সময়চিত্র-আন্দোলনের হুমকি by আসিফ নজরুল
বিভিন্ন কারণে দাতা দেশ ও প্রতিষ্ঠানের কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় আছে আমাদের অনেকের। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী এমন একজন ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর একটি গবেষণার জন্য আলোচনায় বসেন আমার সঙ্গে। আলোচনার একপর্যায়ে অনিবার্যভাবে আসে দেশের রাজনীতির কথা। নির্বাচনে অভাবিত পরাজয় ঘটেছে বিএনপির।
এই ফলাফল কি মেনে নেবে তারা? না মেনে নেওয়ার মতো শক্তি কি আছে তাদের? তিনি খুব আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে জানালেন, বিএনপি ফলাফল মেনে নেবে। আরও বললেন, দুই বছর অন্তত কোনো বড় ধরনের আন্দোলন কর্মসূচি দেবে না বিএনপি, হরতালও করবে না। প্রসঙ্গক্রমে আরও জানালেন, দুই বছর তারেক রহমানও ফিরবেন না বাংলাদেশে।
বিএনপির এখনকার আন্দোলনের হুমকি শুনে সেসব পুরোনো কথা মনে পড়ে। টিপাইমুখ ইস্যু ছিল, ছিল করিডর, দ্রব্যমূল্য এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টার মতো ইস্যু। হাতে আছে ভারতের কাছে ‘দেশকে বেচে দেওয়ার’ গুরুতর অভিযোগও। বেগম খালেদা জিয়া কঠোর ভাষায় আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছেন। কিন্তু আমার সংশয় তবু যায় না। নির্বাচনের দুই বছরের মধ্যে আন্দোলন করা হবে না—এ ধরনের কোনো অলিখিত ‘মুচলেকা’ আছে নাকি কোথাও? না হলে টিপাইমুখ নিয়ে যখন উত্তাল ছিল সিলেট, তখনো অন্তত সিলেটে আধাবেলা হরতাল ডাকা হলো না কেন! এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করার উদাহরণ কি আছে নিকট ইতিহাসে? নেই। তাহলে হয়তো দাতা বন্ধুর কথাই ঠিক। তাদের চেয়ে বেশি জানার সুযোগ নেই আমাদের অনেকের। আবছাভাবে আমরা শুধু জানি বাংলাদেশের ভাগ্যবিধাতা শুধু জনগণ নয়, দাতাদেশ ও প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী এবং বড় ব্যবসায়ী—অন্তত এই তিনটি শ্রেণী বাংলাদেশে কে কখন ক্ষমতায় আসবে তা নির্ধারণে বিরাট ভূমিকা রাখে। উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমেরও। তবে প্রথমোক্ত শ্রেণীর তুলনায় এদের ভূমিকা অনেক খোলামেলা ও প্রকাশ্য।
তুলনামূলকভাবে অপ্রকাশ্য যে তিনটি শ্রেণীর কথা বললাম, এদের ভেতরে ঐক্য আর বোঝাপড়া থাকে অধিকাংশ সময়। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাবলিতে যত বেশি এই বোঝাপড়া থাকে, জনগণের ভূমিকা তত গৌণ হয়ে ওঠে। আবার জনগণ ও জনমতকে প্রকৃত অর্থে সংগঠিত করা গেলে অন্তরালের শক্তিরাও সুযোগমতো অবস্থান বদলে জনগণের ভাষায় কথা বলতে থাকে। ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছি তা। কিছুটা দেখেছি ১/১১-এর দ্বিতীয় বছরেও।
দুই বছরের কোনো সমঝোতা যদি থাকে, তাহলে বড় ধরনের আন্দোলন কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে বিএনপিকে তাই বিশাল জনসমর্থন গড়ে তুলতে হবে দেশে। সেটি এতই বিশাল এবং সুশক্ত হতে হবে যাতে রাজনীতির অন্য নিয়ন্ত্রকেরা আন্দোলনের যৌক্তিকতায় সম্মত হন। প্রশ্ন হচ্ছে, আন্দোলনের পক্ষে এত বড় জনসমর্থন পাওয়ার মতো কোনো ঘটনা কি ঘটেছে দেশে? সেই সমর্থন গড়ে তোলার মতো সাংগঠনিক শক্তি ও প্রস্তুতি কি আছে বিএনপির?
