খোলা চোখে-গুগল নিয়ে গন্ডগোল by হাসান ফেরদৌস
ঘটনা দুটি আলাদা আলাদা, একে অপরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু একদমই সম্পর্ক নেই, সে কথাও খুব জোরে বলতে পারছি না। আপনারাই বিবেচনা করুন। গত বছর নভেম্বরে ঢাকায় দৃক গ্যালারি তাদের নিজস্ব ফটো গ্যালারিতে একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। বিষয়: তিব্বত।
১৯৪৯ সাল থেকে ২০০৯—এই সময়ে যে হাজার হাজার তিব্বতবাসী তাদের দেশ ছেড়ে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছে, প্রদর্শনীতে তাদের সেই দুর্ভোগ ও বঞ্চনার ইতিহাস ফটোর মাধ্যমে দেখানো হয়। তিব্বতি নেতা দালাইলামার কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবিও এই প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু চিত্র প্রদর্শনীটি উদ্বোধনের আগেই তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ, ঢাকার চীনা দূতাবাসের আপত্তি। প্রথমে দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তাঁর আপত্তির কথা গ্যালারির নির্বাহী প্রধানকে জানান। পরে পুলিশপ্রহরা এনে জোর করে প্রদর্শনীটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
অন্য ঘটনাটি খোদ চীনে। এ বছর জানুয়ারির গোড়ার দিকে গুগল আকস্মিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, চীনে তারা আর কাজ করবে না। ইন্টারনেটে যেকোনো তথ্য খুঁজে দেখার জন্য গুগল পৃথিবীর এক নম্বর সার্চ ইঞ্জিন। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে চীনে ইন্টারনেটের পাঠকেরা আর গুগলের ব্যবহার করতে পারবে না। তাদের এ সিদ্ধান্তের কারণ, গুগলের মাধ্যমে যারা ই-মেইল চালাচালি করে, চীনা কর্তৃপক্ষ গোপনে ও বেআইনিভাবে আড়ি পেতে তাদের সেসব চিঠিপত্র পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল। বেইজিং কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ সেসব চীনাদের ব্যাপারে, যারা ভিন্নমতাবলম্বী বলে পরিচিত। এমনিতে চীনে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ কম। রাজনৈতিক দল করা যাবে না, সভা-সমিতি করা যাবে না, পত্রিকায় সমালোচনাপূর্ণ কিছু লেখা যাবে না। এমন অবস্থায় ইন্টারনেট রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের এক বিরাট সহায়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, চীনা সরকার সেখানেও নাক গলাচ্ছে। এরই প্রতিবাদে গুগল সেদেশ ছাড়ার হুমকি দিয়েছে।
প্রথম ঘটনাটি নিয়ে তেমন কথা চালাচালি হয়নি। ঢাকার দু-একটি পত্রিকায় নামকাওয়াস্তে রিপোর্ট করা হয়েছে, ইন্টারনেটে নরম-গরম দু-চার কথা শোনা গেছে। তার বাইরে বেশি কিছু নয়। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনাটি দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছে। চীন এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রধান অর্থনীতি। তার কথা ও কাজের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। সেই চীনকে তোয়াক্কা না করে গুগল মুখের ওপর বলে দিয়েছে, আড়িপাতা বন্ধ না হলে তারা চীনে কাজ করবে না। এতে চীনের—অর্থাত্ চীনের সরকারের খুব যে বয়ে গেল তা নয়। চীনের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন আছে, অধিকাংশ চীনা নাগরিক সে সার্চ ইঞ্জিনই ব্যবহার করে। কিন্তু গুগল তো শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, তার মাধ্যমে ই-মেইল, ফটো ও ভিডিও চালাচালিরও সুযোগ আছে। কেউ গুগলের মাধ্যমে সরকারের প্রতি সমালোচনাপূর্ণ কোনো তথ্য ও ভিডিও পাঠালে ধরা পড়ার ভয় নেই, যে ভয় আছে চীনা সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করলে—এ ভরসাটুকু চীনা রাজনৈতিক কর্মীদের ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, যেখানে সরকারের কড়াকড়ির কারণে খোলামেলাভাবে সমালোচনামূলক কোনো রাজনৈতিক কাজ করা কঠিন (যেমন, ইরানে ও বার্মায়), প্রতিবাদী মানুষ ক্রমশ ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। গুগল বন্ধ হয়ে গেলে চীনের মানুষের সে সুযোগটুকুও চলে যাবে।
