নভোযানে থাকবে তাপরোধী বর্ম

নাসার বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এক দুঃসাহসিক প্রযুক্তির সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন। কাজের গতির চেয়ে দশ গুণ গতিতে ছুটে আসা কোন নভোযান ভবিষ্যতে কোন গ্রহের বায়ুম-লে প্রবেশ করার সময় এই প্রযুক্তির দ্বারা গতি কমিয়ে জ্বলে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারবে।


প্রযুক্তিটা হলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলার উপযোগী এক বিশাল তাপরোধক বর্ম। এটি আসলে নভোযানের সামনের দিকের বহিরাবরণ বা বাইরের খোলস যা নাইট্রোজেনে পূর্ণ করে স্ফীত করা যায়।
নাসার এই সফল পরীক্ষাটি গত ২৩ জুলাই ভার্জিনিয়ার ওয়ালপস ফ্লাইট ফ্যাসিলিটি থেকে একটি রকেট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে করা হয়। রকেটটি নভোযানকে ২৮৮ মাইল উর্ধে পৃথিবীর কক্ষপথের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে খসে পড়ে। এরপর ইনফ্লেটেবল রিএন্ট্রি ভেহিকেল এক্সপেরিমেন্ট বা সংক্ষেপে আইআরভিই-৩ নামে কথিত নভোযানের বহিরাবরণ পরিকল্পনা অনুযায়ী স্ফীত হয় এবং নভোযানটি পৃথিবীর বুকে ফিরে এসে নর্থ ক্যারোলিনার কেপ হ্যাটেরাসের পূর্বে আটলান্টিকে অবতরণ করে। গোটা প্রক্রিয়ায় সময় লেগেছে ২০ মিনিট।
পৃথিবীর বায়ুম-লে পুনর্প্রবেশরত একটা নভোযানের তাপমাত্রা ১৮৫০ ডিগ্রী ফারেনহাইট বেড়ে যায়। কারণ নভোযানটি তখ ঘণ্টায় ৭৬০০ মাইল গতিতে নিচের দিকে ধাবিত হয়। এত বেশি তাপমাত্রায় নভোযানটি জ্বলে যাওয়া অবধারিত। এ অবস্থায় ভিতরের নভোচারী ও সাজসরঞ্জাম রক্ষার জন্য এমন শক্তিশালী বর্ম একান্তই প্রয়োজন যা কিনা তাপ রোধ করতে পারে। নাসার গোটা ইতিহাসে এসব তাপরোধক বর্ম কঠিন উপাদান দিয়ে তৈরি করা হলেও নিরাপত্তার সমস্যাটা থেকে গেছে। যেমন ব্রিটল সিরামিকের টাইল দিয়ে কলম্বিয়া শাটলযানের বর্মটি তৈরি হলেও ২০০৩ সালের দুর্ঘটনাটি এড়ানো যায়নি।
সমস্যাটি সমাধানের এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে নাসা। সেটি হলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা যায় এমন কাপড়ের তৈরি তাপরোধক বর্ম। কাপড়টি কেভলার এবাসিড ফাইবারের তৈরি যাকে বলা হয় কেভলার ফেব্রিক্স। এটি অগ্নি প্রতিরোধক এবং প্রচ- তাপ সহ্য করতে সক্ষম। পরীক্ষামূলকভাবে এই কাপড়ের বর্ম দিয়ে আবৃত করা হয়েছিল নভোযানের উর্ধভাগ। প্রয়োজনের সময় এতে নাইট্রোজেন গ্যাস পাম্প করে একে স্ফীত করে তোলা হয় এবং তখন তা মাশরুম বা ব্যাঙের ছাতার আকৃতি ধারণ করে যার ব্যাস হলো ১০ ফুট। এই তাপরোধক বর্ম বা এরোশেলের ওজন ৬৮০ পাউন্ড। ব্যাপারটা সহজ মনে হলেও এটি উদ্ভাবন করতে প্রায় তিন বছর সময় লেগে গেছে।
উৎক্ষেপণের পর আবার মর্ত্যে ফিরে এসে আটলান্টিকের জলরাশিতে পড়তে এটির প্রায় ২০ মিনিট লেগেছে। এর আগেও এ জাতীয় পরীক্ষার কাজ চালানো হয়েছিল আইআরভিই-২ নিয়ে। ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে এটি মহাশূন্যে উৎক্ষেপণের পর আবার সাফল্যের সঙ্গে পৃথিবীর বায়ুম-লে প্রবেশ করে। তবে নভোযানটি ওজনে ছিল অনেক হাল্কা এবং গতিও ছিল যথেষ্ট কম। আইআরইভি-৩-এর চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি তাপ সইতে পেরেছে। সত্যিকারের অভিযানেও এমন তাপের সম্মুখীন হওয়ার কথা।
পরীক্ষামূলক অভিযানের সময় প্রকৌশলীরা নভোযানের সঙ্গে সংযোজিত ক্যামেরা ও থার্মোমিটার থেকে পাওয়া উপাত্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে চেয়েছেন যে এরোশিল্ড বা তাপরোধক বর্মটি বায়ুম-ল দিয়ে নভোযানের আগে ছুটে আসার সময় উৎপন্ন প্রচ- তাপের হাত থেকে যানটিকে রক্ষা করতে পেরেছে কিনা। নিজেদের সাফল্য দেখে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। ভবিষ্যতের অভিযানে নভোযানের কোন গ্রহে প্রবেশ ও অবতরণের কিম্বা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে পৃথিবীতে মালপত্র ফিরিয়ে আনার কাজে এই প্রযুুক্তি যথেষ্ট সহায়ক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সত্যিকারের মহাকাশ অভিযানে ব্যবহার করার আগে নাসার বিজ্ঞানীরা তাপ প্রতিরোধক অন্যান্য ধরনের বস্ত্রের তৈরি আরও বড় আকারের স্ফীতিযোগ্য বর্ম নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার পরিকল্পনা করেছেন।
নভোযান উৎক্ষেপণ করা এক কথা আর তা পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা আরেক কথা। নভোযানকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারটা নানা কারণে জটিল। কোন বস্তু যখন পৃথিবীর বায়ুম-লে প্রবেশ করে তখন এর ওপর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও টানা হেঁচড়াসহ নানা ধরনের শক্তি কাজ করে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি স্বভাবতই কোন বস্তুকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। তবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একাই যদি কাজ করত তাহলে সেই বস্তুটি বিপজ্জনক দ্রুতগতিতে পৃথিবীতে এসে পড়ত। সৌভাগ্যবশত পৃথিবীর বায়ুম-লে বায়ুকণিকা বিদ্যমান। কোন বস্তু পৃথিবীতে পড়ন্ত থাকাকালে এসব কণিকার সঙ্গে এর আঘাত বা ঘষা লাগে।
এতে একটা সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। এর ফলে সেই বস্তুটি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এর পতনের গতি কমে গিয়ে তা নিরাপদ মাত্রা লাভ করে। এই ঘর্ষণ বা সংঘর্ষের মিশ্র আশীর্বাদ আছে। এতে সেই বস্তুটি উল্টো টান বা বাধা পেলেও একই সঙ্গে এতে প্রচ- তাপও সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে শাটলযানগুলো প্রায় ৩ হাজার ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপের সম্মুখীন হতো। ভোঁতা কাঠামোর নকশার কারণে তাপ সমস্যাটা লাঘব হতো। ভোঁতা আকারের কোন বস্তু যখন পৃথিবীতে ফিরে আসে তখন এই ভোঁতা আকৃতির কারণে নভোযানের সামনে একটা শকওয়েভ সৃষ্টি হয়। শকওয়েভ তখন প্রচ- উত্তাপকে সেই বস্তু থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। একই সঙ্গে ভোঁতা আকৃতির পণ্য বস্তুটির পতনও মন্থর হয়ে যায়। আরেকটি কথাও এই সঙ্গে বলে রাখা দরকার। তা হলো নভোযান যখন পৃথিবীর বাইরে পাঠানো হয় তখন যাত্রার সময় তার নাকটা থাকে উপরের দিকে। আর নেমে আসার সময় তলদেশটা আগে আসে, নাকটা নয়। এতে অবশ্য বেশি তাপ সঞ্চারিত হয়। তবে নামার সময় বাতাসের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয় বলে নভোযানের গতি মন্থর হয়ে যায়। অথচ মন্থর করার জন্য জ্বালানি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও জানবার আছে। সেটা হচ্ছে গতিবৃদ্ধি ও গতিহ্রাস একই ব্যাপার। শুধু তফাত হলো এ দুটো দুই বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া। যেকোনটির ক্ষেত্রে একই পরিমাণ এনার্জি ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়।
প্রকৃতি ও বিজ্ঞান ডেস্ক

No comments

Powered by Blogger.