২.
সরকারের প্রতি জনগণ বিক্ষুব্ধ হয় মূলত দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্য, গণতন্ত্রহীনতা ও দেশবিরোধী কোনো কাজের জন্য। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের দু-একজন উপদেষ্টা ও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তবে তা যথেষ্ট জোরালো ও ব্যাপকভাবে নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনকে নানাভাবে স্থবির ও শক্তিহীন করার চেষ্টা রয়েছে। দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা টেন্ডার ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন এমন অভিযোগও ছাপা হয়েছে দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে। কিন্তু বাংলাদেশের অতীত সরকারগুলোর তুলনায় তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। আওয়ামী লীগ সরকার বরং মাত্রা ছাড়ানো বাড়াবাড়ি করেছে প্রশাসন দলীয়করণে। তবে সাধারণ জনগণ প্রত্যক্ষভাবে এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন না। সরকারকে বিতাড়িত করতে এ কারণে রাস্তায়ও নেমে আসেন না।
আওয়ামী লীগ সরকার তুলনামূলক সাফল্য দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার ক্ষেত্রে। এ সময়ে স্বভাবজাত অপরাধীদের দৌরাত্ম্য, খুন-খারাবি ও বড় অপরাধ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার প্রথম আমলে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা যেভাবে নিজেরাই প্রকাশ্যে গডফাদারের ভূমিকায় নেমেছিলেন এবং যে কারণে জনগণ ও গণমাধ্যম বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল তেমন ঘটনা ঘটেনি এখনো দেশে। বরং গডফাদারদের অনেককে নির্বাচনে মনোনয়ন না দিয়ে এমনকি দলের নেতৃত্ব থেকে বাতিল করে শেখ হাসিনা প্রশংসিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সম্ভাবনাময় সন্ত্রাসীদের জন্য একটি সতর্কবাণী হিসেবেও তা কাজ করেছে। যুবলীগ ও ছাত্রলীগ এ থেকে কতটুকু শিক্ষা নিয়েছে সেই প্রশ্ন অবশ্য বাড়ছে দিনে দিনে।
আওয়ামী লীগের প্রতি কিছু মানুষের ইতিমধ্যে রুষ্ট হয়ে ওঠার কথা দ্রব্যমূল্যোর কারণে। কত টাকায় চাল খাওয়ানো হবে, দ্রব্যমূল্য কতটা সহনীয় থাকবে—এ ধরনের কিছু প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগের নেতারা নির্বাচন চলাকালীন সময়ে দিয়েছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না সরকারের খুব একটা চেষ্টা আছে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষায়। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়ন, চাঁদাবাজি দমন, টিসিবি ধরনের প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ বিশেষজ্ঞরা দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার সুসমন্বিতভাবে দ্রব্যমূল্য কমানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে এমন কিছু শোনা যায়নি।
এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের কিছু ব্যর্থতা আছে ঠিকই, তবে তা ব্যাপক জনগণকে বিক্ষুব্ধ করার পর্যায়ে যায়নি। আওয়ামী লীগের নেতারা দেশে গণতন্ত্র চর্চার পথেও অর্থবহ কোনো প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলেননি। মাঝেমধ্যে টকশো, সংবাদপত্র এবং বাগ্স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের কিছু আত্মঘাতী উদ্যোগের কথা শোনা যায়। কিন্তু সরকার শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো পদক্ষেপ বাস্তবে নেয়নি এখনো। এ সময়ে আমার দেশ পত্রিকার একজন প্রতিবেদককে শারীরিকভাবে হামলা করার মতো কিছু নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে, তবে তা এখনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলের গলা টিপে ধরলে কী ভয়ংকর পরিস্থিতি হয় তা দেখার দুর্ভাগ্য আমাদের হয়েছে অতীতে। সরকার ঠিক সে ধরনের কিছু এখনো করেনি। বিরোধী দল এসব নিয়ে তাদের অভিযোগ করেছে, কিন্তু তা খুব আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে নয়, তেমন জোরালো ভাবেও নয়।
৩.