উভয় উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট যে চীনা কর্তৃপক্ষ যা করছে, তা হলো সেন্সরশিপ। নিজেদের বিরুদ্ধে যাতে কোথাও টুঁ-শব্দটিও না ওঠে, সে জন্য সব দরজায় খিল দিয়ে রাখাই এই সেন্সরের লক্ষ্য। বাংলাদেশের বেলায় তারা কেবল ছোট করে একটু ধমক দিয়েছিল, তাতেই কাজ হয়েছে। ধমক খেয়েও দৃক হয়তো ঘাড় ত্যাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকত। চীন সরকারও হয়তো প্রথামাফিক প্রতিবাদ জানিয়েই তার কাজ শেষ করত। তিব্বতের প্রশ্ন উঠলে প্রতিবাদ করা তাদের কূটনৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের সরকার বন্ধুপ্রতিম চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হোক তা চায় না। ‘না বাবা, চীনকে খেপানো যাবে না’ ভেবে আগ বাড়িয়ে তারাই হয়তো প্রদর্শনীটিই বন্ধ করে দেয়। সে তুলনায় দ্বিতীয় ব্যাপারটা একটু প্যাঁচালো। চীনে রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীদের ওপর গোয়েন্দাগিরি চলছে, এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয়। কিন্তু সে কথা ঢ্যাড়া পিটিয়ে বলা হোক, চীন তা নিশ্চয় চায় না। গুগলের সিদ্ধান্তে ঠিক সে কাজটাই হয়েছে। পৃথিবীর সব প্রধান পত্রপত্রিকায় বড় বড় করে প্রথম পাতায় এ নিয়ে খবর হয়েছে। চীনে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হচ্ছে, এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনাও হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, চীনের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে গুগল। পৃথিবীর নয়া পরাশক্তি চীনের জন্য ঘাড়ে এ যেন একটা রামরদ্দা।
আসলে চীন চায় কী? দেশের মানুষের জন্য চোখ খুলে আকাশ দেখার সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলেই কি সব বিরূপ সমালোচনা থেকে সে নিজেকে আগলে রাখতে পারবে? আগে চীন যখন একটা হতদরিদ্র দেশ ছিল, পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল নামমাত্র, তখন সে দেশের একদলীয় সরকার যা খুশি নিজের ইচ্ছামতো করেছে, করে পারও পেয়ে গেছে। ষাটের দশকে চীনের দক্ষিণে দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষ মরেছে, সে কথা আমরা জানতাম না। তথাকথিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবে মানুষকে কারণে-অকারণে জেলে পোরা হয়েছে, সে কথাও আমরা খুব একটা জানতাম না। জানার উপায়ও ছিল না। কিন্তু এখন তো অবস্থা একদম বদলে গেছে। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের বদৌলতে পৃথিবীটা সত্যিই মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যদি এখন কোনো বিক্ষোভ হয়, অথবা স্থানীয় পার্টি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ইটপাটকেল ছোড়া হয়—আর তেমন কাণ্ড এখন আকছার ঘটছে—চোখের পলকে তা দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশের ভেতরেও মানুষ একে অপরের সঙ্গে সে কথা, ছবি বা ভিডিও আদান-প্রদান করছে। ধমক দিয়ে বা লাঠির বাড়ি দিয়ে কত দিন আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে?
গত দেড়-দুই দশকে শুধু যে পৃথিবী বদলে গেছে তাই নয়, চীনও বদলে গেছে। দেশটি যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ রকম অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে, তার আদত কারণ বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে তার লাফিয়ে লাফিয়ে চলা। সাইবার বিজ্ঞানে তো বটেই, প্রকৌশল, তড়িত্ ও রসায়নের নানা ক্ষেত্রে চীন এখন পশ্চিমের বড় বড় দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। চীন পাল্লা দিচ্ছে মানে সে দেশের ইঞ্জিনিয়ার ও টেকনিশিয়ানরা পাল্লা দিচ্ছে, প্রযুক্তির ব্যবহার তারাই করায়ত্ত করেছে। এখন যদি প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে থাকা এই মানুষগুলোকে বলা হয়, প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু অনুমোদিত ক্ষেত্রে করা যাবে, তার বাইরে কিছু করতে গেলেই জেলে পোরা হবে, সে কথা তারা শুনবে কেন?
