এশিয়া-চীনকে আমরা কীভাবে দেখব? by ইম্মানুয়েল ওয়ালারস্টাইন
দুনিয়াজুড়ে যদি মানুষকে জিজ্ঞেস করা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন, খুবই পরিষ্কার উত্তর মিলবে। উত্তর গোলার্ধ কি দক্ষিণ, ধনী কি গরিব, নারী কি পুরুষ, তরুণ কি বৃদ্ধ, ডানপন্থী কি বামপন্থী প্রত্যেকেই যার যার মতো করে এ ব্যাপারে মত দেবে।
সেসব মত আমেরিকার পক্ষে থেকে শুরু করে চরম বিপক্ষের যা-ই হোক, মানুষ জানে, আমেরিকাকে কীভাবে দেখতে হবে।
৩০ বছর আগে চীনের বেলাতেও এটা সত্য ছিল, কিন্তু এখন আর তা নয়। অনেক মানুষ, সম্ভবত পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই জানে না, চীনকে তারা কি একটি দেশ হিসেবে, নাকি একটি পরাশক্তি হিসেবে দেখবে। বিষয়টা কেবল অনির্দিষ্ট, তা-ই নয়, বিরাট বিতর্ক রয়েছে একে ঘিরে। চীনের বাইরে চীনকে বিচার করার বিষয় মূলত তিনটি।
প্রথম এবং সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত বিতর্ক হলো, চীন প্রধানত একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ, নাকি একটি পুঁজিবাদী দেশ? অবশ্য চীন এখনো নিজেকে সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে। চীনকে এখনো চালায় সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টি। অন্যদিকে চীন তার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে বাজার অর্থনীতির নীতিকে।
বিশ্বের রাজনৈতিক বামপন্থী ও রাজনৈতিক ডানপন্থীরা চীনের বিষয়ে একদম একমত নয়। ডানপন্থীদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছে, যারা মনে করে, বাজারব্যবস্থা আসলে চীনের বাইরের খোলস, এর ভেতরে চলছে চিরাচরিত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী আদর্শ অনুযায়ী ঐতিহাসিক লক্ষ্য অর্জনের মিশন, অর্থাত্ পুঁজিবাদী বিকাশের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো। তবে ডানপন্থীদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যাদের বিশ্বাস, চীন আসলে ‘রূপান্তরের’ ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। চীনের বাজারব্যবস্থা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় আদর্শই আসলে বাইরের খোলস।
বামপন্থীদের মধ্যেও এমন মত রয়েছে। এখানেও এমন মানুষ রয়েছে, যারা মনে করে, চীন এখনো সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের কাছে ‘বাজার’ পরিচালনা আর কিছু নয়, একটি কৌশলগত পশ্চাত্পসরণ অথবা খোলস। উল্টোদিকের মানুষদের অনেকেই চীন নিয়ে বীতস্পৃহ অথবা চীনকে ঘিরে তাদের মোহ ভেঙে গেছে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে মতভেদ রয়েছে, সেটা হলো, চীন কি এখনো দক্ষিণ বলয়ের (প্রাচ্য) অংশ, নাকি তা উত্তরের (পাশ্চাত্যের) অংশ হয়ে গেছে। ৩০ বছর আগে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। চীন ১৯৫৫ সালে বান্দুংয়ে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল। চীন সে সময় সব জায়গায় দক্ষিণের দরিদ্র দেশগুলোর স্বার্থের পক্ষে জোরদার অবস্থান নিত। কিন্তু আজ চীন শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। বিশ্বের গণমাধ্যমে এখন জি-২, অর্থাত্ চীন ও আমেরিকাকে বিশ্বের ক্ষমতার দুই অংশীদার হিসেবে দেখানো হয়। এ অবস্থা ষাটের দশক থেকে একদম আলাদা। সে সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ছিল চীন। তাদের বক্তব্য ছিল, এই দুই ‘পরাশক্তির’ বিরুদ্ধে প্রত্যেকেরই ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত।
অতএব, উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের অনেকেই চীনকে ধনী উত্তরেরই অংশ মনে করে। কিন্তু অন্য মতও রয়েছে। তারা মনে করে, চীন দক্ষিণের দেশগুলোর শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। এতকিছুর পরও তারা বলে, চীনের বিরাট অংশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয়।
