মানুষের মুখ-তিস্তার চরে সারা বেলা by মোছাব্বের হোসেন
জমাটবাঁধা কুয়াশার বুক চিরে সূর্য উঁকি দিয়েছে মাত্র, জানান দিচ্ছে নিজের উপস্থিতি। কনকনে পশ্চিমা বাতাস গায়ে এসে পেরেকের মতো বিঁধছে। গায়ের চাদরটা তাই আরও ভালোভাবে জড়িয়ে নিতে হলো। পাশ দিয়ে যাওয়া খেজুরের রসওয়ালাকে দেখে কিছুতেই লোভ সামলানো গেল না।
ডাকতেই কাছে এলেন, মাটির গ্লাসে খেজুরের রস, আহ! যেন অমৃত!
নদীর জেগে ওঠা চরের পাশে সামান্য পানিতে এক পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছে কয়েকটি সাদা বক। লোকজন ছুটছে যে যার মতো, তবে তেমন কর্মব্যস্ততা নেই কারও মধ্যে। বিস্তীর্ণ চর নদীতে। জায়গাটা লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার এক অজপাড়াগাঁ, চরধুবনী।
পাশেই তিস্তা নদী। তিস্তার ওপর নির্ভর করে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন। তিস্তা ভরপুর হলে ভাসিয়ে নেয় এখানকার মানুষের ঘরবাড়ি ও আবাদি ফসল। অন্যত্র চলে যেতে হয় তখন। আবার চর জাগলে ভাসমান মানুষ নিজ ভিটায় ফেরে। চরে জন্মানো কাশফুলের বন ঘিরে নতুন আশায় ঘর বাঁধে এখানকার মানুষ, অনিশ্চয়তার কথা জেনেও।
আধ মাইলখানেক চরের বালুপথ পেরিয়ে পাওয়া গেল ঘাট। ডিঙি নৌকা অপেক্ষা করছে, ভরে গেলে তবেই ছাড়বেন মাঝি। তবে লোকজন তেমন না থাকায় বোধহয় নিজের সংকল্প থেকে সরে এলেন মাঝি। তাঁর সঙ্গে থাকা ছোট্ট ছেলেটি নৌকাটা সজোরে ঠেলে দিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে উঠল নায়ে! মাঝির নাম ছফর উদ্দিন, নৌকা চালনায় পারদর্শী। মাঝারি বয়সী লোকটির কাছ থেকে জানা গেল, প্রায় পনের বছর ধরে নৌকা চালান তিনি। নৌকায় তিন-চারটি ছাগল নিয়ে উঠেছেন জোহরা খাতুন। উদ্দেশ্য—ওপারে জেগে ওঠা চরে সদ্য গজানো কচি ঘাস খাওয়াবেন এগুলোকে। পরম মমতায় আগলে ধরে রেখেছেন ছাগলগুলোকে। নৌকায় আর যে তিন-চার জন উঠেছেন তাঁদের কেউ বস্তা আর কাচি নিয়ে ঘাস কাটতে বেরিয়েছেন, কেউবা চরে লাগানো ফসল দেখতে যাচ্ছেন।
রোদ এসে ঝিলিক দিচ্ছে তিস্তার শান্ত পানিতে। পাশের অল্প পানিতে কয়েকটি পানকৌড়ি খাবারের খোঁজে বারবার ডুবছে-ভাসছে। বাতাসের শন শন শব্দকে ম্লান করে দিচ্ছে বৈঠার আঘাতে জলের ছলাত্ ছলাত্ শব্দ।
আমরা এবার পৌঁছলাম আরেকটি চরে। আগেরটার মতো এটা অত কাঠখোট্টা নয়। চরদিকটা বেশ সবুজ, লতানো ঘাস আর কাশফুলের ছড়াছড়ি। বিস্তীর্ণ একটি চর। দূরে একটি ঘর। সেদিকেই ছুটছি। হঠাত্ মনে হলো, এ কী! কোনো দ্বীপে এসে পড়লাম না কি! চরের একটি অংশজুড়ে রবিশস্য আবাদ করা হয়েছে, একদিকে লাগানো ধান পেকেছে, অর্ধেক কাটা শেষ আর অর্ধেকটা কাটছেন কৃষকরা। তাঁরা জানালেন, কয়েক বছর ধরে এখানে ধানসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ হয়। এসব কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে এলেন কৃষক আছিম উদ্দিন। তিনি জানালেন তাঁর কষ্টের কথা, ‘এক দিন হামার অনেক কিছু আছিল বাহে, আইজ আর কিছু নাই, তিস্তা সব ভাসি নিয়া গেইছে। টুকটাক আবাদ করি খাই। এই কয়টা দিন। এর পর এগুলা সব আবার পানির তলত ডুবি যাইবে...!’
আছিম উদ্দিন আরও জানান, ভোটের সময় সবাই এসে ভোট চায় আর নির্বাচনের পরে আর কেউ খোঁজখবর রখে না। প্রচন্ড শীতের দিনে কিংবা বন্যার সময় কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়ায় না। এনজিওগুলো উচ্চ ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে সাহায্য করতে আসে। কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ছল ছল করে ওঠে আছিম উদ্দিনের। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষেরই অনেকটা একই দশা। এই চর এলাকার লোকজনের একটাই বড় দাবি সরকারের কাছে। আর তা হলো, একটি বাঁধ নির্মাণ করে দেওয়া। এটি হলে তিস্তার ভাঙন যেমন রোধ হবে, তেমনি এখানকার লোকজনের যাযাবরের মতো দিন কাটাতে হবে না। তিস্তার পানি একেবারেই কমে এসেছে, অল্প পানিতে মাছ ধরছেন কয়েকজন জেলে। কাছে গিয়ে কী মাছ ধরছেন জানতে চাইলে বললেন, বইরালি মাছ বেশি ধরা পড়ছে। এই মাছটির ভালো কদর এই এলাকায়। রুপালি রঙের সুস্বাদু এ মাছ কিনতে অনেক সময় তিস্তার পাড়ে মানুষের হাট বসে রীতিমতো! তিস্তার স্বচ্ছ পানিতে পা আর মন ভেজানোর পর একসময় ডাঙায় উঠে আসতে হলো।
তিস্তার পাড়ে সকাল-দুপুর কেটে গেছে এরই মধ্যে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। অনেক মানুষ হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে একই দিকে, উদ্দেশ্য পাশে হাতিবান্ধার হাটে যাওয়া। ঘাটে আগের মতোই নৌকা অপেক্ষা করছে, সেখানে উঠলে পৌঁছানো যাবে তিস্তার আরেকটি চরে। তিস্তা নদীকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে চলতে আরম্ভ করল নৌকাটি। এবার আর নতুন করে ভাড়া দিতে হলো না। ভাড়া শুধু ওঠার সময়ই দিতে হয়। এটাই এখানকার নিয়ম। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। পেছনের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলো ভাসতে থাকল চোখের সামনে, আর মনে পড়ল সেই অসহায় মানুষেদের দুঃখ-দুর্দশার করুণ চিত্রগুলো। যাঁদের কথা কেউ শুনতে পায় না। কেবল সাক্ষী হয়ে থাকে তিস্তার ঢেউ।
নদীর জেগে ওঠা চরের পাশে সামান্য পানিতে এক পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছে কয়েকটি সাদা বক। লোকজন ছুটছে যে যার মতো, তবে তেমন কর্মব্যস্ততা নেই কারও মধ্যে। বিস্তীর্ণ চর নদীতে। জায়গাটা লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার এক অজপাড়াগাঁ, চরধুবনী।
পাশেই তিস্তা নদী। তিস্তার ওপর নির্ভর করে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন। তিস্তা ভরপুর হলে ভাসিয়ে নেয় এখানকার মানুষের ঘরবাড়ি ও আবাদি ফসল। অন্যত্র চলে যেতে হয় তখন। আবার চর জাগলে ভাসমান মানুষ নিজ ভিটায় ফেরে। চরে জন্মানো কাশফুলের বন ঘিরে নতুন আশায় ঘর বাঁধে এখানকার মানুষ, অনিশ্চয়তার কথা জেনেও।
আধ মাইলখানেক চরের বালুপথ পেরিয়ে পাওয়া গেল ঘাট। ডিঙি নৌকা অপেক্ষা করছে, ভরে গেলে তবেই ছাড়বেন মাঝি। তবে লোকজন তেমন না থাকায় বোধহয় নিজের সংকল্প থেকে সরে এলেন মাঝি। তাঁর সঙ্গে থাকা ছোট্ট ছেলেটি নৌকাটা সজোরে ঠেলে দিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে উঠল নায়ে! মাঝির নাম ছফর উদ্দিন, নৌকা চালনায় পারদর্শী। মাঝারি বয়সী লোকটির কাছ থেকে জানা গেল, প্রায় পনের বছর ধরে নৌকা চালান তিনি। নৌকায় তিন-চারটি ছাগল নিয়ে উঠেছেন জোহরা খাতুন। উদ্দেশ্য—ওপারে জেগে ওঠা চরে সদ্য গজানো কচি ঘাস খাওয়াবেন এগুলোকে। পরম মমতায় আগলে ধরে রেখেছেন ছাগলগুলোকে। নৌকায় আর যে তিন-চার জন উঠেছেন তাঁদের কেউ বস্তা আর কাচি নিয়ে ঘাস কাটতে বেরিয়েছেন, কেউবা চরে লাগানো ফসল দেখতে যাচ্ছেন।
রোদ এসে ঝিলিক দিচ্ছে তিস্তার শান্ত পানিতে। পাশের অল্প পানিতে কয়েকটি পানকৌড়ি খাবারের খোঁজে বারবার ডুবছে-ভাসছে। বাতাসের শন শন শব্দকে ম্লান করে দিচ্ছে বৈঠার আঘাতে জলের ছলাত্ ছলাত্ শব্দ।
আমরা এবার পৌঁছলাম আরেকটি চরে। আগেরটার মতো এটা অত কাঠখোট্টা নয়। চরদিকটা বেশ সবুজ, লতানো ঘাস আর কাশফুলের ছড়াছড়ি। বিস্তীর্ণ একটি চর। দূরে একটি ঘর। সেদিকেই ছুটছি। হঠাত্ মনে হলো, এ কী! কোনো দ্বীপে এসে পড়লাম না কি! চরের একটি অংশজুড়ে রবিশস্য আবাদ করা হয়েছে, একদিকে লাগানো ধান পেকেছে, অর্ধেক কাটা শেষ আর অর্ধেকটা কাটছেন কৃষকরা। তাঁরা জানালেন, কয়েক বছর ধরে এখানে ধানসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ হয়। এসব কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে এলেন কৃষক আছিম উদ্দিন। তিনি জানালেন তাঁর কষ্টের কথা, ‘এক দিন হামার অনেক কিছু আছিল বাহে, আইজ আর কিছু নাই, তিস্তা সব ভাসি নিয়া গেইছে। টুকটাক আবাদ করি খাই। এই কয়টা দিন। এর পর এগুলা সব আবার পানির তলত ডুবি যাইবে...!’
আছিম উদ্দিন আরও জানান, ভোটের সময় সবাই এসে ভোট চায় আর নির্বাচনের পরে আর কেউ খোঁজখবর রখে না। প্রচন্ড শীতের দিনে কিংবা বন্যার সময় কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়ায় না। এনজিওগুলো উচ্চ ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে সাহায্য করতে আসে। কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ছল ছল করে ওঠে আছিম উদ্দিনের। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষেরই অনেকটা একই দশা। এই চর এলাকার লোকজনের একটাই বড় দাবি সরকারের কাছে। আর তা হলো, একটি বাঁধ নির্মাণ করে দেওয়া। এটি হলে তিস্তার ভাঙন যেমন রোধ হবে, তেমনি এখানকার লোকজনের যাযাবরের মতো দিন কাটাতে হবে না। তিস্তার পানি একেবারেই কমে এসেছে, অল্প পানিতে মাছ ধরছেন কয়েকজন জেলে। কাছে গিয়ে কী মাছ ধরছেন জানতে চাইলে বললেন, বইরালি মাছ বেশি ধরা পড়ছে। এই মাছটির ভালো কদর এই এলাকায়। রুপালি রঙের সুস্বাদু এ মাছ কিনতে অনেক সময় তিস্তার পাড়ে মানুষের হাট বসে রীতিমতো! তিস্তার স্বচ্ছ পানিতে পা আর মন ভেজানোর পর একসময় ডাঙায় উঠে আসতে হলো।
তিস্তার পাড়ে সকাল-দুপুর কেটে গেছে এরই মধ্যে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। অনেক মানুষ হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে একই দিকে, উদ্দেশ্য পাশে হাতিবান্ধার হাটে যাওয়া। ঘাটে আগের মতোই নৌকা অপেক্ষা করছে, সেখানে উঠলে পৌঁছানো যাবে তিস্তার আরেকটি চরে। তিস্তা নদীকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে চলতে আরম্ভ করল নৌকাটি। এবার আর নতুন করে ভাড়া দিতে হলো না। ভাড়া শুধু ওঠার সময়ই দিতে হয়। এটাই এখানকার নিয়ম। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। পেছনের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলো ভাসতে থাকল চোখের সামনে, আর মনে পড়ল সেই অসহায় মানুষেদের দুঃখ-দুর্দশার করুণ চিত্রগুলো। যাঁদের কথা কেউ শুনতে পায় না। কেবল সাক্ষী হয়ে থাকে তিস্তার ঢেউ।
No comments