যুক্তি তর্ক গল্প-প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর: নতুন সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ by আবুল মোমেন
ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সহজও নয়, স্বাভাবিকও নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দান, অস্ত্র সরবরাহ এবং চূড়ান্ত পর্বে ভারতীয় সেনাদের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ ছাড়াও ভারত তখন এক কোটি শরণার্থীর বোঝা বহন করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুই দেশের সম্পর্ক কখনো সহজ স্বাভাবিক হয়নি।
আমাদের স্বাধীনতার জন্য ভারতের এই বিশাল ভূমিকা ও বিপুল ত্যাগ ঠিকভাবে স্বীকৃত হয়নি।
প্রায়ই বাঁকাভাবে বলা হয়েছে, ভারত নিজের স্বার্থেই পাকিস্তানকে ভেঙেছে। এটা যে বাংলাদেশের বিবেচনা ও বিবেকের কথা হওয়া উচিত নয়, হতে পারে পাকিস্তানের পরাভূত মনের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া—সেটুকুও এই মানস বুঝতে অপারগ। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক—ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি। সম্পর্কের এতসব সদর্থক উপাদান ছাপিয়ে ভারত রয়ে গেল একটি জ্বলন্ত রাজনৈতিক ইস্যু। এটা আদতে আমাদের পাকিস্তানি উত্তরাধিকার। পাকিস্তানে একজন নাগরিকের দেশপ্রেমের পারদের ওঠানামা নির্ভর করে তার ভারত-বিরোধিতার মাত্রার ওপর। ফলে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত ও নিন্দিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ভারত-প্রেম আবিষ্কারের ভিত্তিতে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো মানুষও এই অপবাদ থেকে রেহাই পাননি। পাকিস্তান ভারত ও হিন্দুকে সমার্থক করে দেখেছে। তাই রবীন্দ্রনাথকে ঠেকিয়ে নজরুলকে বড় করে দেখতে চায় পাকিস্তানি মানস। তাঁরা যে নিজ নিজ প্রতিভায় স্বতন্ত্র মাহাত্ম্যে পরিপূর্ণ, বড়-ছোটর বিষয়টি মুখ্য নয়, তা বিবেচনায় থাকে না।
আটত্রিশ বছর পরও দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করে স্বদেশকে দখলমুক্ত করলেও পাকিস্তানি মানস থেকে মুক্তি মেলেনি আমাদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের পর বিএনপির প্রতিক্রিয়ায় তারই প্রকাশ ঘটছে।
তা বলে আমরা বলি না ভারতের সঙ্গে চোখ-কান বুজে গলবস্ত্র হয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হবে। তেমনি আবার আজ সময় এসেছে বাস্তবতার আলোকেই কথা বলা, সব বিষয় বিচার করা।
বাস্তব জগতে কোনো দেশ যেমন স্থায়ীভাবে বন্ধুদেশ নয়, তেমনি স্থায়ীভাবে শত্রুও কোনো দেশ নয়। সম্পর্কগুলোর মূল্যায়ন, নবায়ন ও পরিমার্জন প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সমাজে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা ধর্মীয় অঙ্গন এবং রাজনীতির মাঠ উভয়ই গরম রাখেন, তাঁদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রচারণার স্থায়ী প্রতিপক্ষ হলো হিন্দু ও ভারত। এমনটাই আমরা ৫০ বছর ধরে তাঁদের ওয়াজ-নসিহত, বক্তৃতা-বিবৃতিতে দেখে আসছি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তার মূল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী ও হিন্দুঘেঁষা দল হিসেবে চিহ্নিত করে জনমানসের ভারত-বিরোধিতার উপাদানটিকে পুঁজি করে রাজনীতি করতে চায়। এতে বিএনপির সঙ্গে ধর্মান্ধ মৌলবাদী দলের রাজনৈতিক পার্থক্য বিশেষ থাকে না। মানুষের মনের পুরোনো সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে চাঙা করে তোলা সহজ বলে বিএনপির এই রাজনৈতিক কৌশলের কারণে আমাদের রাজনীতিতে একদিকে নেতিবাচক উপাদান—ভারত ও হিন্দুর প্রতি সন্দেহ অবিশ্বাস, আর অন্যদিকে ভয় ও আতঙ্কের উপাদান—ইসলাম গেল গেল, সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হলো—যুক্ত হওয়ায় রাজনীতি থেকে যাচ্ছে অপরিণত ও ভঙ্গুর আর হয়ে পড়ছে তামাদি ও অকার্যকর।
ভারতের সঙ্গে আস্থার ও বন্ধুত্বের সম্পর্কই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। অবশ্য স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বন্ধুত্বও হয় না, কোনো সম্পর্কই গড়ে ওঠে না। কিন্তু স্বার্থটা যদি হয় দেশ ও মানুষ, বর্তমান ও ভবিষ্যত্ ছাপিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধতা তাহলে তা আদতে দলীয় স্বার্থ। ক্ষমতার ক্ষুদ্র স্বার্থে বাঁধা পড়ে মুসলিম লীগের বিনাশ দেখেছে এ দেশ। মুসলিম লীগ বস্তুত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তার মূল রাজনৈতিক প্রতিপাদ্য ও বক্তব্য প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে এবং রাজনীতির অসারতার চোরাবালিতে ডুবেই বিলুপ্ত হয়ে গেল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরের মাধ্যমে প্রধান প্রাপ্তি হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা। এটা স্থাপন বেশ কঠিনই ছিল। কারণ পঁচাত্তরের পর থেকে পাকিস্তানের আইএসআই এখানে সক্রিয় ছিল, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং অস্ত্রপ্রাপ্তির মাধ্যম হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। তদুপরি আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ পাঁচ বছরের শাসনামল ছাড়া বাকি সময়টা ভারতবৈরী পাকিস্তানি স্বার্থ হাসিলের দোসরের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের। তাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ হওয়ার উপায় ছিল না।
যা হোক, পারস্পরিক আস্থা হচ্ছে সমস্যা মেটানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সেটা এবারে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অর্জিত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এই আস্থার সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্কের নতুন সম্ভাবনাগুলোকে দেখব, নাকি অনাস্থাকেই টেনে বেড়াব। বিএনপি এবং কিছু ইসলামপন্থী দল অনাস্থাকেই পুঁজি করতে চাইছে। বুঝতে খুব অসুবিধা হয় না, গত দীর্ঘ ৩০ বছরে ভারতবিরোধী ও পাকিস্তানঘেঁষা যে রাজনীতি তারা দাঁড় করিয়েছিল তার অবসান হলে নিজেরা রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে পড়ে যাওয়ার ভয়ে আছে তারা। ফলে কী চুক্তি হলো, তার ভূমিকা কী হবে তা তলিয়ে না দেখেই তড়িঘড়ি প্রত্যাখ্যান করে জোরেশোরে ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চাইছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। যেন এ সুযোগ হাতছাড়া হলে তাদের রাজনীতি দেউলিয়া হয়ে পড়বে। বোঝা যায়, এটা আত্মবিশ্বাস হারানো ভীত ও বেদিশা মানুষের রাজনীতি। এটা প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি, যা সহজেই আক্রমণাত্মক রূপ নিতে পারে এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়। একুশে আগস্টের বোমা হামলা বিএনপি-জামায়াত জোটের এ রকমই ষড়যন্ত্র ও প্রতিক্রিয়ার রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ বলেই এখন মনে হচ্ছে।
মুশকিল হচ্ছে, বাস্তব ভৌগোলিক সম্পর্ক এবং সুদীর্ঘকালের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্কের কারণে ভারতকে এড়িয়ে আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া প্রায় অসম্ভব। ভারত আমাদের এড়িয়ে চললেও তার বিশেষ ক্ষতি নেই, কিন্তু আমাদের বিকল্প পথই নেই। তা বলে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমার স্বাতন্ত্র্য, মর্যাদা ও অধিকার অবশ্যই বজায় রাখতে ও আদায় করতে হবে। কিন্তু লক্ষ্য হবে এতকালের শত্রুতা-বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে আস্থা ও বন্ধুত্বের পর্ব শুরু করা। শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরকে সেদিক থেকে এক ঐতিহাসিক সফর বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধেও যে গ্রন্থি মোচন করা যায়নি, তা যেন এবারে শেখ হাসিনার সফরে ঘুচে গেল।
সাত হাজার কোটি টাকার ঋণ বা আড়াই শ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ সম্পর্কে কিছু খুঁটিনাটি প্রশ্ন থাকলেও জোরালো প্রতিবাদ উঠবে না। সন্ত্রাস দমনসংক্রান্ত চুক্তি নিয়েও বেশি আপত্তির সুযোগ নেই। প্রতিবাদ উঠবে চট্টগ্রাম-চালনা বন্দর ব্যবহার ও সড়ক যোগাযোগের প্রসঙ্গে।
ভারত এই সুবিধা দীর্ঘদিন ধরে চাইছে। তার উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যের পণ্য পরিবহনে বিপুল সুবিধা সে এতে পাবে। আর এই সুবিধা ভারতকে দিয়ে বাংলাদেশ ভালো ব্যবসা করবে, আয় করবে। শুধু তা-ই নয়, শেখ হাসিনা এই সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে নেপাল ও ভুটানের জন্য আমাদের বন্দর ব্যবহার এবং ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহারের সুবিধাও আদায় করে নিয়েছেন। এতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য বাণিজ্যের দিগন্ত আরও বিস্তৃত হয়ে গেল।
ভারত-বৈরিতার রাজনীতিকেরা এ প্রসঙ্গে অনেক যদির অবতারণা করে থাকেন—যদি ভারত আমাদের বন্দর দিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসে, যদি তারা ট্রানজিট-সুবিধাকে অস্ত্র চালানের কাজে ব্যবহার করে, যদি তারা বেনাপোল থেকে তামাবিল দিয়ে সামরিক সরঞ্জাম ও ব্যক্তি পরিবহন করে ইত্যাদি। প্রথমত, বন্দর আমাদের, এশিয়ান হাইওয়ের বাংলাদেশ অংশটুকুর মালিকানা আমাদের। আমাদের বন্দর ও সড়ক কী কাজে কোন পণ্য বা যাত্রীর জন্য ব্যবহূত হবে তা তো শর্তযুক্ত চুক্তির মাধ্যমেই নির্ণিত হবে। এর অন্যথা হলে আমরা চুক্তি বাতিল করব, ব্যবসা স্থগিত করব, প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ফোরামের দ্বারস্থ হব।
এটাও আমাদের বুঝতে হবে এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশের বন্দর ব্যবহার কোনো অভিনব ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়। মধ্যপ্রাচ্যে, ইউরোপে, আফ্রিকায় এ রকম দৃষ্টান্ত অনেক। তা ছাড়া, আজকের পৃথিবীর প্রবণতা ও প্রয়োজনীয়তা দুটোই বুঝতে হবে।
একদিকে আছে বিশ্বায়নের চাপ, পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো বৈশ্বিক সমস্যা আর অন্যদিকে দারিদ্র্য-অশিক্ষা-ক্ষুধা-বেকারত্ব-রোগ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে আঞ্চলিক সমঝোতা সহযোগিতার। জাতি ও দেশের বেঁচে থাকার জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা, আদানপ্রদান অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যুগের এই চাহিদা শেখ হাসিনা উপলব্ধি করেছেন বলেই প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আস্থা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির সময়ও বিএনপি ভারতবিরোধী ভাবাবেগকে পুঁজি করতে চেয়েছিল। খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ফেনী নদীর ওপাড় ভারতের অংশ হয়ে যাবে এবং পাসপোর্ট ভিসার প্রয়োজন হবে চট্টগ্রাম যেতে। এখনো তাঁদের প্রচারণায় এ মনোভাবই মুখ্য।
বিরোধিতার অস্ত্র হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মশতবার্ষিকী দুই দেশের যৌথভাবে উদযাপনের সিদ্ধান্তকেও কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি। বলছেন, নজরুল উপেক্ষিত হয়েছে। সার্ধশত অর্থাত্ জন্মের দেড় শ বছর একটি বড় উপলক্ষ যখন, কেবল ভারত-বাংলাদেশ নয়, রবীন্দ্র স্মরণে বিশ্বব্যাপী নানা অনুষ্ঠান হবে। সম্ভবত ইউনেসকোর উদ্যোগেও নানা দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে। এ উপলক্ষে তাঁর স্মৃতিধন্য দুই দেশ তাদের নিজ নিজ জাতীয় সংগীতের রচয়িতাকে নিয়ে যৌথ উদ্যোগে তাত্পর্যপূর্ণভাবে এ উপলক্ষ উদযাপন করবে তাতে ভয় পাওয়ার, নিন্দার কী থাকতে পারে বোঝা গেল না। এতে নজরুল উপেক্ষিত হচ্ছেন বলে সমালোচনার অবকাশ কোথায়, যদি না তাঁর এ রকম একটি উপলক্ষ এলে তাঁকে উপেক্ষা করা না হয়?
আমরা নিশ্চিত জানি ইরানের জাতীয় কবি ফিরদৌসির জন্মবার্ষিকী ইরানের সঙ্গে যৌথভাবে পালন করলে এ প্রশ্ন উঠত না। ইংল্যান্ডের সঙ্গে শেক্সপিয়রের জন্মবার্ষিকীর ক্ষেত্রেও কোনো সমস্যা হতো বলে মনে হয় না। কিন্তু যাকে আমাদের মনন-মানস গড়ে তোলার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাঁর ক্ষেত্রেই বারবার এ রকম আপত্তি উঠতে দেখা যায়। এটা পাকিস্তানি মনোবৃত্তি, এই ভূত এখনো তাড়া করছে, এটা বেশ অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব। তবে যুক্তিযুক্ত একটা বিষয় তাঁরা তুলেছেন, সেটি হলো সীমান্তে বিএসএফের বাড়াবাড়ি এবং বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ইস্যুটি। বিষয়টি আলোচনায় তুলতে হবে এবং অপকর্মটি বন্ধ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানাতে চাই যে সাধারণভাবে আমরা কিন্তু আমাদের বেকার ভাগ্যান্বেষী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপজ্জনক পথে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা ও তার পরিণাম নিয়ে ততটা ভাবিত নই। আমাদের বহু তরুণ ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবৈধ ও পলাতকের জীবন বেছে নিচ্ছে। এই বিপজ্জনক ‘সুযোগের’ জন্যও তারা বহু অর্থ ব্যয় করছে। অনেকে চরম অমানবিক পরিবেশে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। বরফে, মরুতে, উত্তাল সমুদ্রে কত তরুণ প্রাণ হারাচ্ছে আমরা খবর রাখি না। পত্রিকায় খবরে বেরিয়েছে শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকেই প্রতি মাসে আট-দশজন শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরে আসেন। প্রায় কোনো মৃত্যুই স্বাভাবিক নয়। ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা যায়, প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে ৪০০ নারী পাচার হয়ে যায়। নিউজ নেটওয়ার্কের ২০০০ সালের জরিপে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর দেশ থেকে ২৫ হাজার নারী পাচার হয়ে থাকে। একটি বেসরকারি সংস্থা শুধু পাকিস্তানের পতিতালয়ে এক লাখ ৬৫ হাজার বাংলাদেশি নারীকে শনাক্ত করেছে। এই পরিণতি তো এক একটি জীবনের অবসানের শামিল। এই নীরব হত্যাকাণ্ডকে আমরা নীরবতা ও উপেক্ষার মাধ্যমে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি।
আজ যদি ১০০ জন বেকার তরুণকে—সে গ্রাম বা শহরের, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, যে রকমই হোক না কেন—বলা হয় একটু ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পেরুতে পারলেই ভালো ব্যবসা, ভালো চাকরির সুযোগ আছে তাহলে, আমার ধারণা, ১০০ জনই সেই ঝুঁকি নেবে। আমরা কি নিয়মিত পড়ছি না কাগজে জীবনের কী ভয়াবহ রকম ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষিত তরুণেরাও বরফ, মরু, সমুদ্র পাড়ি দিতে যায়—এমনকি দালাল-প্রতারকদের ধারকর্জ করে বিপুল টাকা দিয়ে? আমরা কি জানি না প্রতারণাপূর্ণ বিয়ের মাধ্যমে কত দরিদ্র বাবা-মা প্রতারকদের হাতে সঁপে দিয়ে তাদের কন্যার সর্বনাশ করছেন?
অনিয়মের অপঘাত বন্ধ করতে হলে আমাদের দিক থেকেও কিছু করার আছে। দেশটাকে সবার জন্য বাসযোগ্য করতে হবে এবং সবার জীবনের বিকাশের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সে কাজ গঠনমূলক সমালোচনার পথ ছেড়ে যেকোনো মূল্যে সরকার-বিরোধিতায় হবে না। প্রতিবেশীর সঙ্গে অযথা অনাস্থা ও বৈরিতার পরিবেশ তৈরি করে হবে না, কঠোর আন্দোলনেও আসবে না। সেটা শুধু আস্থা ও বন্ধুত্বের পরিবেশ এবং জনকল্যাণমুখী গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব।
সেদিক থেকে বলব, শেখ হাসিনার ভারত সফর পরিবর্তনের পথে একটি ইতিবাচক মাইলফলক হতে পারবে। সম্ভাবনাটাকে কাজে পরিণত করতে নেতৃত্ব দিতে হবে সরকারকে, সরকার-প্রধান শেখ হাসিনাকে। বিরোধী দলকেও পুরোনো অভ্যাস ও গতানুগতিক রাজনীতির বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে। বলা যায়, শেখ হাসিনা এই সফর ও চুক্তি সমঝোতার মাধ্যমে আদতে বিরোধিতার রাজনীতির পথ খুলে দেননি, বরং চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন সে পথ পরিহার করে সহযোগিতার গঠনমূলক নতুন ধারার রাজনীতির মাধ্যমে দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের। চ্যালেঞ্জ অনুধাবনে ও কৌশল নির্ধারণে ভুল হলে নিশ্চয় তার মূল্য বিএনপিকেই দিতে হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
প্রায়ই বাঁকাভাবে বলা হয়েছে, ভারত নিজের স্বার্থেই পাকিস্তানকে ভেঙেছে। এটা যে বাংলাদেশের বিবেচনা ও বিবেকের কথা হওয়া উচিত নয়, হতে পারে পাকিস্তানের পরাভূত মনের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া—সেটুকুও এই মানস বুঝতে অপারগ। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক—ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি। সম্পর্কের এতসব সদর্থক উপাদান ছাপিয়ে ভারত রয়ে গেল একটি জ্বলন্ত রাজনৈতিক ইস্যু। এটা আদতে আমাদের পাকিস্তানি উত্তরাধিকার। পাকিস্তানে একজন নাগরিকের দেশপ্রেমের পারদের ওঠানামা নির্ভর করে তার ভারত-বিরোধিতার মাত্রার ওপর। ফলে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত ও নিন্দিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ভারত-প্রেম আবিষ্কারের ভিত্তিতে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো মানুষও এই অপবাদ থেকে রেহাই পাননি। পাকিস্তান ভারত ও হিন্দুকে সমার্থক করে দেখেছে। তাই রবীন্দ্রনাথকে ঠেকিয়ে নজরুলকে বড় করে দেখতে চায় পাকিস্তানি মানস। তাঁরা যে নিজ নিজ প্রতিভায় স্বতন্ত্র মাহাত্ম্যে পরিপূর্ণ, বড়-ছোটর বিষয়টি মুখ্য নয়, তা বিবেচনায় থাকে না।
আটত্রিশ বছর পরও দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করে স্বদেশকে দখলমুক্ত করলেও পাকিস্তানি মানস থেকে মুক্তি মেলেনি আমাদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের পর বিএনপির প্রতিক্রিয়ায় তারই প্রকাশ ঘটছে।
তা বলে আমরা বলি না ভারতের সঙ্গে চোখ-কান বুজে গলবস্ত্র হয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হবে। তেমনি আবার আজ সময় এসেছে বাস্তবতার আলোকেই কথা বলা, সব বিষয় বিচার করা।
বাস্তব জগতে কোনো দেশ যেমন স্থায়ীভাবে বন্ধুদেশ নয়, তেমনি স্থায়ীভাবে শত্রুও কোনো দেশ নয়। সম্পর্কগুলোর মূল্যায়ন, নবায়ন ও পরিমার্জন প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সমাজে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা ধর্মীয় অঙ্গন এবং রাজনীতির মাঠ উভয়ই গরম রাখেন, তাঁদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রচারণার স্থায়ী প্রতিপক্ষ হলো হিন্দু ও ভারত। এমনটাই আমরা ৫০ বছর ধরে তাঁদের ওয়াজ-নসিহত, বক্তৃতা-বিবৃতিতে দেখে আসছি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তার মূল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী ও হিন্দুঘেঁষা দল হিসেবে চিহ্নিত করে জনমানসের ভারত-বিরোধিতার উপাদানটিকে পুঁজি করে রাজনীতি করতে চায়। এতে বিএনপির সঙ্গে ধর্মান্ধ মৌলবাদী দলের রাজনৈতিক পার্থক্য বিশেষ থাকে না। মানুষের মনের পুরোনো সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে চাঙা করে তোলা সহজ বলে বিএনপির এই রাজনৈতিক কৌশলের কারণে আমাদের রাজনীতিতে একদিকে নেতিবাচক উপাদান—ভারত ও হিন্দুর প্রতি সন্দেহ অবিশ্বাস, আর অন্যদিকে ভয় ও আতঙ্কের উপাদান—ইসলাম গেল গেল, সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হলো—যুক্ত হওয়ায় রাজনীতি থেকে যাচ্ছে অপরিণত ও ভঙ্গুর আর হয়ে পড়ছে তামাদি ও অকার্যকর।
ভারতের সঙ্গে আস্থার ও বন্ধুত্বের সম্পর্কই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। অবশ্য স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বন্ধুত্বও হয় না, কোনো সম্পর্কই গড়ে ওঠে না। কিন্তু স্বার্থটা যদি হয় দেশ ও মানুষ, বর্তমান ও ভবিষ্যত্ ছাপিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধতা তাহলে তা আদতে দলীয় স্বার্থ। ক্ষমতার ক্ষুদ্র স্বার্থে বাঁধা পড়ে মুসলিম লীগের বিনাশ দেখেছে এ দেশ। মুসলিম লীগ বস্তুত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তার মূল রাজনৈতিক প্রতিপাদ্য ও বক্তব্য প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে এবং রাজনীতির অসারতার চোরাবালিতে ডুবেই বিলুপ্ত হয়ে গেল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরের মাধ্যমে প্রধান প্রাপ্তি হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা। এটা স্থাপন বেশ কঠিনই ছিল। কারণ পঁচাত্তরের পর থেকে পাকিস্তানের আইএসআই এখানে সক্রিয় ছিল, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং অস্ত্রপ্রাপ্তির মাধ্যম হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। তদুপরি আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ পাঁচ বছরের শাসনামল ছাড়া বাকি সময়টা ভারতবৈরী পাকিস্তানি স্বার্থ হাসিলের দোসরের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের। তাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ হওয়ার উপায় ছিল না।
যা হোক, পারস্পরিক আস্থা হচ্ছে সমস্যা মেটানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সেটা এবারে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অর্জিত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এই আস্থার সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্কের নতুন সম্ভাবনাগুলোকে দেখব, নাকি অনাস্থাকেই টেনে বেড়াব। বিএনপি এবং কিছু ইসলামপন্থী দল অনাস্থাকেই পুঁজি করতে চাইছে। বুঝতে খুব অসুবিধা হয় না, গত দীর্ঘ ৩০ বছরে ভারতবিরোধী ও পাকিস্তানঘেঁষা যে রাজনীতি তারা দাঁড় করিয়েছিল তার অবসান হলে নিজেরা রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে পড়ে যাওয়ার ভয়ে আছে তারা। ফলে কী চুক্তি হলো, তার ভূমিকা কী হবে তা তলিয়ে না দেখেই তড়িঘড়ি প্রত্যাখ্যান করে জোরেশোরে ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চাইছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। যেন এ সুযোগ হাতছাড়া হলে তাদের রাজনীতি দেউলিয়া হয়ে পড়বে। বোঝা যায়, এটা আত্মবিশ্বাস হারানো ভীত ও বেদিশা মানুষের রাজনীতি। এটা প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি, যা সহজেই আক্রমণাত্মক রূপ নিতে পারে এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়। একুশে আগস্টের বোমা হামলা বিএনপি-জামায়াত জোটের এ রকমই ষড়যন্ত্র ও প্রতিক্রিয়ার রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ বলেই এখন মনে হচ্ছে।
মুশকিল হচ্ছে, বাস্তব ভৌগোলিক সম্পর্ক এবং সুদীর্ঘকালের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্কের কারণে ভারতকে এড়িয়ে আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া প্রায় অসম্ভব। ভারত আমাদের এড়িয়ে চললেও তার বিশেষ ক্ষতি নেই, কিন্তু আমাদের বিকল্প পথই নেই। তা বলে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমার স্বাতন্ত্র্য, মর্যাদা ও অধিকার অবশ্যই বজায় রাখতে ও আদায় করতে হবে। কিন্তু লক্ষ্য হবে এতকালের শত্রুতা-বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে আস্থা ও বন্ধুত্বের পর্ব শুরু করা। শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরকে সেদিক থেকে এক ঐতিহাসিক সফর বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধেও যে গ্রন্থি মোচন করা যায়নি, তা যেন এবারে শেখ হাসিনার সফরে ঘুচে গেল।
সাত হাজার কোটি টাকার ঋণ বা আড়াই শ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ সম্পর্কে কিছু খুঁটিনাটি প্রশ্ন থাকলেও জোরালো প্রতিবাদ উঠবে না। সন্ত্রাস দমনসংক্রান্ত চুক্তি নিয়েও বেশি আপত্তির সুযোগ নেই। প্রতিবাদ উঠবে চট্টগ্রাম-চালনা বন্দর ব্যবহার ও সড়ক যোগাযোগের প্রসঙ্গে।
ভারত এই সুবিধা দীর্ঘদিন ধরে চাইছে। তার উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যের পণ্য পরিবহনে বিপুল সুবিধা সে এতে পাবে। আর এই সুবিধা ভারতকে দিয়ে বাংলাদেশ ভালো ব্যবসা করবে, আয় করবে। শুধু তা-ই নয়, শেখ হাসিনা এই সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে নেপাল ও ভুটানের জন্য আমাদের বন্দর ব্যবহার এবং ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহারের সুবিধাও আদায় করে নিয়েছেন। এতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য বাণিজ্যের দিগন্ত আরও বিস্তৃত হয়ে গেল।
ভারত-বৈরিতার রাজনীতিকেরা এ প্রসঙ্গে অনেক যদির অবতারণা করে থাকেন—যদি ভারত আমাদের বন্দর দিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসে, যদি তারা ট্রানজিট-সুবিধাকে অস্ত্র চালানের কাজে ব্যবহার করে, যদি তারা বেনাপোল থেকে তামাবিল দিয়ে সামরিক সরঞ্জাম ও ব্যক্তি পরিবহন করে ইত্যাদি। প্রথমত, বন্দর আমাদের, এশিয়ান হাইওয়ের বাংলাদেশ অংশটুকুর মালিকানা আমাদের। আমাদের বন্দর ও সড়ক কী কাজে কোন পণ্য বা যাত্রীর জন্য ব্যবহূত হবে তা তো শর্তযুক্ত চুক্তির মাধ্যমেই নির্ণিত হবে। এর অন্যথা হলে আমরা চুক্তি বাতিল করব, ব্যবসা স্থগিত করব, প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ফোরামের দ্বারস্থ হব।
এটাও আমাদের বুঝতে হবে এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশের বন্দর ব্যবহার কোনো অভিনব ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়। মধ্যপ্রাচ্যে, ইউরোপে, আফ্রিকায় এ রকম দৃষ্টান্ত অনেক। তা ছাড়া, আজকের পৃথিবীর প্রবণতা ও প্রয়োজনীয়তা দুটোই বুঝতে হবে।
একদিকে আছে বিশ্বায়নের চাপ, পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো বৈশ্বিক সমস্যা আর অন্যদিকে দারিদ্র্য-অশিক্ষা-ক্ষুধা-বেকারত্ব-রোগ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে আঞ্চলিক সমঝোতা সহযোগিতার। জাতি ও দেশের বেঁচে থাকার জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা, আদানপ্রদান অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যুগের এই চাহিদা শেখ হাসিনা উপলব্ধি করেছেন বলেই প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আস্থা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির সময়ও বিএনপি ভারতবিরোধী ভাবাবেগকে পুঁজি করতে চেয়েছিল। খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ফেনী নদীর ওপাড় ভারতের অংশ হয়ে যাবে এবং পাসপোর্ট ভিসার প্রয়োজন হবে চট্টগ্রাম যেতে। এখনো তাঁদের প্রচারণায় এ মনোভাবই মুখ্য।
বিরোধিতার অস্ত্র হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মশতবার্ষিকী দুই দেশের যৌথভাবে উদযাপনের সিদ্ধান্তকেও কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি। বলছেন, নজরুল উপেক্ষিত হয়েছে। সার্ধশত অর্থাত্ জন্মের দেড় শ বছর একটি বড় উপলক্ষ যখন, কেবল ভারত-বাংলাদেশ নয়, রবীন্দ্র স্মরণে বিশ্বব্যাপী নানা অনুষ্ঠান হবে। সম্ভবত ইউনেসকোর উদ্যোগেও নানা দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে। এ উপলক্ষে তাঁর স্মৃতিধন্য দুই দেশ তাদের নিজ নিজ জাতীয় সংগীতের রচয়িতাকে নিয়ে যৌথ উদ্যোগে তাত্পর্যপূর্ণভাবে এ উপলক্ষ উদযাপন করবে তাতে ভয় পাওয়ার, নিন্দার কী থাকতে পারে বোঝা গেল না। এতে নজরুল উপেক্ষিত হচ্ছেন বলে সমালোচনার অবকাশ কোথায়, যদি না তাঁর এ রকম একটি উপলক্ষ এলে তাঁকে উপেক্ষা করা না হয়?
আমরা নিশ্চিত জানি ইরানের জাতীয় কবি ফিরদৌসির জন্মবার্ষিকী ইরানের সঙ্গে যৌথভাবে পালন করলে এ প্রশ্ন উঠত না। ইংল্যান্ডের সঙ্গে শেক্সপিয়রের জন্মবার্ষিকীর ক্ষেত্রেও কোনো সমস্যা হতো বলে মনে হয় না। কিন্তু যাকে আমাদের মনন-মানস গড়ে তোলার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাঁর ক্ষেত্রেই বারবার এ রকম আপত্তি উঠতে দেখা যায়। এটা পাকিস্তানি মনোবৃত্তি, এই ভূত এখনো তাড়া করছে, এটা বেশ অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব। তবে যুক্তিযুক্ত একটা বিষয় তাঁরা তুলেছেন, সেটি হলো সীমান্তে বিএসএফের বাড়াবাড়ি এবং বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ইস্যুটি। বিষয়টি আলোচনায় তুলতে হবে এবং অপকর্মটি বন্ধ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানাতে চাই যে সাধারণভাবে আমরা কিন্তু আমাদের বেকার ভাগ্যান্বেষী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপজ্জনক পথে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা ও তার পরিণাম নিয়ে ততটা ভাবিত নই। আমাদের বহু তরুণ ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবৈধ ও পলাতকের জীবন বেছে নিচ্ছে। এই বিপজ্জনক ‘সুযোগের’ জন্যও তারা বহু অর্থ ব্যয় করছে। অনেকে চরম অমানবিক পরিবেশে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। বরফে, মরুতে, উত্তাল সমুদ্রে কত তরুণ প্রাণ হারাচ্ছে আমরা খবর রাখি না। পত্রিকায় খবরে বেরিয়েছে শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকেই প্রতি মাসে আট-দশজন শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরে আসেন। প্রায় কোনো মৃত্যুই স্বাভাবিক নয়। ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা যায়, প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে ৪০০ নারী পাচার হয়ে যায়। নিউজ নেটওয়ার্কের ২০০০ সালের জরিপে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর দেশ থেকে ২৫ হাজার নারী পাচার হয়ে থাকে। একটি বেসরকারি সংস্থা শুধু পাকিস্তানের পতিতালয়ে এক লাখ ৬৫ হাজার বাংলাদেশি নারীকে শনাক্ত করেছে। এই পরিণতি তো এক একটি জীবনের অবসানের শামিল। এই নীরব হত্যাকাণ্ডকে আমরা নীরবতা ও উপেক্ষার মাধ্যমে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি।
আজ যদি ১০০ জন বেকার তরুণকে—সে গ্রাম বা শহরের, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, যে রকমই হোক না কেন—বলা হয় একটু ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পেরুতে পারলেই ভালো ব্যবসা, ভালো চাকরির সুযোগ আছে তাহলে, আমার ধারণা, ১০০ জনই সেই ঝুঁকি নেবে। আমরা কি নিয়মিত পড়ছি না কাগজে জীবনের কী ভয়াবহ রকম ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষিত তরুণেরাও বরফ, মরু, সমুদ্র পাড়ি দিতে যায়—এমনকি দালাল-প্রতারকদের ধারকর্জ করে বিপুল টাকা দিয়ে? আমরা কি জানি না প্রতারণাপূর্ণ বিয়ের মাধ্যমে কত দরিদ্র বাবা-মা প্রতারকদের হাতে সঁপে দিয়ে তাদের কন্যার সর্বনাশ করছেন?
অনিয়মের অপঘাত বন্ধ করতে হলে আমাদের দিক থেকেও কিছু করার আছে। দেশটাকে সবার জন্য বাসযোগ্য করতে হবে এবং সবার জীবনের বিকাশের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সে কাজ গঠনমূলক সমালোচনার পথ ছেড়ে যেকোনো মূল্যে সরকার-বিরোধিতায় হবে না। প্রতিবেশীর সঙ্গে অযথা অনাস্থা ও বৈরিতার পরিবেশ তৈরি করে হবে না, কঠোর আন্দোলনেও আসবে না। সেটা শুধু আস্থা ও বন্ধুত্বের পরিবেশ এবং জনকল্যাণমুখী গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব।
সেদিক থেকে বলব, শেখ হাসিনার ভারত সফর পরিবর্তনের পথে একটি ইতিবাচক মাইলফলক হতে পারবে। সম্ভাবনাটাকে কাজে পরিণত করতে নেতৃত্ব দিতে হবে সরকারকে, সরকার-প্রধান শেখ হাসিনাকে। বিরোধী দলকেও পুরোনো অভ্যাস ও গতানুগতিক রাজনীতির বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে। বলা যায়, শেখ হাসিনা এই সফর ও চুক্তি সমঝোতার মাধ্যমে আদতে বিরোধিতার রাজনীতির পথ খুলে দেননি, বরং চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন সে পথ পরিহার করে সহযোগিতার গঠনমূলক নতুন ধারার রাজনীতির মাধ্যমে দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের। চ্যালেঞ্জ অনুধাবনে ও কৌশল নির্ধারণে ভুল হলে নিশ্চয় তার মূল্য বিএনপিকেই দিতে হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments