অরণ্যে রোদন-মনেরে আজ কহ যে... by আনিসুল হক
আমাদের একজন বন্ধু মারা গেছে। সে আমার মেয়েরই বয়সী। বলতে পারতাম, আমার কন্যাস্থানীয় একজন মারা গেছে। কিন্তু আমার মেয়েও তো আমার বন্ধুও। তাই ওই কিশোরীর মৃত্যু আমার মধ্যে একজন বন্ধুকে হারানোর বেদনাই জাগিয়ে তুলেছে।
প্রথম কথা হলো, এই মৃত্যুটা অপ্রয়োজনীয়। এই মৃত্যু মোটেও অনিবার্য বা অপরিহার্য ছিল না। ক্লাস নাইনে পড়া নাসফিয়া আপন পিংকির অকাল প্রস্থানের কথাই আমি বলছি। আমাদের এই বন্ধুটি আর আমাদের মধ্যে নেই। তার বয়স হয়েছিল মাত্র ১৪। সে ক্লাস নাইনে পড়ত। সে ছিল ভালো ছাত্রী। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে সে পাঠ্যপুস্তক গ্রহণ করেছিল। তার ছবি কাগজে ছাপা হয়েছিল। ক্লাসের দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল মেয়েটি।
এই মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। সে আর আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে নেই। তার নাকি শখ ছিল সে এমবিএ পড়বে। নতুন ক্লাসে যাওয়ার জন্য তার স্কুলের পোশাক পড়ে আছে দরজির দোকানে। শুধু পিংকি নেই। শ্যামলী আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের একটা প্রাণবন্ত ছাত্রীর এই অকারণ চলে যাওয়ার বেদনা সত্যি আমাদের পক্ষে সহ্য করা কঠিন।
আমাদের দুঃখ কোনো সান্ত্বনা মানে না। কারণ পিংকি আত্মহত্যা করেছে। যাওয়ার আগে সে একটা চিরকুট লিখে রেখে গেছে। চিরকুটটা সে লিখেছে তার দাদির উদ্দেশে। তাতে সে বলেছে, তার মৃত্যুর জন্য পরিবার দায়ী নয়। সে যা বলছে তার ভাবার্থ এই যে দুষ্টুমি করতে গিয়ে তার হাতকাটা গেছে। সে জন্য সে ব্যান্ডেজ কিনতে গিয়েছিল ওষুধের দোকানে। সেখানে মুরাদ নামের এক ছেলে এই ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করেছে আর তাকে চড় মেরেছে। তার জন্য যাতে পরিবারের মানসম্মান না যায়, সে জন্য সে ফাঁসি নিয়েছে।
খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে, মুরাদ বখাটে ছেলে। পিংকির অভিভাবক ও চাচা তেমনটাই বলছেন যে পিংকির চলার পথে মুরাদ তাকে উত্ত্যক্ত করত। সে তাকে চড় মারায় পিংকি আত্মহত্যা করেছে। আর মুরাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পিংকির সঙ্গে তার প্রেম ছিল, পিংকি আবেগের বশে তার হাত কেটেছে, সেটা দেখে আবেগের বশে মুরাদ পিংকিকে চড় মেরেছে, তারই পরিণতিতে পিংকির এই আত্মহত্যা।
১৯ জানুয়ারি ২০১০ ঢাকার শ্যামলী এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনায় মামলা হয়েছে, মুরাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তদন্ত চলছে। মুরাদ বখাটে নাকি পিংকির প্রেমিক, পিংকির প্রেম করার বয়স হয়েছিল কি না, মুরাদ প্রেমিক হলেই তাকে মারতে পারে কি না, পিংকির এই অকাল প্রয়াণের পেছনে মুরাদের দায় কতটুকু—এসব তদন্ত ও বিচারে বেরিয়ে আসবে। সেই তদন্ত সুষ্ঠুভাবে হোক, নিরপেক্ষভাবে হোক, আমরা যাকে বলি ‘গণমাধ্যমের বিচার’ বা ‘মিডিয়া ট্রায়াল’, অর্থাত্ বিচার হওয়ার আগেই একজনকে দায়ী করে ব্যাপক প্রচারণা চালানো, সেটাও করতে চাই না।
