সুস্পষ্ট নীতি নিয়ে সরকারকে অগ্রসর হতে হবে-বেসরকারীকরণ নিয়ে জটিলতা
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পদক্ষেপ বাজার অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মোটা দাগে এর উদ্দেশ্য হলো, ব্যক্তি উদ্যোগকে উত্সাহিত করা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পরিচালনা করা।
এতে রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যয়ভার কমে যায়, কমে যায় ব্যবস্থাপনার দায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দর্শন যখন থেকে বাজারমুখী হয়ে পড়েছে, তখন থেকেই বিরাষ্ট্রীয়করণ বা বেসরকারীকরণের নীতির অনুসরণ শুরু হয়েছে। তবে দুই যুগের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এই কাজে সঠিক নীতিমালা ও পদক্ষেপের ঘাটতি রয়েছে। আর সে কারণেই বেসরকারীকরণের কাঙ্ক্ষিত সুফল বেশির ভাগ সময়ই পাওয়া যায়নি। বিপরীতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতির চক্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই ক্রমশ বোঝায় পরিণত হয়েছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেসরকারীকরণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক বছর পরও এ বিষয়ে কার্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকেই জানা যায়, বেসরকারীকরণ নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় ও প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। শিল্পমন্ত্রী একাধিকবার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে না ছাড়ার কথা বলেছেন। প্রশ্ন হলো, তাহলে কি বছরের পর বছর এসব প্রতিষ্ঠান অদক্ষভাবে চলবে আর রাজকোষ থেকে অর্থ গচ্চা দেওয়া হবে? অন্যদিকে লোকসান ও অদক্ষতা ঠেকানোর জন্য বেসরকারীকরণের নামে নির্বিচারে বিভিন্ন সময়ে যেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে, সেটাও ছিল ভুল পদক্ষেপ। এই ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করার পেছনে বিশ্ব ব্যাংকসহ দাতাগোষ্ঠীর পরামর্শও কম দায়ী নয়। আবার বিভিন্ন সময়ে যারা এসব প্রতিষ্ঠান কিনেছে, তাদের উদ্দেশ্যও সব সময় বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করা না থাকায় বিক্রি হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়েছে।
বস্তুত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভজনক ও দক্ষভাবে পরিচালনা করার জন্য সরাসরি ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেওয়াই একমাত্র বিকল্প নয়। সরকারি মালিকানায় রেখে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটানো, ব্যক্তি খাত থেকে কৌশলগত অংশীদার নিয়ে আসা, পর্যায়ক্রমে শেয়ার ছেড়ে দেওয়ার মতো বিভিন্ন পদ্ধতি আছে, যেগুলো অনুসরণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসব বিকল্প নিয়ে কখনোই গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা হয়নি, এগুলো বাস্তবে প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়নি।
এই বাস্তবতায় সরকার যদি এখন নতুনভাবে বেসরকারীকরণ কার্যক্রমে গতি আনতে চায়, তাহলে প্রথমেই একটি সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এই নীতিতে বেসরকারীকরণের পদ্ধতি এবং বেসরকারীকরণের পর তদারকের বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তি খাতকে উত্সাহিত করতে হবে সরকারের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে কাজ করার জন্য। এ ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অপসারণ অপরিহার্য। মনে রাখা প্রয়োজন, সবকিছু ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দিয়ে সরকার তথা রাষ্ট্র নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। আর ব্যক্তি খাত মানেই সবকিছু দক্ষ ও লাভজনকভাবে চলবে, এমনটা ভাবাও অযৌক্তিক।
No comments