চূড়ান্তভাবে বিতর্কটা এখানেই, চীনকে কি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি হিসেবে দেখা হবে, নাকি চীন নিজেই একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি? উত্তর গোলার্ধের চেয়ে এই বিতর্ক দক্ষিণ গোলার্ধেই বেশি হয়ে থাকে। অনেকেরই ধারণা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ক্ষমতা খর্ব করায় চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এতকিছুর পরও এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে চীনা অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়ার ধরন ইউরোপ ও আমেরিকার সাহায্য দেওয়ার ধরন থেকে আলাদা। চীনা সাহায্য ইউরোপ-আমেরিকার সাহায্যের মতো কঠিন শর্তে আবদ্ধ নয়। তাদের মতে, চীন দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক দিক থেকে সুবিধাজনক জায়গায় ছাড় দিয়ে থাকে। এটাই তাদের কাছে সমাজতান্ত্রিক সহযোগিতার আদর্শ উদাহরণ।
একই সঙ্গে এটাও সত্য, দক্ষিণ গোলার্ধের অনেকেই মনে করে, চীনা অর্থনৈতিক সাহায্য আসলে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল পাওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ। অনেকেই চীনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপরও বিরক্ত, অনেক জায়গাতেই তারা ঔপনিবেশিক কায়দায় জেঁকে বসছে। এদের জন্য স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সুবিধা করতে পারছে না।
আজকে চীনের ভাবমূর্তি অস্পষ্ট এবং এই ভাবমূর্তির বিভেদ রেখাটিও অনিশ্চিত। তবে বেশি দিন এভাবে চলবে না। সম্ভবত ১০ কি ২০ বছরের মধ্যে সবাই আবার আগের মতো নিশ্চিত হয়ে যাবে চীনের ভূমিকা বিষয়ে। তখন হয়তো চীনকে নিয়ে মতামতও এখনকার থেকে দৃঢ় হবে।
এজেন্সে গ্লোবাল থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ইম্মানুয়েল ওয়ালারস্টাইন: ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক।
৩০ বছর আগে চীনের বেলাতেও এটা সত্য ছিল, কিন্তু এখন আর তা নয়। অনেক মানুষ, সম্ভবত পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই জানে না, চীনকে তারা কি একটি দেশ হিসেবে, নাকি একটি পরাশক্তি হিসেবে দেখবে। বিষয়টা কেবল অনির্দিষ্ট, তা-ই নয়, বিরাট বিতর্ক রয়েছে একে ঘিরে। চীনের বাইরে চীনকে বিচার করার বিষয় মূলত তিনটি।
প্রথম এবং সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত বিতর্ক হলো, চীন প্রধানত একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ, নাকি একটি পুঁজিবাদী দেশ? অবশ্য চীন এখনো নিজেকে সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে। চীনকে এখনো চালায় সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টি। অন্যদিকে চীন তার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে বাজার অর্থনীতির নীতিকে।
বিশ্বের রাজনৈতিক বামপন্থী ও রাজনৈতিক ডানপন্থীরা চীনের বিষয়ে একদম একমত নয়। ডানপন্থীদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছে, যারা মনে করে, বাজারব্যবস্থা আসলে চীনের বাইরের খোলস, এর ভেতরে চলছে চিরাচরিত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী আদর্শ অনুযায়ী ঐতিহাসিক লক্ষ্য অর্জনের মিশন, অর্থাত্ পুঁজিবাদী বিকাশের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো। তবে ডানপন্থীদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যাদের বিশ্বাস, চীন আসলে ‘রূপান্তরের’ ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। চীনের বাজারব্যবস্থা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় আদর্শই আসলে বাইরের খোলস।
বামপন্থীদের মধ্যেও এমন মত রয়েছে। এখানেও এমন মানুষ রয়েছে, যারা মনে করে, চীন এখনো সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের কাছে ‘বাজার’ পরিচালনা আর কিছু নয়, একটি কৌশলগত পশ্চাত্পসরণ অথবা খোলস। উল্টোদিকের মানুষদের অনেকেই চীন নিয়ে বীতস্পৃহ অথবা চীনকে ঘিরে তাদের মোহ ভেঙে গেছে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে মতভেদ রয়েছে, সেটা হলো, চীন কি এখনো দক্ষিণ বলয়ের (প্রাচ্য) অংশ, নাকি তা উত্তরের (পাশ্চাত্যের) অংশ হয়ে গেছে। ৩০ বছর আগে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। চীন ১৯৫৫ সালে বান্দুংয়ে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল। চীন সে সময় সব জায়গায় দক্ষিণের দরিদ্র দেশগুলোর স্বার্থের পক্ষে জোরদার অবস্থান নিত। কিন্তু আজ চীন শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। বিশ্বের গণমাধ্যমে এখন জি-২, অর্থাত্ চীন ও আমেরিকাকে বিশ্বের ক্ষমতার দুই অংশীদার হিসেবে দেখানো হয়। এ অবস্থা ষাটের দশক থেকে একদম আলাদা। সে সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ছিল চীন। তাদের বক্তব্য ছিল, এই দুই ‘পরাশক্তির’ বিরুদ্ধে প্রত্যেকেরই ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত।
অতএব, উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের অনেকেই চীনকে ধনী উত্তরেরই অংশ মনে করে। কিন্তু অন্য মতও রয়েছে। তারা মনে করে, চীন দক্ষিণের দেশগুলোর শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। এতকিছুর পরও তারা বলে, চীনের বিরাট অংশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয়।
চূড়ান্তভাবে বিতর্কটা এখানেই, চীনকে কি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি হিসেবে দেখা হবে, নাকি চীন নিজেই একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি? উত্তর গোলার্ধের চেয়ে এই বিতর্ক দক্ষিণ গোলার্ধেই বেশি হয়ে থাকে। অনেকেরই ধারণা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ক্ষমতা খর্ব করায় চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এতকিছুর পরও এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে চীনা অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়ার ধরন ইউরোপ ও আমেরিকার সাহায্য দেওয়ার ধরন থেকে আলাদা। চীনা সাহায্য ইউরোপ-আমেরিকার সাহায্যের মতো কঠিন শর্তে আবদ্ধ নয়। তাদের মতে, চীন দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক দিক থেকে সুবিধাজনক জায়গায় ছাড় দিয়ে থাকে। এটাই তাদের কাছে সমাজতান্ত্রিক সহযোগিতার আদর্শ উদাহরণ।
একই সঙ্গে এটাও সত্য, দক্ষিণ গোলার্ধের অনেকেই মনে করে, চীনা অর্থনৈতিক সাহায্য আসলে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল পাওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ। অনেকেই চীনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপরও বিরক্ত, অনেক জায়গাতেই তারা ঔপনিবেশিক কায়দায় জেঁকে বসছে। এদের জন্য স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সুবিধা করতে পারছে না।
আজকে চীনের ভাবমূর্তি অস্পষ্ট এবং এই ভাবমূর্তির বিভেদ রেখাটিও অনিশ্চিত। তবে বেশি দিন এভাবে চলবে না। সম্ভবত ১০ কি ২০ বছরের মধ্যে সবাই আবার আগের মতো নিশ্চিত হয়ে যাবে চীনের ভূমিকা বিষয়ে। তখন হয়তো চীনকে নিয়ে মতামতও এখনকার থেকে দৃঢ় হবে।
এজেন্সে গ্লোবাল থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ইম্মানুয়েল ওয়ালারস্টাইন: ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক।
No comments