আমরা যেটা বলতে চাই, আমার বন্ধুদের, আমার মেয়ে আর তার বন্ধুদের, আমার বোনদের, আমার ভাইবোন-সন্তানদের, এসো বেঁচে থাকি। আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়, বরং সমাধানের পথ বেরোনোর আগেই একটা নতুন সমস্যা তৈরি করা।
আমরা জানি, আমাদের সমাজটা পুরুষশাসিত। এই সমাজে মেয়েদের চলাফেরা করা কঠিন। কথাবার্তা বলা কঠিন। স্বাধীন পেশা বেছে নেওয়া কঠিন। তাই বলে আমরা তো লড়াই করার আগেই হেরে যেতে পারি না। অনেক কঠিন সময় আসবে, সুসময়ও আসবে। মানুষের জীবনে চড়াই-উতরাই থাকেই। আজকে যদি মনে হয়, আমি খুবই দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, নিশ্চিত থাকতে পারো, কালকে অনেক সুন্দর সময় আসবে, যখন আমরা প্রাণভরে হাসতে পারব; যখন কেবল নিজের জীবনটা তো সুন্দর মনে হবেই, মনে হবে, আমার জন্য চারপাশের মানুষের জীবনও সুন্দর হয়ে উঠছে।
পিংকির চিরকুটটায় আসি। ও লিখেছে, ‘আমার জন্য যাতে তোমাদের মানসম্মান না যায় তার জন্য আমি ফাঁসি দিলাম।’ ও চেয়েছিল অন্যের দুঃখ লাঘব করতে, পরিবারের অন্যদের মানসম্মান রক্ষা করতে, কিন্তু ওর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কি সেটা সে পারল? স্বজনদের দুঃখ-কষ্ট কি কমল?
আমরা জানি, এ বয়সের ছেলেমেয়েদের আবেগ বড় তীব্র থাকে। রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।...স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো আধো কথা ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি, এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা মাত্র।...সেও সর্বদা মনে মনে বুঝিতে পারে, পৃথিবীর কোথাও সে ঠিক খাপ খাইতেছে না; এ জন্য আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সর্বদা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া থাকে। অথচ এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিত্ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এ সময়ে যদি সে কোনো সহূদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ বা সখ্য লাভ করিতে পারে, তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না, কারণ সেটা সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে।’
তারা বড় হচ্ছে, অথচ কেউ তাদের বড় ভাবে না; তাদেরও হূদয়সংক্রান্ত জটিলতা হতে পারে, সেটাকে কেউ খুব গুরুত্ব দেয় না, বরং কঠোর ভাষায় ও পদ্ধতিতে এ ব্যাপারগুলো গুঁড়িয়ে দিতে চায় সবাই। এসব সমস্যা বড়দের কাছে হয় হাস্যকর, নয়তো খুবই আপত্তিকর, কিন্তু ওটা যে ওই বয়সীদের জন্য একটা বাস্তবতা আর সমস্যা, সেটা কেউ বুঝতে চায় না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, স্নেহ দেওয়া হলে লোকে তাকে বলে প্রশ্রয় দেওয়া।
আজ তাই আমাদের অভিভাবকদের বলব, লোকের কথা বা প্রচলিত সংস্কারের বশবর্তী না হয়ে আপনার কিশোর-তরুণ ছেলে বা মেয়েটিকে, ভাই বা বোনটিকে, ভাগ্নে বা ভাগ্নিকে আপনি একটু প্রশ্রয় দিন। শিক্ষকদের বলব, অভিভাবকদের বলব, আপনি আপনার এই কিশোর-তরুণটির বন্ধু হোন। শুধু এটা কোরো না, ওটা কোরো না; বাবা-মায়ের মুখে কালি মেখো না, না বলে তার প্রকৃত বন্ধু হয়ে তার সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনুন। তার মনের ব্যথা ভাগ করে নিন। দুঃখ ভাগ করে নিলে কমে, আনন্দ ভাগ করে নিলে বাড়ে।
আর আছে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা। আমরা কারও নিরাপত্তা দিতে পারি না, নারীদের তো নয়ই, কিশোরী-তরুণদেরও নয়। কত কত আত্মহত্যার কথা মনে পড়ে। সেই যে খুলনার খালিশপুর এলাকায় রুমি আত্মহত্যা করল এক বৈশাখী দুপুরে, সে তো বাড়ি পর্যন্ত এসে বখাটেরা উপদ্রব করেছিল বলে, গাইবান্ধায় বখাটেদের ধাওয়া খেয়ে পানিতে পড়ে মারা গেল ছোট্ট মেয়ে তৃষা, নারায়ণগঞ্জ চারুকলা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী সিমি মারা গেল পাড়ার সামাজিক শৃঙ্খলারক্ষক বখাটেদের খোঁটা সইতে না পেরে, তার অপরাধ ছিল সে কেন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার বাসায় ফিরতে বেশি রাত করে। এসব মৃত্যুর কথা যতবার মনে পড়ে, ততবার আমরা মন খারাপ করি, আমাদের সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করি। এই অসুন্দর, সাম্যহীন সমাজটাকে আরেকটু সুন্দর, আরেকটু মানবিক, আরেকটু নারীবান্ধব করার সংগ্রামে আমরা শামিল হই, অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হোক সে ব্যাপারে সোচ্চার থাকি। কিন্তু তবুও বলি, বারবার বলি, আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়। আমাদের যে সংগ্রাম বখাটেদের বিরুদ্ধে, অসুন্দরের বিরুদ্ধে, এই মৃত্যু সেই লড়াইয়ে আমাদের জয়লাভ করতে সাহায্য করে না। আমাদের হারিয়ে দেয়। আমার বন্ধুদের বলি, আমার বোনদের বলি, আমার মেয়েদের বলি, আমাদের অসংখ্য কিশোর-তরুণ ভাইবোন-বন্ধুকে বলি, মরবে কেন? বাঁচো। প্রতিবাদ করো। রুখে দাঁড়াও। কথা বলো। তোমার কথা, তোমার বেদনা কারও সঙ্গে ভাগ করে নাও। মনে রাখবে, তোমরা একা নও। কেউ না কেউ এই পৃথিবীতে আছে, যে তোমার এই বেদনা বুঝতে পারবে।
প্রেম হবে, প্রেম ভেঙেও যাবে; প্রেম হবে না, প্রত্যাখ্যানের বেদনা সইতে হবে; জীবনটাকে তুচ্ছ মনে হবে, চারপাশের লোকেরা ভীষণ কঠিন করে তুলবে আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপ, পরীক্ষার ফল খারাপ হতে পারে, সবাই যখন ভালো ফল করে হাসছে, নাচছে, ছবি তুলছে, তখন আমি আশানুরূপ ফল নাও করতে পারি, মা-বাবার মনে প্রত্যাশাভঙ্গের বেদনাও জাগাতে পারি, কিংবা চলার পথে খুব বড় কোনো ভুল করে পরিবারের মানসম্মানের কথা ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হতে পারি, কিন্তু এসবের কোনোটাই কোনো অচিকিত্স্য সমস্যা নয়। সব সমস্যাই কেটে যাবে। ভালো ফল করার একটা প্রচণ্ড চাপ আমাদের চারপাশে আছে, আমাদের স্কুল-কলেজ, প্রতিষ্ঠান, বাবা, মা, শিক্ষক—সবাই মিলে এ রকম একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আমরা তৈরি করেছি যে সবাইকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটারবিদ, সিএ হতে হবে। ব্যাপার মোটেও তা নয়। জীবনের সফলতার সঙ্গে পরীক্ষার ফলের সম্পর্ক খুব কম, পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করা ভালো, কিন্তু পরীক্ষার ফল ভালো করেও জীবনের পরীক্ষায় ভালো করেনি এমন মানুষের সংখ্যাও প্রচুর। তেমনি তেমন ভালো ফল না করেও জীবন-জগত্-সভ্যতাকে আলোকিত করেছে, এমন উদাহরণও আছে ভূরি ভূরি। রবীন্দ্রনাথের ফল ভালো ছিল না, আইনস্টাইনেরও না। বিল গেটস তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করেননি।