চীনের আসল সমস্যা হলো এখানেই। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে তারা একুশ শতকের মানুষ, কিন্তু যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা তারা ধরে রেখেছে, তাকে বিশ শতকীয় বলতেও দ্বিধা হয়। একটি ক্ষেত্রে দেশ এগোবে, অন্য ক্ষেত্রে সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে, তা তো হওয়ার নয়। ফলে আজ বা দুদিন পর এই দুইয়ের সংঘর্ষ অনিবার্য। কথাটা চীনা কমিউনিস্ট নেতারা যে জানেন না তা নয়। তেমন বিপদ এড়াতে তারা যতটা সম্ভব সমঝে চলারও চেষ্টা করছেন। দেশের ভেতরে রাজনৈতিক বিক্ষোভ বাড়ছে, বিশেষ করে গ্রাম ও শহরের মধ্যে এবং ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধানের কারণে—এ কথা তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন। দুবছর আগে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির ১৭তম কংগ্রেসে খোদ পার্টির নেতারাই নরম-গরম গলায় বলেছিলেন, সাধারণ মানুষের অবস্থার উন্নতি না করা গেলে চীনে সামাজিক অসন্তোষ বাড়বে। সে অসন্তোষ যাতে না বাড়ে, অর্থাত্ আরেকটা বিপ্লব না ঘটে, সে জন্য নানা রকম দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল। অবশ্য চীনা নেতারা ধরেই নিয়েছেন, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যত দিন অব্যাহত থাকবে, আরেকটা বিপ্লব ঘটার কোনোই সম্ভাবনা চীনে নেই। রাজনৈতিক অধিকার চুলোয় যাক, আগে তো বুলেট ট্রেন চালু হোক!
কিন্তু সমস্যা হলো, ক্ষুধা মিটলে মানুষ গান গাইতে চায়, গলা খুলে চেঁচাতে চায়। চীনা নেতারা গান গাওয়ার বিরুদ্ধে নন, কিন্তু সে গানের কথা কী হবে, তাঁরা কেবল সে ব্যাপারে খবরদারি ধরে রাখতে চান। আশির দশকে দেং শিয়াও পিংয়ের নেতৃত্ব চীনে যখন প্রথম ‘কোমল ধনতন্ত্র’ (সফট ক্যাপিটালিজম) চালু হয়, অনেকেই তার বিরোধিতা করেছিল। একবার ধনতন্ত্র চালু হলে তার সঙ্গে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি নানা দাবিও জুড়ে বসবে। কিন্তু সেই বুড়ো গলা খাঁকারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘খোলা বাতাসের জন্য জানালা খুললে দু-চারটে মাছি তো আসবেই।’ সরকারের কাজ হবে, মাছি ঢোকামাত্রই সপাটে তা মেরে ফেলা। এত দিন সেভাবেই চলছিল। কোনো সমস্যা হয়নি বা ছোটখাটো যে সমস্যা হয়েছে, ওই সপাটে মাছি তাড়ানোর মতো তাদের ‘ম্যানেজ’ করা হয়েছে।
এই ইন্টারনেটের কথাই ভাবুন। চীনের সরকার নিজ থেকেই কিন্তু সারা দেশে ইন্টারনেটের প্রসারে সাহায্য করেছে। তারা নিজেরাও রাষ্ট্রীয় কাজে স্বচ্ছতার নামে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সুশাসন (ই-গভর্নেন্স) চালু করেছে। অনেক শিল্পোন্নত দেশের চেয়ে চীন ই-গর্ভনেন্সে এগিয়ে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে নাগরিকরা সরাসরি সরকারি নেতাদের কাছে অভিযোগ লিখে পাঠাতে পারে, নিজের পরামর্শ জানাতে পারে, কোনো দুর্নীতির খোঁজ জানলে, তাও গোপনে প্রকাশ করতে পারে। এ সুযোগ সৃষ্টি করে এক অর্থে সরকার নিজেই দেশের নাগরিকের ক্ষমতায়নে সাহায্য করেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কে কী বলছে, কোন বিষয়ে অভিযোগ তুলছে, তার খবরদারিও রাখা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে। পাঁচ-সাত বছর আগে যখন প্রথম ইন্টারনেটে ব্লগ লেখার ব্যবস্থার চল হলো, চীন তখনো আপত্তি করেনি। কিন্তু সে ব্লগে কী লেখা যাবে বা কী লেখা যাবে না, তার একটা লিখিত ও অলিখিত নীতিমালা তৈরি করে সে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্লগের মাধ্যমে সব খবর চালাচালির ওপর নজরদারি করা সম্ভব নয়। লাখ লাখ লোক এ কাজ করছে, সবার ওপর নজরদারি করতে গেলে রাজার টাঁকশালও