এই বাহিনী বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বিলুপ্ত হয়।
উত্তর : স্বাধীন হবার পর এগুলো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন : গোলাম আযম কোন কমিটিতে আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন না।
উত্তর : ইহা সত্য নয়।
এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আরও দু’জন সাক্ষী তাদের জবানবন্দী পেশ করেছেন। তারা হলেন বিশিষ্ট গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ও মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম (এসপি মাহাবুব)। ১ মে সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। পরে ৫ জুন তার বিরুদ্ধে (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণের কাজ শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-১।
১ জুন পাঁচ ধরনের ঘটনায় ৬২টি অভিযোগের মধ্যে মোট ৬১টি ঘটনার ভিত্তিতে অভিযোগ গঠন করা হয় জমায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে। তার আগে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯১ পৃষ্ঠার অভিযোগ উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন পক্ষ। ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার পর গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজনসেলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।
No comments