আর মৃত্যুর কথা ভাবার দরকারই নেই। জীবন খুবই সুন্দর। বাবা, মা, ভাইবোন, বন্ধু—সবাই আমাদের কী প্রচণ্ডভাবে ভালোই না বাসেন! আমার জীবন আমি যা খুশি করব, কথাটা তা নয়। এই জীবন কেবল আমার নয়, আমার দেশের আলো-বাতাস-অন্ন এই দেহে মিশে আছে, মা-বাবার রক্ত আছে, অজস্র বন্ধু-সুহূদ-শিক্ষকের একটু একটু অবদান আছে আমার বেড়ে ওঠায়। সবার মধ্যে সুন্দরভাবে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে, প্রতিকূলতা এলে সবাই মিলেই সেটা জয় করতে হবে।
সবাই মিলে জয় করার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের আরেকটু বন্ধুভাবাপন্ন হতে হবে। চাকরিবাকরি, ব্যবসা, আধুনিকতা, প্রতিযোগিতা—সব মিলিয়ে আমরা আমাদের জীবনকেও বড় যান্ত্রিক করে তুলছি। আমাদের সময় করতে হবে পাখির গান শোনার, রংধনু দেখে মুগ্ধ হওয়ার, বৃষ্টিদিনে কদম ফুল কিনে বাড়ি ফেরার, সন্তানের সঙ্গে গল্প করার, তাদের সময় দেওয়ার। আর তাদের ওপর প্রত্যাশার জোয়াল চাপিয়ে না দিয়ে তার আত্মবিশ্বাসটা জাগ্রত করার।
একটা উদাহরণ দিই। হঠাত্ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে ছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। প্রায় ১০ জন শিক্ষার্থী, বেশির ভাগই ছাত্রী, আত্মহত্যা করল। এখন ওই প্রতিষ্ঠানে পরামর্শকেন্দ্র খোলা হয়েছে, ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রে ও মেয়েদের হলে। আত্মহত্যার ঘটনা কমে এসেছে।
রবীন্দ্রনাথের বোঝাপড়া কবিতাটা দিয়ে শেষ করি:
মনেরে আজ কহ যে,
ভালোমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে,
কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা
সিকি পয়সা ধারে না যে ......
......তোমার মাপে হয়নি সবাই।
তুমিও হওনি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে—
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।
আকাশ তবু সুনীল থাকে
মধুর ঠেকে ভোরের আলো,
মরণ এলে হঠাত্ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।
কাজেই, মরণ এলে তাকে হটিয়ে দিয়ে বাঁচতে হবে; বাঁচলে দেখা যাবে, মরার চেয়ে বাঁচা ঢের ঢের ভালো। জীবন মূল্যবান, সেটার মূল্য আমাদের ধরে রাখতে হবে; জীবন সুন্দর, বেঁচে থাকাটাও এক অপূর্ব সুন্দর ব্যাপার। অসুন্দর এসে জীবনকে কালিমালিপ্ত করতে চাইলে আমরা লড়াই করব, হেরে বসে থাকব না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
এই মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। সে আর আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে নেই। তার নাকি শখ ছিল সে এমবিএ পড়বে। নতুন ক্লাসে যাওয়ার জন্য তার স্কুলের পোশাক পড়ে আছে দরজির দোকানে। শুধু পিংকি নেই। শ্যামলী আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের একটা প্রাণবন্ত ছাত্রীর এই অকারণ চলে যাওয়ার বেদনা সত্যি আমাদের পক্ষে সহ্য করা কঠিন।
আমাদের দুঃখ কোনো সান্ত্বনা মানে না। কারণ পিংকি আত্মহত্যা করেছে। যাওয়ার আগে সে একটা চিরকুট লিখে রেখে গেছে। চিরকুটটা সে লিখেছে তার দাদির উদ্দেশে। তাতে সে বলেছে, তার মৃত্যুর জন্য পরিবার দায়ী নয়। সে যা বলছে তার ভাবার্থ এই যে দুষ্টুমি করতে গিয়ে তার হাতকাটা গেছে। সে জন্য সে ব্যান্ডেজ কিনতে গিয়েছিল ওষুধের দোকানে। সেখানে মুরাদ নামের এক ছেলে এই ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করেছে আর তাকে চড় মেরেছে। তার জন্য যাতে পরিবারের মানসম্মান না যায়, সে জন্য সে ফাঁসি নিয়েছে।
খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে, মুরাদ বখাটে ছেলে। পিংকির অভিভাবক ও চাচা তেমনটাই বলছেন যে পিংকির চলার পথে মুরাদ তাকে উত্ত্যক্ত করত। সে তাকে চড় মারায় পিংকি আত্মহত্যা করেছে। আর মুরাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পিংকির সঙ্গে তার প্রেম ছিল, পিংকি আবেগের বশে তার হাত কেটেছে, সেটা দেখে আবেগের বশে মুরাদ পিংকিকে চড় মেরেছে, তারই পরিণতিতে পিংকির এই আত্মহত্যা।
১৯ জানুয়ারি ২০১০ ঢাকার শ্যামলী এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনায় মামলা হয়েছে, মুরাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তদন্ত চলছে। মুরাদ বখাটে নাকি পিংকির প্রেমিক, পিংকির প্রেম করার বয়স হয়েছিল কি না, মুরাদ প্রেমিক হলেই তাকে মারতে পারে কি না, পিংকির এই অকাল প্রয়াণের পেছনে মুরাদের দায় কতটুকু—এসব তদন্ত ও বিচারে বেরিয়ে আসবে। সেই তদন্ত সুষ্ঠুভাবে হোক, নিরপেক্ষভাবে হোক, আমরা যাকে বলি ‘গণমাধ্যমের বিচার’ বা ‘মিডিয়া ট্রায়াল’, অর্থাত্ বিচার হওয়ার আগেই একজনকে দায়ী করে ব্যাপক প্রচারণা চালানো, সেটাও করতে চাই না।
আমরা যেটা বলতে চাই, আমার বন্ধুদের, আমার মেয়ে আর তার বন্ধুদের, আমার বোনদের, আমার ভাইবোন-সন্তানদের, এসো বেঁচে থাকি। আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়, বরং সমাধানের পথ বেরোনোর আগেই একটা নতুন সমস্যা তৈরি করা।
আমরা জানি, আমাদের সমাজটা পুরুষশাসিত। এই সমাজে মেয়েদের চলাফেরা করা কঠিন। কথাবার্তা বলা কঠিন। স্বাধীন পেশা বেছে নেওয়া কঠিন। তাই বলে আমরা তো লড়াই করার আগেই হেরে যেতে পারি না। অনেক কঠিন সময় আসবে, সুসময়ও আসবে। মানুষের জীবনে চড়াই-উতরাই থাকেই। আজকে যদি মনে হয়, আমি খুবই দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, নিশ্চিত থাকতে পারো, কালকে অনেক সুন্দর সময় আসবে, যখন আমরা প্রাণভরে হাসতে পারব; যখন কেবল নিজের জীবনটা তো সুন্দর মনে হবেই, মনে হবে, আমার জন্য চারপাশের মানুষের জীবনও সুন্দর হয়ে উঠছে।
পিংকির চিরকুটটায় আসি। ও লিখেছে, ‘আমার জন্য যাতে তোমাদের মানসম্মান না যায় তার জন্য আমি ফাঁসি দিলাম।’ ও চেয়েছিল অন্যের দুঃখ লাঘব করতে, পরিবারের অন্যদের মানসম্মান রক্ষা করতে, কিন্তু ওর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কি সেটা সে পারল? স্বজনদের দুঃখ-কষ্ট কি কমল?
আমরা জানি, এ বয়সের ছেলেমেয়েদের আবেগ বড় তীব্র থাকে। রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।...স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো আধো কথা ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি, এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা মাত্র।...সেও সর্বদা মনে মনে বুঝিতে পারে, পৃথিবীর কোথাও সে ঠিক খাপ খাইতেছে না; এ জন্য আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সর্বদা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া থাকে। অথচ এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিত্ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এ সময়ে যদি সে কোনো সহূদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ বা সখ্য লাভ করিতে পারে, তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না, কারণ সেটা সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে।’
তারা বড় হচ্ছে, অথচ কেউ তাদের বড় ভাবে না; তাদেরও হূদয়সংক্রান্ত জটিলতা হতে পারে, সেটাকে কেউ খুব গুরুত্ব দেয় না, বরং কঠোর ভাষায় ও পদ্ধতিতে এ ব্যাপারগুলো গুঁড়িয়ে দিতে চায় সবাই। এসব সমস্যা বড়দের কাছে হয় হাস্যকর, নয়তো খুবই আপত্তিকর, কিন্তু ওটা যে ওই বয়সীদের জন্য একটা বাস্তবতা আর সমস্যা, সেটা কেউ বুঝতে চায় না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, স্নেহ দেওয়া হলে লোকে তাকে বলে প্রশ্রয় দেওয়া।
আজ তাই আমাদের অভিভাবকদের বলব, লোকের কথা বা প্রচলিত সংস্কারের বশবর্তী না হয়ে আপনার কিশোর-তরুণ ছেলে বা মেয়েটিকে, ভাই বা বোনটিকে, ভাগ্নে বা ভাগ্নিকে আপনি একটু প্রশ্রয় দিন। শিক্ষকদের বলব, অভিভাবকদের বলব, আপনি আপনার এই কিশোর-তরুণটির বন্ধু হোন। শুধু এটা কোরো না, ওটা কোরো না; বাবা-মায়ের মুখে কালি মেখো না, না বলে তার প্রকৃত বন্ধু হয়ে তার সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনুন। তার মনের ব্যথা ভাগ করে নিন। দুঃখ ভাগ করে নিলে কমে, আনন্দ ভাগ করে নিলে বাড়ে।
আর আছে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা। আমরা কারও নিরাপত্তা দিতে পারি না, নারীদের তো নয়ই, কিশোরী-তরুণদেরও নয়। কত কত আত্মহত্যার কথা মনে পড়ে। সেই যে খুলনার খালিশপুর এলাকায় রুমি আত্মহত্যা করল এক বৈশাখী দুপুরে, সে তো বাড়ি পর্যন্ত এসে বখাটেরা উপদ্রব করেছিল বলে, গাইবান্ধায় বখাটেদের ধাওয়া খেয়ে পানিতে পড়ে মারা গেল ছোট্ট মেয়ে তৃষা, নারায়ণগঞ্জ চারুকলা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী সিমি মারা গেল পাড়ার সামাজিক শৃঙ্খলারক্ষক বখাটেদের খোঁটা সইতে না পেরে, তার অপরাধ ছিল সে কেন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার বাসায় ফিরতে বেশি রাত করে। এসব মৃত্যুর কথা যতবার মনে পড়ে, ততবার আমরা মন খারাপ করি, আমাদের সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করি। এই অসুন্দর, সাম্যহীন সমাজটাকে আরেকটু সুন্দর, আরেকটু মানবিক, আরেকটু নারীবান্ধব করার সংগ্রামে আমরা শামিল হই, অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হোক সে ব্যাপারে সোচ্চার থাকি। কিন্তু তবুও বলি, বারবার বলি, আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়। আমাদের যে সংগ্রাম বখাটেদের বিরুদ্ধে, অসুন্দরের বিরুদ্ধে, এই মৃত্যু সেই লড়াইয়ে আমাদের জয়লাভ করতে সাহায্য করে না। আমাদের হারিয়ে দেয়। আমার বন্ধুদের বলি, আমার বোনদের বলি, আমার মেয়েদের বলি, আমাদের অসংখ্য কিশোর-তরুণ ভাইবোন-বন্ধুকে বলি, মরবে কেন? বাঁচো। প্রতিবাদ করো। রুখে দাঁড়াও। কথা বলো। তোমার কথা, তোমার বেদনা কারও সঙ্গে ভাগ করে নাও। মনে রাখবে, তোমরা একা নও। কেউ না কেউ এই পৃথিবীতে আছে, যে তোমার এই বেদনা বুঝতে পারবে।
প্রেম হবে, প্রেম ভেঙেও যাবে; প্রেম হবে না, প্রত্যাখ্যানের বেদনা সইতে হবে; জীবনটাকে তুচ্ছ মনে হবে, চারপাশের লোকেরা ভীষণ কঠিন করে তুলবে আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপ, পরীক্ষার ফল খারাপ হতে পারে, সবাই যখন ভালো ফল করে হাসছে, নাচছে, ছবি তুলছে, তখন আমি আশানুরূপ ফল নাও করতে পারি, মা-বাবার মনে প্রত্যাশাভঙ্গের বেদনাও জাগাতে পারি, কিংবা চলার পথে খুব বড় কোনো ভুল করে পরিবারের মানসম্মানের কথা ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হতে পারি, কিন্তু এসবের কোনোটাই কোনো অচিকিত্স্য সমস্যা নয়। সব সমস্যাই কেটে যাবে। ভালো ফল করার একটা প্রচণ্ড চাপ আমাদের চারপাশে আছে, আমাদের স্কুল-কলেজ, প্রতিষ্ঠান, বাবা, মা, শিক্ষক—সবাই মিলে এ রকম একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আমরা তৈরি করেছি যে সবাইকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটারবিদ, সিএ হতে হবে। ব্যাপার মোটেও তা নয়। জীবনের সফলতার সঙ্গে পরীক্ষার ফলের সম্পর্ক খুব কম, পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করা ভালো, কিন্তু পরীক্ষার ফল ভালো করেও জীবনের পরীক্ষায় ভালো করেনি এমন মানুষের সংখ্যাও প্রচুর। তেমনি তেমন ভালো ফল না করেও জীবন-জগত্-সভ্যতাকে আলোকিত করেছে, এমন উদাহরণও আছে ভূরি ভূরি। রবীন্দ্রনাথের ফল ভালো ছিল না, আইনস্টাইনেরও না। বিল গেটস তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করেননি।
আর মৃত্যুর কথা ভাবার দরকারই নেই। জীবন খুবই সুন্দর। বাবা, মা, ভাইবোন, বন্ধু—সবাই আমাদের কী প্রচণ্ডভাবে ভালোই না বাসেন! আমার জীবন আমি যা খুশি করব, কথাটা তা নয়। এই জীবন কেবল আমার নয়, আমার দেশের আলো-বাতাস-অন্ন এই দেহে মিশে আছে, মা-বাবার রক্ত আছে, অজস্র বন্ধু-সুহূদ-শিক্ষকের একটু একটু অবদান আছে আমার বেড়ে ওঠায়। সবার মধ্যে সুন্দরভাবে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে, প্রতিকূলতা এলে সবাই মিলেই সেটা জয় করতে হবে।
সবাই মিলে জয় করার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের আরেকটু বন্ধুভাবাপন্ন হতে হবে। চাকরিবাকরি, ব্যবসা, আধুনিকতা, প্রতিযোগিতা—সব মিলিয়ে আমরা আমাদের জীবনকেও বড় যান্ত্রিক করে তুলছি। আমাদের সময় করতে হবে পাখির গান শোনার, রংধনু দেখে মুগ্ধ হওয়ার, বৃষ্টিদিনে কদম ফুল কিনে বাড়ি ফেরার, সন্তানের সঙ্গে গল্প করার, তাদের সময় দেওয়ার। আর তাদের ওপর প্রত্যাশার জোয়াল চাপিয়ে না দিয়ে তার আত্মবিশ্বাসটা জাগ্রত করার।
একটা উদাহরণ দিই। হঠাত্ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে ছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। প্রায় ১০ জন শিক্ষার্থী, বেশির ভাগই ছাত্রী, আত্মহত্যা করল। এখন ওই প্রতিষ্ঠানে পরামর্শকেন্দ্র খোলা হয়েছে, ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রে ও মেয়েদের হলে। আত্মহত্যার ঘটনা কমে এসেছে।
রবীন্দ্রনাথের বোঝাপড়া কবিতাটা দিয়ে শেষ করি:
মনেরে আজ কহ যে,
ভালোমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে,
কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা
সিকি পয়সা ধারে না যে ......
......তোমার মাপে হয়নি সবাই।
তুমিও হওনি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে—
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।
আকাশ তবু সুনীল থাকে
মধুর ঠেকে ভোরের আলো,
মরণ এলে হঠাত্ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।
কাজেই, মরণ এলে তাকে হটিয়ে দিয়ে বাঁচতে হবে; বাঁচলে দেখা যাবে, মরার চেয়ে বাঁচা ঢের ঢের ভালো। জীবন মূল্যবান, সেটার মূল্য আমাদের ধরে রাখতে হবে; জীবন সুন্দর, বেঁচে থাকাটাও এক অপূর্ব সুন্দর ব্যাপার। অসুন্দর এসে জীবনকে কালিমালিপ্ত করতে চাইলে আমরা লড়াই করব, হেরে বসে থাকব না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
No comments