ফুরিয়ে যাবে। সে কথা মাথায় রেখে চীন সম্পূর্ণ ভিন্নপথে অগ্রসর হয়। সে দেশে যে কোম্পানিগুলো ইন্টারনেট সার্ভিস দেয়, সরকার সেই কোম্পানিগুলোকে এই খবরদারি করার দায়িত্ব দেয়। বছর কয়েক আগে ওয়াশিংটন পোস্ট এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, চীনে সরকারিভাবে কতগুলো শব্দের তালিকা নির্ধারণ করা আছে, যার ব্যবহার ইন্টারনেটে নিষিদ্ধ। ধরা যাক, একটা শব্দ হলো ‘স্বেচ্ছাচার’। কেউ যদি এই শব্দ ব্যবহার করতে চায়, ইন্টারনেট তা গ্রহণ করবে না। গৃহীত না হলেও যারা সে শব্দ ব্যবহারের চেষ্টা করবে, তার হদিস সার্ভিস প্রভাইডারের কাছে রয়ে যায়। সে লোকের নাম-ঠিকানাও গোপনে চলে যাবে সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে।
অন্য কথায়, চীনে মাথার ওপর একটা ‘বড় ভাই’ ঠিকই বসে রয়েছে। যত দিন এই ‘বড় ভাই’কে টেনে নামানো না যাচ্ছে, চীনের মানুষ মুখ খুলে কথা বলতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষ এই অধিকারটা কমবেশি আদায় করে নিয়েছে, যদিও এর জন্য বিস্তর রক্ত দিতে হয়েছে আমাদের। এখন আমাদের উচিত হবে, চীনের মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো। তিব্বতের যে চিত্র প্রদর্শনী সরকারি চাপে বন্ধ হয়েছে, সেটা আবার চালু হোক—এ দাবি দিয়েই সে কাজ আমরা শুরু করতে পারি।
২০ জানুয়ারি ২০১০, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
অন্য ঘটনাটি খোদ চীনে। এ বছর জানুয়ারির গোড়ার দিকে গুগল আকস্মিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, চীনে তারা আর কাজ করবে না। ইন্টারনেটে যেকোনো তথ্য খুঁজে দেখার জন্য গুগল পৃথিবীর এক নম্বর সার্চ ইঞ্জিন। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে চীনে ইন্টারনেটের পাঠকেরা আর গুগলের ব্যবহার করতে পারবে না। তাদের এ সিদ্ধান্তের কারণ, গুগলের মাধ্যমে যারা ই-মেইল চালাচালি করে, চীনা কর্তৃপক্ষ গোপনে ও বেআইনিভাবে আড়ি পেতে তাদের সেসব চিঠিপত্র পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল। বেইজিং কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ সেসব চীনাদের ব্যাপারে, যারা ভিন্নমতাবলম্বী বলে পরিচিত। এমনিতে চীনে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ কম। রাজনৈতিক দল করা যাবে না, সভা-সমিতি করা যাবে না, পত্রিকায় সমালোচনাপূর্ণ কিছু লেখা যাবে না। এমন অবস্থায় ইন্টারনেট রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের এক বিরাট সহায়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, চীনা সরকার সেখানেও নাক গলাচ্ছে। এরই প্রতিবাদে গুগল সেদেশ ছাড়ার হুমকি দিয়েছে।
প্রথম ঘটনাটি নিয়ে তেমন কথা চালাচালি হয়নি। ঢাকার দু-একটি পত্রিকায় নামকাওয়াস্তে রিপোর্ট করা হয়েছে, ইন্টারনেটে নরম-গরম দু-চার কথা শোনা গেছে। তার বাইরে বেশি কিছু নয়। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনাটি দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছে। চীন এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রধান অর্থনীতি। তার কথা ও কাজের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। সেই চীনকে তোয়াক্কা না করে গুগল মুখের ওপর বলে দিয়েছে, আড়িপাতা বন্ধ না হলে তারা চীনে কাজ করবে না। এতে চীনের—অর্থাত্ চীনের সরকারের খুব যে বয়ে গেল তা নয়। চীনের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন আছে, অধিকাংশ চীনা নাগরিক সে সার্চ ইঞ্জিনই ব্যবহার করে। কিন্তু গুগল তো শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, তার মাধ্যমে ই-মেইল, ফটো ও ভিডিও চালাচালিরও সুযোগ আছে। কেউ গুগলের মাধ্যমে সরকারের প্রতি সমালোচনাপূর্ণ কোনো তথ্য ও ভিডিও পাঠালে ধরা পড়ার ভয় নেই, যে ভয় আছে চীনা সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করলে—এ ভরসাটুকু চীনা রাজনৈতিক কর্মীদের ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, যেখানে সরকারের কড়াকড়ির কারণে খোলামেলাভাবে সমালোচনামূলক কোনো রাজনৈতিক কাজ করা কঠিন (যেমন, ইরানে ও বার্মায়), প্রতিবাদী মানুষ ক্রমশ ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। গুগল বন্ধ হয়ে গেলে চীনের মানুষের সে সুযোগটুকুও চলে যাবে।
উভয় উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট যে চীনা কর্তৃপক্ষ যা করছে, তা হলো সেন্সরশিপ। নিজেদের বিরুদ্ধে যাতে কোথাও টুঁ-শব্দটিও না ওঠে, সে জন্য সব দরজায় খিল দিয়ে রাখাই এই সেন্সরের লক্ষ্য। বাংলাদেশের বেলায় তারা কেবল ছোট করে একটু ধমক দিয়েছিল, তাতেই কাজ হয়েছে। ধমক খেয়েও দৃক হয়তো ঘাড় ত্যাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকত। চীন সরকারও হয়তো প্রথামাফিক প্রতিবাদ জানিয়েই তার কাজ শেষ করত। তিব্বতের প্রশ্ন উঠলে প্রতিবাদ করা তাদের কূটনৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের সরকার বন্ধুপ্রতিম চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হোক তা চায় না। ‘না বাবা, চীনকে খেপানো যাবে না’ ভেবে আগ বাড়িয়ে তারাই হয়তো প্রদর্শনীটিই বন্ধ করে দেয়। সে তুলনায় দ্বিতীয় ব্যাপারটা একটু প্যাঁচালো। চীনে রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীদের ওপর গোয়েন্দাগিরি চলছে, এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয়। কিন্তু সে কথা ঢ্যাড়া পিটিয়ে বলা হোক, চীন তা নিশ্চয় চায় না। গুগলের সিদ্ধান্তে ঠিক সে কাজটাই হয়েছে। পৃথিবীর সব প্রধান পত্রপত্রিকায় বড় বড় করে প্রথম পাতায় এ নিয়ে খবর হয়েছে। চীনে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হচ্ছে, এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনাও হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, চীনের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে গুগল। পৃথিবীর নয়া পরাশক্তি চীনের জন্য ঘাড়ে এ যেন একটা রামরদ্দা।
আসলে চীন চায় কী? দেশের মানুষের জন্য চোখ খুলে আকাশ দেখার সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলেই কি সব বিরূপ সমালোচনা থেকে সে নিজেকে আগলে রাখতে পারবে? আগে চীন যখন একটা হতদরিদ্র দেশ ছিল, পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল নামমাত্র, তখন সে দেশের একদলীয় সরকার যা খুশি নিজের ইচ্ছামতো করেছে, করে পারও পেয়ে গেছে। ষাটের দশকে চীনের দক্ষিণে দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষ মরেছে, সে কথা আমরা জানতাম না। তথাকথিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবে মানুষকে কারণে-অকারণে জেলে পোরা হয়েছে, সে কথাও আমরা খুব একটা জানতাম না। জানার উপায়ও ছিল না। কিন্তু এখন তো অবস্থা একদম বদলে গেছে। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের বদৌলতে পৃথিবীটা সত্যিই মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যদি এখন কোনো বিক্ষোভ হয়, অথবা স্থানীয় পার্টি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ইটপাটকেল ছোড়া হয়—আর তেমন কাণ্ড এখন আকছার ঘটছে—চোখের পলকে তা দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশের ভেতরেও মানুষ একে অপরের সঙ্গে সে কথা, ছবি বা ভিডিও আদান-প্রদান করছে। ধমক দিয়ে বা লাঠির বাড়ি দিয়ে কত দিন আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে?
গত দেড়-দুই দশকে শুধু যে পৃথিবী বদলে গেছে তাই নয়, চীনও বদলে গেছে। দেশটি যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ রকম অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে, তার আদত কারণ বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে তার লাফিয়ে লাফিয়ে চলা। সাইবার বিজ্ঞানে তো বটেই, প্রকৌশল, তড়িত্ ও রসায়নের নানা ক্ষেত্রে চীন এখন পশ্চিমের বড় বড় দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। চীন পাল্লা দিচ্ছে মানে সে দেশের ইঞ্জিনিয়ার ও টেকনিশিয়ানরা পাল্লা দিচ্ছে, প্রযুক্তির ব্যবহার তারাই করায়ত্ত করেছে। এখন যদি প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে থাকা এই মানুষগুলোকে বলা হয়, প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু অনুমোদিত ক্ষেত্রে করা যাবে, তার বাইরে কিছু করতে গেলেই জেলে পোরা হবে, সে কথা তারা শুনবে কেন?
চীনের আসল সমস্যা হলো এখানেই। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে তারা একুশ শতকের মানুষ, কিন্তু যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা তারা ধরে রেখেছে, তাকে বিশ শতকীয় বলতেও দ্বিধা হয়। একটি ক্ষেত্রে দেশ এগোবে, অন্য ক্ষেত্রে সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে, তা তো হওয়ার নয়। ফলে আজ বা দুদিন পর এই দুইয়ের সংঘর্ষ অনিবার্য। কথাটা চীনা কমিউনিস্ট নেতারা যে জানেন না তা নয়। তেমন বিপদ এড়াতে তারা যতটা সম্ভব সমঝে চলারও চেষ্টা করছেন। দেশের ভেতরে রাজনৈতিক বিক্ষোভ বাড়ছে, বিশেষ করে গ্রাম ও শহরের মধ্যে এবং ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধানের কারণে—এ কথা তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন। দুবছর আগে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির ১৭তম কংগ্রেসে খোদ পার্টির নেতারাই নরম-গরম গলায় বলেছিলেন, সাধারণ মানুষের অবস্থার উন্নতি না করা গেলে চীনে সামাজিক অসন্তোষ বাড়বে। সে অসন্তোষ যাতে না বাড়ে, অর্থাত্ আরেকটা বিপ্লব না ঘটে, সে জন্য নানা রকম দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল। অবশ্য চীনা নেতারা ধরেই নিয়েছেন, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যত দিন অব্যাহত থাকবে, আরেকটা বিপ্লব ঘটার কোনোই সম্ভাবনা চীনে নেই। রাজনৈতিক অধিকার চুলোয় যাক, আগে তো বুলেট ট্রেন চালু হোক!
কিন্তু সমস্যা হলো, ক্ষুধা মিটলে মানুষ গান গাইতে চায়, গলা খুলে চেঁচাতে চায়। চীনা নেতারা গান গাওয়ার বিরুদ্ধে নন, কিন্তু সে গানের কথা কী হবে, তাঁরা কেবল সে ব্যাপারে খবরদারি ধরে রাখতে চান। আশির দশকে দেং শিয়াও পিংয়ের নেতৃত্ব চীনে যখন প্রথম ‘কোমল ধনতন্ত্র’ (সফট ক্যাপিটালিজম) চালু হয়, অনেকেই তার বিরোধিতা করেছিল। একবার ধনতন্ত্র চালু হলে তার সঙ্গে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি নানা দাবিও জুড়ে বসবে। কিন্তু সেই বুড়ো গলা খাঁকারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘খোলা বাতাসের জন্য জানালা খুললে দু-চারটে মাছি তো আসবেই।’ সরকারের কাজ হবে, মাছি ঢোকামাত্রই সপাটে তা মেরে ফেলা। এত দিন সেভাবেই চলছিল। কোনো সমস্যা হয়নি বা ছোটখাটো যে সমস্যা হয়েছে, ওই সপাটে মাছি তাড়ানোর মতো তাদের ‘ম্যানেজ’ করা হয়েছে।
এই ইন্টারনেটের কথাই ভাবুন। চীনের সরকার নিজ থেকেই কিন্তু সারা দেশে ইন্টারনেটের প্রসারে সাহায্য করেছে। তারা নিজেরাও রাষ্ট্রীয় কাজে স্বচ্ছতার নামে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সুশাসন (ই-গভর্নেন্স) চালু করেছে। অনেক শিল্পোন্নত দেশের চেয়ে চীন ই-গর্ভনেন্সে এগিয়ে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে নাগরিকরা সরাসরি সরকারি নেতাদের কাছে অভিযোগ লিখে পাঠাতে পারে, নিজের পরামর্শ জানাতে পারে, কোনো দুর্নীতির খোঁজ জানলে, তাও গোপনে প্রকাশ করতে পারে। এ সুযোগ সৃষ্টি করে এক অর্থে সরকার নিজেই দেশের নাগরিকের ক্ষমতায়নে সাহায্য করেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কে কী বলছে, কোন বিষয়ে অভিযোগ তুলছে, তার খবরদারিও রাখা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে। পাঁচ-সাত বছর আগে যখন প্রথম ইন্টারনেটে ব্লগ লেখার ব্যবস্থার চল হলো, চীন তখনো আপত্তি করেনি। কিন্তু সে ব্লগে কী লেখা যাবে বা কী লেখা যাবে না, তার একটা লিখিত ও অলিখিত নীতিমালা তৈরি করে সে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্লগের মাধ্যমে সব খবর চালাচালির ওপর নজরদারি করা সম্ভব নয়। লাখ লাখ লোক এ কাজ করছে, সবার ওপর নজরদারি করতে গেলে রাজার টাঁকশালও ফুরিয়ে যাবে। সে কথা মাথায় রেখে চীন সম্পূর্ণ ভিন্নপথে অগ্রসর হয়। সে দেশে যে কোম্পানিগুলো ইন্টারনেট সার্ভিস দেয়, সরকার সেই কোম্পানিগুলোকে এই খবরদারি করার দায়িত্ব দেয়। বছর কয়েক আগে ওয়াশিংটন পোস্ট এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, চীনে সরকারিভাবে কতগুলো শব্দের তালিকা নির্ধারণ করা আছে, যার ব্যবহার ইন্টারনেটে নিষিদ্ধ। ধরা যাক, একটা শব্দ হলো ‘স্বেচ্ছাচার’। কেউ যদি এই শব্দ ব্যবহার করতে চায়, ইন্টারনেট তা গ্রহণ করবে না। গৃহীত না হলেও যারা সে শব্দ ব্যবহারের চেষ্টা করবে, তার হদিস সার্ভিস প্রভাইডারের কাছে রয়ে যায়। সে লোকের নাম-ঠিকানাও গোপনে চলে যাবে সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে।
অন্য কথায়, চীনে মাথার ওপর একটা ‘বড় ভাই’ ঠিকই বসে রয়েছে। যত দিন এই ‘বড় ভাই’কে টেনে নামানো না যাচ্ছে, চীনের মানুষ মুখ খুলে কথা বলতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষ এই অধিকারটা কমবেশি আদায় করে নিয়েছে, যদিও এর জন্য বিস্তর রক্ত দিতে হয়েছে আমাদের। এখন আমাদের উচিত হবে, চীনের মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো। তিব্বতের যে চিত্র প্রদর্শনী সরকারি চাপে বন্ধ হয়েছে, সেটা আবার চালু হোক—এ দাবি দিয়েই সে কাজ আমরা শুরু করতে পারি।
২০ জানুয়ারি ২০১০, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments