ওবামার এক বছর-মধ্যপথে চলছেন ওবামা by সের্গি হালিমি

খাপছাড়া ঐক্য, অনিশ্চিত নীতি আর পরবর্তী হতাশা যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাজনীতির ময়দানের চিত্র। এক বছর আগে অবস্থাটা এমন ছিল না। রিপাবলিকানদের পরাজয়ের ফলে পশ্চাদ্পসরণ এবং প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের বিদায়ে মানুষ উল্লসিত হয়েছিল।


যাঁরা ওবামাকে নির্বাচিত করেছিলেন, তাঁদের অনেকের ভাগ্যোন্নয়ন না ঘটা সত্ত্বেও তাঁর প্রতি তাঁদের আস্থা যদি রয়েও যায়, তবু সেই উল্লাস আর নেই। আফগানিস্তানে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির উদ্যোগে শান্তিবাদীরা হতাশ। স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার যুক্তিসংগত প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি, তেমনি পরিবেশবিষয়ক নীতিও হতাশ করেছে। নিরাশার ভাব তৈরিতে তা ভূমিকা রাখছে। রাজনৈতিক ভাবাবেগ এক পক্ষ থেকে আরেক পক্ষে চলে যাচ্ছে।
এমন অবস্থা মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রকৃত ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন জাগায়। ওবামা বুশ নন, কিন্তু ওবামা কোন দিকে চলেছেন তা বলার জন্য তিনি যে বুশ নন এটাই যথেষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্র সংকটে আছে; বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে গেছে। ওবামা কথা বলে চলেছেন, ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, যুক্তির মাধ্যমে দৃঢ়প্রত্যয় জাগাতে তাঁর আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি নেই। কিন্তু এসব চেষ্টা কী ফল বয়ে আনে? কায়রোতে তিনি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের নিন্দা জানান, পরে ইসরায়েলের বসতি বিস্তারের কাছে সমর্পিত হন। একটি উচ্চাভিলাষী স্বাস্থ্যসেবা সংস্কারের সমর্থন দেন তিনি। কিন্তু কংগ্রেস যখন এ পরিকল্পনায় জল ঢালে তখন তিনি তা মেনে নেন।
ওয়েস্ট পয়েন্ট ক্যাডেটদের উদ্দেশে একদিন ওবামা বলেন, আফগানিস্তানে শক্তি বৃদ্ধির জন্য আরও সেনা পাঠাবেন, পরের দিন তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করেন। এই বৈপরীত্যের একটি প্রতিকার আছে। প্রতিটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার ভারসাম্য তৈরি করেন বিপরীত কথার স্রোতের মাধ্যমে। বারবার যে কথাগুলো উচ্চারণ করেন: ‘আমার প্রগতিশীল বন্ধুরা এই বলেন; আমার রিপাবলিকান বন্ধুরা ওই উত্তর দেন। প্রথম পক্ষ বেশি বেশি দাবি করছে, দ্বিতীয় পক্ষ যথেষ্ট ছাড় দিচ্ছে না। তাই আমি মধ্যপথ বেছে নিচ্ছি।’
ওবামা ওয়েস্ট পয়েন্ট ক্যাডেটদের ‘বলপ্রয়োগে সংযম দেখাতে’ উত্সাহিত করেছেন। আর অসলোর বিচারকদের উদ্দেশে বলেছেন, বলপ্রয়োগ কখনো কখনো প্রয়োজনীয় হতে পারে—এ কথা কোনো নৈরাশ্যবাদী আহ্বান নয়, এটা ইতিহাসের স্বীকৃতি; মানুষের অপূর্ণতা ও যুক্তির সীমাবদ্ধতার স্বীকৃতি।’
অথচ ওবামার শুরুটা ছিল দারুণ। ২০০৮ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটার হওয়ার উপযোগী দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের (৮৯ দশমিক ৭ শতাংশ রেজিস্টার্ড ভোটারের) অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়। রিপাবলিকানরা পুরোপুরি বিপর্যস্ত হন। তাঁদের নয়া উদারনৈতিক দর্শন তখন মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। আর ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসের উভয় কক্ষে বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যান।
নির্বাচনের তিন মাস আগে ওবামা সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ‘এখন আমরা সবচেয়ে বড় যে ঝুঁকি নিতে পারি তা হলো পুরোনো রাজনীতিবিদদের দিয়ে পুরোনো রাজনীতির মাধ্যমে নতুন ফলের প্রত্যাশা। আপনারা (তৃণমূলের সমর্থকেরা) দেখিয়েছেন ইতিহাস আমাদের কী শিক্ষা দেয়—এ সময়ের মতো নির্ধারক মুহূর্তে আমাদের যে পরিবর্তন দরকার তা ওয়াশিংটন থেকে আসে না। পরিবর্তনই আসে ওয়াশিংটনে। পরিবর্তন ঘটে কারণ, আমেরিকার জনগণ পরিবর্তন চায়—কারণ তারা জাগে; নতুন ভাবনা ও নতুন নেতৃত্ব, নতুন সময়ের জন্য নতুন রাজনীতির ওপর তাদের আগ্রহ।’
তৃণমূল আন্দোলনের মাধ্যমে রাজধানীর রক্ষণশীলদের জড়তাকে নাড়িয়ে দেওয়া যায়, অনেকের এমন ধারণা থাকতে পারে। এই এক বছরে কোনো গণ-আন্দোলনের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ সেই পুরোনো রাজনীতিবিদেরা সেই পুরোনো রাজনীতি দিয়ে পরিকল্পিত অনেক আইন প্রণয়ন ঠেকিয়ে দিয়েছেন বা এগুলোর ধার কমিয়ে দিয়েছেন।
ওবামার কুল-পরিচয় তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা—এ কথা সত্য। শুধু দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যের কারণেই তা নয়, বরং হোয়াইট হাউসের কোনো বাসিন্দা যৌবনে নিউইয়র্কে আইন চর্চার মাধ্যমে ধনী হওয়ার সুযোগ ফেলে শিকাগোর দরিদ্র প্রতিবেশীদের সাহায্য করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সচরাচর এমন দেখা যায় না। কিন্তু ওবামার মন্ত্রিসভার দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, সেখানে অভিনবত্বের চমক কম। হিলডা সোলিস ওবামার শ্রমমন্ত্রী। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। আর তিনি পুরোনো নীতি থেকে সরে আসার অঙ্গীকার করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন হিলারি ক্লিনটন। তাঁর কূটনৈতিক অবস্থান আগের থেকে কিছুটা আলাদা। এরপর আছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস। বুশ প্রশাসনের রেখে যাওয়া লোক। অর্থমন্ত্রী টিমথি গাইটনার। তিনি ওয়াল স্ট্রিটের এত ঘনিষ্ঠ যে তাঁর পক্ষে এর সংস্কার করতে চাওয়া বা সংস্কার করা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক উপদেষ্টা লরেন্স সামারস। তিনি অর্থনৈতিক বিধি-নিষেধগুলো তুলে নেওয়ার কারিগর, যা তাঁর দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।
শুরুতে ওবামা আশা করেছিলেন বর্তমান দুর্দশা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্ধার করতে রিপাবলিকান পার্টির সবচেয়ে যুক্তিবাদী অংশ তাঁর সঙ্গে থাকবেন। কিন্তু তিনি হাত বাড়ালেও ফিরলেন শূন্য হাতে। এই বিষয়ে সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘বিরোধী দলের সহায়তা ছাড়াই এমন পদক্ষেপ নিতে অনেকাংশে আমরা বাধ্য হয়েছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যেসব সিদ্ধান্তের ফলে সংকট তৈরি হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে তারা সমাধানের ভার আমাদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
এমন আশার অসারতা স্পষ্ট হতে বেশি সময় লাগেনি। ওবামা হোয়াইট হাউসে আসার এক মাস না পেরোতেই তাঁর সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের ১৭৭ জন রিপাবলিকানের কারোর সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়। নভেম্বর মাসে আসে স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার, মাত্র একজন বিরোধীদলীয় সদস্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেমোক্রেটদের সঙ্গে ভোট দেয়। ডিসেম্বরে ঋণদাতা কোম্পানিগুলোর প্রবঞ্চনামূলক কাজ থেকে ভোক্তাদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যে প্রণীত আইনটিও পাস হয় কোনো রিপাবলিকান সমর্থন ছাড়াই। অবশ্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিল সংশোধন করে ভোটাভুটির জন্য উত্থাপন করা হয়, যেন দুই পক্ষের সমর্থন পাওয়া যায়। আর্থিক সংস্কারের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত ওবামার স্বাক্ষরিত আইন কেমন হবে—তা কেউ বলতে পারে না।
তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কার করা কি সম্ভব? আসলে দেশটিতে বিভিন্ন ক্ষমতার কেন্দ্র রয়েছে, যার সব কটি চালিত হয় ডলারের দ্বারা।
২০০৮ সালে লাখ লাখ তরুণ রাজনৈতিক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা ধারণা করেছিল, ওবামা প্রেসিডেন্ট হলে কোনো কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। কিন্তু তিনিও এখন দরকারি ভোট কেনায় নেমেছেন, যাকে তিনি অবজ্ঞা করেন, তার মন জয়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
রিপাবলিকানরা ওবামাকে বিপজ্জনক মনে করে। ডেমোক্রেটিক কর্মীদের আশা, তাঁদের প্রেসিডেন্ট যদিও এখন পর্যন্ত হতাশ করেছেন, তবু তিনি যত দ্রুত সম্ভব আরও প্রগতিশীল নীতি কার্যকর করবেন। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যও তা-ই। এক পক্ষের ভয় আরেক পক্ষের আশা জাগায়।
২০০৮ সালের নভেম্বর নির্বাচনের অলৌকিকতা হয়তো আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া যে, অলৌকিকতা বলে কিছু নেই; আর অন্য সব দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের নিয়তিও কোনো একজনের ব্যক্তিত্ব বা প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার সঙ্গে কোনোভাবেই গুলিয়ে ফেলা যাবে না।
লে মঁদ ডিপ্লোমেটিক থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: আহসান হাবীব
সের্গি হালিমি: ফরাসি সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.