বঙ্গবন্ধু-স্মৃতি ও শোকগাথা by সোহরাব হাসান

গত বুধবার মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়। কারাগারের সামনে বহু উত্সুক মানুষের ভিড় ছিল। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ও ঘাতকদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল। অনেকে টেলিভিশনে সে দৃশ্য দেখেছে। জাতি দায়মুক্ত হয়েছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।


এ সময় কেন্দ্রীয় কারাগারে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। ঘটনাটি বলেছিলেন সে সময়ে কারাগারে আটক একজন রাজনৈতিক কর্মী। নাম একরামুল হক, একসময়ের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা। পরবর্তী সময়ে জাসদে যোগ দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করায় তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পেয়ে স্বভাবতই তাঁর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁর নেতা। আর রাজনৈতিক কারণে তিনি তখন কারাগারে। সকালে ঘুম থেকে উঠে কারাগারের ভেতরে সদর গেট বরাবর বড় জটলা দেখতে পান একরামুল হক। সেখানে দালাল আইনে আটক মুসলিম লীগ, পিডিপি ও জামায়াতের নেতারা বসে সলাপরামর্শ করছিলেন। আর বাইরে পতাকাদণ্ডের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন।
একরামুল হক কৌতূহল নিয়ে তাঁদের কাছে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী দেখছেন?’ তাঁরা বললেন, ‘শেখ মুজিব মারা গেছেন তো।’ একরামুল হক জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, তিনি মারা গেছেন, তার সঙ্গে পতাকাদণ্ডের দিকে তাকানোর সম্পর্ক কী?’
একজন বললেন, ‘না, শেখ সাহেব মারা গেছেন। ওখানে নতুন পতাকা ওঠে কি না, তাই দেখছি।’ নতুন পতাকা মানে বাংলাদেশের পতাকার বদলে পাকিস্তানি পতাকা।
একরামুল হক তাঁদের ধমক দিয়ে বললেন, ‘যান, এখানে বসে জটলা করবেন না।’ তারপর তিনি দেশের ভবিষ্যত্ সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। একজন ব্যক্তির মৃত্যুর সঙ্গে যখন একটি দেশের পতাকা ওঠানামা নির্ভর করে, তখন আর তিনি ব্যক্তি থাকেন না। দেশের অস্তিত্ব ও আত্মার অংশীদার হয়ে যান। এই ছিলেন শেখ মুজিব।

দুই.
১৯৮৪ সালের আরেকটি ঘটনা। বাংলাদেশের কূটনীতিক ও আমলা (তখন অবসর নিয়েছেন) আবুল মাল আবদুল মুহিত সস্ত্রীক মিসরে বেড়াতে গিয়েছেন। তাঁদের গাইড ও চালক ছিলেন মিসরীয় নাগরিক। বিখ্যাত আসওয়ান বাঁধ দেখার সময় গাইড তাঁকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তোমার বাড়ি কোথায়?’ জবাবে মুহিত বাংলাদেশ বলতেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বললেন, ‘ওহ রহমান! রহমান!’ পরে পুরো নামটি বললেন শেখ মুজিবুর রহমানের দেশের লোক। তার পরই তাঁর প্রশ্ন, ‘তোমরা তোমাদের নেতাকে হত্যা করলে?’ মুহিত প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। ১৯৭১ সালে তিনি যখন মার্কিন সিনেটর ও প্রতিনিধি সভার সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলছিলেন, বাঙালির ন্যায়সংগত সংগ্রামের কথা তুলে ধরছিলেন, তখন তাঁদের অনেকেই জানতে চেয়েছিলেন, তোমাদের নেতৃত্ব কে দেবেন? মুহিত বলেছিলেন, কেন শেখ মুুজিবুর রহমান। এতে মার্কিন সিনেটর ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা আশ্বস্ত হয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের পর সত্যি সত্যি বাংলাদেশ নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছিল।

তিন.
ছিয়াত্তরে যুক্তরাজ্যে পিএইচডি করতে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক এস এম মুজিবুর রহমান। তিনি গবেষণা করছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলে। ব্রিটিশ লর্ডসভার পক্ষ থেকে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর গবেষকদের জন্য একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল গিল্ড হলে। তখন লর্ডসভার অধ্যক্ষা ছিলেন লেডি রবিনসন। এস এম মুজিবুর রহমানের বাড়ি বাংলাদেশে জানতে পেরে তিনি তাঁর সঙ্গে আলাপে আগ্রহী হলেন। তখন বাংলাদেশে সামরিক আইন চলছিল। রবিনসন তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়েও কথা বলেন।
আলোচনায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গ এল। তিনি বললেন, ‘তাঁর মতো একজন বড় মাপের নেতাকে তোমরা মেরে ফেললে কেন?’ বাংলাদেশি গবেষক নিরুত্তর। তাঁর মনে হয়েছে, এ প্রশ্ন শুধু তাঁকে করা হয়নি, করা হয়েছে বাংলাদেশের সব মানুষকে। লেডি রবিনসন আরও যোগ করলেন, ‘আমরা জানি, তোমাদের দেশ ছোট্ট, অনেক মানুষ। তোমাদের দেশে জায়গা না হলে এই ছোট্ট দ্বীপটিতে পাঠিয়ে দিতে পারতে।’ তাঁর বক্তব্যে যেমন বেদনা ছিল, তেমনি ছিল অভিযোগের সুর।

চার.
আমাদের কোনো কোনো রাজনীতিক বুদ্ধিজীবী ঘাতকদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, এখনো গাইছেন। কিন্তু ১৫ আগস্টের অন্যতম ঘাতক খন্দকার আবদুর রশিদের বাবা করিম খন্দকার ছেলেকে ক্ষমা করেননি। বহু বছর আগে দৈনিক সংবাদ-এ আহমেদ খালেদ ‘পিতা তাঁকে ক্ষমা করেননি’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলেন। সেই লেখার একটি অংশ এখানে তুলে ধরছি—‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আত্মস্বীকৃত ঘাতক কর্নেল আবদুর রশিদকে তাঁর জন্মদাতা করিম খন্দকার বঙ্গবন্ধুর হত্যার দায়ে ক্ষমা করে যাননি। এই চরম সত্য কথাটি দেশবাসীর জেনে রাখা দরকার। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম হত্যাকারী রশিদের বাড়ি কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার উত্তর বাড়েরা ইউনিয়নের ছয়ঘরিয়া গ্রামে। অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার করিম খন্দকার ব্যক্তিগতভাবে ভালো লোক ছিলেন। ১৯৯৪ সালের শেষদিকে তিনি মারা যান... বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমৃত্যু করিম খন্দকার ছেলে রশিদের সঙ্গে কথা বলেননি, তাঁর কোনো টাকা-পয়সা গ্রহণ করেননি। জাতির পিতাকে হত্যার পর করিম খন্দকার আত্মীয়স্বজনের কাছে অছিয়ত করে গেছেন, তাঁর মৃত্যুর পর যেন রশিদ তাঁর শেষকৃত্যে না থাকে, মৃতদেহ যেন স্পর্শ না করে। তিনি আরও বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাকে যে হত্যা করেছে, সে আমার পুত্র নয়, আমি তাকে ক্ষমা করব না। আল্লাহ তাকে শাস্তি দিক।’
করিম খন্দকারের জীবনের শেষ দিকে রশিদ লিবিয়া থেকে ছুটে এসেছিল ছয়ঘরিয়ায় বাবার কাছে। করিম খন্দকার তখন হাঁটাচলা করতে পারেন। বাবার বিছানার ডান পাশে দাঁড়িয়ে আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে সে বলল, ‘বাবা, আমি রেন্টু (রশিদের ডাক নাম) এসেছি আপনার কাছে মাফ চাইতে।’ বাবা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
শেষ দিন পর্যন্ত করিম খন্দকার ছেলেকে ক্ষমা করতে পারেননি, তাঁর সঙ্গে কথা বলেননি, জানাজায় শরিক হতে নিষেধ করেছেন। আত্মীয়স্বজন বাবার অন্তিম ইচ্ছে পূরণের জন্যই হয়তো রশিদকে জানাজায় অংশ নিতে দেননি। পিতৃস্নেহকে অনায়াসে জয় করেছে করিম খন্দকারের ন্যায় ও মানবধর্ম। আমাদের অনেকের ভীরুতা, কাপুরুষতা, গ্লানি ও লজ্জা ঢেকে দিয়েছেন কুলাঙ্গার ছেলের এক মহান বাবা।

পাঁচ.
বাংলাদেশের অভ্যুদয় যদি আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে আখ্যায়িত করি, তাহলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড প্রধান বিয়োগান্ত ঘটনা বলেই বিবেচনা করতে হবে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট কেবল শেখ মুজিবের দেহকেই বুলেটবিদ্ধ করা হয়নি, জাতীয়তাবাদকে বিকৃত করা হয়েছে। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি থাকে গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্রের গায়ে পরিয়ে দেওয়া হলো পনেরো বছর মেয়াদি সামরিক পোশাক। বাংলাদেশের স্থপতি ও তাঁর আদর্শ হত্যার ঘৃণ্য তত্পরতার বিরুদ্ধে সেদিন রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের যেভাবে প্রতিবাদ করার কথা ছিল, সেভাবে তাঁরা প্রতিবাদ করেননি।

ছয়.
লেখক-শিক্ষাবিদ আবুল ফজল পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সামরিক শাসকের অধীনে শিক্ষা উপদেষ্টা হয়েছিলেন। তার আগে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। আবুল ফজল যে চিন্তা-চেতনা ও চরিত্রের মানুষ, তাতে তাঁর সামরিক শাসকের সহযোগী হওয়ার কথা ছিল না। আজকের প্রগতিশীল লেখক-সাহিত্যিকদের অনেকেই যখন বিএনআর, লেখক সংঘ প্রভৃতি করে আইয়ুব খানের আস্থা ও অনুদান পেতে তত্পর ছিলেন, আবুল ফজল তখন মানবতন্ত্র লিখে স্বৈরশাসকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসকের অধীনে আবুল ফজলের উপদেষ্টা হওয়ার ঘটনা অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হয়েছিল। সম্ভবত মনের দিক থেকে তিনিও বিষয়টি মানতে পারেননি। ১৯৭৭ সালে বিচারপতি সায়েম সরকারের উপদেষ্টা থাকা অবস্থায়ই আবুল ফজল লিখলেন মৃতের আত্মহত্যা। প্রকাশিত হয় হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত মাসিক সমকালে। ছাপার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন সমকাল অফিসে এসে লেখকের ঠিকানা-পরিচয় জানতে চাইলে জানানো হয়, লেখক আবুল ফজল খুবই পরিচিত লোক। তিনি বাংলাদেশ সচিবালয়ের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বসেন। ইচ্ছে করলে তাঁরা সেখানে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা বেকুব বনে চলে যান।
মৃতের আত্মহত্যার বিষয়বস্তু ছিল মোটামুটি এ রকম: দেশের রাজাকে হত্যা করে এক ঘাতক বিদেশি মিশনে সম্মানজনক চাকরি পেয়েছেন। রাজাকে হত্যার জন্য ঘাতকের মনে কোনো অনুশোচনা না হলেও তাঁর স্ত্রী বিষয়টি মানতে পারেননি। তিনি তখন ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। তিনি যে সন্তান জন্ম দিতে যাচ্ছেন, সেই সন্তান পৃথিবীতে ঘাতকের সন্তান বলে পরিচিত হবে—এই ভাবনা সারাক্ষণ তাঁকে পেয়ে বসে। মানসিক যন্ত্রণা ও অনুশোচনায় তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে সেই মহিলা একসময় আত্মহত্যা করেন। উদ্দেশ্য, তাঁর অনাগত সন্তানকে যাতে কেউ হন্তারকের সন্তান না বলতে পারে।

সাত.
পঁচাত্তরের পর কবিতায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। ৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কবি নির্মলেন্দু গুণ বাংলা একাডেমীর মঞ্চে হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতার সামনে পাঠ করলেন, ‘আজ আমি কারও রক্ত চাইতে আসিনি। কবিতায় আমি শেখ মুজিবের কথা বলতে এসেছি।’ কবিতা পাঠের পর বাংলা একাডেমীর তত্কালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী হায় হায় করে উঠলেন। তাঁর চাকরি বুঝি চলে যায়। তিনি কবিকে মঞ্চের পেছনে নিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলেন। কী বোঝাবেন তিনি? কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতা পড়ে অন্যায় করেননি। গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথাই প্রকাশ করেছেন। আরও অনেক পরে শামসুর রাহমান লিখলেন, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি’ ‘ধন্য সেই পুরুষ।’ এরপর ফল্গুধারার মতো বাংলাদেশের কবি-লেখকেরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য গল্প-কবিতা-নিবন্ধ-প্রবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু শোকের সে পঙিক্তমালা প্রতিবাদের অগ্নস্ফুিলিঙ্গে রূপ নিতে পারেনি। এ আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা।
সোহরাব হাসান : কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.