বিশেষ সাক্ষাত্কার-ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও প্রেস কাউন্সিলের আওতায় আনতে হবে by এবাদুল হক
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে যথাক্রমে ১০ বছর ও এক বছর বিচারিক দায়িত্ব পালন করেছেন। হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালে কাজী এবাদুল হক বাংলা ভাষায় রায় লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।
প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত আছেন ১ নভেম্বর ২০০৭ থেকে। সাংবাদিকতার মানোন্নয়ন এবং সাংবাদিকদের আচরণবিধি পালনে প্রেস কাউন্সিল কী ভূমিকা রাখছে, অন্যান্য দেশে প্রেস কাউন্সিল কীভাবে কাজ করে, সেসব নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম।
সাক্ষাত্কার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কি কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারছে?
কাজী এবাদুল হক প্রেস কাউন্সিল কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারছে কি না, সে প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে দেখতে হবে এর দায়িত্ব কী? প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার মূলে রয়েছে নৈতিক অবস্থান। একটি নৈতিক আদালত। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণ তথা সাংবাদিকদের আচরণবিধি সমুন্নত রাখাই প্রেস কাউন্সিলের দায়িত্ব। সাংবাদিকতার নীতিমালা পালনের উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করেছে। এটি করেছেন সংবাদপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই।
স্বাধীনতার পর অন্য সবকিছুর মতো সাংবাদিকতায়ও এক ধরনের লাগামহীনতা লক্ষ করা যায়। অনেক পত্রিকা সংবাদপত্রের নীতিমালা ও নৈতিকতা অগ্রাহ্য করতে থাকে। পাকিস্তান আমলে এসব দেখার জন্য প্রেস কোড অব অনার গঠন করা হয়েছিল। অনেকটা তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে প্রেস কাউন্সিল আইন পাস হয়। তবে এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে আরও পরে, ১৯৮০ সালে।
প্রথম আলো অনেকেরই অভিযোগ, প্রেস কাউন্সিল একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আপনি কী বলেন?
কাজী এবাদুল হক প্রেস কাউন্সিল সম্পর্কে এ ধরনের ঢালাও মন্তব্যের আগে এর কার্যপরিধি জানা প্রয়োজন। ১৫ সদস্যের প্রেস কাউন্সিল পরিচালনা কমিটির মধ্যে শুধু চেয়ারম্যানই সরকার নিযুক্ত, বাকি ১৪ জনের অধিকাংশই সংবাদপত্রসেবী। এর মধ্যে তিনজন সাংবাদিক, তিনজন সম্পাদক, তিনজন সংবাদপত্রের মালিক প্রতিনিধি। বাকি তিনজনের একজন সংস্কৃতিসেবী, যিনি বাংলা একাডেমী মনোনীত একজন আইনজীবী, যিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল মনোনীত একজন শিক্ষাবিদ, যিনি ইউজিসি মনোনীত এবং দুজন সাংসদ। অতএব, প্রেস কাউন্সিলকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে সংবাদপত্রসেবীদেরই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। আগে সাংবাদিকদের মধ্যে যখন এতটা বিভাজন ছিল না, তখন প্রেস কাউন্সিল অনেক বেশি সক্রিয় ছিল। কিন্তু সাংবাদিকদের মধ্যকার বিভাজনের নেতিবাচক প্রভাব প্রেস কাউন্সিলের কাজকর্মেও পড়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদের সমর্থক সাংবাদিকেরাই কমিটির সদস্য হন। এর ব্যতিক্রমও আছে। বর্তমান কমিটিতে সরকারের সমর্থক নন, এমন সম্পাদকও আছেন। আবার অনেক সাংবাদিক প্রতিনিধি আছেন, যাঁরা কমিটির বৈঠকেই হাজির হন না। আসলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, যাঁদের প্রেস কাউন্সিল সম্পর্কে আগ্রহ আছে, তাঁদের নিয়ে কমিটি হলে সংবাদপত্রসেবীরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি প্রেস কাউন্সিলও তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।
প্রথম আলো অসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক খবর প্রকাশের জন্য প্রায়ই সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু তাঁরা প্রেস কাউন্সিলে আসছেন না।
কাজী এবাদুল হক একেবারে আসছেন না, এ কথা ঠিক নয়। কম আসছেন। প্রেস কাউন্সিল ও সাধারণ আদালতে অভিযোগ দায়েরের ধরনও ভিন্ন। কেউ যদি মনে করেন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সংবাদপত্র ভুল বা অসত্য খবর ছেপেছে, এ সংক্রান্ত সঠিক তথ্যটি তিনি পাঠককে জানাতে চান, তাহলে তাঁর প্রথম দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠানো। পত্রিকাটি সেটি ছাপলে অভিযোগকারীকে প্রেস কাউন্সিলে আসার দরকার হয় না। কোনো পত্রিকা অসত্য বা উদ্দেশ্যমূলক খবর ছেপেও যদি অভিযোগকারীর বক্তব্য আমলে না নেয়, কিংবা তার সংশোধনী না ছাপে, তাহলে প্রেস কাউন্সিল সেটি ছাপতে বাধ্য করতে পারে না। কিন্তু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট পত্রিকার বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ পেশ করলে চেয়ারম্যানের পৌরহিত্যে গঠিত ইহার বিচারিক কমিটি উভয়পক্ষের বক্তব্য শোনার পর অভিযুক্ত পক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করলে তাকে সতর্ক, ভর্ত্সনা ও তিরস্কার করতে পারে এবং তদন্ত রিপোর্টটি সাংবাদিকের নামসহ সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে পারে।
প্রথম আলো প্রেস কাউন্সিলের বিচারিক কাজটি কীভাবে হয়?
