বাংলা গানে রজনী কান্ত সেন by জোবায়ের আলী জুয়েল
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই/ দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের, তার বেশি আর সাধ্য নাই।
অথবা- ভিক্ষার চালে কাজ নাই, সে বড় অপমান/ মোটা হোক যে সোনা মোদেরÑ মায়ের ক্ষেতের ধান।
স্বদেশ প্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত এই বিখ্যাত গানের রচয়িতা কবি রজনী কান্ত সেন।সেকালে ‘কান্ত কবি’ নামে তিনি সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। বাঙালীর কণ্ঠে ঘরে ঘরে গীত হতো সেকালের এই বিখ্যাত গানগুলো। রজনী কান্ত সেনের গান বলতে আমরা বুঝি বিশ শতকের ত্রিশ, চল্লিশ দশকের কথা। এখন যাকে বলা হয় পুরনো দিনের গান।
রজনী কান্ত সেনের জন্ম ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামে। পিতা গুরু প্রসাদ সেন ছিলেন সেকালের সঙ্গীতঙ্গ গুণী ব্যক্তিত্ব ও বরিশালের নামকরা সাবজজ এবং ব্যক্তিত্বময়ী নারী মনোমোহিনী দেবীর তৃতীয় সন্তান ছিলেন রজনী কান্ত সেন। মানিকগঞ্জের তারক নাথ সেনের কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
রজনী কান্ত সেন কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে ১৮৮৩ সালে এন্ট্রান্স, ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ, ১৮৮৯ সালে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিএ ও ১৮৯১ সালে বিএল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীকালে তিনি রাজশাহী কোর্টে ওকালতি শরু করেন। কিছুদিন তিনি নাটোর ও নওগাঁয় অস্থায়ী মুন্সেফও ছিলেন। বিএল পরীক্ষা দেবার আগে থেকেই তাঁর কবিতা ও গান রাজশাহী পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে।
রজনী কান্ত সেন শৈশবে বাবার কাছে সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘কালী সঙ্গীত’ রচনা করে কবিত্ব শক্তির পরিচয় দেন।
ওকালতি পেশায় প্রবেশ করলেও গানের নেশা, কবিতা ও রসব্যঙ্গ কাব্য লেখা তাঁর পরবর্তীতে নেশা হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর কবিতা ও গানের বিষয়বস্তু প্রধানত ভক্তি ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত। রজনী কান্ত সেনের ভক্তি সঙ্গীতগুলো ‘কান্ত পদাবলী’ নামে পরিচিত। তাঁর প্রথম কাব্য ‘গীতি বাণী’ ১৯০২ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া কল্যাণী (১৯০৫ খ্রিঃ), অভয়া (১৯১০ খ্রিঃ), অমৃত নীতি কবিতা (১৯১০ খ্রিঃ), আনন্দময়ী (১৯১০ খ্রিঃ), বিশ্রাম (১৯১০ খ্রিঃ), সদ্ভাব কুসুম (১৯১৩ খ্রিঃ), শেষ দান (১৯১৬ খ্রিঃ) প্রকাশিত হয়।
পেশায় ওকালতি অথচ নেশায় সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের সঙ্গে রাজশাহীতে রজনী কান্ত সেনের সৌহার্দ্য ছিল। এই রাজশাহীতেই গানের রাজা দ্বিজেন্দ্র লাল রায় ও ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেনের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়।
আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাসে পঞ্চগীতি কবিদের (রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, দ্বীজেন্দ্র লাল, অতুল প্রসাদ, রজনী কান্ত) অন্যতম ছিলেন রজনী কান্ত সেন। রবীন্দ্র প্রভাবে প্রভাবিত হয়েও তিনি যে গানগুলো রচনা করেছেন তা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। রজনী কান্ত স্বদেশী গান, ভক্তিমূলক গান ও হাসির গান লিখেছেন অসংখ্য। একটি বিখ্যাত গান : “তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে, মলিনমর্ম মুছায়ে/ তব পুণ্য কিরণ দিয়ে যাক, মোর/মোহ কালিমা ঘুচায়ে।”
তার বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান হলোÑ
১ আমিতো তোমারে চাহিনী জীবনে (২) আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে, (৩) কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব। (৪) আমি অকৃতি অধম বলেও তো/কিছু কম করে মোরে দাওনি/ যা দিয়েছে তার অযোগ্য ভাবিয়া। কেড়েও তো কিছু নাওনি। (৫) তোমারি দেয়া প্রাণে তোমারি দেয়া দুঃখ (৬) কেন বঞ্চিত হব চরণে? আমি কত আশা করে বসে আছি/ পাব জীবনে না হয় মরণে। (৭) সে যে পরম প্রেম সুন্দর/জ্ঞান নয়ন-নন্দন/ পুণ্য মধুর নিরমল/জ্যোতি জগৎ বন্দন।
তাঁর এই ভক্তিমূলক গানগুলো মানবের প্রাণে সঞ্চার করে প্রার্থনার আকুতি।
রজনী কান্তের হাসির গানগুলো চমৎকার ও অসাধারণ যেমন-
(১) আমরা ভূমধ্যকারী বঙ্গে/সদা এয়ার বন্ধু সঙ্গে/ কত ফুর্তিতে করি সময় হত্যা/ তাস, পাশা, চতুরঙ্গে।
(২) বাজার হুদ্দা কিন্যা আইন্যা চাইলা দিচি পায়/ তোমার লগে কেমতে পারুম, হৈয়া উঠছে, দায়/আরসি দিচি, কাহই দিচি, গাও মাজনের ছাপান দিচি, আর কি দ্যাওন যায়?
রজনী কান্ত সেনের নীতি কবিতাগুলো আমরা প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের বাংলা পাঠ্য পুস্তকে সবাই পড়েছি যেমন তাঁর বিখ্যাত কবিতাÑ‘স্বাধীনতার সুখ’
“বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই,
কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই।”
অথবা- ‘পরো পকার’
“নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল।”
ইত্যাদি কবিতাগুলো এখনও পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
রজনী কান্তের স্বদেশী গান প্রেম ভক্তির রসামৃতে নন্দিত। যেমন ‘বঙ্গ মাতা’ শীর্ষক কাব্য গীতিতে তিনি লিখেছেনÑ
নমো নমো জননী বঙ্গ!/ উত্তরে ঐ অভ্রভেদী/অতুল বিপুল গিরি, অরণ্য/দক্ষিণে সুবিশাল জলধি/চুম্বে চরণতল নিরবধি/মধ্যেপুত জাহ্নবী জল/ধৌত শ্যাম-ক্ষেত্র সঙ্ঘ।
ভক্তি রস ছাড়াও রজনী কান্তের অনেক গানে দেশাত্মবোধ ও হাস্যরসের উপস্থিতিও লক্ষণীয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলন রজনী কান্তকে যে দেশাত্মবোধে উদ্দীপিত করেছিল তার প্রকাশ দেখা যায়Ñ“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই” গানটিতে। বিশেষ করে সেকালে শিক্ষার্থী যুবকদের কণ্ঠে গীত হতো। স্বদেশী গান সেই ব্রিটিশ যুুগে দেশপ্রেমিক কবি রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, রজনী কান্ত সেন, অতুল প্রসাদ সেনও লিখেছেন।
রজনী কান্ত হাস্য রসাত্মক গান রচনায় উদ্বুদ্ধ হন দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের প্রভাবে। তাঁর রচিত প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক গানের সংখ্যাও কম নয়।
তাঁর গান বাংলার মৌলিক সাঙ্গীতিক উপাদানে সমৃদ্ধ। কীর্তন, বাউল, রাম-প্রসাদী, পাঁচালি ইত্যাদি গানের সুর ও ভাবের প্রভাব তাঁর গানে লক্ষণীয়।
রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্র লাল প্রমুখ গীতিকারের মতো বিলেত যাওয়ার বা বড় কোন ওস্তাদের কাছে গান শেখার সুযোগ তাঁর হয়নি। তাই কান্তগীতির সুরে কিছুটা বৈচিত্র্যের অভাব পরিলক্ষিত হলেও ভক্তি ভাবের সহজ অভিব্যক্তিতে তা হৃদয়গ্রাহী। সঙ্গীতের বিবিধ কারু কাজ তাঁর গানে না থাকলেও গানের সহজ সরল ভাবপূর্ণ কথার সঙ্গে মিড়ের টান যুক্ত সুরের আবেদন শ্রোতাকে সহজেই আকর্ষণ করে, মোহিত করে।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের প্রচার মাধ্যমগুলোতে তাঁর গান নিয়মিত গাওয়া হয়। কোলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের পাঠ্য সূচীতেও কান্তগীতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আমাদের বাংলাদেশেও রজনী কান্তের গান বিশেষভাবে পরিচিত এবং জনপ্রিয়।
সঙ্গীতপ্রাণ রজনী কান্ত সেন যখন গৌরবের শিখরে আসীন তখনই এলো তাঁর দেহে কাল ব্যাধি ক্যান্সার।
সুদীর্ঘকাল রোগ শয্যায় মেডিক্যাল কলেজে থেকেও তিনি বহহুগীতি কবিতা লিখেছিলেন। প্রায় দুই বছর কঠিন রোগ ভোগের পর ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর গানের রাজা রজনী কান্ত সেন পরম প্রভুর কাছে শান্তি ধামে প্রস্থান করেন।
তথ্যসূত্র : ১) করুণাময় গোস্বামী : সঙ্গীত কোষ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা ১৯৮৫ খ্রিঃ
২) সুধীর চক্রবর্তী : বাংলা গানের সন্ধানে অরুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ (১৯৯০ খ্রিঃ)
৩) রজনী কান্ত সেন : ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরী দৈনিক জনকণ্ঠ, ঢাকা
No comments