পাঁচ খুনির ফাঁসি-নির্মম হত্যাকাণ্ডের রেশ মিলিয়ে যায়নি by এবিএম মূসা

বৃহস্পতিবারের দৈনিক পত্রিকাগুলোর শিরোনাম এক ও অভিন্ন। ‘পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর’। পাঁচজনকে যখন ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে বলে খবরটি রাত ১২টা ১ মিনিটে চূড়ান্তভাবে জানা গেল, আমি তখন ‘চ্যানেল আইতে’ আদালতের আদেশ কার্যকর করা নিয়ে সঞ্চালক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম।


খবরটি জেনেই মতি আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন। আমি উত্তরে বলেছি, ‘খুনিদের ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের রেশ থেকে যাবে।’ সঞ্চালক মন্তব্যটির ব্যাখ্যা চাইলেন। সময়ের স্বল্পতার কারণে পুরো ব্যাখ্যা দেওয়া যায়নি। শুধু বলেছি, ‘খুনিদের বিচার হয়েছে, হত্যাকারী অর্থাত্ নির্মম ঘটনাটির মূল হোতাদের অনেকের এখনো বিচার হয়নি।’ আমার বক্তব্যটির পূর্ণ ব্যাখ্যায় আমি আরও বলতে চেয়েছিলাম, আমি খুনি আর হত্যাকারী, ঘাতক আর তাদের নিয়োগকারীদের বরাবরই আলাদা করে দেখেছি। ইংরেজিতে বলব, মার্ডার আর অ্যাসাসিনেশনের মধ্যে শব্দার্থে ও ভাবার্থে পার্থক্য রয়েছে। এই কথাটি আমি অনেক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি। পাঁচজন খুনিকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলালেই কি ৩৫ বছর আগের সংঘটিত নির্মমতার যবনিকাপাত ঘটেছে বলে মনে করা হবে। জাতি কি এর মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ কলঙ্কমুক্ত হয়ে গেল? বুঝতে হবে পাঁচটি ফাঁসি জাতির জীবনের ট্র্যাজিক বা বিয়োগান্ত নাটকের শেষাঙ্ক নয়। একটি নির্মমতার বিচারের পরিসমাপ্তিও নয়। শেষাঙ্কটি লিখতে হলে একজন ব্যক্তিকে খুন আর জাতির ইতিহাসের জঘন্যতম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন আঙ্গিকে পর্যালোচনা করতে হবে। জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডটি ‘কতিপয় বিপথগামী সৈনিকের’ দ্বারা সংঘটিত বিশেষ কয়েকটি মুহূর্তের ঘটনা ছিল না। এ জন্য বুঝতে হবে অনেক কিছু, মানতে হবে অনেকের অজানা ভূমিকা। সুদূরপ্রসারী অতীতকে পর্যালোচনা করতে হবে। এ জন্য আমি বহুবার একটি কথা বলেছি, একটি কমিশন গঠন করতে হবে। কারণ পনেরো আগস্টের হত্যাকাণ্ড সংঘটনের পশ্চাত্পটের অপ্রকাশ্য ঘটনাবলির বিস্তৃতি এখনো অনেকাংশে অজানা রয়ে গেছে। তাহলেই আমার পূর্ববর্ণিত ‘হত্যাকাণ্ডের রেশ’ রয়ে যাওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করা যাবে।
পনেরো আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমি ইতিপূর্বে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কিছু কাহিনি আমার কয়েকটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি। আমার অনেক প্রতিবেদনে জানা-অজানা ও সংগৃহীত তথ্য থাকলেও পনেরো আগস্ট নিয়ে পরিপূর্ণ গবেষণা করিনি। অন্তত আমার জানামতে, অন্য কেউ করেননি। আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবী ও সমর্থক, ক্ষমতাসীন সরকার ‘যাদের ধরা গেছে’ শুধু তাদের বিচার নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিলেন। সেই বিচারাকাজও পরিপূর্ণ হয়নি, কারণ সব খুনিকে এখনো কবজা করা যায়নি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপে যে জটিলতা বিরাজ করছে, তা আলোচিত হয়েছে, তাই পুনরুল্লেখ করলাম না। আমি আজকে ভবিষ্যত্ গবেষণাকারীদের দুটি তথ্য উদ্ঘাটনের প্রয়োজনীয়তা জানাব। এ জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের পটভূমিতে কতিপয় প্রশ্ন উত্থাপন করে উত্তর খুঁজছি।
প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে, খুনিরা ও তাদের উত্সাহ, সমর্থনকারী ও পরিকল্পনাকারীরা পনেরো আগস্ট দিনটি কেন বেছে নিয়েছিল? কেউ হয়তো বলবেন, হত্যার দিবসটি যেকোনো দিন হতে পারত। আমার পাল্টা বক্তব্য হচ্ছে, সে দিনটি ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। রাজধানী নয়াদিল্লিতে সেই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, এই তথ্যটি খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীরা কি পরিকল্পনায় বিবেচনা এনেছিল? দুই, ১৫ আগস্টের সেই দিনটিতে আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দুটি দেশের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে অনুপস্থিত থাকবেন, সেই তথ্যটিও কি তাদের হত্যাপরিকল্পনার ছকে ছিল? বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভবিষ্যত্ গবেষণাকারীরা আশা করি আমার এই দুটি প্রশ্নের গুরুত্ব অনুধাবন করবেন।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে নির্মম হত্যাকাণ্ডের কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কীভাবে তা রাওয়ালপিন্ডি আর ওয়াশিংটনে পৌঁছেছিল? খবরটির জন্য দুটি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, সেই কাহিনি ও তার মাজেজা ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রতিবেদনে আমি উল্লেখ করেছি। আরও অনেকেই এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। অপ্রকাশিত অনেক তথ্য ও সত্য ৩৫ বছর পর কতিপয় দলিল-দস্তাবেজে উদ্ঘাটিত হয়েছে। আমার প্রস্তাবিত অনুসন্ধানী কমিশন সেসব তথ্যও যাচাই-বাছাই করে দেখতে পারে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর একটি বিভ্রান্তি ছড়ানোর কার্যকারণ উল্লেখ করে আমার ধারণাটি ব্যক্ত করছি। পঁচাত্তরের পর একটি বিশেষ রাজনৈতিক মহল ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতাকারী অনেকে বলে থাকেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কেউ ‘ইন্না লিল্লাহ’ বলেননি। সাড়ে সাত কোটি নরনারী, আবালবৃদ্ধবণিতা ‘ইন্না লিল্লাহ’ বলেননি তাঁরা তা জানলেন কীভাবে। আসলে এই কথাটির মাধ্যমে তাঁরা হত্যাকাণ্ডটিকে আপত্তিকর ইঙ্গিতের মাধ্যমে বিকৃত উল্লাস প্রকাশ করেছেন। অপ্রীতিকর হলেও একটি বিষয় এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করব। জিয়া হত্যার পরও সে ক্ষেত্রে দুই দিন কেউ ‘ইন্না লিল্লাহ’ বলেননি। যখন জিয়ার অনুসারীরা নিশ্চিত হয়েছেন জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হননি, তখনই তাঁদের ‘শোক প্রকাশের’ সাহস হয়েছিল। জিয়া অনুসারীরা শোকের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। এ নিয়ে অধিকতর আলোচনা করব না, শুধু পনেরো আগস্টের পরবর্তী আরেকটি আলোচিত বিষয় পর্যালোচনা করব।
যে বিশেষ মহলটির কথা উল্লেখ করেছি, তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করে থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু সাধারণ নেতা-কর্মীরা হাটে-মাঠে কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রদর্শন করেননি কেন? প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়নি কেন দেশব্যাপী? এই প্রশ্নের উত্তরেও খুনি, ঘাতক ও চক্রান্তকারীদের চাতুর্যের উল্লেখ করব। তখন সবেমাত্র বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা পর্বের সূচনা হয়েছে। মূল আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে বিলুপ্ত। তার পরও দলের তৃণমূলপর্যায়ে বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটত, যদি জেলা-মহকুমা পর্যায়ের নেতারা মাঠে থাকতেন। নতুন সরকারপদ্ধতিতে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রতি জেলায় গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মূল দল ও অঙ্গসংগঠনের প্রতি জেলায় সাধারণ সম্পাদক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সার্কিট হাউস রোডের দু-তিনটি ভবনে তাঁদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে। শহর-গ্রাম-মফস্বলের শত শত পদপ্রার্থী আর হাজার হাজার কর্মী তখন ঢাকায়। মফস্বলের শহর-গ্রাম কর্মীশূন্য ও নেতৃত্বহীন। এ অবস্থায় বিক্ষোভ প্রতিরোধ আয়োজন করা ছিল দুরূহ। তবুও কোথাও যে বিক্ষিপ্তভাবে যে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়নি তা নয়। আমার জানা একটি উদাহরণ এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে পারি। আমার গ্রাম-অঞ্চলে ফেনী-বিলনিয়া রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছিল।
যাই হোক, আবারও প্রশ্ন, খুনি ও নেপথ্য পরিকল্পনাকারীরা কি হত্যার ছক তৈরিতে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে এমন আগাম আভাস পেয়েছিল? কারা দিয়েছিল সেই আভাস? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে যাঁরা ভবিষ্যতে আমার প্রস্তাবিত অনুসন্ধানী গবেষণা করবেন, তাঁরা গূঢ় তথ্যটি উদ্ঘাটন করতে পারবেন।
উপরিউক্ত চিন্তাভাবনার পরিপ্রেক্ষিতেই আমি বলেছি, হত্যাকাণ্ডের ঘটনার রেশ কাটেনি। বাস্তবে আমি বলতে চেয়েছি, পাঁচ খুনির ফাঁসি একটি জাতীয় ট্র্যাজেডির শেষ অধ্যায় নয়। ন্যায়বিচারের পথযাত্রার পাঁচটি ফাঁসির মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটেনি। বর্তমান সরকারের আমলেই শেষ অধ্যায়গুলো অনুসন্ধানী গবেষণার মাধ্যমে সামনে পরস্ফুিট করতে হবে। অসম্পূর্ণ অধ্যায়গুলো হলো অন্য জীবিত ঘাতকদের ফাঁসির মঞ্চে ওঠানো, জাতীয় নেতাদের হত্যার পুনঃ তদন্ত, শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার তথ্য উদ্ঘাটন ইত্যাদি। তা না হলে পাঁচ খুনির ফাঁসির পরও পনেরো আগস্টের ট্র্যাজেডির রেশ থেকেই যাবে।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.