বিশেষ সাক্ষাত্কার-পানিবণ্টন সমস্যা সমাধানের এখনই উপযুক্ত সময় by দীপক গেওয়ালী

হিমালয়ভিত্তিক নদীগুলোর ওপর এক আন্তর্জাতিক কর্মশালায় অংশ নিতে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারত ও নেপালের দুই সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী। দুজনের দুটি সাক্ষাত্কার ছাপা হলো।  সাক্ষাত্কার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ


নেপালের সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী দীপক গেওয়ালী (২০০২-২০০৩) বর্তমানে পানি ও নদীবিষয়ক নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। নেপাল ওয়াটার কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের হয়ে নীতি গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। নেপাল একাডেমি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সদস্য। অসলোভিত্তিক সংস্থা দ্য ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার একাডেমি ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস মার্টিন ইনিশিয়েটিভ ফর সায়েন্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশনের আজীবন সদস্য।

প্রথম আলো  দক্ষিণ এশিয়ায় পানি নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
দীপক গেওয়ালী  দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য পানি শুধু খাওয়ার জিনিস নয়। এটি এ অঞ্চলের মানুষের জন্য একই সঙ্গে জীবিকা, প্রকৌশলবিদ্যা, সমাজ, রাজনীতি ও কবিতার অংশ। ফলে পানি ও নদী সমস্যাকে আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। পানি নিয়ে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয় তাকে আমরা কোনো একটি একক ধারণার ভিত্তিতে সমাধানের চেষ্টা করি। কখনো প্রকৌশলগত বা কখনো রাজনীতির মধ্যে পানি সমস্যার সমাধান খুঁজি। সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে দেখি না।
প্রথম আলো  দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার মতো অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
দীপক গেওয়ালী  ৭৭টি অভিন্ন বড় নদী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক লেগেই আছে। তবে আমি মনে করি আরও যে ৫৫টি ছোট নদী আছে সেগুলোর পানি বণ্টন নিয়েও সমান্তরালভাবে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। ছোট নদীগুলোর পানির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশেই প্রতিবছর বন্যা হচ্ছে। আবার পানির অভাবে খরা দেখা দিচ্ছে। ভালো ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ছোট নদীগুলো থেকেও দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ সুবিধা নিতে পারে।
প্রথম আলো  দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নদীকে অনেকে জাতীয় স্বার্থের অংশ হিসেবে দেখে।
দীপক গেওয়ালী  হ্যাঁ, বিশেষত বাংলাদেশ ও নেপালে নদীর পানি বণ্টন জাতীয় রাজনীতির বড় বিষয়। মহাকালি নদী নিয়ে নেপালের সঙ্গে ভারতের চুক্তির অবস্থা অনেকটা ফারাক্কার মতো অবস্থা। চুক্তি হয়েছে ১৩ বছর হলো, কিন্তু এখনো এ নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি হয়নি।
প্রথম আলো  নেপালে ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পানি সংরক্ষণাগার ও জলবিদ্যুেকন্দ্র তৈরির কথা অনেক দিন ধরে হচ্ছে।
দীপক গেওয়ালী  নেপালের প্রতিটি উপত্যকা ও নদীর উজানে প্রচুর জনবসতি রয়েছে। উর্বর জমির ঘাটতি রয়েছে। পানি সংরক্ষণাগার তৈরি করলে নেপালে ১০ হাজার একর ফসলি জমি ও বসতি এলাকা ডুবে যাবে। আর ভারতের ৫০ হাজার একর অতিরিক্ত জমিতে চাষাবাদ করা যাবে। ফলে নেপালে জলাধার ও বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে জনমত অনেক শক্তিশালী।
প্রথম আলো  নদীর পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান কি তাহলে সম্ভব নয়?
দীপক গেওয়ালী  সত্ চিন্তা ও মুক্ত আলোচনার মনোভাব নিয়ে শুরু করলে সমাধান সম্ভব। সমঝোতার পথ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। এ পর্যন্ত ভারতের ছয়জন প্রধানমন্ত্রী নেপালে জলবিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। জহরলাল নেহেরু থেকে শুরু হয়ে সর্বশেষ মনমোহন সিং পর্যন্ত এই আলোচনা করে যাচ্ছেন। নেপালে জলাধার ও বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ হলে উত্তর ভারত, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। এই প্রদেশগুলো থেকে ভারতের লোকসভার এক-তৃতীয়াংশ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁরাও কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপ দিয়ে নেপালের সঙ্গে চুক্তি করাতে পারেননি। অথচ এই বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর পরিকল্পনা ভারতের দিক থেকে প্রথমে এসেছে। জলবিদ্যুেকন্দ্র তৈরি করলে নেপালের মানুষ কতটা সুবিধা পাবে তা নিশ্চিত না হওয়ায় এখনো এ নিয়ে বিরোধিতা হয়। বাংলাদেশের টিপাইমুখ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এই প্রকল্প তৈরি হলে বাংলাদেশের মানুষ কতটা লাভবান হবে তা বাংলাদেশের মানুষের কাছে নিশ্চিত না। তাই বাংলাদেশে এই প্রকল্প নিয়ে বিরোধিতা রয়েছে বলে আমরা শুনেছি।
প্রথম আলো  কিন্তু নেপালের উন্নয়নের জন্যও তো বিদ্যুত্ দরকার।
দীপক গেওয়ালী  নেপালের সঙ্গে উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের পার্থক্য হচ্ছে, নেপাল কখনো ঔপনিবেশিক শাসনে ছিল না। এর ইতিবাচক দিক যেমন আছে, নেতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার কারণে বাংলাদেশ ও ভারতে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক তাড়াতাড়ি শুরু হয়েছে। নেপালে প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়ন মাত্র শুরু হয়েছে।
নেপালে বিদ্যুতের অভাবের কারণে ছোট ও মাঝারি শিল্প স্থাপন এবং পরিচালনা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পাগুশোর ড্যামের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া গেছে। কিন্তু স্থানীয় প্রতিরোধের কারণে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। কাঠমান্ডুতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টাই লোডশেডিং থাকে।
প্রথম আলো  অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ দেওয়া নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অস্থিরতা আছে।
দীপক গেওয়ালী  ফারাক্কা একটি ভালো চুক্তি কিন্তু তার বাস্তবায়ন নিয়ে সমস্যা রয়ে গেছে। তিস্তার ক্ষেত্রে একই অবস্থা। আমি যখন নেপালের পানিসম্পদমন্ত্রী ছিলাম তখন একটা বিষয় আমাকে খুবই পীড়া দিত। তা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সীমানার পার্থক্যের কারণে একই নদীর একেক স্থানে একাধিক বাঁধ দেওয়া হয়েছে। যেমন: তিস্তা নদীর কয়েক কিলোমিটার সীমানার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশ দুটি ব্যারাজ নির্মাণ করেছে। এটা বড় ধরনের রাষ্ট্রীয় অপচয়। এই বাঁধের টাকা দুই দেশের মানুষের কর থেকে দেওয়া হচ্ছে। এখন এই দুই দেশ তিস্তার ব্যবস্থাপনা ও পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ-ভারত আলোচনা করছে। সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অথচ আগে থেকেই দুই দেশ আলোচনা করে একটি বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করতে পারত। এতে আঞ্চলিক সম্পর্কের টানাপোড়েন কমত। এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ লাভবান হতো।
প্রথম আলো  ভারত তো এ অঞ্চলের সবচেয়ে ক্ষমতাবান দেশ। বাংলাদেশ ও নেপালের মতো দেশের পক্ষে কি ভারতের সঙ্গে সমান লাভ রেখে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করা সম্ভব? নেপালের সপ্তকোসি ও মনিপুরে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগের বিষয় উঠছে। বর্তমান অবস্থায় এই উদ্যোগগুলো কি বাস্তবসম্মত?
দীপক গেওয়ালী  দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। ফলে এখনই এই অঞ্চলের নদী ও পানি সমস্যার সমাধানের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। সদিচ্ছা ও খোলা মন নিয়ে আলোচনা শুরু করলে সমাধান সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হচ্ছে এই দেশগুলোর পানিসম্পদসংক্রান্ত সরকারি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এরা অবকাঠামো নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ও প্রকৌশলীদের দিয়ে অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়। তাদের আচরণ ও কথা শুনলে মনে হয় তারা পানিসম্পদ উন্নয়নের জন্য নয়, সিমেন্ট ও রডশিল্পে উন্নয়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। এই দশা থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেরিয়ে আসতে হবে।
প্রথম আলো  বিদ্যুত্ উত্পাদন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য তো বাঁধ দেওয়া প্রয়োজন। বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে?
দীপক গেওয়ালী  বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মুনাফার কথা চিন্তা করে কাজ করে। ফলে স্থানীয় মানুষ তাদের বিশ্বাস করে না। বড় স্থাপনা নির্মাণের দায়িত্ব সরকারের হাতে থাকা উচিত। এ ক্ষেত্রে সরকার স্থানীয় উদ্যোক্তা ও জনগণকে সঙ্গে রাখবে। সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমকে পর্যবেক্ষক হিসেবে রাখা যেতে পারে। গত কয়েক যুগের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, স্থানীয় মানুষ বিদেশি ও বড় কোম্পানিগুলোর আচরণ তত্পরতায় বিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
দীপক গেওয়ালী  আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.