কাজী এবাদুল হক কেউ অভিযোগ করলে প্রেস কাউন্সিল প্রথমে সেটি আমলে নেওয়ার জন্য ১৫ সদস্যের কমিটির মধ্য থেকে একটি বিচারিক কমিটি গঠন করে। প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এ কমিটিরও প্রধান হবেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে অভিযুক্ত পত্রিকার কাছে নোটিশ পাঠিয়ে তাদের বক্তব্য চাওয়া হয়। উভয়পক্ষের বক্তব্য বিবেচনা করার জন্য তাদের শুনানিতে ডাকা হয়। সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। তবে কমিটির সদস্যরা সমানভাবে বিভক্ত হয়ে পড়লে চেয়ারম্যান নিজের সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। অর্থাত্ তাঁর মতই চূড়ান্ত।
প্রথম আলো প্রেস কাউন্সিলকে আরও সক্রিয় ও কার্যকর করা যায় কীভাবে?
কাজী এবাদুল হক মনে রাখতে হবে, প্রেস কাউন্সিল একটি নৈতিকতাধর্মী প্রতিষ্ঠান। সাংবাদিকদের নৈতিকাবোধ সমুন্নত রাখাই আমাদের উদ্দেশ্য, যাতে এ পেশার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়ে। গত বছর সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের নিয়ে আমরা একটি সেমিনার করেছিলাম। তাতে বেশ কিছু প্রস্তাব ছিল, যেমন কোনো সংবাদপত্র যদি বারবার নীতিমালা লঙ্ঘন করে, তার ডিক্লারেশন বাতিল করা। বর্তমানে পত্রিকার ডিক্লারেশন পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব শর্ত আছে, সেসবের সঙ্গে এটিও যুক্ত করা যেতে পারে। সাংবাদিকদের দাবি ছিল, সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে অন্য কোনো আদালতের আগে প্রথমে প্রেস কাউন্সিলে যেতে হবে। তাঁদের আরেকটি দাবি ছিল, মানহানি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যাবে না। এ দাবিটি সরকার মেনে নিয়েছে।
আমি মনে করি, উল্লেখিত প্রস্তাব দুটি সরকার আমলে নিলে প্রেস কাউন্সিল যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি সাংবাদিকতার নৈতিক মানও বাড়বে। প্রকাশিত সংবাদের ব্যাপারে অভিযোগ থাকলে প্রথমে অভিযোগকারীকে প্রেস কাউন্সিলে আসতে হবে। প্রেস কাউন্সিলের রায়ে তিনি সন্তুষ্ট না হলে অন্য আদালতে যাওয়ার পথ তো খোলাই আছে।
প্রথম আলো সাধারণত প্রেস কাউন্সিলে একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে কত দিন সময় লাগে?
কাজী এবাদুল হক এটি নির্ভর করে অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের ওপর। অনেক সময় দুই পক্ষ অথবা এক পক্ষ সময় নেয়। প্রেস কাউন্সিলে কোনো অভিযোগ এলে ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে বিবাদীকে নোটিশ দেওয়া হয়। এর জবাব পাওয়ার পর অভিযোগকারীকে তাঁর কপি পাঠিয়ে তাদের পাল্টা বক্তব্য আছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। আমার ধারণা তিন মাসের মধ্যে যেকোনো মামলা নিষ্পত্তি হতে পারে যদি কোনো পক্ষ বাগড়া না দেয়।
প্রথম আলো আপনি এক ক্রান্তিকালে প্রেস কাউন্সিলের দায়িত্ব নিয়েছেন। তখন চারদলীয় জোট সরকার না থাকলেও তাদের মনোনীত ব্যক্তিরা কমিটিতে ছিলেন। এখন আবার নতুন কমিটির সঙ্গে কাজ করছেন।
কাজী এবাদুল হক আমি সবার সহযোগিতা পাচ্ছি। এর আগে যাঁরা ছিলেন তাঁদের সঙ্গেও কাজ করতে অসুবিধা হয়নি। তবে প্রেস কাউন্সিলকে বাজেট বরাদ্দের অর্থ ছাড় করাতে নানা আমলাতান্ত্রিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এতে কাজের গতি কমে যায়। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেলায়ও তা প্রযোজ্য।
প্রথম আলো পত্রিকার ডিক্লারেশন দেওয়া না-দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিলের কি কোনো ভূমিকা আছে? কর্তৃপক্ষ একটি পত্রিকার ডিক্লারেশন না দেওয়ায় প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা প্রেস অ্যাপিলেট কমিটির কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, যা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল।
কাজী এবাদুল হক পত্রিকার ডিক্লারেশন দিয়ে থাকেন জেলা প্রশাসক। এ ব্যাপারে প্রেস কাউন্সিলের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে না। তবে যেহেতু প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে প্রেস অ্যাপিলেট বোর্ডেরও চেয়ারম্যান এবং এর অন্য দুজন সদস্যের একজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, অপরজন প্রেস কাউন্সিলের একজন সদস্য। কর্তৃপক্ষ ডিক্লারেশন না দিলে যে কেউ তার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন। সেজন্য এ ব্যাপারে প্রেস কাউন্সিলের পরোক্ষ ভূমিকা আছে। এবিএম মূসার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক কর্তৃক ডিক্লারেশন না দেওয়াকে প্রেস অ্যাপিলেট বোর্ড বেআইনি ঘোষণা করেছিল এবং ডিক্লারেশন দেওয়ার জন্য ঢাকার জেলা প্রশাসককে নির্দেশও দিয়েছিল।
প্রথম আলো ডিক্লারেশন বাতিলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কি প্রেস কাউন্সিলে আসে?
কাজী এবাদুল হক হ্যাঁ, আমরা কিছু আপিল পেয়ে থাকি। তার বেশির ভাগই মফস্বল শহরের এবং পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয় না এমন পত্রিকার পক্ষ থেকে। অনিয়মিত প্রকাশনার কারণেই সেসব পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়েছে।
প্রথম আলো বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? তাদের মধ্যে নীতিমালা মেনে চলা না লঙ্ঘনের প্রবণতা বেশি?
কাজী এবাদুল হক মূলধারার পত্রিকাগুলো মোটামুটি নীতিমালা ও আচরণবিধি মেনে চলে। সেসব পত্রিকার সাংবাদিকতার মানও ভালো। কিন্তু সেসব পত্রিকার কোনো কোনো সাংবাদিকও মাঝেমধ্যে আচরণবিধি ভঙ্গ করে খবর ছেপে থাকে। এমন অভিযোগও প্রেস কাউন্সিলে আসে। তবে যেসব পত্রিকায় পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি, প্রচারসংখ্যা কম, চমকপ্রদ খবর ছেপে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে, সেগুলো আচরণবিধি মেনে চলছে বলা যাবে না।
প্রথম আলো ১৯৭৪ সালে যখন প্রেস কাউন্সিল আইন হয়, তখন বেসরকারি খাতে কোনো বেতার-টিভি ছিল না। বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভি পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখন অনেক বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও এফএম রেডিও চালু আছে। সেক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য প্রেস কাউন্সিলের মতো পৃথক কোনো প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজন আছে কি না?
কাজী এবাদুল হক ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য প্রেস কাউন্সিলের মতো পৃথক কোনো প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজন নেই। প্রেস কাউন্সিল তো সংবাদক্ষেত্রসংক্রান্ত বিষয়ই আমলে নিয়ে থাকে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর সম্পর্কে যেমন অভিযোগ আছে, তেমনি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত খবর সম্পর্কেও আছে। দুটিই সংবাদক্ষেত্র। সে ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিলের আইন সংশোধন করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তাহলে অন্য আর একই ধরনের প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। এতে সরকারের অহেতুক ব্যয় বৃদ্ধিও হবে না। সে ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিকে প্রেস কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
কাজী এবাদুল হক আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাত্কার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কি কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারছে?
কাজী এবাদুল হক প্রেস কাউন্সিল কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারছে কি না, সে প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে দেখতে হবে এর দায়িত্ব কী? প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার মূলে রয়েছে নৈতিক অবস্থান। একটি নৈতিক আদালত। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণ তথা সাংবাদিকদের আচরণবিধি সমুন্নত রাখাই প্রেস কাউন্সিলের দায়িত্ব। সাংবাদিকতার নীতিমালা পালনের উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করেছে। এটি করেছেন সংবাদপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই।
স্বাধীনতার পর অন্য সবকিছুর মতো সাংবাদিকতায়ও এক ধরনের লাগামহীনতা লক্ষ করা যায়। অনেক পত্রিকা সংবাদপত্রের নীতিমালা ও নৈতিকতা অগ্রাহ্য করতে থাকে। পাকিস্তান আমলে এসব দেখার জন্য প্রেস কোড অব অনার গঠন করা হয়েছিল। অনেকটা তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে প্রেস কাউন্সিল আইন পাস হয়। তবে এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে আরও পরে, ১৯৮০ সালে।
প্রথম আলো অনেকেরই অভিযোগ, প্রেস কাউন্সিল একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আপনি কী বলেন?
কাজী এবাদুল হক প্রেস কাউন্সিল সম্পর্কে এ ধরনের ঢালাও মন্তব্যের আগে এর কার্যপরিধি জানা প্রয়োজন। ১৫ সদস্যের প্রেস কাউন্সিল পরিচালনা কমিটির মধ্যে শুধু চেয়ারম্যানই সরকার নিযুক্ত, বাকি ১৪ জনের অধিকাংশই সংবাদপত্রসেবী। এর মধ্যে তিনজন সাংবাদিক, তিনজন সম্পাদক, তিনজন সংবাদপত্রের মালিক প্রতিনিধি। বাকি তিনজনের একজন সংস্কৃতিসেবী, যিনি বাংলা একাডেমী মনোনীত একজন আইনজীবী, যিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল মনোনীত একজন শিক্ষাবিদ, যিনি ইউজিসি মনোনীত এবং দুজন সাংসদ। অতএব, প্রেস কাউন্সিলকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে সংবাদপত্রসেবীদেরই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। আগে সাংবাদিকদের মধ্যে যখন এতটা বিভাজন ছিল না, তখন প্রেস কাউন্সিল অনেক বেশি সক্রিয় ছিল। কিন্তু সাংবাদিকদের মধ্যকার বিভাজনের নেতিবাচক প্রভাব প্রেস কাউন্সিলের কাজকর্মেও পড়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদের সমর্থক সাংবাদিকেরাই কমিটির সদস্য হন। এর ব্যতিক্রমও আছে। বর্তমান কমিটিতে সরকারের সমর্থক নন, এমন সম্পাদকও আছেন। আবার অনেক সাংবাদিক প্রতিনিধি আছেন, যাঁরা কমিটির বৈঠকেই হাজির হন না। আসলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, যাঁদের প্রেস কাউন্সিল সম্পর্কে আগ্রহ আছে, তাঁদের নিয়ে কমিটি হলে সংবাদপত্রসেবীরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি প্রেস কাউন্সিলও তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।
প্রথম আলো অসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক খবর প্রকাশের জন্য প্রায়ই সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু তাঁরা প্রেস কাউন্সিলে আসছেন না।
কাজী এবাদুল হক একেবারে আসছেন না, এ কথা ঠিক নয়। কম আসছেন। প্রেস কাউন্সিল ও সাধারণ আদালতে অভিযোগ দায়েরের ধরনও ভিন্ন। কেউ যদি মনে করেন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সংবাদপত্র ভুল বা অসত্য খবর ছেপেছে, এ সংক্রান্ত সঠিক তথ্যটি তিনি পাঠককে জানাতে চান, তাহলে তাঁর প্রথম দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠানো। পত্রিকাটি সেটি ছাপলে অভিযোগকারীকে প্রেস কাউন্সিলে আসার দরকার হয় না। কোনো পত্রিকা অসত্য বা উদ্দেশ্যমূলক খবর ছেপেও যদি অভিযোগকারীর বক্তব্য আমলে না নেয়, কিংবা তার সংশোধনী না ছাপে, তাহলে প্রেস কাউন্সিল সেটি ছাপতে বাধ্য করতে পারে না। কিন্তু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট পত্রিকার বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ পেশ করলে চেয়ারম্যানের পৌরহিত্যে গঠিত ইহার বিচারিক কমিটি উভয়পক্ষের বক্তব্য শোনার পর অভিযুক্ত পক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করলে তাকে সতর্ক, ভর্ত্সনা ও তিরস্কার করতে পারে এবং তদন্ত রিপোর্টটি সাংবাদিকের নামসহ সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে পারে।
প্রথম আলো প্রেস কাউন্সিলের বিচারিক কাজটি কীভাবে হয়?
