শিল্প ও পরিবেশ-জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য যা দরকার by মশিউল আলম
সীতাকুণ্ডের উপকূলে পুরোনো জাহাজভাঙা শিল্পে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারায়। যখন এমন ঘটে তখন সংবাদমাধ্যমে খবর হয়, কয়েক দিন লেখালেখি চলে; নড়েচড়ে ওঠে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো। গত ২৬ ডিসেম্বর এ রকম এক দুর্ঘটনায় চারজনের মৃত্যু ও ২৫ জনের আহত হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমে যথারীতি
সাড়া পড়ে গেল; সীতাকুণ্ড সফর করলেন বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী। সরকারের তরফ থেকে বলা হলো, পুরোনো জাহাজ আমদানি ও ভাঙার বিষয়ে একটি নীতিমালা এবং আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করবে এমন বিধিমালা তৈরি করা হবে। ১ জানুয়ারি খবর বেরোল, পরিবেশ অধিদপ্তর ৮৪টি জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডকে পরিবেশগত ছাড়পত্র সংগ্রহ করার জন্য নোটিশ পাঠিয়েছে। কিন্তু এই তত্পরতা যে কিছুদিনের মধ্যে স্তিমিত হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। কেননা প্রায় সব সমস্যার ক্ষেত্রেই স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা বা নিরন্তর নজদারির বদলে তাত্ক্ষণিক বা অস্থায়ী সমাধান খোঁজার প্রবণতা সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে লক্ষ করা যায়। জাহাজভাঙা শিল্প এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে সরকারের অন্তত তিনটি দপ্তরের নিয়মিত নজরদারি প্রয়োজন।
মদিনা এন্টারপ্রাইজ নামের এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি পুরোনো জাহাজ আমদানি ও ভাঙা নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের মার্চ মাসে হাইকোর্ট একটি রায় দিয়েছিলেন। ইংরেজিতে লেখা ২২ পৃষ্ঠা দীর্ঘ সে রায়ের ভাষ্য থেকে এ দেশে জাহাজভাঙা শিল্পের একটা চিত্র পাওয়া যায়।
মদিনা এন্টারপ্রাইজ সিঙ্গাপুরের ইয়ালুম্বা ইন্ক নামের এক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এমটি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি পুরোনো তেলট্যাংকার ভাঙার উদ্দেশ্যে আমদানি করে। নিয়ম অনুযায়ী, ভাঙার উদ্দেশ্যে পুরোনো জাহাজ বিদেশ থেকে আমদানি করার জন্য এলসি খুলতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হয়। মদিনা এন্টারপ্রাইজ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়ে অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্র পায় ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৮। তারপর অধিদপ্তর জানতে পারে, গ্রিনপিস নামের আন্তর্জাতিক সংস্থার ক্ষতিকর পদার্থবাহী জাহাজের তালিকায় ওই পুরোনো তেলট্যাংকারটির নাম রয়েছে; অধিদপ্তর অনাপত্তিপত্রটি বাতিল করে। মদিনা এন্টারপ্রাইজ বাতিলাদেশের বিরুদ্ধে আদালতে রিট করে এবং অধিদপ্তরকে তদন্তের আবেদন জানায়। অধিদপ্তর ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের একজন প্রকৌশলী ও শিপ সার্ভেয়ার, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডক মাস্টার ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান রসায়নবিদকে নিয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট এক তদন্ত কমিটি গঠন করে। সে কমিটি পরের দিনই (২৭ আগস্ট ২০০৮) তদন্ত করে এবং ২৮ আগস্ট প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘সমুদ্রে চলাচলের সময় এ ধরনের জলযানে যে মাত্রায় বিষাক্ত পদার্থ থাকে, এ জাহাজটিতে বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ তার চেয়ে বেশি নয়।’ ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়কে ২০০৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এক চিঠি দিয়ে মদিনা এন্টারপ্রাইজকে দেওয়া অনাপত্তিপত্র বাতিলের আদেশ প্রত্যাহারের ইচ্ছা প্রকাশ করে। তখন অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় আদালতকে জানায় যে সরকার মদিনা এন্টারপ্রাইজের বাতিলাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আদালত ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ এক আদেশে মদিনা এন্টারপ্রাইজকে ‘যথাযথ আইনকানুন মেনে’ উল্লিখিত জাহাজটি ‘ব্যবহারের’ (ভাঙা) স্বাধীনতা দেয়।
এ পর্যায়ে এগিয়ে আসে আইনবিদদের সংগঠন বেলা; ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারা আদালতে রিট আবেদন করে। রিটের শুনানির পর আদালত ১৭ সেপ্টেম্বর এক রুলনিশি জারি করে প্রথমে দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিতাদেশ দেন, পরে এর মেয়াদ আরও বাড়ানো হয়। মদিনা এন্টারপ্রাইজ পাল্টা আপিল করে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২৭ অক্টোবর হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন; কিন্তু তার আগেই মদিনা এন্টারপ্রাইজ আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য করেই জাহাজটি কাটা শুরু করে। বেলা আদালত অবমাননার অভিযোগ তোলে, আবার শুনানি চলে, এভাবে পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্ক চলে। ১৭ মার্চ ২০০৯ হাইকোর্ট বেলার মামলার চূড়ান্ত রায় দেন, যেখানে জাহাজ কাটা বন্ধ করার পাশাপাশি অনুমতিহীনভাবে জাহাজভাঙায় নিয়োজিত সব ইয়ার্ড বন্ধ করে দিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সর্বশেষ আপিল বিভাগ ইয়ার্ডগুলো বন্ধের আদেশ স্থগিত করে জাহাজভাঙা শিল্প সম্পর্কে একটি নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়নের আদেশ দেন।
মদিনা এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে বেলার দীর্ঘ ও জটিল আইনি লড়াইয়ের এই প্রক্রিয়ায় দেশের জাহাজভাঙা শিল্পের মালিক ও এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর আচরণ লক্ষ করা দরকার।
প্রথমত, মদিনা এন্টারপ্রাইজ উল্লিখিত তেলট্যাংকারটি আমদানি করার জন্য এলসি খোলার আগে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্রটি নিয়েছে অধিদপ্তরকে ধোঁকা দিয়ে। প্রতিষ্ঠানটি তাদের আবেদনপত্রে এ তথ্যটি গোপন করেছে যে এমটি এন্টারপ্রাইজ নামের পুরোনো তেলট্যাংকারটি গ্রিনপিসের তালিকাভুক্ত এবং তাতে ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক পদার্থ আছে। আদালতের রায়ে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, মদিনা এন্টারপ্রাইজ সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরকে বিভ্রান্ত (mislead) করেছে।
কিন্তু জাহাজটি গ্রিনপিসের তালিকাভুক্ত, এটা না জানলেও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ জানত যে জাহাজটি ১৯৭৯ সালে জাপানে তৈরি। আর এও তাদের জানা থাকার কথা যে বাংলাদেশের আমদানিনীতি আদেশ (২০০৬—২০০৯) অনুযায়ী ২৫ বছরের বেশি পুরোনো কোনো জাহাজ ভাঙার উদ্দেশ্যে আমদানি করা নিষিদ্ধ। আমদানির সময় এমটি এন্টারপ্রাইজের বয়স হয়েছিল ২৯ বছর। তাহলে কী করে এই জাহাজ আমদানির জন্য মদিনা এন্টারপ্রাইজ সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্র পেল? আদালতের রায়ে এ বিষয়ে বলা হয়েছে: ‘সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর এমটি এন্টারপ্রাইজ নামের পুরোনো জাহাজটি আমদানির জন্য মদিনা এন্টারপ্রাইজকে অনাপত্তিপত্র দিয়েছে এমনভাবে, যেটাকে কারসাজি (subterfuge) বলে আখ্যা দেওয়া যায়।’ সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান রসায়নবিদের ফাইল নোটিং উদ্ধৃত করা হয়েছে আদালতের রায়ে: ‘জাহাজটির তথ্যসমূহ রেজি. সার্টিফিকেট ও এমওএ অনুযায়ী যথাযথ আছে। অনলাইন কানেকশন পাওয়া যায়নি। জাহাজটি গ্রিনপিস তালিকাভুক্ত নয়। এমতাবস্থায় এমটি এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে এনওসি নম্বর ০৮০৭০৩৮ অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।’ আদালত বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এই বলে: ‘এটা বোধগম্য নয়, মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা অনলাইন কানেকশন পাওয়া যায়নি স্বীকার করেও কীভাবে সিদ্ধান্ত দিতে পারলেন যে জাহাজটি গ্রিনপিসের তালিকায় নেই।’ তারপর যখন অধিদপ্তর জানতে পারে জাহাজটি গ্রিনপিসের তালিকাভুক্ত, তখন অনাপত্তিপত্র বাতিল করে, কিন্তু প্রধান রসায়নবিদসহ যেসব কর্মকর্তা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরকে বিভ্রান্ত করে মদিনা এন্টারপ্রাইজকে অনাপত্তিপত্র পাইয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আদালতের রায়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় ফাওজিয়া নামের এক কর্মকর্তার কথা, যিনি অনাপত্তিপত্র বাতিলের সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করতে বারবার সুপারিশ করেন। রায়ে বলা হয়েছে, ‘আমাদের অনুভূতি হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, অর্থাত্ ফাওজিয়ার যোগ্যতা-দক্ষতা নিরূপণের লক্ষ্যে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত; অনুরূপভাবে, প্রধান রসায়নবিদের ভূমিকাও ওপরে বর্ণিত ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নবিদ্ধ।’
দ্বিতীয়ত, দেরিতে হলেও অধিদপ্তর যখন জানতে পারে যে জাহাজটি গ্রিনপিসের ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক পদার্থবাহী জাহাজের তালিকাভুক্ত এবং সে কারণে মদিনা এন্টারপ্রাইজকে দেওয়া আমদানির অনাপত্তিপত্রটি বাতিল করে, তখন মদিনা এন্টারপ্রাইজ আদালতের শরণ নেওয়ার পাশাপাশি অধিদপ্তরকে আবারও বিভ্রান্ত করে। তারা বারবার দাবি করতে থাকে যে গ্রিনপিসের তালিকায় এমটি এন্টারপ্রাইজ নামের তেলট্যাংকারটি নেই। নিউ আটলান্টিয়া নামের যে তেলট্যাংকারটি আছে, সেটিই যে নাম পাল্টে এমটি এন্টারপ্রাইজ হয়েছে, এ তথ্য তারা অস্বীকার করে। সেই সঙ্গে মদিনা এন্টারপ্রাইজ তদন্ত করার জন্য অধিদপ্তরকে আবেদন জানালে অধিদপ্তর তদন্ত কমিটি গঠন করে, কিন্তু জাহাজটি গ্রিনপিসের তালিকায় আছে কি না তা খতিয়ে না দেখে বরং জাহাজটিতে কী পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ আছে তা নিরূপণ করতে যায়। এবং এটা তারা করে খুব তড়িঘড়ি করে। অধিদপ্তরের তৈরি তদন্ত কমিটি মাত্র এক দিনের মধ্যে জাহাজটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয় যে সমুদ্রগামী এ ধরনের অন্য যেকোনো জাহাজে যে মাত্রায় বিষাক্ত পদার্থ থাকে, এমটি এন্টারপ্রাইজ তেলট্যাংকারটিতে তার চেয়ে বেশি নেই। এ প্রসঙ্গে আদালতের রায়ে বলা হয়েছে: ‘সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের উদ্যোগে পরিচালিত তদন্তটির কার্যপরিধি (টার্মস অব রেফারেন্স) দৃশ্যত আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত, উদ্দেশ্যমূলক ও ভ্রান্ত (self-serving, motivated and misconceived)। এতে তদন্তের প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেনি। যে পরীক্ষা করা হয়েছে তা অযৌক্তিক, তদন্ত কমিটির দেওয়া তথ্যগুলো অগ্রহণযোগ্য... তদন্তকারীদের আন্তরিকতা নিয়ে আমরা সন্দিগ্ধ।’ রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর তিন সদস্যের যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল, তা যথাযথ প্রতিনিধিত্বশীল ছিল না, বিশেষ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্ব সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্রের বলে বিদেশ থেকে পুরোনো জাহাজ আমদানি করলেই তা ভাঙা/কাটার কাজ শুরু করা যায় না। এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছ থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হয়। আদালতে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে মদিনা এন্টারপ্রাইজ এমটি এন্টারপ্রাইজ নামের তেলট্যাংকারটি কাটার কাজ শুরু করে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়েই। আদালতের রায়ে মন্তব্য করা হয়েছে, এ ব্যাপারে ‘পরিবেশ অধিদপ্তর সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়েও বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) ও এর অধীনস্থ বিধি-বিধান প্রয়োগে মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।’ শুধু মদিনা এন্টারপ্রাইজ নয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া হিসাবেই ৮৪টি জাহাজ কাটার ইয়ার্ড কাজ করছে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই (বাস্তবে এই সংখ্যা শতাধিক)।
অর্থাত্ জাহাজভাঙা শিল্পের সঙ্গে জড়িত সরকারের দুটি কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে বিরাট ঘাটতি আছে; অনৈতিক অনুশীলনও যে আছে, বেলার মামলার রায়ে তার আভাষ সুস্পষ্ট। এ ছাড়া বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো পুরোনো জাহাজ কাটা শুরু করার আগে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়। গত ২৬ ডিসেম্বর যে জাহাজটিতে বিস্ফোরণ ঘটে চারজন মানুষ মারা গেল, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা দূর থেকে সেটি দেখে ইয়ার্ডের লোকজনকে বলেন, কাটো, কিন্তু পেছনের দিকে ওই অংশটুকু বাদ দিয়ে। তিনি কোনো লিখিত অনুমতি দিয়ে যাননি। এই একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক শিল্পক্ষেত্রের ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা কী মর্মান্তিক। বলা হয়, জাহাজ কাটার মৌখিক অনুমতির ক্ষেত্রেও অবৈধ অর্থযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে জাহাজকাটা শিল্প সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্রগুলোর একটি। প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও প্রাণের ঝুঁকি অত্যধিক। কিন্তু এই শিল্প বন্ধ করার ভাবনা অনেক কারণেই বাস্তবসম্মত নয়। প্রয়োজন এ শিল্পের ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতি সর্বোচ্চ মাত্রায় কমিয়ে ফেলা। সে জন্য দরকার সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলতা, আন্তরিক তত্পরতা ও সততা। আমদানিনীতি আদেশ, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, শ্রম আইন, বাসিল কনভেনশন—এগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী আইনি হাতিয়ার। কিন্তু এসবের যথাযথ প্রয়োগ নেই। গত মঙ্গলবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আগামী দুই মাসের মধ্যে জাহাজভাঙা শিল্প সম্পর্কে পৃথক বিধিমালা ও গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা খুবই ভালো ও দরকারি কাজ। কিন্তু বিধিমালা প্রয়োগ করা না হলে সবই নিষ্ফল। ১৭ মার্চের রায়ে আদালত বিদেশ থেকে পুরোনো জাহাজ আনার আগে সেগুলোর প্রি-ক্লিনিং বা বর্জ্যমুক্ত করা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া নিশ্চিত করতে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর আগের মতোই, অর্থাত্ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও বর্জ্যমুক্তকরণ নিশ্চিত না করেই বিষাক্ত পদার্থবাহী জাহাজ আমদানির অনুমোদন দিয়ে চলেছে। তাই গত মঙ্গলবার আদালত সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছেন, ১৭ মার্চ ২০০৯-এর পর থেকে এ পর্যন্ত কতটি পুরোনো জাহাজ ভাঙার উদ্দেশ্যে আমদানি করা হয়েছে এবং সেগুলো কোথায় কীভাবে বর্জ্যমুক্ত করা হয়েছে সে সম্পর্কে জানাতে।
বেলার মামলার রায়ে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, এবং ১৭ মার্চ ২০০৯ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ রায়টির পরও যে চিত্রে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর তেমন আচরণের বিচার ও শাস্তি না হলে অবস্থার উন্নতি হবে না। তাদের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই সবচেয়ে জরুরি কাজ।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
মদিনা এন্টারপ্রাইজ নামের এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি পুরোনো জাহাজ আমদানি ও ভাঙা নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের মার্চ মাসে হাইকোর্ট একটি রায় দিয়েছিলেন। ইংরেজিতে লেখা ২২ পৃষ্ঠা দীর্ঘ সে রায়ের ভাষ্য থেকে এ দেশে জাহাজভাঙা শিল্পের একটা চিত্র পাওয়া যায়।
মদিনা এন্টারপ্রাইজ সিঙ্গাপুরের ইয়ালুম্বা ইন্ক নামের এক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এমটি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি পুরোনো তেলট্যাংকার ভাঙার উদ্দেশ্যে আমদানি করে। নিয়ম অনুযায়ী, ভাঙার উদ্দেশ্যে পুরোনো জাহাজ বিদেশ থেকে আমদানি করার জন্য এলসি খুলতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হয়। মদিনা এন্টারপ্রাইজ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়ে অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্র পায় ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৮। তারপর অধিদপ্তর জানতে পারে, গ্রিনপিস নামের আন্তর্জাতিক সংস্থার ক্ষতিকর পদার্থবাহী জাহাজের তালিকায় ওই পুরোনো তেলট্যাংকারটির নাম রয়েছে; অধিদপ্তর অনাপত্তিপত্রটি বাতিল করে। মদিনা এন্টারপ্রাইজ বাতিলাদেশের বিরুদ্ধে আদালতে রিট করে এবং অধিদপ্তরকে তদন্তের আবেদন জানায়। অধিদপ্তর ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের একজন প্রকৌশলী ও শিপ সার্ভেয়ার, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডক মাস্টার ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান রসায়নবিদকে নিয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট এক তদন্ত কমিটি গঠন করে। সে কমিটি পরের দিনই (২৭ আগস্ট ২০০৮) তদন্ত করে এবং ২৮ আগস্ট প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘সমুদ্রে চলাচলের সময় এ ধরনের জলযানে যে মাত্রায় বিষাক্ত পদার্থ থাকে, এ জাহাজটিতে বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ তার চেয়ে বেশি নয়।’ ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়কে ২০০৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এক চিঠি দিয়ে মদিনা এন্টারপ্রাইজকে দেওয়া অনাপত্তিপত্র বাতিলের আদেশ প্রত্যাহারের ইচ্ছা প্রকাশ করে। তখন অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় আদালতকে জানায় যে সরকার মদিনা এন্টারপ্রাইজের বাতিলাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আদালত ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ এক আদেশে মদিনা এন্টারপ্রাইজকে ‘যথাযথ আইনকানুন মেনে’ উল্লিখিত জাহাজটি ‘ব্যবহারের’ (ভাঙা) স্বাধীনতা দেয়।
এ পর্যায়ে এগিয়ে আসে আইনবিদদের সংগঠন বেলা; ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারা আদালতে রিট আবেদন করে। রিটের শুনানির পর আদালত ১৭ সেপ্টেম্বর এক রুলনিশি জারি করে প্রথমে দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিতাদেশ দেন, পরে এর মেয়াদ আরও বাড়ানো হয়। মদিনা এন্টারপ্রাইজ পাল্টা আপিল করে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২৭ অক্টোবর হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন; কিন্তু তার আগেই মদিনা এন্টারপ্রাইজ আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য করেই জাহাজটি কাটা শুরু করে। বেলা আদালত অবমাননার অভিযোগ তোলে, আবার শুনানি চলে, এভাবে পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্ক চলে। ১৭ মার্চ ২০০৯ হাইকোর্ট বেলার মামলার চূড়ান্ত রায় দেন, যেখানে জাহাজ কাটা বন্ধ করার পাশাপাশি অনুমতিহীনভাবে জাহাজভাঙায় নিয়োজিত সব ইয়ার্ড বন্ধ করে দিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সর্বশেষ আপিল বিভাগ ইয়ার্ডগুলো বন্ধের আদেশ স্থগিত করে জাহাজভাঙা শিল্প সম্পর্কে একটি নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়নের আদেশ দেন।
মদিনা এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে বেলার দীর্ঘ ও জটিল আইনি লড়াইয়ের এই প্রক্রিয়ায় দেশের জাহাজভাঙা শিল্পের মালিক ও এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর আচরণ লক্ষ করা দরকার।
প্রথমত, মদিনা এন্টারপ্রাইজ উল্লিখিত তেলট্যাংকারটি আমদানি করার জন্য এলসি খোলার আগে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্রটি নিয়েছে অধিদপ্তরকে ধোঁকা দিয়ে। প্রতিষ্ঠানটি তাদের আবেদনপত্রে এ তথ্যটি গোপন করেছে যে এমটি এন্টারপ্রাইজ নামের পুরোনো তেলট্যাংকারটি গ্রিনপিসের তালিকাভুক্ত এবং তাতে ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক পদার্থ আছে। আদালতের রায়ে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, মদিনা এন্টারপ্রাইজ সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরকে বিভ্রান্ত (mislead) করেছে।
কিন্তু জাহাজটি গ্রিনপিসের তালিকাভুক্ত, এটা না জানলেও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ জানত যে জাহাজটি ১৯৭৯ সালে জাপানে তৈরি। আর এও তাদের জানা থাকার কথা যে বাংলাদেশের আমদানিনীতি আদেশ (২০০৬—২০০৯) অনুযায়ী ২৫ বছরের বেশি পুরোনো কোনো জাহাজ ভাঙার উদ্দেশ্যে আমদানি করা নিষিদ্ধ। আমদানির সময় এমটি এন্টারপ্রাইজের বয়স হয়েছিল ২৯ বছর। তাহলে কী করে এই জাহাজ আমদানির জন্য মদিনা এন্টারপ্রাইজ সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্র পেল? আদালতের রায়ে এ বিষয়ে বলা হয়েছে: ‘সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর এমটি এন্টারপ্রাইজ নামের পুরোনো জাহাজটি আমদানির জন্য মদিনা এন্টারপ্রাইজকে অনাপত্তিপত্র দিয়েছে এমনভাবে, যেটাকে কারসাজি (subterfuge) বলে আখ্যা দেওয়া যায়।’ সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান রসায়নবিদের ফাইল নোটিং উদ্ধৃত করা হয়েছে আদালতের রায়ে: ‘জাহাজটির তথ্যসমূহ রেজি. সার্টিফিকেট ও এমওএ অনুযায়ী যথাযথ আছে। অনলাইন কানেকশন পাওয়া যায়নি। জাহাজটি গ্রিনপিস তালিকাভুক্ত নয়। এমতাবস্থায় এমটি এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে এনওসি নম্বর ০৮০৭০৩৮ অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।’ আদালত বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এই বলে: ‘এটা বোধগম্য নয়, মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা অনলাইন কানেকশন পাওয়া যায়নি স্বীকার করেও কীভাবে সিদ্ধান্ত দিতে পারলেন যে জাহাজটি গ্রিনপিসের তালিকায় নেই।’ তারপর যখন অধিদপ্তর জানতে পারে জাহাজটি গ্রিনপিসের তালিকাভুক্ত, তখন অনাপত্তিপত্র বাতিল করে, কিন্তু প্রধান রসায়নবিদসহ যেসব কর্মকর্তা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরকে বিভ্রান্ত করে মদিনা এন্টারপ্রাইজকে অনাপত্তিপত্র পাইয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আদালতের রায়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় ফাওজিয়া নামের এক কর্মকর্তার কথা, যিনি অনাপত্তিপত্র বাতিলের সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করতে বারবার সুপারিশ করেন। রায়ে বলা হয়েছে, ‘আমাদের অনুভূতি হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, অর্থাত্ ফাওজিয়ার যোগ্যতা-দক্ষতা নিরূপণের লক্ষ্যে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত; অনুরূপভাবে, প্রধান রসায়নবিদের ভূমিকাও ওপরে বর্ণিত ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নবিদ্ধ।’
দ্বিতীয়ত, দেরিতে হলেও অধিদপ্তর যখন জানতে পারে যে জাহাজটি গ্রিনপিসের ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক পদার্থবাহী জাহাজের তালিকাভুক্ত এবং সে কারণে মদিনা এন্টারপ্রাইজকে দেওয়া আমদানির অনাপত্তিপত্রটি বাতিল করে, তখন মদিনা এন্টারপ্রাইজ আদালতের শরণ নেওয়ার পাশাপাশি অধিদপ্তরকে আবারও বিভ্রান্ত করে। তারা বারবার দাবি করতে থাকে যে গ্রিনপিসের তালিকায় এমটি এন্টারপ্রাইজ নামের তেলট্যাংকারটি নেই। নিউ আটলান্টিয়া নামের যে তেলট্যাংকারটি আছে, সেটিই যে নাম পাল্টে এমটি এন্টারপ্রাইজ হয়েছে, এ তথ্য তারা অস্বীকার করে। সেই সঙ্গে মদিনা এন্টারপ্রাইজ তদন্ত করার জন্য অধিদপ্তরকে আবেদন জানালে অধিদপ্তর তদন্ত কমিটি গঠন করে, কিন্তু জাহাজটি গ্রিনপিসের তালিকায় আছে কি না তা খতিয়ে না দেখে বরং জাহাজটিতে কী পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ আছে তা নিরূপণ করতে যায়। এবং এটা তারা করে খুব তড়িঘড়ি করে। অধিদপ্তরের তৈরি তদন্ত কমিটি মাত্র এক দিনের মধ্যে জাহাজটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয় যে সমুদ্রগামী এ ধরনের অন্য যেকোনো জাহাজে যে মাত্রায় বিষাক্ত পদার্থ থাকে, এমটি এন্টারপ্রাইজ তেলট্যাংকারটিতে তার চেয়ে বেশি নেই। এ প্রসঙ্গে আদালতের রায়ে বলা হয়েছে: ‘সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের উদ্যোগে পরিচালিত তদন্তটির কার্যপরিধি (টার্মস অব রেফারেন্স) দৃশ্যত আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত, উদ্দেশ্যমূলক ও ভ্রান্ত (self-serving, motivated and misconceived)। এতে তদন্তের প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেনি। যে পরীক্ষা করা হয়েছে তা অযৌক্তিক, তদন্ত কমিটির দেওয়া তথ্যগুলো অগ্রহণযোগ্য... তদন্তকারীদের আন্তরিকতা নিয়ে আমরা সন্দিগ্ধ।’ রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর তিন সদস্যের যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল, তা যথাযথ প্রতিনিধিত্বশীল ছিল না, বিশেষ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্ব সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্রের বলে বিদেশ থেকে পুরোনো জাহাজ আমদানি করলেই তা ভাঙা/কাটার কাজ শুরু করা যায় না। এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছ থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হয়। আদালতে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে মদিনা এন্টারপ্রাইজ এমটি এন্টারপ্রাইজ নামের তেলট্যাংকারটি কাটার কাজ শুরু করে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়েই। আদালতের রায়ে মন্তব্য করা হয়েছে, এ ব্যাপারে ‘পরিবেশ অধিদপ্তর সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়েও বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) ও এর অধীনস্থ বিধি-বিধান প্রয়োগে মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।’ শুধু মদিনা এন্টারপ্রাইজ নয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া হিসাবেই ৮৪টি জাহাজ কাটার ইয়ার্ড কাজ করছে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই (বাস্তবে এই সংখ্যা শতাধিক)।
অর্থাত্ জাহাজভাঙা শিল্পের সঙ্গে জড়িত সরকারের দুটি কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে বিরাট ঘাটতি আছে; অনৈতিক অনুশীলনও যে আছে, বেলার মামলার রায়ে তার আভাষ সুস্পষ্ট। এ ছাড়া বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো পুরোনো জাহাজ কাটা শুরু করার আগে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়। গত ২৬ ডিসেম্বর যে জাহাজটিতে বিস্ফোরণ ঘটে চারজন মানুষ মারা গেল, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা দূর থেকে সেটি দেখে ইয়ার্ডের লোকজনকে বলেন, কাটো, কিন্তু পেছনের দিকে ওই অংশটুকু বাদ দিয়ে। তিনি কোনো লিখিত অনুমতি দিয়ে যাননি। এই একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক শিল্পক্ষেত্রের ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা কী মর্মান্তিক। বলা হয়, জাহাজ কাটার মৌখিক অনুমতির ক্ষেত্রেও অবৈধ অর্থযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে জাহাজকাটা শিল্প সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্রগুলোর একটি। প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও প্রাণের ঝুঁকি অত্যধিক। কিন্তু এই শিল্প বন্ধ করার ভাবনা অনেক কারণেই বাস্তবসম্মত নয়। প্রয়োজন এ শিল্পের ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতি সর্বোচ্চ মাত্রায় কমিয়ে ফেলা। সে জন্য দরকার সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলতা, আন্তরিক তত্পরতা ও সততা। আমদানিনীতি আদেশ, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, শ্রম আইন, বাসিল কনভেনশন—এগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী আইনি হাতিয়ার। কিন্তু এসবের যথাযথ প্রয়োগ নেই। গত মঙ্গলবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আগামী দুই মাসের মধ্যে জাহাজভাঙা শিল্প সম্পর্কে পৃথক বিধিমালা ও গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা খুবই ভালো ও দরকারি কাজ। কিন্তু বিধিমালা প্রয়োগ করা না হলে সবই নিষ্ফল। ১৭ মার্চের রায়ে আদালত বিদেশ থেকে পুরোনো জাহাজ আনার আগে সেগুলোর প্রি-ক্লিনিং বা বর্জ্যমুক্ত করা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া নিশ্চিত করতে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর আগের মতোই, অর্থাত্ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও বর্জ্যমুক্তকরণ নিশ্চিত না করেই বিষাক্ত পদার্থবাহী জাহাজ আমদানির অনুমোদন দিয়ে চলেছে। তাই গত মঙ্গলবার আদালত সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছেন, ১৭ মার্চ ২০০৯-এর পর থেকে এ পর্যন্ত কতটি পুরোনো জাহাজ ভাঙার উদ্দেশ্যে আমদানি করা হয়েছে এবং সেগুলো কোথায় কীভাবে বর্জ্যমুক্ত করা হয়েছে সে সম্পর্কে জানাতে।
বেলার মামলার রায়ে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, এবং ১৭ মার্চ ২০০৯ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ রায়টির পরও যে চিত্রে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর তেমন আচরণের বিচার ও শাস্তি না হলে অবস্থার উন্নতি হবে না। তাদের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই সবচেয়ে জরুরি কাজ।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments