কপোতাক্ষ-মধুমতীর তীর থেকে-তিন আনন্দ সংবাদ by আমিরুল আলম খান
যশোরের সংস্কৃতিপ্রেমীদের জন্য এবার অন্তত তিনটি সুখবর আছে। প্রথমত, ১৯৯৪ সালের পর যশোর ইনস্টিটিউট আবার বইমেলা করার উদ্যোগ নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এবারের মধুমেলায় উন্মুক্ত মঞ্চে মঞ্চস্থ হচ্ছে যাত্রাভিনয়। তৃতীয় হলো, মার্চেই অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন।
২.
বইমেলার সঙ্গে যশোরের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলাদেশে বইমেলার সূচনা হয় যশোর থেকে, ৪৩ বছর আগে, ১৯৬৭ সালে। ‘হরেকরকম বই, রঙিন বেলুন, বইয়ের গান, বিচিত্র পোস্টারের সমাবেশ, বইবিষয়ক আলোচনা সভা—সব মিলিয়ে সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মিছিল। সেবারের বইমেলায় স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অজানা এক জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে কী আনন্দ তাদের।’ স্মৃতিমন্থন করে লিখেছেন বইমেলার প্রাণপুরুষ মোহম্মদ শরীফ হোসেন। শুরু থেকে বইমেলা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে মাত্র পাঁচ বছরে, ১৯৭১ সালে তা শহর ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় থানা পর্যন্ত। গ্রামের মানুষ বলত, ‘পুস্তক অপেরা’। নামটা দেন বইমেলার পথিকৃত্ শরীফ হোসেন।
সে আয়োজনের সাফল্য ছিল বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টিতে। ‘আপনি কি আজ বই পড়েছেন?’ স্লোগান ওঠে এবং অচিরেই তা অত্যন্ত জনপ্রিয় স্লোগানে পরিণত হয়। স্বাধীনতা-পূর্বকালেই বইমেলার মাধ্যমে যশোরে বই পড়া আর পাঠাগার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে ওঠে শরীফ হোসেন ও তাঁর প্রিয় সহকর্মীদের অক্লান্ত শ্রম-সাধনায়। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উদ্যাপিত হয় নানা মনমাতানো রঙিন অনুষ্ঠানে। তাতে মেতে ওঠে সারা যশোর, মাতিয়ে দেয় সারা দেশ। মোহাম্মদ এনামুল হক, সরদার জয়েনউদ্দিন, মস্কোর প্যাট্রিস লুমুুম্বা, মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক দানিয়েল গ্নাতুক চুক সেবারের বইমেলাকে নতুন মাত্রা দান করেন। বই পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তারপর যশোরে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন জারির পর ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে যশোরে বইমেলা আয়োজনে অনুমতি মেলেনি। ১৯৮৪ সাল থেকে সীমিত পরিসরে আবার বইমেলা হলেও আগের সেই প্রাণ ও ব্যাপ্তি ছিল না তাতে। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যশোরের সব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনকে একই মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যশোরে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন যশোরবাসীর ঐক্যকে আরও সংহত করে: নবোদ্যমে বইমেলার আয়োজন, সম্মিলিতভাবে বাংলা নববর্ষ, স্বাধীনতা ও বিজয়ের ২০ বছর সাড়ম্বরে উদ্যাপন।
১৯৯১ সালের পর প্রতিবছর বইমেলার কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৯৪ সালে তা সর্বোচ্চ মাত্রা অর্জন করে। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির অংশগ্রহণে এ সময় যশোর পরিণত হয় দেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলায়। তাঁদের অনেকেই (শামসুর রাহমান, আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, সৈয়দ আলী আহসান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আজীজুল হক, সমুদ্র গুপ্ত) আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু ১৯৯৪ সালের পর নানা কারণে যশোরে বইমেলা বন্ধ হয়ে যায়।
দীর্ঘকাল পর আবার বইমেলা হবে যশোরে। এ খবরে সবাই এখন দারুণ খুশি। সর্বত্র সাজ সাজ রব। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি এই মেলায় আবার অংশগ্রহণে সম্মত হয়েছে। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয়ে মেলা চলবে স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত। যশোর আবার দেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলায় পরিণত হবে। আশির দশকে যশোরে সন্ত্রাসের নজিরবিহীন বিস্তার ঘটলে যাঁরা যশোরকে সন্ত্রাসের শহর বলে ভয় পেতেন, তাঁরাও জানেন সংস্কৃতির প্রতি যশোরবাসীর উত্সাহের প্রাবল্য। গভীর রাত পর্যন্ত কবি-সাহিত্যিকদের আলোচনা শ্রবণে ক্লান্ত হয় না যশোরের মানুষ। এমন উত্সাহী ও ধৈর্যশীল শ্রোতা বাংলাদেশে বিরল। আর তাই যশোরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে ঢাকা-কলকাতার কবি-সাহিত্যিকদের উত্সাহের কোনো অভাব হয় না। তেমনি ঢাকার বাইরে যশোরের বইমেলায় বই বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। পুস্তক ব্যবসায়ীদের কাছে তাই যশোরের বইমেলার আলাদা আকর্ষণ রয়েছে।
৩.
স্বাধীনতার পর মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মোত্সবকে কেন্দ্র করে কবির জন্মস্থান সাগরদাঁড়িতে শুরু হয় মধুমেলা। মেলায় অংশ নেন দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা। মেলা উপলক্ষে কারুশিল্পীদের প্রস্তুতি চলে অনেক আগে থেকে। জানুয়ারির শেষ পক্ষকাল যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুর উত্সবে মেতে ওঠে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ঘরে ঘরে তখন অতিথি-মেহমান। ঈদ-পূজা-মেলার মধ্য দিয়ে বাঙালি জীবনে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা।
এ বছর মধুমেলায় বাড়তি পাওনা মেলার দ্বিতীয় দিন থেকে উন্মুক্ত মঞ্চে যাত্রাভিনয় উপভোগ। বাঙালির নাড়ির স্পন্দন উপলব্ধি করা যায় যাত্রাপালায়। যাত্রাপালায় নাচের ব্যবহার পুরোনো হলেও আশির দশকে স্বৈরশাসন যুবসমাজকে বিপথগামী করতে যাত্রাপালায় ‘প্রিন্সেস নৃত্যে’র অনুপ্রবেশ ঘটায়। অপসংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে প্রবল গণপ্রতিরোধ। সে প্রতিরোধ অশ্লীল নৃত্যের বিরুদ্ধে হলেও ধর্মান্ধ সংগঠনগুলো তাকে যাত্রানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়। ফলে সারা দেশে প্রায় বন্ধ হয়ে যায় যাত্রানুষ্ঠান। যশোর প্রশাসন এবার মধুমেলায় ‘প্রিন্সেস-নৃত্যমুক্ত’ সুস্থ বিনোদন হিসেবে যাত্রা প্রদর্শনীর আয়োজন করে একটি বড়মাপের কাজে হাত দিল। আর বিনাটিকিটে সবার জন্য তা উন্মুক্ত করে দেওয়ায় যাত্রার পালে নতুন হাওয়া লাগবে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে, আমাদের বিশ্বাস, বাংলা যাত্রাপালা আবার স্বমহিমায় ফিরে আসবে।
৪.
এ বছর যশোরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন। সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ। আয়োজকেরা রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন সফল করে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
১৯৯১ সালের পর একসঙ্গে এতগুলো সংস্কৃতিবিষয়ক আনন্দ সংবাদ পায়নি যশোরবাসী। আর তাই সবাই এখন ক্ষণ গণনায় ব্যস্ত। তাদের স্বপ্ন, সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার স্বর্ণদ্বার যশোর নেতৃত্ব দেবে সমগ্র জাতির।
প্রসঙ্গত, যশোরে একটি দাবি ক্রমশ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে—তা হলো, সাগরদাঁড়িতে একটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। দুই বছর আগে সাংস্কৃতিককর্মী আবু সালেহ তোতা মধুমেলায় প্রথম প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। তারপর থেকে এই দাবি এখন যশোরবাসীর প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। যশোরবাসী মনে করে, অপসংস্কৃতির প্রবল আগ্রাসন প্রতিহত করতে এবং সংস্কৃতির সুস্থ চর্চা ও বিকাশে মধুসূদন সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব সাগরদাঁড়িতে মধুসূদন সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হওয়া।
যশোরবাসী সেই সুদিনের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে।
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ
amirulkhan7@gmail.com
বইমেলার সঙ্গে যশোরের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলাদেশে বইমেলার সূচনা হয় যশোর থেকে, ৪৩ বছর আগে, ১৯৬৭ সালে। ‘হরেকরকম বই, রঙিন বেলুন, বইয়ের গান, বিচিত্র পোস্টারের সমাবেশ, বইবিষয়ক আলোচনা সভা—সব মিলিয়ে সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মিছিল। সেবারের বইমেলায় স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অজানা এক জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে কী আনন্দ তাদের।’ স্মৃতিমন্থন করে লিখেছেন বইমেলার প্রাণপুরুষ মোহম্মদ শরীফ হোসেন। শুরু থেকে বইমেলা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে মাত্র পাঁচ বছরে, ১৯৭১ সালে তা শহর ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় থানা পর্যন্ত। গ্রামের মানুষ বলত, ‘পুস্তক অপেরা’। নামটা দেন বইমেলার পথিকৃত্ শরীফ হোসেন।
সে আয়োজনের সাফল্য ছিল বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টিতে। ‘আপনি কি আজ বই পড়েছেন?’ স্লোগান ওঠে এবং অচিরেই তা অত্যন্ত জনপ্রিয় স্লোগানে পরিণত হয়। স্বাধীনতা-পূর্বকালেই বইমেলার মাধ্যমে যশোরে বই পড়া আর পাঠাগার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে ওঠে শরীফ হোসেন ও তাঁর প্রিয় সহকর্মীদের অক্লান্ত শ্রম-সাধনায়। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উদ্যাপিত হয় নানা মনমাতানো রঙিন অনুষ্ঠানে। তাতে মেতে ওঠে সারা যশোর, মাতিয়ে দেয় সারা দেশ। মোহাম্মদ এনামুল হক, সরদার জয়েনউদ্দিন, মস্কোর প্যাট্রিস লুমুুম্বা, মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক দানিয়েল গ্নাতুক চুক সেবারের বইমেলাকে নতুন মাত্রা দান করেন। বই পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তারপর যশোরে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন জারির পর ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে যশোরে বইমেলা আয়োজনে অনুমতি মেলেনি। ১৯৮৪ সাল থেকে সীমিত পরিসরে আবার বইমেলা হলেও আগের সেই প্রাণ ও ব্যাপ্তি ছিল না তাতে। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যশোরের সব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনকে একই মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যশোরে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন যশোরবাসীর ঐক্যকে আরও সংহত করে: নবোদ্যমে বইমেলার আয়োজন, সম্মিলিতভাবে বাংলা নববর্ষ, স্বাধীনতা ও বিজয়ের ২০ বছর সাড়ম্বরে উদ্যাপন।
১৯৯১ সালের পর প্রতিবছর বইমেলার কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৯৪ সালে তা সর্বোচ্চ মাত্রা অর্জন করে। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির অংশগ্রহণে এ সময় যশোর পরিণত হয় দেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলায়। তাঁদের অনেকেই (শামসুর রাহমান, আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, সৈয়দ আলী আহসান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আজীজুল হক, সমুদ্র গুপ্ত) আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু ১৯৯৪ সালের পর নানা কারণে যশোরে বইমেলা বন্ধ হয়ে যায়।
দীর্ঘকাল পর আবার বইমেলা হবে যশোরে। এ খবরে সবাই এখন দারুণ খুশি। সর্বত্র সাজ সাজ রব। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি এই মেলায় আবার অংশগ্রহণে সম্মত হয়েছে। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয়ে মেলা চলবে স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত। যশোর আবার দেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলায় পরিণত হবে। আশির দশকে যশোরে সন্ত্রাসের নজিরবিহীন বিস্তার ঘটলে যাঁরা যশোরকে সন্ত্রাসের শহর বলে ভয় পেতেন, তাঁরাও জানেন সংস্কৃতির প্রতি যশোরবাসীর উত্সাহের প্রাবল্য। গভীর রাত পর্যন্ত কবি-সাহিত্যিকদের আলোচনা শ্রবণে ক্লান্ত হয় না যশোরের মানুষ। এমন উত্সাহী ও ধৈর্যশীল শ্রোতা বাংলাদেশে বিরল। আর তাই যশোরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে ঢাকা-কলকাতার কবি-সাহিত্যিকদের উত্সাহের কোনো অভাব হয় না। তেমনি ঢাকার বাইরে যশোরের বইমেলায় বই বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। পুস্তক ব্যবসায়ীদের কাছে তাই যশোরের বইমেলার আলাদা আকর্ষণ রয়েছে।
৩.
স্বাধীনতার পর মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মোত্সবকে কেন্দ্র করে কবির জন্মস্থান সাগরদাঁড়িতে শুরু হয় মধুমেলা। মেলায় অংশ নেন দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা। মেলা উপলক্ষে কারুশিল্পীদের প্রস্তুতি চলে অনেক আগে থেকে। জানুয়ারির শেষ পক্ষকাল যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুর উত্সবে মেতে ওঠে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ঘরে ঘরে তখন অতিথি-মেহমান। ঈদ-পূজা-মেলার মধ্য দিয়ে বাঙালি জীবনে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা।
এ বছর মধুমেলায় বাড়তি পাওনা মেলার দ্বিতীয় দিন থেকে উন্মুক্ত মঞ্চে যাত্রাভিনয় উপভোগ। বাঙালির নাড়ির স্পন্দন উপলব্ধি করা যায় যাত্রাপালায়। যাত্রাপালায় নাচের ব্যবহার পুরোনো হলেও আশির দশকে স্বৈরশাসন যুবসমাজকে বিপথগামী করতে যাত্রাপালায় ‘প্রিন্সেস নৃত্যে’র অনুপ্রবেশ ঘটায়। অপসংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে প্রবল গণপ্রতিরোধ। সে প্রতিরোধ অশ্লীল নৃত্যের বিরুদ্ধে হলেও ধর্মান্ধ সংগঠনগুলো তাকে যাত্রানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়। ফলে সারা দেশে প্রায় বন্ধ হয়ে যায় যাত্রানুষ্ঠান। যশোর প্রশাসন এবার মধুমেলায় ‘প্রিন্সেস-নৃত্যমুক্ত’ সুস্থ বিনোদন হিসেবে যাত্রা প্রদর্শনীর আয়োজন করে একটি বড়মাপের কাজে হাত দিল। আর বিনাটিকিটে সবার জন্য তা উন্মুক্ত করে দেওয়ায় যাত্রার পালে নতুন হাওয়া লাগবে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে, আমাদের বিশ্বাস, বাংলা যাত্রাপালা আবার স্বমহিমায় ফিরে আসবে।
৪.
এ বছর যশোরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন। সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ। আয়োজকেরা রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন সফল করে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
১৯৯১ সালের পর একসঙ্গে এতগুলো সংস্কৃতিবিষয়ক আনন্দ সংবাদ পায়নি যশোরবাসী। আর তাই সবাই এখন ক্ষণ গণনায় ব্যস্ত। তাদের স্বপ্ন, সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার স্বর্ণদ্বার যশোর নেতৃত্ব দেবে সমগ্র জাতির।
প্রসঙ্গত, যশোরে একটি দাবি ক্রমশ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে—তা হলো, সাগরদাঁড়িতে একটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। দুই বছর আগে সাংস্কৃতিককর্মী আবু সালেহ তোতা মধুমেলায় প্রথম প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। তারপর থেকে এই দাবি এখন যশোরবাসীর প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। যশোরবাসী মনে করে, অপসংস্কৃতির প্রবল আগ্রাসন প্রতিহত করতে এবং সংস্কৃতির সুস্থ চর্চা ও বিকাশে মধুসূদন সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব সাগরদাঁড়িতে মধুসূদন সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হওয়া।
যশোরবাসী সেই সুদিনের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে।
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ
amirulkhan7@gmail.com
No comments