সরল গরল-প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সমীকরণ by মিজানুর রহমান খান
প্রধান বিচারপতি পদে দুই সপ্তাহ পর কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিতে পারে। কারণ, দায়িত্বশীল সূত্রগুলো থেকে ইঙ্গিত মিলছে, প্রধান বিচারপতি হিসেবে এবার এরই মধ্যে দুবার পাশ কাটানো (সুপারসিডেড) বিচারপতি মো. ফজলুল করিমকে নিয়োগ করা হতে পারে।
এই সম্ভাবনাকে ঘিরে সুপ্রিম কোর্টের অন্দরমহলে নানামুখী স্রোত বইছে। চলছে বিচার-বিশ্লেষণ।
সংবিধান অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতি স্বাধীন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ফাইলই শুধু প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায় না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমরা দৃশ্যত দলীয়ভাবে ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে ব্যক্তিগতভাবে অতিশয় অনুগত রাষ্ট্রপতি পাচ্ছি। তাই রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী কী করছেন আর কী করছেন না, তা নিয়ে জনমনে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। শপথগ্রহণের সময় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) কোনো ভুল করতে পারেন না।’
জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী বিচারপতি মো. ফজলুল করিমের প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ছিল আরও অনেক আগে। অবশ্য আওয়ামী লীগের বিগত সরকার অন্যদের ডিঙিয়ে তাঁকে আপিল বিভাগে এনেছিল। বিচারপতি ফজলুল করিম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়দানকারী অন্যতম বিচারক। ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিভক্ত রায় দিয়েছিলেন। উভয় বিচারপতি ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে একমত হন। তাঁরা হলেন ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার খান, খন্দকার আবদুর রশিদ, বজলুল হুদা, শরিফুল হক ডালিম, এ এম রাশেদ চৌধুরী, এ কে এম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), নূর চৌধুরী ও আবদুল আজিজ পাশা। ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের মৃত্যুদণ্ড কোন আইনে গণ্য হবে, সে প্রশ্নে তাঁরা ভিন্ন মত দেন। বিচারপতি মো. রুহুল আমিন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), মেজর আহমেদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম, ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিনকে খালাস দেন। কিন্তু বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক উল্লিখিত ১৫ জনেরই মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। এ অবস্থায় বিচারপতি মো. ফজলুল করিম বিভক্ত রায় শোনার জন্য তৃতীয় বিচারক নিযুক্ত হন। তখন তাঁর সামনে মূল বিচার্য হয়ে দাঁড়ায় পাঁচজনের দণ্ড কিংবা খালাস বহাল রাখা-না রাখা। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল বিচারপতি মো. ফজলুল করিম তাঁর রায়ে তিনজনকে (মেজর আহমেদ শরিফুল, লে. কিসমত ও লে. নাজমুল) খালাস দেন। আর আর্টিলারির মুহিউদ্দিন ও রিসালদার মোসলেমের মৃত্যুদণ্ড এবং ক্যাপ্টেন মাজেদের বিষয়ে আইনের প্রশ্নে বিচারপতি খায়রুল হকের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হন। এক অর্থে তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ নেই। উপরন্তু যে কারণ দেখিয়ে তিনি তিনজনকে খালাস দেন, তা অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়কে ঘিরে বিচারপতি মো. ফজলুল করিমের বিরুদ্ধে কঠিন ও প্রকাশ্য সমালোচনাও রয়েছে। তিনি ওই রায়ের পর দুই হাত উঁচিয়ে অবিচারকসুলভ ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়েছিলেন। সেই ছবি সংবাদপত্রেও ছাপা হয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এক অনুষ্ঠানে এ জন্য তিনি সমালোচিত হন। তিনি শারীরিকভাবে দায়িত্ব পালনে সমর্থ কি না, সে প্রশ্নও কম জোরালো নয়।
প্রধান বিচারপতি পদে বিচারপতি ফজলুল করিমকে এর আগে কেন দুবার সুপারসিড বা পাশ কাটানো হলো, তার লিখিত কারণ জানা যাবে না। এ বিষয়ে বঙ্গভবন, আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্ট কীভাবে নথিপত্র সংরক্ষণ করে, তা জানা যায় না। এ ব্যাপারে একটি নিদারুণ পরিহাস চলছে। আমাদের নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ ধনুকভাঙা পণ করেছে, তারা এখানে কিছুতেই স্বচ্ছতা আনবে না। বড় আশা করেছিলাম, সুপ্রিম কোর্ট হয়তো নিজ মর্যাদা সুরক্ষার তাগিদে একটা ভূমিকা রাখবেন। ভারতে কী হচ্ছে, সে উদাহরণ দিলে অনেকে ভ্রূ কুঞ্চিত করেন। কিন্তু তাই বলে আমরা কি পাকিস্তানের মতোও হতে পারি না? ১৯৯৬ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট আল জিহাদ ট্রাস্ট মামলায় একটি মাইলফলক রায় দেন। এর সারকথা হলো, জ্যেষ্ঠ বিচারকই প্রধান বিচারপতি হবেন। যদি এর ব্যত্যয় ঘটাতে হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি/নির্বাহী বিভাগকে লিখিত কারণ দেখাতে হবে। একইভাবে প্রধান বিচারপতির সুপারিশমতেই নতুন বিচারক নিয়োগ পাবেন। সরকার মানতে না পারলে লিখিত কারণ দেখাবে। স্রেফ রাজনৈতিক ঘেঁষা বলেই কাউকে অযোগ্য বলা যাবে না। যদিও এটা সত্য, পাকিস্তানের বিচারক নিয়োগসংক্রান্ত রোগবালাই দূর হয়নি। নানা ঝকমারি চলছেই। বিশিষ্ট পাকিস্তানি সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী আই এ রহমানের কাছ থেকে একটি নিবন্ধ পেলাম। ২১ জানুয়ারি তিনি লিখেছেন, সুশীল সমাজ জোরেশোরে আওয়াজ তুলেছে যে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই সংসদের উভয় কক্ষের নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারি নিশ্চয় ‘গণতন্ত্র সনদ’ ভুলে গেছেন। কারণ তিনিই তো এখন গণতন্ত্রের দেবতা! তাঁর প্রয়াত স্ত্রী বেনজির ভুট্টো ও প্রতিদ্বন্দ্বী নওয়াজ শরিফ তাঁদের নির্বাসিত জীবনে ওই সনদে সই করেছিলেন। এটা কিছুটা আমাদের সেই পরিত্যক্ত তিন জোটের রূপরেখার মতো। জারদারি হয়তো সনদ মেনে বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠন বা গণশুনানির আয়োজন করবেন না। সুশীল সমাজের দাবিও তিনি অগ্রাহ্য করবেন। কারণ, সেনা শাসকদের তিনি খুব লজ্জা দিতে পারেন না! তাই আল জিহাদ ট্রাস্টের নন্দিত নির্দেশনা উপেক্ষিত থাকবে। তবুও বলব, এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পর্যায়ে আমরা উঠতে পারলাম না। ১০ বিচারকের মামলায় বিচারপতি মো. আবদুর রশীদের নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর বেঞ্চ টেনেহিঁচড়ে একটু তুলেছিলেন, আপিল বিভাগ ফেলে দিয়েছেন। আল জিহাদে ভর করে হাইকোর্ট প্রায় অভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছিলেন, কিন্তু আপিল বিভাগের তা মনঃপূত হয়নি। তাঁরা একটি ভালো রায়ের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো বিসর্জন দিয়েছেন। সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলেছেন। তাঁদের রায় গোপনে বিচারক নিয়োগ রীতির জন্য একটি দুর্ভাগ্যজনক রক্ষাকবচ। দ্বিতীয়ত, আমাদের লেজওয়ালা সুশীল সমাজ ও বার গোপন বিচারক নিয়োগে এখনো পর্যন্ত কার্যত ঐক্যবদ্ধ। মাঝেমধ্যে অনেক অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, টিভি পর্দার তারকা, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী স্বচ্ছতা নিয়ে কখনো কথা বলেন বটে। কিন্তু তাকে বাস্তবে রূপ দিতে তাঁদের কোনো আন্তরিক উদ্যোগ কিংবা প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না। তাই আওয়ামী লীগ যথারীতি গোপনীয়তা বজায় রেখেই নতুন অতিরিক্ত বিচারক নেওয়ার প্রস্তুতির পাশাপাশি তার চলতি মেয়াদে দ্বিতীয়বার প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে যাচ্ছে।
জরুরি অবস্থায় বিচারপতি মো. ফজলুল করিমকে পাশ কাটিয়ে বিচারপতি মো. রুহুল আমিনকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল। তখন বড় তর্ক ওঠেনি। প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ফজলুল করিমের অবসরে যাওয়ার তারিখ যথাক্রমে ২০১০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ও ২৯ সেপ্টেম্বর। এরপরে আছেন বিচারপতি মো. আবদুল মতিন ও বিচারপতি শাহ আবু নঈম মোমিনুর রহমান। তাঁদের নিয়ে রয়েছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। বিচারপতি মতিন ইনডেমনিটি বাতিলের পক্ষে রায়দানকারী। যদিও তিনি পরে ব্যক্তিগত ‘নিরাপত্তাজনিত’ কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শুনতে বিব্রত হয়েছিলেন। বিচারপতি শাহ আবু নঈমকে নিয়েও আওয়ামী লীগ শিবিরে খুঁতখুঁতানি রয়েছে। তাঁকে আপিল বিভাগে নেওয়া হবে কি না, সে প্রশ্ন ছিল। তিনি শেখ হাসিনার অবৈধ সম্পদের বিবরণী মামলা কোয়াশ করে আলোচিত হয়েছিলেন। জরুরি অবস্থায় তিনি তাঁর অনেক বিচারিক আদেশের মাধ্যমে যথেষ্ট সক্রিয় ও সাহসী ভূমিকা রাখেন বলে মত আছে। তিনি তখন ‘আইনের’ ঝাণ্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। আবার বিচারপতি আবদুল মতিন তখন আপিল বিভাগে থেকে অনেক ক্ষেত্রে সেসব আদেশ উল্টে সঠিক ভূমিকা রাখেন বলে মনে করা হয়।
বর্তমান সংসদের স্বাভাবিক মৃত্যু তারিখ ৩০ জানুয়ারি ২০১৪। জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হলে বিচারপতি শাহ আবু নঈম মোমিনুর রহমান ওই সময় সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে থাকবেন। বিচারপতি মতিন ও বিচারপতি নঈমের অবসরে যাওয়ার তারিখ যথাক্রমে ২৫ ডিসেম্বর ২০১০ ও ১৪ নভেম্বর ২০১১। পঞ্চম সংশোধনী মামলার আলোচিত রায়দানকারী বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের অবসরে যাওয়ার তারিখটিও বিবেচ্য। তিনি অবসরে যাবেন ১৭ মে ২০১১। যদি বিচারপতি মো. ফজলুল করিমকে এখন প্রধান বিচারপতি করা হয়, তাহলে বিচারপতি মো. আবদুল মতিনের সম্ভাবনা তিরোহিত হবে। এরপর বিচারপতি ফজলুল করিম যদি আগেভাগে পদত্যাগ না করেন, তাহলে জ্যেষ্ঠতার শর্তে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা বিচারপতি শাহ আবু নঈমের। আর তাঁকে প্রধান বিচারপতি করা হলে বিচারপতি বিজন কুমার দাস ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রধান বিচারপতি হওয়ার সুযোগ থাকবে না। বিচারপতি বিজন কুমার দাস অবসরে যাবেন ১০ এপ্রিল ২০১০। বিচারপতি খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হবেন এমনটা জানা যায়। কিন্তু তা কখন সেটা জানা যায় না। অবশ্য তাঁকে প্রধান বিচারপতি করা হলে এবং সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তাঁকে ঘিরে আদৌ কথা উঠলে তিনি দ্রুত বিব্রত হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে অবাক হব না। কারণ, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের এ ধরনের পদ গ্রহণের বিরুদ্ধে তাঁর একটি মাইলফলক রায় আছে। আমরা এই রায় মেনে সংবিধান সংশোধনে শাসক দলের আগ্রহ দেখি না। আগ্রহ দেখি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপে।
গত ডিসেম্বরে প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন অবসরে যাওয়ার পর বিচারপতি মো. ফজলুল করিমকে নতুন প্রধান বিচারপতি করা যেত। সে ক্ষেত্রে তিনি এই পদে নয় মাস থাকতেন। কিন্তু বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম প্রধান বিচারপতি হতে পারতেন না। কারণ, মো. ফজলুল করিম প্রধান বিচারপতি পদে বহাল থাকতেই ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে অবসরে যেতে হতো।
প্রধান বিচারপতি পদটি উল্লিখিত ঘরানার বিচার-বিবেচনার ঊর্ধ্বে রাখার কথা। অথচ নির্বাহী বিভাগের পক্ষে এ রকম চিন্তাভাবনা করা সম্ভব হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা বজায় থাকবে বলে আশঙ্কা করা চলে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বিচারপতি নিয়োগের মতোই গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে। জানা যায়, বর্তমান প্রধান বিচারপতি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, ‘বিচারপতি নিয়োগে গোপনীয়তার নীতি অনুসরণ করা উচিত নয়।’ জ্যেষ্ঠতার নীতি আঁকড়ে ধরা যেমন কাম্য নয়, তেমনি কেন জ্যেষ্ঠতার বিচ্যুতি ঘটল, তার একটা সদুত্তর থাকা দরকার। দিল্লি হাইকোর্টের সাম্প্রতিক চমকপ্রদ রায়ে ভারতের প্রধান বিচারপতি হেরে গেছেন। দিল্লি হাইকোর্ট বলেছেন, প্রধান বিচারপতির দপ্তর পাবলিক অফিস। সেখানে কী ঘটছে তা জানার অধিকার জনগণের আছে। আমরা একসুরে বলব, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কে এবং কেন হচ্ছেন, তা আগে জানার অধিকারও জনগণের আছে। আমাদের একজন ‘জুডিশিয়াল স্টেটসম্যান’ দরকার।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক
mrkhanbd@gmail.com
সংবিধান অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতি স্বাধীন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ফাইলই শুধু প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায় না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমরা দৃশ্যত দলীয়ভাবে ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে ব্যক্তিগতভাবে অতিশয় অনুগত রাষ্ট্রপতি পাচ্ছি। তাই রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী কী করছেন আর কী করছেন না, তা নিয়ে জনমনে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। শপথগ্রহণের সময় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) কোনো ভুল করতে পারেন না।’
জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী বিচারপতি মো. ফজলুল করিমের প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ছিল আরও অনেক আগে। অবশ্য আওয়ামী লীগের বিগত সরকার অন্যদের ডিঙিয়ে তাঁকে আপিল বিভাগে এনেছিল। বিচারপতি ফজলুল করিম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়দানকারী অন্যতম বিচারক। ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিভক্ত রায় দিয়েছিলেন। উভয় বিচারপতি ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে একমত হন। তাঁরা হলেন ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার খান, খন্দকার আবদুর রশিদ, বজলুল হুদা, শরিফুল হক ডালিম, এ এম রাশেদ চৌধুরী, এ কে এম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), নূর চৌধুরী ও আবদুল আজিজ পাশা। ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের মৃত্যুদণ্ড কোন আইনে গণ্য হবে, সে প্রশ্নে তাঁরা ভিন্ন মত দেন। বিচারপতি মো. রুহুল আমিন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), মেজর আহমেদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম, ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিনকে খালাস দেন। কিন্তু বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক উল্লিখিত ১৫ জনেরই মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। এ অবস্থায় বিচারপতি মো. ফজলুল করিম বিভক্ত রায় শোনার জন্য তৃতীয় বিচারক নিযুক্ত হন। তখন তাঁর সামনে মূল বিচার্য হয়ে দাঁড়ায় পাঁচজনের দণ্ড কিংবা খালাস বহাল রাখা-না রাখা। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল বিচারপতি মো. ফজলুল করিম তাঁর রায়ে তিনজনকে (মেজর আহমেদ শরিফুল, লে. কিসমত ও লে. নাজমুল) খালাস দেন। আর আর্টিলারির মুহিউদ্দিন ও রিসালদার মোসলেমের মৃত্যুদণ্ড এবং ক্যাপ্টেন মাজেদের বিষয়ে আইনের প্রশ্নে বিচারপতি খায়রুল হকের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হন। এক অর্থে তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ নেই। উপরন্তু যে কারণ দেখিয়ে তিনি তিনজনকে খালাস দেন, তা অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়কে ঘিরে বিচারপতি মো. ফজলুল করিমের বিরুদ্ধে কঠিন ও প্রকাশ্য সমালোচনাও রয়েছে। তিনি ওই রায়ের পর দুই হাত উঁচিয়ে অবিচারকসুলভ ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়েছিলেন। সেই ছবি সংবাদপত্রেও ছাপা হয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এক অনুষ্ঠানে এ জন্য তিনি সমালোচিত হন। তিনি শারীরিকভাবে দায়িত্ব পালনে সমর্থ কি না, সে প্রশ্নও কম জোরালো নয়।
প্রধান বিচারপতি পদে বিচারপতি ফজলুল করিমকে এর আগে কেন দুবার সুপারসিড বা পাশ কাটানো হলো, তার লিখিত কারণ জানা যাবে না। এ বিষয়ে বঙ্গভবন, আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্ট কীভাবে নথিপত্র সংরক্ষণ করে, তা জানা যায় না। এ ব্যাপারে একটি নিদারুণ পরিহাস চলছে। আমাদের নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ ধনুকভাঙা পণ করেছে, তারা এখানে কিছুতেই স্বচ্ছতা আনবে না। বড় আশা করেছিলাম, সুপ্রিম কোর্ট হয়তো নিজ মর্যাদা সুরক্ষার তাগিদে একটা ভূমিকা রাখবেন। ভারতে কী হচ্ছে, সে উদাহরণ দিলে অনেকে ভ্রূ কুঞ্চিত করেন। কিন্তু তাই বলে আমরা কি পাকিস্তানের মতোও হতে পারি না? ১৯৯৬ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট আল জিহাদ ট্রাস্ট মামলায় একটি মাইলফলক রায় দেন। এর সারকথা হলো, জ্যেষ্ঠ বিচারকই প্রধান বিচারপতি হবেন। যদি এর ব্যত্যয় ঘটাতে হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি/নির্বাহী বিভাগকে লিখিত কারণ দেখাতে হবে। একইভাবে প্রধান বিচারপতির সুপারিশমতেই নতুন বিচারক নিয়োগ পাবেন। সরকার মানতে না পারলে লিখিত কারণ দেখাবে। স্রেফ রাজনৈতিক ঘেঁষা বলেই কাউকে অযোগ্য বলা যাবে না। যদিও এটা সত্য, পাকিস্তানের বিচারক নিয়োগসংক্রান্ত রোগবালাই দূর হয়নি। নানা ঝকমারি চলছেই। বিশিষ্ট পাকিস্তানি সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী আই এ রহমানের কাছ থেকে একটি নিবন্ধ পেলাম। ২১ জানুয়ারি তিনি লিখেছেন, সুশীল সমাজ জোরেশোরে আওয়াজ তুলেছে যে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই সংসদের উভয় কক্ষের নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারি নিশ্চয় ‘গণতন্ত্র সনদ’ ভুলে গেছেন। কারণ তিনিই তো এখন গণতন্ত্রের দেবতা! তাঁর প্রয়াত স্ত্রী বেনজির ভুট্টো ও প্রতিদ্বন্দ্বী নওয়াজ শরিফ তাঁদের নির্বাসিত জীবনে ওই সনদে সই করেছিলেন। এটা কিছুটা আমাদের সেই পরিত্যক্ত তিন জোটের রূপরেখার মতো। জারদারি হয়তো সনদ মেনে বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠন বা গণশুনানির আয়োজন করবেন না। সুশীল সমাজের দাবিও তিনি অগ্রাহ্য করবেন। কারণ, সেনা শাসকদের তিনি খুব লজ্জা দিতে পারেন না! তাই আল জিহাদ ট্রাস্টের নন্দিত নির্দেশনা উপেক্ষিত থাকবে। তবুও বলব, এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পর্যায়ে আমরা উঠতে পারলাম না। ১০ বিচারকের মামলায় বিচারপতি মো. আবদুর রশীদের নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর বেঞ্চ টেনেহিঁচড়ে একটু তুলেছিলেন, আপিল বিভাগ ফেলে দিয়েছেন। আল জিহাদে ভর করে হাইকোর্ট প্রায় অভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছিলেন, কিন্তু আপিল বিভাগের তা মনঃপূত হয়নি। তাঁরা একটি ভালো রায়ের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো বিসর্জন দিয়েছেন। সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলেছেন। তাঁদের রায় গোপনে বিচারক নিয়োগ রীতির জন্য একটি দুর্ভাগ্যজনক রক্ষাকবচ। দ্বিতীয়ত, আমাদের লেজওয়ালা সুশীল সমাজ ও বার গোপন বিচারক নিয়োগে এখনো পর্যন্ত কার্যত ঐক্যবদ্ধ। মাঝেমধ্যে অনেক অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, টিভি পর্দার তারকা, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী স্বচ্ছতা নিয়ে কখনো কথা বলেন বটে। কিন্তু তাকে বাস্তবে রূপ দিতে তাঁদের কোনো আন্তরিক উদ্যোগ কিংবা প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না। তাই আওয়ামী লীগ যথারীতি গোপনীয়তা বজায় রেখেই নতুন অতিরিক্ত বিচারক নেওয়ার প্রস্তুতির পাশাপাশি তার চলতি মেয়াদে দ্বিতীয়বার প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে যাচ্ছে।
জরুরি অবস্থায় বিচারপতি মো. ফজলুল করিমকে পাশ কাটিয়ে বিচারপতি মো. রুহুল আমিনকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল। তখন বড় তর্ক ওঠেনি। প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ফজলুল করিমের অবসরে যাওয়ার তারিখ যথাক্রমে ২০১০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ও ২৯ সেপ্টেম্বর। এরপরে আছেন বিচারপতি মো. আবদুল মতিন ও বিচারপতি শাহ আবু নঈম মোমিনুর রহমান। তাঁদের নিয়ে রয়েছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। বিচারপতি মতিন ইনডেমনিটি বাতিলের পক্ষে রায়দানকারী। যদিও তিনি পরে ব্যক্তিগত ‘নিরাপত্তাজনিত’ কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শুনতে বিব্রত হয়েছিলেন। বিচারপতি শাহ আবু নঈমকে নিয়েও আওয়ামী লীগ শিবিরে খুঁতখুঁতানি রয়েছে। তাঁকে আপিল বিভাগে নেওয়া হবে কি না, সে প্রশ্ন ছিল। তিনি শেখ হাসিনার অবৈধ সম্পদের বিবরণী মামলা কোয়াশ করে আলোচিত হয়েছিলেন। জরুরি অবস্থায় তিনি তাঁর অনেক বিচারিক আদেশের মাধ্যমে যথেষ্ট সক্রিয় ও সাহসী ভূমিকা রাখেন বলে মত আছে। তিনি তখন ‘আইনের’ ঝাণ্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। আবার বিচারপতি আবদুল মতিন তখন আপিল বিভাগে থেকে অনেক ক্ষেত্রে সেসব আদেশ উল্টে সঠিক ভূমিকা রাখেন বলে মনে করা হয়।
বর্তমান সংসদের স্বাভাবিক মৃত্যু তারিখ ৩০ জানুয়ারি ২০১৪। জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হলে বিচারপতি শাহ আবু নঈম মোমিনুর রহমান ওই সময় সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে থাকবেন। বিচারপতি মতিন ও বিচারপতি নঈমের অবসরে যাওয়ার তারিখ যথাক্রমে ২৫ ডিসেম্বর ২০১০ ও ১৪ নভেম্বর ২০১১। পঞ্চম সংশোধনী মামলার আলোচিত রায়দানকারী বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের অবসরে যাওয়ার তারিখটিও বিবেচ্য। তিনি অবসরে যাবেন ১৭ মে ২০১১। যদি বিচারপতি মো. ফজলুল করিমকে এখন প্রধান বিচারপতি করা হয়, তাহলে বিচারপতি মো. আবদুল মতিনের সম্ভাবনা তিরোহিত হবে। এরপর বিচারপতি ফজলুল করিম যদি আগেভাগে পদত্যাগ না করেন, তাহলে জ্যেষ্ঠতার শর্তে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা বিচারপতি শাহ আবু নঈমের। আর তাঁকে প্রধান বিচারপতি করা হলে বিচারপতি বিজন কুমার দাস ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রধান বিচারপতি হওয়ার সুযোগ থাকবে না। বিচারপতি বিজন কুমার দাস অবসরে যাবেন ১০ এপ্রিল ২০১০। বিচারপতি খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হবেন এমনটা জানা যায়। কিন্তু তা কখন সেটা জানা যায় না। অবশ্য তাঁকে প্রধান বিচারপতি করা হলে এবং সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তাঁকে ঘিরে আদৌ কথা উঠলে তিনি দ্রুত বিব্রত হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে অবাক হব না। কারণ, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের এ ধরনের পদ গ্রহণের বিরুদ্ধে তাঁর একটি মাইলফলক রায় আছে। আমরা এই রায় মেনে সংবিধান সংশোধনে শাসক দলের আগ্রহ দেখি না। আগ্রহ দেখি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপে।
গত ডিসেম্বরে প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন অবসরে যাওয়ার পর বিচারপতি মো. ফজলুল করিমকে নতুন প্রধান বিচারপতি করা যেত। সে ক্ষেত্রে তিনি এই পদে নয় মাস থাকতেন। কিন্তু বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম প্রধান বিচারপতি হতে পারতেন না। কারণ, মো. ফজলুল করিম প্রধান বিচারপতি পদে বহাল থাকতেই ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে অবসরে যেতে হতো।
প্রধান বিচারপতি পদটি উল্লিখিত ঘরানার বিচার-বিবেচনার ঊর্ধ্বে রাখার কথা। অথচ নির্বাহী বিভাগের পক্ষে এ রকম চিন্তাভাবনা করা সম্ভব হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা বজায় থাকবে বলে আশঙ্কা করা চলে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বিচারপতি নিয়োগের মতোই গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে। জানা যায়, বর্তমান প্রধান বিচারপতি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, ‘বিচারপতি নিয়োগে গোপনীয়তার নীতি অনুসরণ করা উচিত নয়।’ জ্যেষ্ঠতার নীতি আঁকড়ে ধরা যেমন কাম্য নয়, তেমনি কেন জ্যেষ্ঠতার বিচ্যুতি ঘটল, তার একটা সদুত্তর থাকা দরকার। দিল্লি হাইকোর্টের সাম্প্রতিক চমকপ্রদ রায়ে ভারতের প্রধান বিচারপতি হেরে গেছেন। দিল্লি হাইকোর্ট বলেছেন, প্রধান বিচারপতির দপ্তর পাবলিক অফিস। সেখানে কী ঘটছে তা জানার অধিকার জনগণের আছে। আমরা একসুরে বলব, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কে এবং কেন হচ্ছেন, তা আগে জানার অধিকারও জনগণের আছে। আমাদের একজন ‘জুডিশিয়াল স্টেটসম্যান’ দরকার।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক
mrkhanbd@gmail.com
No comments