পানিব্যবস্থা-গঙ্গা নদী কি মরে যাবে? by আশরাফ দেওয়ান
দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৫০০ মিলিয়ন জনসংখ্যার জীবন ও জীবিকার বিকাশে গঙ্গার অবদান কম নয়। এই নদী বাংলাদেশের প্রায় ৩৭ ভাগ এলাকায় স্বাদুপানির উত্স এবং দেশের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর জীবিকার সহায়কশক্তি হিসেবে স্মরণাতীতকাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রতিবেশ-ব্যবস্থাও গঙ্গা নদীব্যবস্থার অবিরাম প্রবাহের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তসরকার প্যানেল (ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) বা আইপিসিসি ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, গঙ্গা নদী-ব্যবস্থার পানির উত্স অর্থাত্ গঙ্গোত্রী হিমবাহ ২০৩৫ সাল নাগাদ নিঃশেষ হয়ে যাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব শুধু সমগ্র পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপরই পড়বে না, যুগ যুগ ধরে গঙ্গার পানির ওপর ভর করে গড়ে ওঠা মানব-বসতিও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। উত্স থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ পর্যন্ত গঙ্গার ওপর এ পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৩৪টি বাঁধ/ড্যাম, এর অন্যতম একটি হচ্ছে ফারাক্কা ব্যারাজ, যা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত। ফারাক্কা ব্যারাজের প্রভাব সম্পর্কে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, এই স্থাপনা শুধু ভাটির দেশ বাংলাদেশের ৩৭ ভাগ এলাকাকেই বিপদাপন্ন করে তোলেনি, বরং ভারতীয় অংশেও অকালে বন্যা ও ভূমিক্ষয় দ্রুততর করেছে। অপরদিকে, উজানের তুলনায় ভাটি অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে বহুবিধ সমস্যা। একদিকে যেমন গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল বহু নদ-নদী এরই মধ্যে মরে গেছে, অন্যদিকে তেমনি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় দেখা দিয়েছে ব্যাপক জলাবদ্ধতা। লবণাক্ততার বিরূপ প্রভাবে হুমকির সম্মুখীন ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন, যা তিনি সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায় বলেছেন।
১৯৭২-২০০৮ সাল পর্যন্ত রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির মাধ্যমে গঙ্গার (বাংলাদেশ অংশের) ভূ-সংস্থানিক পরিবর্তন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত গঙ্গার তীরবর্তী ভাঙন ছিল মারাত্মক, প্রতিবছর গড়ে ৮৫ বর্গ কিলোমিটার করে। ১৯৮৪ সালের পর থেকে ক্ষয়সাধন প্রক্রিয়া হ্রাস পেলেও সঞ্চয়নের হার খুব বৃদ্ধি পায়। ১৯৭২ সালে সঞ্চয়নের পরিমাণ যেখানে ছিল গড়ে ১৮৬ বর্গকিলোমিটার, সেখানে বর্তমানে সঞ্চয়নের হার গড়ে ২২০ বর্গকিলোমিটার (২০০৮ সালে)। পরের পরিসংখ্যান থেকে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে—১৯৭২ সালে চর এলাকার মোট আয়তন ছিল ৩১২ বর্গকিলোমিটার, ১৯৮৪ সালে ৪৫৪ বর্গকিলোমিটার ও ২০০৮ সালে ৩৬০ বর্গকিলোমিটার। যেহেতু, ১৯৮৪ সালে গঙ্গার পানির একতরফা প্রত্যাহার কার্যকর ছিল, সেহেতু গঙ্গায় চরের পরিমাণও তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল ২০০৮ সাল থেকে। বক্রতাসূচক বিশ্লেষণে দেখা যায়, গঙ্গার অবস্থা সর্পিলাকার বা বিনুনি কোন অবস্থাতেই নেই, এটা ধীরে ধীরে ওয়ান্ডারিং নদীতে রূপান্তরিত হতে চলেছে। পাশাপাশি রাজশাহী-গোয়ালন্দ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে ছোট ছোট পকেট, যেখানে পার্শ্বীয় ক্ষয়ের মাধ্যমে ভূমিক্ষয় আগের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা থেকে প্রতীয়মান হয়, ফারাক্কার মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করায় গঙ্গায় পলি ভরাটের পরিমাণ দ্রুততর হয়েছে, তাই চরের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর তলদেশও ভরাট হতে চলেছে। ফলে সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল আজ মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন। যশোর ও সাতক্ষীরা এলাকার হাজার হাজার মানুষ বছরের ৬-৭ মাস নিজ বাসভূমি ছেড়ে বাঁধ অথবা রাস্তার ওপর বসবাস করে। অপরদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত বাঁধ ও পোল্ডারও পরিবেশের বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করেছে। কেননা, আমাদের দেশের পলির কথাটা মাথায় না রেখেই নির্মিত এই বাঁধ অথবা পোল্ডার এখন কোথাও কোথাও মরণফাঁদ হয়ে দেখা দিয়েছে, যেমনটি হয়েছে যশোরের কপোতাক্ষ ও ভবদহ এলাকায়।
যদিও ১৯৯৬ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টনের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, তথাপিও এই চুক্তি থেকে খুব কমই ফল পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৮৯-৯৫ সালের (চুক্তিবিহীন সময়কালে) শুষ্ক মৌসুমের পানির প্রবাহকে ১৯৯৬-২০০৮ সালের (চুক্তির সময়কাল) পানির প্রবাহের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, শুষ্ক মৌসুমের প্রবাহ যত্সামান্যই বেড়েছে, কিন্তু গ্রীষ্মকালীন প্রবাহের ধরন আগের তুলনায় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ-মাধ্যম এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সরবরাহ করা উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালের চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি পাওয়ার কথা, বাংলাদেশ ততটুকু পাচ্ছে না। আর তাই গঙ্গার প্রধান শাখা গড়াই এরই মধ্যে শুকিয়ে খালের রূপ ধারণ করেছে। যার ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভূগর্ভ ও ভূপৃষ্ঠের পানির লবণাক্ততার পরিমাণ এরই মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করেছে। হুমকির সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের অস্তিত্ব নিয়ে। অন্যদিকে, নদী ড্রেজিংয়ের জন্য সরকারকে গুনতে হচ্ছে হাজার কোটি টাকা, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করছে।
সদ্য সমাপ্ত দিল্লি শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার প্রবাহিত নদীগুলোর পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এখন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পালা—যেখানে বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়ে ভারতের ওপর বিভিন্ন উপায়ে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। যদিও গঙ্গার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি আসেনি, তবুও আমাদের মনে রাখতে হবে, তিস্তার তুলনায় গঙ্গার বিষয়টি আরও বেশি স্পর্শকাতর। কেননা, দেশের ৩৭ ভাগ ভূমিসহ পুরো সুন্দরবন গঙ্গার পানির অবিরাম প্রবাহের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। শুধু তাই নয়, বহুদিন ধরে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু এ ব্যাপারে অগ্রগতি এখনো পর্যন্ত যত্সামান্য। একটি ব্যারাজ নির্মাণের জন্য যত অর্থই প্রয়োজন হোক না কেন, সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিবেশ, পরিবেশ ও মানুষকে বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই এটা নির্মাণ করতে হবে। অন্যথায় আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দিনদিন বৃদ্ধি পাবে, সঙ্গে হারাতে হবে সুন্দরবনকেও। ইতিমধ্যেই স্বাদুপানির অভাবে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল বহুদিন ধরে বন্ধ। আবার পলি-ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, অবিরাম পানির অভাবে গঙ্গা নদীর মূল প্রবাহ এবং গড়াই শুষ্ক মৌসুমে মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হতে চলেছে। শুধু ড্রেজিং করে পলি সরালেই চলবে না, গঙ্গার মূল প্রবাহের অবিরাম পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা দরকার, যাতে গড়াই ও অন্যান্য প্রশাখার মাধ্যমে সমুদ্র থেকে উঠে আসা লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে লবণাক্ততার অবস্থা আরও মারাত্মক রূপ ধারণ করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। প্রথম আলোয় ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত সাক্ষাত্কারে দেশের প্রখ্যাত পানিবিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশগত বিপর্যয় রোধে গঙ্গার অবিরাম প্রবাহের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। গত ২০ বছরের গঙ্গা অববাহিকার ওপর গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশগত বিপর্যয় খুবই যত্সামান্য, একমাত্র ফারাক্কার মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার এই অঞ্চলের পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য প্রয়োজন যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত পানির প্রবাহ তদারকি এবং ভারতের কাছ থেকে ১৯৯৬ সালের চুক্তির হিস্যা অনুযায়ী পানি বুঝে নেওয়া। নয়তো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচানো এক সময় দুরূহ হয়ে পড়বে। কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সময় কিন্তু এখনই।
আশরাফ দেওয়ান: সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
dewan1971@gmail.com
No comments