কাজী এবাদুল হক কেউ অভিযোগ করলে প্রেস কাউন্সিল প্রথমে সেটি আমলে নেওয়ার জন্য ১৫ সদস্যের কমিটির মধ্য থেকে একটি বিচারিক কমিটি গঠন করে। প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এ কমিটিরও প্রধান হবেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে অভিযুক্ত পত্রিকার কাছে নোটিশ পাঠিয়ে তাদের বক্তব্য চাওয়া হয়। উভয়পক্ষের বক্তব্য বিবেচনা করার জন্য তাদের শুনানিতে ডাকা হয়। সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। তবে কমিটির সদস্যরা সমানভাবে বিভক্ত হয়ে পড়লে চেয়ারম্যান নিজের সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। অর্থাত্ তাঁর মতই চূড়ান্ত।
প্রথম আলো প্রেস কাউন্সিলকে আরও সক্রিয় ও কার্যকর করা যায় কীভাবে?
কাজী এবাদুল হক মনে রাখতে হবে, প্রেস কাউন্সিল একটি নৈতিকতাধর্মী প্রতিষ্ঠান। সাংবাদিকদের নৈতিকাবোধ সমুন্নত রাখাই আমাদের উদ্দেশ্য, যাতে এ পেশার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়ে। গত বছর সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের নিয়ে আমরা একটি সেমিনার করেছিলাম। তাতে বেশ কিছু প্রস্তাব ছিল, যেমন কোনো সংবাদপত্র যদি বারবার নীতিমালা লঙ্ঘন করে, তার ডিক্লারেশন বাতিল করা। বর্তমানে পত্রিকার ডিক্লারেশন পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব শর্ত আছে, সেসবের সঙ্গে এটিও যুক্ত করা যেতে পারে। সাংবাদিকদের দাবি ছিল, সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে অন্য কোনো আদালতের আগে প্রথমে প্রেস কাউন্সিলে যেতে হবে। তাঁদের আরেকটি দাবি ছিল, মানহানি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যাবে না। এ দাবিটি সরকার মেনে নিয়েছে।
আমি মনে করি, উল্লেখিত প্রস্তাব দুটি সরকার আমলে নিলে প্রেস কাউন্সিল যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি সাংবাদিকতার নৈতিক মানও বাড়বে। প্রকাশিত সংবাদের ব্যাপারে অভিযোগ থাকলে প্রথমে অভিযোগকারীকে প্রেস কাউন্সিলে আসতে হবে। প্রেস কাউন্সিলের রায়ে তিনি সন্তুষ্ট না হলে অন্য আদালতে যাওয়ার পথ তো খোলাই আছে।
প্রথম আলো সাধারণত প্রেস কাউন্সিলে একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে কত দিন সময় লাগে?
কাজী এবাদুল হক এটি নির্ভর করে অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের ওপর। অনেক সময় দুই পক্ষ অথবা এক পক্ষ সময় নেয়। প্রেস কাউন্সিলে কোনো অভিযোগ এলে ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে বিবাদীকে নোটিশ দেওয়া হয়। এর জবাব পাওয়ার পর অভিযোগকারীকে তাঁর কপি পাঠিয়ে তাদের পাল্টা বক্তব্য আছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। আমার ধারণা তিন মাসের মধ্যে যেকোনো মামলা নিষ্পত্তি হতে পারে যদি কোনো পক্ষ বাগড়া না দেয়।
প্রথম আলো আপনি এক ক্রান্তিকালে প্রেস কাউন্সিলের দায়িত্ব নিয়েছেন। তখন চারদলীয় জোট সরকার না থাকলেও তাদের মনোনীত ব্যক্তিরা কমিটিতে ছিলেন। এখন আবার নতুন কমিটির সঙ্গে কাজ করছেন।
কাজী এবাদুল হক আমি সবার সহযোগিতা পাচ্ছি। এর আগে যাঁরা ছিলেন তাঁদের সঙ্গেও কাজ করতে অসুবিধা হয়নি। তবে প্রেস কাউন্সিলকে বাজেট বরাদ্দের অর্থ ছাড় করাতে নানা আমলাতান্ত্রিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এতে কাজের গতি কমে যায়। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেলায়ও তা প্রযোজ্য।
প্রথম আলো পত্রিকার ডিক্লারেশন দেওয়া না-দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিলের কি কোনো ভূমিকা আছে? কর্তৃপক্ষ একটি পত্রিকার ডিক্লারেশন না দেওয়ায় প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা প্রেস অ্যাপিলেট কমিটির কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, যা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল।
কাজী এবাদুল হক পত্রিকার ডিক্লারেশন দিয়ে থাকেন জেলা প্রশাসক। এ ব্যাপারে প্রেস কাউন্সিলের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে না। তবে যেহেতু প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে প্রেস অ্যাপিলেট বোর্ডেরও চেয়ারম্যান এবং এর অন্য দুজন সদস্যের একজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, অপরজন প্রেস কাউন্সিলের একজন সদস্য। কর্তৃপক্ষ ডিক্লারেশন না দিলে যে কেউ তার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন। সেজন্য এ ব্যাপারে প্রেস কাউন্সিলের পরোক্ষ ভূমিকা আছে। এবিএম মূসার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক কর্তৃক ডিক্লারেশন না দেওয়াকে প্রেস অ্যাপিলেট বোর্ড বেআইনি ঘোষণা করেছিল এবং ডিক্লারেশন দেওয়ার জন্য ঢাকার জেলা প্রশাসককে নির্দেশও দিয়েছিল।
প্রথম আলো ডিক্লারেশন বাতিলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কি প্রেস কাউন্সিলে আসে?
কাজী এবাদুল হক হ্যাঁ, আমরা কিছু আপিল পেয়ে থাকি। তার বেশির ভাগই মফস্বল শহরের এবং পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয় না এমন পত্রিকার পক্ষ থেকে। অনিয়মিত প্রকাশনার কারণেই সেসব পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়েছে।
প্রথম আলো বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? তাদের মধ্যে নীতিমালা মেনে চলা না লঙ্ঘনের প্রবণতা বেশি?
কাজী এবাদুল হক মূলধারার পত্রিকাগুলো মোটামুটি নীতিমালা ও আচরণবিধি মেনে চলে। সেসব পত্রিকার সাংবাদিকতার মানও ভালো। কিন্তু সেসব পত্রিকার কোনো কোনো সাংবাদিকও মাঝেমধ্যে আচরণবিধি ভঙ্গ করে খবর ছেপে থাকে। এমন অভিযোগও প্রেস কাউন্সিলে আসে। তবে যেসব পত্রিকায় পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি, প্রচারসংখ্যা কম, চমকপ্রদ খবর ছেপে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে, সেগুলো আচরণবিধি মেনে চলছে বলা যাবে না।
প্রথম আলো ১৯৭৪ সালে যখন প্রেস কাউন্সিল আইন হয়, তখন বেসরকারি খাতে কোনো বেতার-টিভি ছিল না। বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভি পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখন অনেক বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও এফএম রেডিও চালু আছে। সেক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য প্রেস কাউন্সিলের মতো পৃথক কোনো প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজন আছে কি না?
কাজী এবাদুল হক ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য প্রেস কাউন্সিলের মতো পৃথক কোনো প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজন নেই। প্রেস কাউন্সিল তো সংবাদক্ষেত্রসংক্রান্ত বিষয়ই আমলে নিয়ে থাকে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর সম্পর্কে যেমন অভিযোগ আছে, তেমনি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত খবর সম্পর্কেও আছে। দুটিই সংবাদক্ষেত্র। সে ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিলের আইন সংশোধন করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তাহলে অন্য আর একই ধরনের প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। এতে সরকারের অহেতুক ব্যয় বৃদ্ধিও হবে না। সে ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিকে প্রেস কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
কাজী এবাদুল হক আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments