শ্রদ্ধাঞ্জলি-আমাদের সেই ওয়াহিদ ভাই by বিপ্লব বালা
সারা জীবন কত কাজ করে গেছেন ওয়াহিদ ভাই। যাকে বলে ‘জীবন ভরিয়া’ কত কত সব কাজ। তার জন্য কত রকম সব দল করতে হয়েছে। কত মানুষকে জোটাতে হয়েছে কাজে। মাথায় তাঁর খেলত যেন এক কাজের ঘোর। একবোঝা কাজ মাথায়।
একা তো আর সে কাজ করার নয়। তার জন্য নানা স্বভাব-ঝোঁকের মানুষ চাই। একেক ধরনের মানুষ নিয়ে একেক কাজ করে চলা। যখন যা করণীয় মনে হয়েছে। পাকিস্তান তাঁর কাছে ছিল তো এক মামদো ভূত। মূর্তিমান কালাপাহাড়। এত যে সাধের দেশ, সমাজ—সব ভেঙেচুরে খান খান করেছিল তো সে। বিষিয়ে দিয়েছিল মানুষের মন। যা কিছু ছিল সহজ, স্বাভাবিক, সুন্দর, তা বিরূপ-কুরূপ করে তুলেছিল। তাই নিয়েই ছিল ওয়াহিদ ভাইয়ের জনমভর মাথাব্যথা। কদর্য কুিসত সেই বীভত্সতার হাত থেকে বাঁচানো মানুষকে। কুবুদ্ধি মানুষের সুবুদ্ধি ফেরানোর সুলুক সন্ধান করা। তারই জন্য কাজ, নানা কাজের আয়োজন আর মানুষ জোটানো। সাংবাদিক ছিলেন তো জীবিকার ফেরে। রাজনীতির কাজ তাঁর স্বভাবের স্বধর্ম ছিল না। মন ছিল শিল্প-সংস্কৃতির বিচিত্র দিকে। সাহিত্য, কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র, বিজ্ঞান, খেলাধুলা। সবার ওপরে গান—বাংলা গান, রবীন্দ্রসংগীত। বুঝে নিয়েছিলেন, গানেই যে বাঙালির প্রাণভোমরা। তাকে জাগাতে, বাঁচাতে হলে চাই গান। নগরের যত আধমরা, সুরহারা মানুষজনে যদি ফিরে পেতে হয় প্রাণ, মন। তার স্বভাব, সত্তা। তবে সে কেবল সত্ রাজনীতির গণসংগীত হলেই চলবে না। তাতে যে কেবল খানিক ঝাঁকি লাগে আদর্শ-বুদ্ধির ওপরতলে। মনের ঠিক সাড়া জাগে না। তার জন্য বাংলা গানের আপন স্বভাব-সুর আর নিজের ভাব-ভাষা চাই। নাগরিক জীবনে দ্বিজেন্দ্র-অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত-নজরুল—বিশেষ করে রবীন্দ্রগানেই যে তার ভুবনজোড়া স্বদেশী আসনখানি। তবে ঘরের কোণে একা একা গাইলে চলবে না সে গান। হূদয় দুয়ার খুলে, বাইরে বেরোতে হবে। আর সবার সঙ্গে মিলে। খোলা আকাশের নিচে সুর মেলাতে হবে সুরে। ‘যুক্ত কর হে সবার সঙ্গে, মুক্ত কর হে বন্ধ।’ তাই তো নানা জায়গায় আসর করে ফেরা। পুরান ঢাকায় বাগানে, ছাদে, শিলাইদহ কুটিরে। খোলা মঞ্চে মঞ্চে। এভাবেই একদিন সব পথ মিলে যায় রমনায়। বটমূলে পহেলা বৈশাখের ভোরবেলায়। হারিয়ে-খুইয়ে বসা বিশ্ব প্রকৃতির যেন কোলের পরে, বুকের তলায়। স্থান-কালের যোগ বিনা যে সুর জাগে না মনের তানে। খোলা আকাশের তলে, আলো-হাওয়ায় সুরে সুরে ফিরে পায় নগরবাসী আপনায়। তারপরে কে রোধে সে জোয়ার—জীবন-মন-প্রাণ তরঙ্গ? এই আয়োজন সম্পন্ন করতে মিলতে হয়েছে তো কত কত মানুষে। গড়তে হয়েছে দল—ছায়ানট। পাকিস্তানি মারের সাগর পাড়ি দিতে। রবীন্দ্র-নিষেধাজ্ঞার জবাবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্গতি আর রাজনৈতিক দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রাণপণ করাও ছিল একই কাজের আরেক পিঠ। কিংবা চলচ্চিত্র সংসদের পত্তন। অথবা বাংলাদেশকালে রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ গঠন। আনন্দধ্বনি, কণ্ঠশীলন, গীতসূত্র, নালন্দা—এই সকল কাজের একজন বড় কাজি ছিলেন তিনি। আমাদের সেই ওয়াহিদ ভাই। গানে গানে বন্ধন কাটাতে দেশজুড়ে ফিরেছেন। অনাহূত, রবাহূত হয়েও জেলা শহরে, গ্রামে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে। সে তো এখন সবারই জানা সর্বশেষ এক অপরূপকথা।
এত এত সব কাজে সারা জীবনে, দেশজুড়ে কত মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে? শত শত, হাজার হাজার। আর কেবলই কি ছিল তা পরিচয়মাত্র? ছিল তো যাকে বলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সোজা বাংলায় সবার সঙ্গেই ছিল ভাব-ভালোবাসা। আর এটাই বুঝি তাঁর সর্বসেরা কাজ, মাস্টারপিস। শহর আর নগর মানেই তো অচিন অজানা যত মানুষের বাস। একসঙ্গে তারা যত যা-ই করুক না কেন, কারও সঙ্গেই থাকে না কারও সম্পর্কের বালাই। তা সে রাজনীতি বা সংস্কৃতির যত যা রাজা-উজির মারাই হোক। সেসব যেন বাইরের কাজ। কাজ শেষ তো সব শেষ। তারপর আবার কিসের কী সম্পর্ক। যে যার কাজ ফুরালেই পাজি—চিন-পরিচয় থাকেই না আর।
রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু এই বন্ধন মোচন করেন। ঘুচিয়ে ফিরেছেন মানুষের সঙ্গে মানুষের এই সম্পর্কহীনতা। এই নিয়ে তো মুখে মুখে ফেরে মিথ—কত বছর পরে কোন গণ্ডগ্রামের বছিরুদ্দির কাছে জানতে চান বাড়ির সবার খবর নাম ধরে ধরে। গাছপালা-পুকুরঘাটও বাদ যায় না সেই তল্লাট থেকে। তাই তো তিনি বঙ্গবন্ধু। শিল্প-সংস্কৃতির আপনাতে আপনি মশগুল মানুষজনের সঙ্গে সেই কাজই করেন আমাদের ওয়াহিদ ভাই। আর তাতে তো কোনো ভেদ ছিল না। নাম-ডাক কি বয়সের। বাংলাদেশের নানা পেশার বিখ্যাত সব মানুষ থেকে শুরু করে অনামা-অনামী নানা বয়সী যত নারী-পুরুষ। সবার সঙ্গেই তাঁর কত রকম সব অম্লমধুর জান-পেহসান। কৃষ্ণ-কানাইয়ের দেশে সখা-সখীর এক মেলা না কি হাট বসিয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের গানেই বলতে হয়, ‘ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর/তোমার প্রেম তোমারে এমন করে করেছে নিষ্ঠুর।’ প্রেমের যেন এক লীলাজীবনই যাপন করেছেন তিনি। রসিক গোরাচাঁদ হেন। এটাই ছিল তাঁর বুঝি সংস্কৃতির বড় কাজ। আত্মীয় সম্বন্ধ না পাতিয়ে বাঙালির নাকি কথা ফোটে না চেনা-অচেনা কারও সঙ্গেই। এই সম্পর্কবন্ধনই তার মর্ম-ধর্মের শানে-নযুল। যার সামনে হতবাক, মাথা নত করেছে বিশ্বজন একদা। জগত্সভায় তার শ্রেষ্ঠ আসন এই কারণেই নাকি ছিল একদিন। জানি না ওয়াহিদ ভাই ঠিক তাত্ত্বিক, নীতি-আদর্শ বিবেচনায় মাথায় তুলে নিয়েছিলেন কি না এই দেশাচার, মানবের সার এই ধর্ম। মনের মানুষ বা মানুষ-রতনের এই সন্ধান যে বাংলা-মনেরই আদি সাধন। অন্য এক ব্যক্তিগত পথে ওয়াহিদ ভাই এই কুবুদ্ধিধর নগরবাসেও তাকে ফলিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত আগুনতিজনের মনে কোথায় যেন জানে তাই একই অনুভব। ভাবের রসে যেমন ঘটে একই আস্বাদন। প্রাচ্য শিল্প-নন্দনের সেই তো চিরকালের গূঢ়তম অন্বিষ্ট।
কেবল তো শিল্পে নয়, দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবে ওয়াহিদ ভাই এমনই এক অসাধ্য সাধন করেছিলেন। অসম্ভব এই কৃত্যের ভুক্তভোগী আমরা আছি কতজনা দেশজুড়ে। আজ তাঁর মৃত্যুদিনে তাঁদের এক সতীর্থজনের কৃতার্থ এই প্রণতি—‘তোমায় নূতন করে পাবো বলে...’।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্গতি আর রাজনৈতিক দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রাণপণ করাও ছিল একই কাজের আরেক পিঠ। কিংবা চলচ্চিত্র সংসদের পত্তন। অথবা বাংলাদেশকালে রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ গঠন। আনন্দধ্বনি, কণ্ঠশীলন, গীতসূত্র, নালন্দা—এই সকল কাজের একজন বড় কাজি ছিলেন তিনি। আমাদের সেই ওয়াহিদ ভাই। গানে গানে বন্ধন কাটাতে দেশজুড়ে ফিরেছেন। অনাহূত, রবাহূত হয়েও জেলা শহরে, গ্রামে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে। সে তো এখন সবারই জানা সর্বশেষ এক অপরূপকথা।
এত এত সব কাজে সারা জীবনে, দেশজুড়ে কত মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে? শত শত, হাজার হাজার। আর কেবলই কি ছিল তা পরিচয়মাত্র? ছিল তো যাকে বলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সোজা বাংলায় সবার সঙ্গেই ছিল ভাব-ভালোবাসা। আর এটাই বুঝি তাঁর সর্বসেরা কাজ, মাস্টারপিস। শহর আর নগর মানেই তো অচিন অজানা যত মানুষের বাস। একসঙ্গে তারা যত যা-ই করুক না কেন, কারও সঙ্গেই থাকে না কারও সম্পর্কের বালাই। তা সে রাজনীতি বা সংস্কৃতির যত যা রাজা-উজির মারাই হোক। সেসব যেন বাইরের কাজ। কাজ শেষ তো সব শেষ। তারপর আবার কিসের কী সম্পর্ক। যে যার কাজ ফুরালেই পাজি—চিন-পরিচয় থাকেই না আর।
রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু এই বন্ধন মোচন করেন। ঘুচিয়ে ফিরেছেন মানুষের সঙ্গে মানুষের এই সম্পর্কহীনতা। এই নিয়ে তো মুখে মুখে ফেরে মিথ—কত বছর পরে কোন গণ্ডগ্রামের বছিরুদ্দির কাছে জানতে চান বাড়ির সবার খবর নাম ধরে ধরে। গাছপালা-পুকুরঘাটও বাদ যায় না সেই তল্লাট থেকে। তাই তো তিনি বঙ্গবন্ধু। শিল্প-সংস্কৃতির আপনাতে আপনি মশগুল মানুষজনের সঙ্গে সেই কাজই করেন আমাদের ওয়াহিদ ভাই। আর তাতে তো কোনো ভেদ ছিল না। নাম-ডাক কি বয়সের। বাংলাদেশের নানা পেশার বিখ্যাত সব মানুষ থেকে শুরু করে অনামা-অনামী নানা বয়সী যত নারী-পুরুষ। সবার সঙ্গেই তাঁর কত রকম সব অম্লমধুর জান-পেহসান। কৃষ্ণ-কানাইয়ের দেশে সখা-সখীর এক মেলা না কি হাট বসিয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের গানেই বলতে হয়, ‘ওগো আমার প্রাণের ঠাকুর/তোমার প্রেম তোমারে এমন করে করেছে নিষ্ঠুর।’ প্রেমের যেন এক লীলাজীবনই যাপন করেছেন তিনি। রসিক গোরাচাঁদ হেন। এটাই ছিল তাঁর বুঝি সংস্কৃতির বড় কাজ। আত্মীয় সম্বন্ধ না পাতিয়ে বাঙালির নাকি কথা ফোটে না চেনা-অচেনা কারও সঙ্গেই। এই সম্পর্কবন্ধনই তার মর্ম-ধর্মের শানে-নযুল। যার সামনে হতবাক, মাথা নত করেছে বিশ্বজন একদা। জগত্সভায় তার শ্রেষ্ঠ আসন এই কারণেই নাকি ছিল একদিন। জানি না ওয়াহিদ ভাই ঠিক তাত্ত্বিক, নীতি-আদর্শ বিবেচনায় মাথায় তুলে নিয়েছিলেন কি না এই দেশাচার, মানবের সার এই ধর্ম। মনের মানুষ বা মানুষ-রতনের এই সন্ধান যে বাংলা-মনেরই আদি সাধন। অন্য এক ব্যক্তিগত পথে ওয়াহিদ ভাই এই কুবুদ্ধিধর নগরবাসেও তাকে ফলিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত আগুনতিজনের মনে কোথায় যেন জানে তাই একই অনুভব। ভাবের রসে যেমন ঘটে একই আস্বাদন। প্রাচ্য শিল্প-নন্দনের সেই তো চিরকালের গূঢ়তম অন্বিষ্ট।
কেবল তো শিল্পে নয়, দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবে ওয়াহিদ ভাই এমনই এক অসাধ্য সাধন করেছিলেন। অসম্ভব এই কৃত্যের ভুক্তভোগী আমরা আছি কতজনা দেশজুড়ে। আজ তাঁর মৃত্যুদিনে তাঁদের এক সতীর্থজনের কৃতার্থ এই প্রণতি—‘তোমায় নূতন করে পাবো বলে...’।
No comments