তথ্যপ্রযুক্তি-এভাবে বাড়ুক কাজের সময় by মুনির হাসান
দিন দশেক আগে মোবাইল ফোনে একটি এসএমএস/খুদে বার্তা পেয়েছি। আমার বাসার ডিসেম্বর মাসের বিদ্যুত্ বিল তৈরি হয়েছে এবং তার পরিমাণ। প্রতি মাসে আমি এ মেসেজটি পাই, যা আমাকে বিদ্যুত্ বিল পরিশোধের কথা মনে করিয়ে দেয়।
দেশজুড়ে হতে থাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উত্সবের কারণে জানুয়ারি মাসে আমি প্রায় দৌড়ের ওপর থাকি। ফলে, বিদ্যুত্ বিলের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু ২৫ তারিখ সকালে বাসা থেকে অফিসে আসার সময় আমার মোবাইল ফোনে একটা খুদে বার্তা এল যে আমার ডিসেম্বর মাসের বিদ্যুত্ বিল এখনো দেওয়া হয়নি এবং ওই দিনই হলো আমার বিল দেওয়ার শেষ দিন। ততক্ষণে আমি বাসা থেকে বের হয়ে পড়েছি। ফলে বিদ্যুত্ বিলটি আমার পক্ষে আনা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমি খেয়াল করলাম, খুদে বার্তাটিতে বিল পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো অর্থাত্ ডিপিডিসি, আমার গ্রাহক নম্বর, বিল নম্বর এবং বিলের পরিমাণ উল্লেখ ছিল। ২০০৯ সালের মার্চ মাস থেকে আমি আমার মোবাইল ফোন থেকে বিদ্যুত্ আর গ্যাসের বিল পরিশোধ করি। কাজেই আমি ওই দিন গাড়িতে বসে বিদ্যুত্ বিল পরিশোধ করে ফেললাম!
তথ্যপ্রযুক্তি এভাবে আমাদের জীবনযাত্রাকে বদলে দিচ্ছে। কাজের সময়ও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বছর কয়েক আগে, বুয়েটে থাকার সময় আমি মাসে একবেলা ছুটি নিয়ে পরিষেবা বিল পরিশোধ করতে তিনটি ব্যাংকে ছুটতাম! এখন আমি ঘরে বসেই বিলগুলো দিতে পারছি। এ যেন ‘প্রযুক্তির ব্যবহার যত বেশি হয়, কাজের সময় বাড়ে, কমে আসে নষ্ট সময়’।
বছর কয়েক আগে বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে একটি জরিপ করা হয়েছিল সরকারের কোন সেবাটি লোকে ডিজিটালাইজেশন চায় তার ওপর। সেখানে ৫০টি সেবাকে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে এক নম্বরে ছিল পরিষেবা বিল পরিশোধে ভোগান্তির অবসান! কেবল যে দিন নষ্ট হয় তা নয়, ভয় থাকে প্রতারিত হওয়ারও। ঢাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে, শুনেছি উদ্ভাবনী কেয়ারটেকার এক বছরের বিদ্যুত্ বিল তছরুপ করে কেটে পড়েছে। সেই কেয়ারটেকার নিজেই ব্যাংকের সিল/ছাপ্পড় বানিয়ে নিয়েছিল! বড় বড় কমপ্লেক্সগুলোর আরও ভয় আছে। ৫০ বা তার বেশিসংখ্যক ফ্ল্যাটের বেলায় এক মাসের বিলের পরিমাণ লক্ষাধিক টাকার বেশি হতে পারে। সশরীরে ব্যাংকে এত টাকা বহন করে নিয়ে যাওয়া মোটেই সাহসের কাজ নয়!
কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের এই দিনগুলোকে বদলে দিতে পারে, যেমনটি দিয়েছে আমার সকালটিকে। বর্তমানে দেশের কয়েকটি শহরে গ্যাস, বিদ্যুত্ এবং চট্টগ্রামে পানির বিল পরিশোধের ব্যবস্থা চালু হয়েছে, আরও কিছু চালু হবে অচিরে। মোবাইল ফোন ছাড়া অপারেটরদের দোকান থেকেও এখন বিল পরিশোধ করা যায়, যেকোনো সময়, রাতের বেলায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অনেকে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। অনেকেই মনে করেন যে মোবাইল ফোনে বা ইন্টারনেটে বিল পরিশোধ করাটা বিপজ্জনক। অথচ, আপনি যেভাবেই বিল পরিশোধ করুন না কেন, পরের মাসের বিলে আপনি তার হিসাব পাবেন। যখন ব্যাংকে নগদ টাকায় বিল পরিশোধ করা হয়, তখন ব্যাংক থেকে একটি কাগজ বিদ্যুত্ অফিসে যায়। সেখানে কম্পিউটারে এন্ট্রি দেওয়ার পরই কেবল গ্রাহকের হিসাব হালনাগাদ হয়। সে কারণে অনেক সময় বিল পরিশোধ করা সত্ত্বেও পরের মাসে বকেয়া বিল দেখানো হয়। কারণ, কম্পিউটারের ডেটাবেইস তথ্য হালনাগাদ না-হওয়া। কিন্তু মোবাইল ফোন বা ইন্টারেনেটে বিল পরিশোধ করলে তা সঙ্গে সঙ্গে পরিষেবা দপ্তরের কম্পিউটার ডেটাবেইসকে হালনাগাদ করে। ফলে সে রকম কোনো ভুলের আশঙ্কা থাকে না। আবার অনেকে ভাবেন যে একটি কাগজের রসিদ দরকার! অথচ, তাঁরা নিজেরাই যখন একই দোকান থেকে মোবাইল ফোনে টাকা ভরেন তখন কিন্তু কোনো রসিদ দাবি করেন না! এটি আমাদের পুরোনো ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ করতে না পারার একটি উদাহরণ। যদিও উভয় ক্ষেত্রে নেপথ্যের ঘটনাগুলো একই।
কেবল বিভিন্ন বিল পরিশোধে নয়, এবারে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-প্রক্রিয়ায় মোবাইল ফোনকে ব্যবহার করা হয়েছে একই কায়দায়। ফলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা যখন রাস্তা অবরোধ করেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিএসসির সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, তখন শাবিপ্রবিতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থী মনোনিবেশ করেছেন তাঁর পাঠে। কারণ, তাঁর এই সমগ্র প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে ১০ মিনিট সময়ও ব্যয় হয়নি, তাঁকে যেতে হয়নি শাবিপ্রবিতে দুইবার—একবার ফরম আনার জন্য আরেকবার জমা দেওয়ার জন্য। আমি দেখেছি, ঈদের দিন রাত দুইটার সময় শিক্ষার্থীরা মুঠোফোনে তাঁদের রেজিস্ট্রেশন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। এই যে ১৬ হাজার শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের দুইবার সিলেটে আসা-যাওয়া করতে হলো না, তাতে আমাদের কত কার্বন নিঃসরণ কম হয়েছে? এই ১৬ হাজার শিক্ষার্থী অহেতুক কোনো কাগজ ফটোকপি করেননি। এতে কত গাছ বেঁচেছে? তিনবারের জায়গায় মাত্র একবার যেতে হয়েছে বলে এবার শাবিপ্রবিতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক মেয়েদের সংখ্যা হয়েছে বেশি! এভাবে তথ্যপ্রযুক্তির নানা উদ্যোগ আমাদের নষ্ট সময়গুলোকে কাজের সময়ে পরিণত করতে পারে।
কেবল বিল পরিশোধ বা ভর্তিপ্রক্রিয়া নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক এবং উদ্ভাবনী প্রয়োগ আমাদের নষ্ট সময়গুলোকে কাজের সময়ে পরিণত করতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশকে সামনে রেখে এমন অনেক উদ্যোগ আমরা এখন দেখছি। তবে, এগুলোর পাশাপাশি আমাদের নিজেদের ধ্যান-ধারণাও পাল্টাতে হবে। কারণ, যে চিন্তা আমাদের সব সময় কাগজের রসিদ দাবি করতে প্ররোচিত করে, সেটি শেষ বিচারে বদলের পক্ষে নয়। দিনবদলের তো নয়।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
তথ্যপ্রযুক্তি এভাবে আমাদের জীবনযাত্রাকে বদলে দিচ্ছে। কাজের সময়ও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বছর কয়েক আগে, বুয়েটে থাকার সময় আমি মাসে একবেলা ছুটি নিয়ে পরিষেবা বিল পরিশোধ করতে তিনটি ব্যাংকে ছুটতাম! এখন আমি ঘরে বসেই বিলগুলো দিতে পারছি। এ যেন ‘প্রযুক্তির ব্যবহার যত বেশি হয়, কাজের সময় বাড়ে, কমে আসে নষ্ট সময়’।
বছর কয়েক আগে বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে একটি জরিপ করা হয়েছিল সরকারের কোন সেবাটি লোকে ডিজিটালাইজেশন চায় তার ওপর। সেখানে ৫০টি সেবাকে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে এক নম্বরে ছিল পরিষেবা বিল পরিশোধে ভোগান্তির অবসান! কেবল যে দিন নষ্ট হয় তা নয়, ভয় থাকে প্রতারিত হওয়ারও। ঢাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে, শুনেছি উদ্ভাবনী কেয়ারটেকার এক বছরের বিদ্যুত্ বিল তছরুপ করে কেটে পড়েছে। সেই কেয়ারটেকার নিজেই ব্যাংকের সিল/ছাপ্পড় বানিয়ে নিয়েছিল! বড় বড় কমপ্লেক্সগুলোর আরও ভয় আছে। ৫০ বা তার বেশিসংখ্যক ফ্ল্যাটের বেলায় এক মাসের বিলের পরিমাণ লক্ষাধিক টাকার বেশি হতে পারে। সশরীরে ব্যাংকে এত টাকা বহন করে নিয়ে যাওয়া মোটেই সাহসের কাজ নয়!
কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের এই দিনগুলোকে বদলে দিতে পারে, যেমনটি দিয়েছে আমার সকালটিকে। বর্তমানে দেশের কয়েকটি শহরে গ্যাস, বিদ্যুত্ এবং চট্টগ্রামে পানির বিল পরিশোধের ব্যবস্থা চালু হয়েছে, আরও কিছু চালু হবে অচিরে। মোবাইল ফোন ছাড়া অপারেটরদের দোকান থেকেও এখন বিল পরিশোধ করা যায়, যেকোনো সময়, রাতের বেলায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অনেকে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। অনেকেই মনে করেন যে মোবাইল ফোনে বা ইন্টারনেটে বিল পরিশোধ করাটা বিপজ্জনক। অথচ, আপনি যেভাবেই বিল পরিশোধ করুন না কেন, পরের মাসের বিলে আপনি তার হিসাব পাবেন। যখন ব্যাংকে নগদ টাকায় বিল পরিশোধ করা হয়, তখন ব্যাংক থেকে একটি কাগজ বিদ্যুত্ অফিসে যায়। সেখানে কম্পিউটারে এন্ট্রি দেওয়ার পরই কেবল গ্রাহকের হিসাব হালনাগাদ হয়। সে কারণে অনেক সময় বিল পরিশোধ করা সত্ত্বেও পরের মাসে বকেয়া বিল দেখানো হয়। কারণ, কম্পিউটারের ডেটাবেইস তথ্য হালনাগাদ না-হওয়া। কিন্তু মোবাইল ফোন বা ইন্টারেনেটে বিল পরিশোধ করলে তা সঙ্গে সঙ্গে পরিষেবা দপ্তরের কম্পিউটার ডেটাবেইসকে হালনাগাদ করে। ফলে সে রকম কোনো ভুলের আশঙ্কা থাকে না। আবার অনেকে ভাবেন যে একটি কাগজের রসিদ দরকার! অথচ, তাঁরা নিজেরাই যখন একই দোকান থেকে মোবাইল ফোনে টাকা ভরেন তখন কিন্তু কোনো রসিদ দাবি করেন না! এটি আমাদের পুরোনো ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ করতে না পারার একটি উদাহরণ। যদিও উভয় ক্ষেত্রে নেপথ্যের ঘটনাগুলো একই।
কেবল বিভিন্ন বিল পরিশোধে নয়, এবারে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-প্রক্রিয়ায় মোবাইল ফোনকে ব্যবহার করা হয়েছে একই কায়দায়। ফলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা যখন রাস্তা অবরোধ করেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিএসসির সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, তখন শাবিপ্রবিতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থী মনোনিবেশ করেছেন তাঁর পাঠে। কারণ, তাঁর এই সমগ্র প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে ১০ মিনিট সময়ও ব্যয় হয়নি, তাঁকে যেতে হয়নি শাবিপ্রবিতে দুইবার—একবার ফরম আনার জন্য আরেকবার জমা দেওয়ার জন্য। আমি দেখেছি, ঈদের দিন রাত দুইটার সময় শিক্ষার্থীরা মুঠোফোনে তাঁদের রেজিস্ট্রেশন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। এই যে ১৬ হাজার শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের দুইবার সিলেটে আসা-যাওয়া করতে হলো না, তাতে আমাদের কত কার্বন নিঃসরণ কম হয়েছে? এই ১৬ হাজার শিক্ষার্থী অহেতুক কোনো কাগজ ফটোকপি করেননি। এতে কত গাছ বেঁচেছে? তিনবারের জায়গায় মাত্র একবার যেতে হয়েছে বলে এবার শাবিপ্রবিতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক মেয়েদের সংখ্যা হয়েছে বেশি! এভাবে তথ্যপ্রযুক্তির নানা উদ্যোগ আমাদের নষ্ট সময়গুলোকে কাজের সময়ে পরিণত করতে পারে।
কেবল বিল পরিশোধ বা ভর্তিপ্রক্রিয়া নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক এবং উদ্ভাবনী প্রয়োগ আমাদের নষ্ট সময়গুলোকে কাজের সময়ে পরিণত করতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশকে সামনে রেখে এমন অনেক উদ্যোগ আমরা এখন দেখছি। তবে, এগুলোর পাশাপাশি আমাদের নিজেদের ধ্যান-ধারণাও পাল্টাতে হবে। কারণ, যে চিন্তা আমাদের সব সময় কাগজের রসিদ দাবি করতে প্ররোচিত করে, সেটি শেষ বিচারে বদলের পক্ষে নয়। দিনবদলের তো নয়।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
No comments