আওয়ামী লীগ সরকার সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে ‘ভারতপ্রীতির’ কারণে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর এই সমালোচনা আরও তীব্র হয়েছে। তার সরকার ভারতকে ইতিমধ্যে কিছু বিষয় ‘ডেলিভার’ করেছে (যেমন উলফা নেতাদের সমর্পণ), কিছু বিষয়ে তুলনামূলকভাবে ভারতের জন্য বেশি লাভজনক চুক্তি করেছে (যেমন সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন), কিছু বিষয়ে ভারতকে আনুকূল্য দেওয়ার সুশক্ত অঙ্গীকার করেছে (যেমন বন্দর ব্যবহার, নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভে সমর্থন)। কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশ যা পেয়েছে তা মূলত ভবিষ্যতে কিছু পাওয়ার প্রতিশ্রুতি, আশ্বাস ও আশাবাদ।
বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি এমনকি লিখিত চুক্তি পালনের ক্ষেত্রে ভারতের ট্র্যাক-রেকর্ড অবশ্য আশাপ্রদ নয়। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি, ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তিসহ বেশ কিছু উদাহরণ দেওয়া যায় এ ক্ষেত্রে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানও তাঁর সাম্প্রতিক লেখায় ভারতের কয়েকটি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কথা বলেছেন। তিনি আশাবাদী মানুষ বলে তারপরও আমাদের ‘মনের বাঘ’ থেকে বেরিয়ে এসে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সম্ভাবনাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার জন্য বলেছেন। কিন্তু সব মানুষ সমভাবে আশাবাদী ধরনের নয়। বিশেষ করে ফারাক্কা ব্যারাজের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর ভারত সম্পর্কে অবিশ্বাস ও আশঙ্কায় ভোগা অযৌক্তিকও বলা যাবে না।
এই অবিশ্বাস দূর করানোর ক্ষমতা রয়েছে মূলত ভারতেরই। বাণিজ্যবৈষম্য কমানো, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ, কানেকটিভিটি সুবিধা সমভাবে বণ্টন, সমুদ্রসীমানা ন্যায়ভাবে নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে ভারত প্রকৃত বন্ধুসুলভ পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত ভারতবিরোধী মনোভাব বহু মানুষের মধ্যে থাকা স্বাভাবিক। এ পরিস্থিতিতে একতরফাভাবে বাংলাদেশের মাটি ও বন্দর ভারতকে উন্মুক্ত করে দিলে জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভের সঞ্চার হবে তা ব্যবহার করে ভবিষ্যতে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা অবশ্যই সম্ভব।
তবে এই ভবিষ্যত্ খুব নিকটে নয়। ভারতকে যা যা দেওয়ার অঙ্গীকার আছে যৌথ ইশতেহারে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রায় বছর দুয়েক সময় লাগবে আওয়ামী লীগ সরকারের। আমার ধারণা, এই হিসাব যথেষ্টভাবেই বিবেচনায় রয়েছে বিএনপির। সরকারবিরোধী আন্দোলনে এখনই তাই ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা নয় দলটির। কাউন্সিল অনুষ্ঠান এবং ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা রিজভী আহমেদের মতো ব্যক্তিদের ক্ষমতাবান করার পর বিএনপি কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে অবশ্যই। কিন্তু অতীতে এই দলটির আন্দোলনে বিশাল ভূমিকা রাখত যে ছাত্রদল, তার নেতৃত্ব নির্বাচনে চরম ভুল করে ছাত্রদলের কতটা শক্তি ক্ষয় করা হয়েছে তার কিছু আলামত এখনি দেখা যাচ্ছে।
৪.
সরকারের ব্যর্থতা উন্মোচনের জন্য রাজপথের চেয়ে শ্রেয়তর ফোরাম হচ্ছে সংসদ। অতীতে কোনো বিরোধী দল সংসদের শক্তিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। বাস্তবতাকে বিবেচনা করে বিএনপিকে সেই চেষ্টাই করতে হবে। মাঠপর্যায়ে শক্তি সংহত করার পাশাপাশি সংসদে গেলে বিএনপির অন্তত কোনো ক্ষতি নেই।
নতুন প্রজন্ম এখন আগের চেয়ে বেশি সচেতন। এদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হলে বিএনপি যে ভবিষ্যতে শ্রেয়তর সরকার হবে তা গবেষণালব্ধ বক্তব্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ভারতের সঙ্গে চুক্তিসহ সব বিষয়ে নিজের চিন্তা ও পরিকল্পনা সংসদ ও বাইরে তুলে ধরতে হবে। তা না হলে আন্দোলনের সাফল্যের জন্য বিএনপিকে সরকারের বিশাল কোনো ব্যর্থতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমার ধারণা, কারও ব্যর্থতা বা অযোগ্যতার জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা শ্রেয়তর।
আসিফ নজরুল: আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিএনপির এখনকার আন্দোলনের হুমকি শুনে সেসব পুরোনো কথা মনে পড়ে। টিপাইমুখ ইস্যু ছিল, ছিল করিডর, দ্রব্যমূল্য এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টার মতো ইস্যু। হাতে আছে ভারতের কাছে ‘দেশকে বেচে দেওয়ার’ গুরুতর অভিযোগও। বেগম খালেদা জিয়া কঠোর ভাষায় আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছেন। কিন্তু আমার সংশয় তবু যায় না। নির্বাচনের দুই বছরের মধ্যে আন্দোলন করা হবে না—এ ধরনের কোনো অলিখিত ‘মুচলেকা’ আছে নাকি কোথাও? না হলে টিপাইমুখ নিয়ে যখন উত্তাল ছিল সিলেট, তখনো অন্তত সিলেটে আধাবেলা হরতাল ডাকা হলো না কেন! এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করার উদাহরণ কি আছে নিকট ইতিহাসে? নেই। তাহলে হয়তো দাতা বন্ধুর কথাই ঠিক। তাদের চেয়ে বেশি জানার সুযোগ নেই আমাদের অনেকের। আবছাভাবে আমরা শুধু জানি বাংলাদেশের ভাগ্যবিধাতা শুধু জনগণ নয়, দাতাদেশ ও প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী এবং বড় ব্যবসায়ী—অন্তত এই তিনটি শ্রেণী বাংলাদেশে কে কখন ক্ষমতায় আসবে তা নির্ধারণে বিরাট ভূমিকা রাখে। উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমেরও। তবে প্রথমোক্ত শ্রেণীর তুলনায় এদের ভূমিকা অনেক খোলামেলা ও প্রকাশ্য।
তুলনামূলকভাবে অপ্রকাশ্য যে তিনটি শ্রেণীর কথা বললাম, এদের ভেতরে ঐক্য আর বোঝাপড়া থাকে অধিকাংশ সময়। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাবলিতে যত বেশি এই বোঝাপড়া থাকে, জনগণের ভূমিকা তত গৌণ হয়ে ওঠে। আবার জনগণ ও জনমতকে প্রকৃত অর্থে সংগঠিত করা গেলে অন্তরালের শক্তিরাও সুযোগমতো অবস্থান বদলে জনগণের ভাষায় কথা বলতে থাকে। ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছি তা। কিছুটা দেখেছি ১/১১-এর দ্বিতীয় বছরেও।
দুই বছরের কোনো সমঝোতা যদি থাকে, তাহলে বড় ধরনের আন্দোলন কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে বিএনপিকে তাই বিশাল জনসমর্থন গড়ে তুলতে হবে দেশে। সেটি এতই বিশাল এবং সুশক্ত হতে হবে যাতে রাজনীতির অন্য নিয়ন্ত্রকেরা আন্দোলনের যৌক্তিকতায় সম্মত হন। প্রশ্ন হচ্ছে, আন্দোলনের পক্ষে এত বড় জনসমর্থন পাওয়ার মতো কোনো ঘটনা কি ঘটেছে দেশে? সেই সমর্থন গড়ে তোলার মতো সাংগঠনিক শক্তি ও প্রস্তুতি কি আছে বিএনপির?
২.
সরকারের প্রতি জনগণ বিক্ষুব্ধ হয় মূলত দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্য, গণতন্ত্রহীনতা ও দেশবিরোধী কোনো কাজের জন্য। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের দু-একজন উপদেষ্টা ও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তবে তা যথেষ্ট জোরালো ও ব্যাপকভাবে নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনকে নানাভাবে স্থবির ও শক্তিহীন করার চেষ্টা রয়েছে। দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা টেন্ডার ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন এমন অভিযোগও ছাপা হয়েছে দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে। কিন্তু বাংলাদেশের অতীত সরকারগুলোর তুলনায় তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। আওয়ামী লীগ সরকার বরং মাত্রা ছাড়ানো বাড়াবাড়ি করেছে প্রশাসন দলীয়করণে। তবে সাধারণ জনগণ প্রত্যক্ষভাবে এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন না। সরকারকে বিতাড়িত করতে এ কারণে রাস্তায়ও নেমে আসেন না।
আওয়ামী লীগ সরকার তুলনামূলক সাফল্য দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার ক্ষেত্রে। এ সময়ে স্বভাবজাত অপরাধীদের দৌরাত্ম্য, খুন-খারাবি ও বড় অপরাধ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার প্রথম আমলে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা যেভাবে নিজেরাই প্রকাশ্যে গডফাদারের ভূমিকায় নেমেছিলেন এবং যে কারণে জনগণ ও গণমাধ্যম বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল তেমন ঘটনা ঘটেনি এখনো দেশে। বরং গডফাদারদের অনেককে নির্বাচনে মনোনয়ন না দিয়ে এমনকি দলের নেতৃত্ব থেকে বাতিল করে শেখ হাসিনা প্রশংসিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সম্ভাবনাময় সন্ত্রাসীদের জন্য একটি সতর্কবাণী হিসেবেও তা কাজ করেছে। যুবলীগ ও ছাত্রলীগ এ থেকে কতটুকু শিক্ষা নিয়েছে সেই প্রশ্ন অবশ্য বাড়ছে দিনে দিনে।
আওয়ামী লীগের প্রতি কিছু মানুষের ইতিমধ্যে রুষ্ট হয়ে ওঠার কথা দ্রব্যমূল্যোর কারণে। কত টাকায় চাল খাওয়ানো হবে, দ্রব্যমূল্য কতটা সহনীয় থাকবে—এ ধরনের কিছু প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগের নেতারা নির্বাচন চলাকালীন সময়ে দিয়েছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না সরকারের খুব একটা চেষ্টা আছে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষায়। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়ন, চাঁদাবাজি দমন, টিসিবি ধরনের প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ বিশেষজ্ঞরা দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার সুসমন্বিতভাবে দ্রব্যমূল্য কমানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে এমন কিছু শোনা যায়নি।
এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের কিছু ব্যর্থতা আছে ঠিকই, তবে তা ব্যাপক জনগণকে বিক্ষুব্ধ করার পর্যায়ে যায়নি। আওয়ামী লীগের নেতারা দেশে গণতন্ত্র চর্চার পথেও অর্থবহ কোনো প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলেননি। মাঝেমধ্যে টকশো, সংবাদপত্র এবং বাগ্স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের কিছু আত্মঘাতী উদ্যোগের কথা শোনা যায়। কিন্তু সরকার শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো পদক্ষেপ বাস্তবে নেয়নি এখনো। এ সময়ে আমার দেশ পত্রিকার একজন প্রতিবেদককে শারীরিকভাবে হামলা করার মতো কিছু নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে, তবে তা এখনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলের গলা টিপে ধরলে কী ভয়ংকর পরিস্থিতি হয় তা দেখার দুর্ভাগ্য আমাদের হয়েছে অতীতে। সরকার ঠিক সে ধরনের কিছু এখনো করেনি। বিরোধী দল এসব নিয়ে তাদের অভিযোগ করেছে, কিন্তু তা খুব আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে নয়, তেমন জোরালো ভাবেও নয়।
৩.
আওয়ামী লীগ সরকার সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে ‘ভারতপ্রীতির’ কারণে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর এই সমালোচনা আরও তীব্র হয়েছে। তার সরকার ভারতকে ইতিমধ্যে কিছু বিষয় ‘ডেলিভার’ করেছে (যেমন উলফা নেতাদের সমর্পণ), কিছু বিষয়ে তুলনামূলকভাবে ভারতের জন্য বেশি লাভজনক চুক্তি করেছে (যেমন সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন), কিছু বিষয়ে ভারতকে আনুকূল্য দেওয়ার সুশক্ত অঙ্গীকার করেছে (যেমন বন্দর ব্যবহার, নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভে সমর্থন)। কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশ যা পেয়েছে তা মূলত ভবিষ্যতে কিছু পাওয়ার প্রতিশ্রুতি, আশ্বাস ও আশাবাদ।
বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি এমনকি লিখিত চুক্তি পালনের ক্ষেত্রে ভারতের ট্র্যাক-রেকর্ড অবশ্য আশাপ্রদ নয়। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি, ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তিসহ বেশ কিছু উদাহরণ দেওয়া যায় এ ক্ষেত্রে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানও তাঁর সাম্প্রতিক লেখায় ভারতের কয়েকটি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কথা বলেছেন। তিনি আশাবাদী মানুষ বলে তারপরও আমাদের ‘মনের বাঘ’ থেকে বেরিয়ে এসে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সম্ভাবনাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার জন্য বলেছেন। কিন্তু সব মানুষ সমভাবে আশাবাদী ধরনের নয়। বিশেষ করে ফারাক্কা ব্যারাজের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর ভারত সম্পর্কে অবিশ্বাস ও আশঙ্কায় ভোগা অযৌক্তিকও বলা যাবে না।
এই অবিশ্বাস দূর করানোর ক্ষমতা রয়েছে মূলত ভারতেরই। বাণিজ্যবৈষম্য কমানো, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ, কানেকটিভিটি সুবিধা সমভাবে বণ্টন, সমুদ্রসীমানা ন্যায়ভাবে নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে ভারত প্রকৃত বন্ধুসুলভ পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত ভারতবিরোধী মনোভাব বহু মানুষের মধ্যে থাকা স্বাভাবিক। এ পরিস্থিতিতে একতরফাভাবে বাংলাদেশের মাটি ও বন্দর ভারতকে উন্মুক্ত করে দিলে জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভের সঞ্চার হবে তা ব্যবহার করে ভবিষ্যতে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা অবশ্যই সম্ভব।
তবে এই ভবিষ্যত্ খুব নিকটে নয়। ভারতকে যা যা দেওয়ার অঙ্গীকার আছে যৌথ ইশতেহারে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রায় বছর দুয়েক সময় লাগবে আওয়ামী লীগ সরকারের। আমার ধারণা, এই হিসাব যথেষ্টভাবেই বিবেচনায় রয়েছে বিএনপির। সরকারবিরোধী আন্দোলনে এখনই তাই ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা নয় দলটির। কাউন্সিল অনুষ্ঠান এবং ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা রিজভী আহমেদের মতো ব্যক্তিদের ক্ষমতাবান করার পর বিএনপি কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে অবশ্যই। কিন্তু অতীতে এই দলটির আন্দোলনে বিশাল ভূমিকা রাখত যে ছাত্রদল, তার নেতৃত্ব নির্বাচনে চরম ভুল করে ছাত্রদলের কতটা শক্তি ক্ষয় করা হয়েছে তার কিছু আলামত এখনি দেখা যাচ্ছে।
৪.
সরকারের ব্যর্থতা উন্মোচনের জন্য রাজপথের চেয়ে শ্রেয়তর ফোরাম হচ্ছে সংসদ। অতীতে কোনো বিরোধী দল সংসদের শক্তিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। বাস্তবতাকে বিবেচনা করে বিএনপিকে সেই চেষ্টাই করতে হবে। মাঠপর্যায়ে শক্তি সংহত করার পাশাপাশি সংসদে গেলে বিএনপির অন্তত কোনো ক্ষতি নেই।
নতুন প্রজন্ম এখন আগের চেয়ে বেশি সচেতন। এদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হলে বিএনপি যে ভবিষ্যতে শ্রেয়তর সরকার হবে তা গবেষণালব্ধ বক্তব্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ভারতের সঙ্গে চুক্তিসহ সব বিষয়ে নিজের চিন্তা ও পরিকল্পনা সংসদ ও বাইরে তুলে ধরতে হবে। তা না হলে আন্দোলনের সাফল্যের জন্য বিএনপিকে সরকারের বিশাল কোনো ব্যর্থতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমার ধারণা, কারও ব্যর্থতা বা অযোগ্যতার জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা শ্রেয়তর।
আসিফ নজরুল: আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments