আমরা-তারা একাকার by সুভাষ সাহা
মানী লোকদের মান রক্ষার ব্যাপারে বাঙালির ঐতিহ্য নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে টেলিফোনে কথা হচ্ছিল এ দেশেরই পোড়-খাওয়া ও দেশে-বিদেশে সুপরিচিত এক সাংবাদিকের সঙ্গে। একথা-সেকথা বলতে বলতে তিনি নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে।
স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির জনকের হত্যাকারীদের যে দেশে তিরস্কৃত না করে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা হয় এবং সেই নৃশংসতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত কুলাঙ্গারদের বীরের সম্মান দেওয়া হয় এবং সেই দৃশ্য এ দেশেরই অনেকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন, তখন আমরা গুণী লোককে প্রকৃত সম্মান জানাতে পারি_ এ কথা কি কোনো বোকার হদ্দও বিশ্বাস করবে? তাই এখন এ দেশে সবাই গড়পড়তা দরের। খবরদার! কেউ আগ বাড়িয়ে কোনো গুণী লোককে সম্মাননা দিতে যাবেন না যেন। আগে ভাবুন, এরপর কোনো দিক থেকে চাপ এলে তা সামাল দেওয়ার মতো লাইনঘাট, শক্তি-সামর্থ্য, অর্থ ও পেশিশক্তির জোর আছে তো? নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথাই ভাবুন না। তিনি নাকি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। সুতরাং তার অপমানের সঙ্গে তামাম দেশের মানুষের সম্মান জড়িত থাকার কথা। অথচ ইংরেজরা যখন তাকে রাস্তা দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ সে দৃশ্য উপভোগ করছিল। জাতি সেদিন বুঝল না নবাবের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ তাদেরও শত শত বছরের জন্য কয়েদ করে ফেলছে। আর এখন দেখুন, সেই হতভাগ্য নবাবের কাহিনী নিয়ে যখন সিনেমা হয় তখন আমরা তা দেখে হাপুস নয়নে অশ্রুপাত করি। জাতির জনকের নিথর দেহ থেকে রক্তের ধারা সিঁড়ি বেয়ে বয়ে পড়ছে, তখনও কেউ এগিয়ে এলো না একটা গগনবিদারী হুঙ্কর দিয়ে শহীদি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে।
একই সঙ্গে বাঙালি চরিত্রের এ বৈপরীত্য নিয়েই আমরা নিজেদের মধ্যে মজে আছি। হ্যাঁ! আমরা সাময়িক সময়ের জন্য গর্জে উঠতে পারি। কিন্তু রক্তের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্য রক্ষা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা চালানোর মতো ধৈর্য এখনও আমাদের নেই। সে কারণেই বাঙালির সামগ্রিক বা সমন্বিত কোনো রেনেসাঁ নেই। আমরা কল্পনাবিলাসী, পরের কাসুন্দি ঘাঁটতে ভালোবাসি, পরশ্রীকাতর_ আরও কত অভিধায় অভিহিত করে গেছেন অনাবাসী বাঙালি লেখক নীরদ সি চৌধুরী। তাই আমাদের এখন সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য কোনো জাতীয় নেতা নেই। সমন্বিত কোনো ইতিহাস নেই। যারা যখন ক্ষমতায় আসে তারা তখন তাদের খয়েরখাঁ লেখকদের দিয়ে ইতিহাস লেখায়। কেউ নিজের ইতিহাসমনস্কতা তুলে ধরার মাধ্যমে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করলেই বিপদ! বাঙালি বাবু হন আর বাংলাদেশি সাহেব হন রক্ষা নেই।
পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের অনেক বৈপরীত্য সত্ত্বেও একটি ক্ষেত্রে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সাংবাদিক বন্ধুটি আমাকে টেলিফোন আলাপের সময় পাকিস্তানের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আবদুল সালামের কথা বললেন। আমি বললাম, তাকে তো পাকিস্তান সরকার ডেকে এনে সম্মান জানিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তার মৃত্যুর পর লাশ পাকিস্তানের কোথায় দাফন হবে, এ নিয়ে পাকিস্তানে দাঙ্গা বেধে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়েছিল_ সে কথা বন্ধুটি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। এই সালামই তাকে ১৯৫৭ সালে লাহোর কলেজের অধ্যাপনা থেকে বের করে দেওযার পর ১৯৭৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ের পর পুরস্কারটি নিয়ে পাকিস্তানে এসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রফেসর সালামের লাশ জাতীয় কবরস্থানে দাফন করা গেল না। কেন? কারণ, তিনি সুনি্ন মুসলমান নন, তিনি একজন আহাম্মদি। সালাম যদি মৃত্যুর আগে জানতে পারতেন, তার লাশ নিয়ে এ ধরনের তামাশা হবে তাহলে হয়তো তিনি বিদেশের মাটিতেই শেষ শয়ানের আর্জি জানিয়ে যেতেন।
রাজনীতি, ধর্মনীতি এমন কঠিন বস্তু_ যেখানে মানুষ আর মানুষ থাকে না, মনুষ্যত্ব পর্যন্ত অগ্রাধিকার পায় না শেষ পর্যন্ত, টোটেম সমাজের মতোই আমরা গোষ্ঠী পরিচয়ে নিজেদের পরিচিত করি। সে কারণে সালাম একজন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও সব পাকিস্তানি মিলে তার গৌরবে আত্মহারা হতে পারে না। এখানেই মনে হয় পাকিস্তানি ও আমাদের মধ্যে অদ্ভুত সাদৃশ্য এখনও বিদ্যমান। এটাকে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের অবশেষগুলোর মধ্যে মর্যাদার আসন দেওয়া যায় না!
একই সঙ্গে বাঙালি চরিত্রের এ বৈপরীত্য নিয়েই আমরা নিজেদের মধ্যে মজে আছি। হ্যাঁ! আমরা সাময়িক সময়ের জন্য গর্জে উঠতে পারি। কিন্তু রক্তের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্য রক্ষা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা চালানোর মতো ধৈর্য এখনও আমাদের নেই। সে কারণেই বাঙালির সামগ্রিক বা সমন্বিত কোনো রেনেসাঁ নেই। আমরা কল্পনাবিলাসী, পরের কাসুন্দি ঘাঁটতে ভালোবাসি, পরশ্রীকাতর_ আরও কত অভিধায় অভিহিত করে গেছেন অনাবাসী বাঙালি লেখক নীরদ সি চৌধুরী। তাই আমাদের এখন সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য কোনো জাতীয় নেতা নেই। সমন্বিত কোনো ইতিহাস নেই। যারা যখন ক্ষমতায় আসে তারা তখন তাদের খয়েরখাঁ লেখকদের দিয়ে ইতিহাস লেখায়। কেউ নিজের ইতিহাসমনস্কতা তুলে ধরার মাধ্যমে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করলেই বিপদ! বাঙালি বাবু হন আর বাংলাদেশি সাহেব হন রক্ষা নেই।
পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের অনেক বৈপরীত্য সত্ত্বেও একটি ক্ষেত্রে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সাংবাদিক বন্ধুটি আমাকে টেলিফোন আলাপের সময় পাকিস্তানের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আবদুল সালামের কথা বললেন। আমি বললাম, তাকে তো পাকিস্তান সরকার ডেকে এনে সম্মান জানিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তার মৃত্যুর পর লাশ পাকিস্তানের কোথায় দাফন হবে, এ নিয়ে পাকিস্তানে দাঙ্গা বেধে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়েছিল_ সে কথা বন্ধুটি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। এই সালামই তাকে ১৯৫৭ সালে লাহোর কলেজের অধ্যাপনা থেকে বের করে দেওযার পর ১৯৭৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ের পর পুরস্কারটি নিয়ে পাকিস্তানে এসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রফেসর সালামের লাশ জাতীয় কবরস্থানে দাফন করা গেল না। কেন? কারণ, তিনি সুনি্ন মুসলমান নন, তিনি একজন আহাম্মদি। সালাম যদি মৃত্যুর আগে জানতে পারতেন, তার লাশ নিয়ে এ ধরনের তামাশা হবে তাহলে হয়তো তিনি বিদেশের মাটিতেই শেষ শয়ানের আর্জি জানিয়ে যেতেন।
রাজনীতি, ধর্মনীতি এমন কঠিন বস্তু_ যেখানে মানুষ আর মানুষ থাকে না, মনুষ্যত্ব পর্যন্ত অগ্রাধিকার পায় না শেষ পর্যন্ত, টোটেম সমাজের মতোই আমরা গোষ্ঠী পরিচয়ে নিজেদের পরিচিত করি। সে কারণে সালাম একজন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও সব পাকিস্তানি মিলে তার গৌরবে আত্মহারা হতে পারে না। এখানেই মনে হয় পাকিস্তানি ও আমাদের মধ্যে অদ্ভুত সাদৃশ্য এখনও বিদ্যমান। এটাকে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের অবশেষগুলোর মধ্যে মর্যাদার আসন দেওয়া যায় না!
No comments