বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস-কুষ্ঠরোগ: যে অবস্থার পরিবর্তন জরুরি by মার্টিন অধিকারী
আজ বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস। মানুষের জানা সব রোগের মধ্যে কুষ্ঠ একটি প্রাচীনতম রোগ। অতীতে রোগটি অত্যন্ত সংক্রামক, বংশগত, আরোগ্য হয় না, এর দ্বারা রোগীর অঙ্গহানি অনিবার্য এবং রোগটি ঈশ্বরের অভিশাপ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু আজ ওই সব ধারণা পাল্টে গেছে। এখন বিনা মূল্যে এ রোগের সফল চিকিত্সা পাওয়া যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত এমডিটি বা মাল্টি ড্রাগ থেরাপি রোগের মাত্রাভেদে নির্দিষ্ট মেয়াদে সেবন করলে এ রোগ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। তবে দুঃখের বিষয়, আজও আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবার-পরিজন এবং আগে কুষ্ঠ ছিল এমন সব ব্যক্তির সমাজে স্থান করে নেওয়া বড়ই কঠিন। অনেক ক্ষেত্রেই তারা তাদের মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এখনো অনেকেই কুষ্ঠরোগীদের বিষয়ে পুরোনো সংস্কারজনিত ‘অস্পৃশ্যতা’র (Stigma) মনোভাব পোষণ করে থাকে। তাই আজও এ রোগ চিকিত্সা সমস্যার চেয়ে একটি সামাজিক ও মানসিক সমস্যা। সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, ভুল বোঝাবুঝি, উদাসীনতা ইত্যাদি কারণে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত মানুষ ও তাদের পরিবারের লোকজন অনেক দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনার শিকার হয়ে জীবনকে বোঝাস্বরূপ মেনে নিয়ে কোনো মতে বেঁচে থাকেন। তাদের শারীরিক প্রতিবন্ধিতার চেয়ে বেশি বড় প্রতিবন্ধিতা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি।
এ অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন জরুরি। যাদের কুষ্ঠরোগ হয়, তাদের প্রতি বিরাজমান অস্পৃশ্যতার কারণে তাদের নিজেদের মধ্যেও তৈরি হয় এক আত্মধিক্কার (self-stigma)। এ কারণে কারও কুষ্ঠ হলে তিনি এ রোগ অন্যের কাছ থেকে গোপন রাখতে চান; এমনকি কেউ কেউ চিকিত্সাও গ্রহণ করতে চান না। এর পরিণতি হয় ভয়াবহ, ধীরে ধীরে রোগী প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়। শরীরের কুষ্ঠ ভালো হলেও মনের কুষ্ঠ যেন সারে না। কুষ্ঠের কারণ ও কুফল সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে জড়িত। তাই কুষ্ঠরোগের প্রসঙ্গটি একটা মানবাধিকার ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগের অবস্থান
২০০৮ সালের নতুন কুষ্ঠরোগী চিকিত্সা প্রদানের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ পঞ্চম অবস্থানে আছে। কয়েক বছর ধরে দেশে বছরে পাঁচ-ছয় হাজার নতুন নতুন কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে। প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আছে, যারা এর কারণে বিভিন্নভাবে ও মাত্রায় প্রতিবন্ধী হয়ে আছে। ১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্য থেকে এক লাখ ৮২ হাজার রোগী নিয়মিত চিকিত্সা নিয়ে সুস্থ হয়েছে। বর্তমানে আনুমানিক চার হাজার রোগী চিকিত্সাধীন। যদিও বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার অনুপাতে নথিভুক্ত রোগীর হার এক-এর কম) অর্জন করেছে, তদুপরি এখনো বার্ষিক রোগী শনাক্তকরণ সংখ্যা একটি উল্লেখযোগ্য পর্যায়েই রয়ে গেছে। কুষ্ঠ বাংলাদেশের সর্বত্র সমানভাবে বিস্তৃত নয়। দেখা গেছে যে কয়েকটি জেলায়, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় সব সময়ই দেশের অধিকসংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়ে আসছে। বর্তমানে নীলফামারী, গাইবান্ধা, সিলেট, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে এই পাঁচটি জেলায় কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব এখনো বেশি।
‘জাতীয় কুষ্ঠ উচ্ছেদ কর্মসূচি’র আওতাধীন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশে কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের সেবার কাজ চলছে। এ সেবা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে প্রদান করা হয়। কুষ্ঠরোগে আক্রান্তের সংখ্যা আরও কমিয়ে আনা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখায় দেশি-বিদেশি কর্মসূচি রয়েছে।
কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পক্ষে অ্যাডভোকেসি
কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের অবস্থার সামগ্রিক ইতিবাচক পরিবর্তনের স্বার্থে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সুশীল সমাজ, সরকারি ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী কিংবা পেশাদারি সব সংগঠন ও কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হলো: ১. কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এ বিষয়ে ইতিবাচকভাবে বিভিন্ন সংবাদ ও কুষ্ঠ বিষয়ে সাফল্যমূলক তথ্য ও খবরাখবর পরিবেশন করা আবশ্যক। দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বক্ষব্যাধি ক্লিনিক এবং দি লেপ্রসি মিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পসহ কুষ্ঠরোগের জন্য কাজ করে এমন সব সংস্থায় এ রোগের চিকিত্সা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়—এ তথ্য প্রচার করা গুরুত্বপূর্ণ।
২. আক্রান্ত ব্যক্তিরা যাতে নিজেদের সমস্যার কথা নিজেরাই বলতে পারে, তার জন্য তাদের ক্ষমতায়ন করা, যেন তারা স্থানীয় ও বৃহত্তর পরিমণ্ডলে তাদের মানবাধিকার অর্জনের জন্য চেষ্টা করতে পারে। তৃণমূল পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংগঠন তৈরিতে সাহায্য করা ও তাদের সঙ্গে কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের অধিকারের কথা নিজেরা বলতে না পারবে, ততক্ষণ তারা অধিকার লাভ করতে পারবে না। কমিউনিটি বেইজড রিহ্যাবিলিটেশনের মাধ্যমে কুষ্ঠরোগের শিকার দরিদ্র ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে আর্থসামাজিকভাবে পুনর্বাসন করার বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এভাবে তাদের অন্যের ওপর নির্ভর করার চেয়ে স্বনির্ভর হলে তাদের আত্মধিক্কার দূর হবে এবং এর মাধ্যমে Self-advocacy-ও হবে; তৃণমূল পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংগঠন তৈরিতে সাহায্য করা প্রয়োজন। এভাবে তারা আত্মধিক্কারের পরিবর্তে আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা লাভ করবে।
৩. কোন কোন ক্ষেত্রে রোগীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেসব বিষয় শনাক্ত করা দরকার। এ রোগ সম্পর্কে পুরোনো যে আইন আছে, যেমন: ১৮৯৮-এর লেপার্স অ্যাক্ট (Lepers Act 1898), তা বাতিল করা প্রয়োজন। আইনটি দ্বারা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাজের অন্য মানুষদের কাছ থেকে আলাদা রাখা হতো। তারা এখানে-সেখানে পালিয়ে বেড়াত ও বাঁচার জন্য ভিক্ষা করত। তাই তাদের গ্রেপ্তার করে সমাজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা হতো। এবং তাদের অনেক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হতো। সেকালে ওই আইনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা এখন বাতিল করা দরকার।
৪. বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি কুষ্ঠরোগেরও চিকিত্সার ব্যবস্থাপনা (Integration of treatment) থাকা উচিত। দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে কুষ্ঠরোগ ও তার চিকিত্সার বিষয়ে যথেষ্ট শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। কুষ্ঠরোগীরা যেন প্রয়োজনীয় চিকিত্সা পেতে পারে, তার স্বার্থে প্রতিটি মেডিকেল কলেজে ও নার্সিং ট্রেনিং প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে যথেষ্ট বাস্তবানুগ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।
সংশ্লিষ্ট সবার অবগতি ও বিবেচনার জন্য জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল-এর কুষ্ঠরোগ সম্পর্কিত নীতিমালা নিচে উল্লেখ করছি: ১. প্রতিটি স্বাক্ষরকারী দেশের (বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি) মানতে হবে যে কুষ্ঠরোগের কারণে বৈষম্য মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। ২. প্রতিটি দেশের সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে যেন কুষ্ঠরোগের কারণে ঘটা সব বৈষম্য দূর করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ৩. জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনারের দপ্তরকে অনুরোধ করা হয়েছে যেন তারা কুষ্ঠরোগকেন্দ্রিক মানবাধিকারমূলক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ৪. তাদের আরও অনুরোধ করা হয়েছে যেন তারা কুষ্ঠরোগ-সংক্রান্ত বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশ যে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তার ওপর গবেষণা চালান ও তথাদি সংগ্রহ করেন।
বিগত দুই বছরে জাতিসংঘ ও তার হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল অ্যাডভাইজরি কমিটি কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য দূর করার স্বার্থে অনেক কাজ করেছে। এসব মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দলিল ও পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশাবাদী হতে পারি যে দেশের সব মহলেই কুষ্ঠের কারণে ঘটিত প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনকে পরিপূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার স্বার্থে যথাসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। আসুন আমরা সবাই কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে সবাই কাজ করি।
রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী: লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি ও প্রমোশন বিভাগের পরিচালক।
এ অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন জরুরি। যাদের কুষ্ঠরোগ হয়, তাদের প্রতি বিরাজমান অস্পৃশ্যতার কারণে তাদের নিজেদের মধ্যেও তৈরি হয় এক আত্মধিক্কার (self-stigma)। এ কারণে কারও কুষ্ঠ হলে তিনি এ রোগ অন্যের কাছ থেকে গোপন রাখতে চান; এমনকি কেউ কেউ চিকিত্সাও গ্রহণ করতে চান না। এর পরিণতি হয় ভয়াবহ, ধীরে ধীরে রোগী প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়। শরীরের কুষ্ঠ ভালো হলেও মনের কুষ্ঠ যেন সারে না। কুষ্ঠের কারণ ও কুফল সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে জড়িত। তাই কুষ্ঠরোগের প্রসঙ্গটি একটা মানবাধিকার ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগের অবস্থান
২০০৮ সালের নতুন কুষ্ঠরোগী চিকিত্সা প্রদানের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ পঞ্চম অবস্থানে আছে। কয়েক বছর ধরে দেশে বছরে পাঁচ-ছয় হাজার নতুন নতুন কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে। প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আছে, যারা এর কারণে বিভিন্নভাবে ও মাত্রায় প্রতিবন্ধী হয়ে আছে। ১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্য থেকে এক লাখ ৮২ হাজার রোগী নিয়মিত চিকিত্সা নিয়ে সুস্থ হয়েছে। বর্তমানে আনুমানিক চার হাজার রোগী চিকিত্সাধীন। যদিও বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার অনুপাতে নথিভুক্ত রোগীর হার এক-এর কম) অর্জন করেছে, তদুপরি এখনো বার্ষিক রোগী শনাক্তকরণ সংখ্যা একটি উল্লেখযোগ্য পর্যায়েই রয়ে গেছে। কুষ্ঠ বাংলাদেশের সর্বত্র সমানভাবে বিস্তৃত নয়। দেখা গেছে যে কয়েকটি জেলায়, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় সব সময়ই দেশের অধিকসংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়ে আসছে। বর্তমানে নীলফামারী, গাইবান্ধা, সিলেট, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে এই পাঁচটি জেলায় কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব এখনো বেশি।
‘জাতীয় কুষ্ঠ উচ্ছেদ কর্মসূচি’র আওতাধীন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশে কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের সেবার কাজ চলছে। এ সেবা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে প্রদান করা হয়। কুষ্ঠরোগে আক্রান্তের সংখ্যা আরও কমিয়ে আনা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখায় দেশি-বিদেশি কর্মসূচি রয়েছে।
কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পক্ষে অ্যাডভোকেসি
কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের অবস্থার সামগ্রিক ইতিবাচক পরিবর্তনের স্বার্থে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সুশীল সমাজ, সরকারি ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী কিংবা পেশাদারি সব সংগঠন ও কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হলো: ১. কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এ বিষয়ে ইতিবাচকভাবে বিভিন্ন সংবাদ ও কুষ্ঠ বিষয়ে সাফল্যমূলক তথ্য ও খবরাখবর পরিবেশন করা আবশ্যক। দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বক্ষব্যাধি ক্লিনিক এবং দি লেপ্রসি মিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পসহ কুষ্ঠরোগের জন্য কাজ করে এমন সব সংস্থায় এ রোগের চিকিত্সা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়—এ তথ্য প্রচার করা গুরুত্বপূর্ণ।
২. আক্রান্ত ব্যক্তিরা যাতে নিজেদের সমস্যার কথা নিজেরাই বলতে পারে, তার জন্য তাদের ক্ষমতায়ন করা, যেন তারা স্থানীয় ও বৃহত্তর পরিমণ্ডলে তাদের মানবাধিকার অর্জনের জন্য চেষ্টা করতে পারে। তৃণমূল পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংগঠন তৈরিতে সাহায্য করা ও তাদের সঙ্গে কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের অধিকারের কথা নিজেরা বলতে না পারবে, ততক্ষণ তারা অধিকার লাভ করতে পারবে না। কমিউনিটি বেইজড রিহ্যাবিলিটেশনের মাধ্যমে কুষ্ঠরোগের শিকার দরিদ্র ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে আর্থসামাজিকভাবে পুনর্বাসন করার বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এভাবে তাদের অন্যের ওপর নির্ভর করার চেয়ে স্বনির্ভর হলে তাদের আত্মধিক্কার দূর হবে এবং এর মাধ্যমে Self-advocacy-ও হবে; তৃণমূল পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংগঠন তৈরিতে সাহায্য করা প্রয়োজন। এভাবে তারা আত্মধিক্কারের পরিবর্তে আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা লাভ করবে।
৩. কোন কোন ক্ষেত্রে রোগীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেসব বিষয় শনাক্ত করা দরকার। এ রোগ সম্পর্কে পুরোনো যে আইন আছে, যেমন: ১৮৯৮-এর লেপার্স অ্যাক্ট (Lepers Act 1898), তা বাতিল করা প্রয়োজন। আইনটি দ্বারা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাজের অন্য মানুষদের কাছ থেকে আলাদা রাখা হতো। তারা এখানে-সেখানে পালিয়ে বেড়াত ও বাঁচার জন্য ভিক্ষা করত। তাই তাদের গ্রেপ্তার করে সমাজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা হতো। এবং তাদের অনেক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হতো। সেকালে ওই আইনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা এখন বাতিল করা দরকার।
৪. বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি কুষ্ঠরোগেরও চিকিত্সার ব্যবস্থাপনা (Integration of treatment) থাকা উচিত। দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে কুষ্ঠরোগ ও তার চিকিত্সার বিষয়ে যথেষ্ট শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। কুষ্ঠরোগীরা যেন প্রয়োজনীয় চিকিত্সা পেতে পারে, তার স্বার্থে প্রতিটি মেডিকেল কলেজে ও নার্সিং ট্রেনিং প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে যথেষ্ট বাস্তবানুগ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।
সংশ্লিষ্ট সবার অবগতি ও বিবেচনার জন্য জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল-এর কুষ্ঠরোগ সম্পর্কিত নীতিমালা নিচে উল্লেখ করছি: ১. প্রতিটি স্বাক্ষরকারী দেশের (বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি) মানতে হবে যে কুষ্ঠরোগের কারণে বৈষম্য মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। ২. প্রতিটি দেশের সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে যেন কুষ্ঠরোগের কারণে ঘটা সব বৈষম্য দূর করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ৩. জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনারের দপ্তরকে অনুরোধ করা হয়েছে যেন তারা কুষ্ঠরোগকেন্দ্রিক মানবাধিকারমূলক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ৪. তাদের আরও অনুরোধ করা হয়েছে যেন তারা কুষ্ঠরোগ-সংক্রান্ত বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশ যে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তার ওপর গবেষণা চালান ও তথাদি সংগ্রহ করেন।
বিগত দুই বছরে জাতিসংঘ ও তার হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল অ্যাডভাইজরি কমিটি কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য দূর করার স্বার্থে অনেক কাজ করেছে। এসব মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দলিল ও পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশাবাদী হতে পারি যে দেশের সব মহলেই কুষ্ঠের কারণে ঘটিত প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনকে পরিপূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার স্বার্থে যথাসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। আসুন আমরা সবাই কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে সবাই কাজ করি।
রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী: লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি ও প্রমোশন বিভাগের পরিচালক।
No comments