নতুন বছরে প্রত্যাশা by আফসা পারভীন
কালের গর্ভে হারিয়ে গেল আরও একটি বছর। ২০০৯ সালকে পেছনে ফেলে এলেও কিছু প্রশ্ন রয়ে গেল অনেকের মনে। যার মধ্যে একটি গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরবতর্ী সময় থেকে আজ অব্দি নারীর মতায়ন কতটা হয়েছে এবং সেটা কোন কোন েেত্র? বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী।
তাই নারীসমাজের সার্বিক মুক্তির জন্য নারীর মতায়নের ভূমিকা অপরিসীম। উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকের মধ্যে নারীর ৰমতায়ন একটি গুরম্নত্বপূর্ণ ইসু্য। তাই বর্তমানে বাংলাদেশের নারীরা কতটা মতায়নের দিকে এগোচ্ছে তা বিশেস্নষণের দাবি রাখে। আমরা যদি ২০০৯ সালের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখব বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর মতায়ন হয়েছে বিস্ময়কর। ২০০৯ সালে ৬ জানুয়ারি ডা. দীপু মনি, যিনি প্রথম নারী হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৩ ফেব্রম্নয়ারি-০৯ নবম জাতীয় সংসদে সংসদ উপনেতা হিসেবে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী নির্বাচিত হন। তিনি দেশের প্রথম নারী উপনেতা। বিভিন্ন গুরম্নত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন নারী মন্ত্রীরা। সংসদে সংরতি মহিলা আসনে ৪৫ জন নারী সদস্য রয়েছেন। উপজেলা পরিষদে নারী ভাইস-চেয়ারম্যান পদ এবং ইউনিয়নে পরিষদের নারী সদস্যপদ সংরতি রয়েছে। আরও একটি উলেস্নখযোগ্য বিষয়_ মার্কিন প্রভাবশালী সাময়িকী ফোবর্সের বিশ্বের ৰমতাধর একশ' নারীর নতুন তালিকায় বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী স্থান পেয়েছেন। তিনি ৭৮ নম্বরে রয়েছেন। উলেস্নখ্য, বিগত নির্বাচনে ভোট প্রদানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। এই অংশগ্রহণ কিছুটা হলেও নারীর রাজনীতি সচেতনতার বহির্প্রকাশ।শুধু রাজনীতি নয়, প্রশাসনিক কাজেও নারীরা দতার পরিচয় দিচ্ছেন। ১ জানুয়ারি ২০০৯ নাজনীন সুলতানা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম নির্বাহী হিসেবে যোগদান করেন। এছাড়া বিচারপতি, পিএসসির চেয়ারম্যান, ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক, ডিসি-এসপি ছাড়াও সেনাবাহিনী, পুলিশসহ বিভিন্ন গুরম্নত্বপূর্ণ পদে নারীর মতায়ন ঘটেছে।
শুধু তাই নয়, বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নারীরা কর্মরত রয়েছেন এবং যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন। মিডিয়ার কাজেও তারা ভাল করেছেন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নিউজ প্রেজেন্টার, টিভি রিপোর্টিং, উপস্থাপিকা, প্রোডিউসার, ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন। সংবাদপত্র, কর্পোরেট অফিস, ব্যাংক ও শিা প্রতিষ্ঠানে সুচারম্নভাবে কাজ সম্পন্ন করছেন। সাংস্কৃতিক কর্মকা-েও তারা এগিয়ে রয়েছেন। পুরস্কারের পাশাপাশি কাজের স্বীকৃতি ও প্রশংসা পাচ্ছেন।
এই চিত্রটি যদি নারীর মতায়নের অগ্রগতির সূচক হিসেবে ধরে নেয়া যায়, তথাপি নারীর অবস্থা ও অবস্থানের কতটা পরিবর্তন হয়েছে তা চুলচেরা বিশেস্নষণের দাবি রাখে। কেননা এই চিত্রটি সমগ্র দেশের চিত্র নয়। এটি শহরভিত্তিক এবং একটি শ্রেণীকে চিহ্নিত করে। যারা বিভিন্ন েেত্র তাদের অধিকার আদায় করে নিচ্ছে এবং সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু আমরা যদি সুবিধাবঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া নারী গোষ্ঠীর দিকে তাকাই তাহলে দেখব নারীর মতায়ন প্রায় শূন্যের কোঠায়। পত্রিকা খুললেই নারী সহিংসতার ঘটনা চোখে পড়ে। গ্রামের মেয়েরা এখনও বাল্যবিবাহ, যৌতুক, যৌননির্যাতন, ফতোয়াবাজি, কুসংস্কার, পর্দাপ্রথার শিকার। মতামত প্রদান ও সিদ্ধানত্ম গ্রহণের মতা নেই বললেই চলে। নারী-পুরম্নষের বৈষম্য রয়েছে প্রকটরূপে। সম্পত্তিতে প্রজনন ও জন্মশাসনে এবং আইনের আশ্রয় লাভের েেত্র অপারগ, নির্যাতনের বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদী নয়। এখনও তারা পুরম্নষের ওপর নির্ভরশীল এবং ভাগ্যে বিশ্বাসী।
'নারীর মতায়ন' বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল আইনজীবী সারা হোসেনের কাছে। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, তিনি নারীর মতায়ন বলতে একটি নির্যাতনমুক্ত পরিবেশে একজন মানুষের যেসব আর্থ-সামাজিক অধিকার রয়েছে তা নিয়ে স্বাধীনভাবে মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে বাস করাকে বোঝেন। তিনি মনে করেন, নারী অধিকার আদায়ের এখন সুন্দর সময়। কেননা মৌলবাদী গোষ্ঠী এখন কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। তিনি মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরিণ শারমিন চৌধুরীর বর্তমান কর্মকা-কে নারীদের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করেন। এবং সংরতি মহিলা সাংসদরা নারী অধিকার আদায়ে জোরালো ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করেন। এেেত্র নারী উন্নয়ননীতিকে সুসমন্বিত করে এর সফল বাসত্মবায়ন, মিডিয়া, নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আরও জোরালো ভূমিকা নারীর মতায়নকে বেগবান করবে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, নারী সহিংসতা রোধে প্রশাসনের বলিষ্ঠ পদপে প্রয়োজন। তিনি খুবই আশাবাদী। তিনি মনে করেন নারীরা তাদের অধিকার আদায় বিষয়ে অনেক সচেতন। তারা আগের চেয়ে অনেক স্বাধীন ও সংগঠিত।
অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল নারীর মতায়ন বলতে তিনি কি বোঝেন? ত্রপা উত্তরে বলেন, তিনি নারীকে আলাদা বিশেষণে বিশেষিত করতে চান না। তিনি বলেন, মানুষ হিসেবে তার অধিকারগুলো নিশ্চিত হওয়া দরকার। তিনি নারী অধিকার আদায়ে এনজিও এবং নারী সংগঠনগুলোর ভূমিকার প্রশংসা করেন। যদিও তারা ছোট পরিসরে কাজ করছে। তিনি বলেন, এেেত্র রাষ্ট্রের জোরালো পৃষ্ঠপোষকতা ও পদপে দরকার। মিডিয়া এেেত্র কি ভূমিকা রাখতে পারে জানতে চাওয়া হলে বলেন, মিডিয়া একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হলেও সমাজে যা বিরাজ করছে তাই তুলে ধরে। তারা প্রথা ভেঙ্গে সহজে কিছু তুলে ধরতে চায় না। বর্তমানে মিডিয়া নারী অধিকার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। যদিও মিডিয়ার আরও ব্যাপক কার্যক্রম নেয়া দরকার। তিনি বলেন, মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হওয়াটা জরম্নরী। তা তাদের মতায়নের দিকে নিয়ে যাবে। তবে এেেত্র তিনি অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আশা করেন। শিা, নারী স্বাধীনতা এবং কর্মসংস্থানের মধ্যে দিয়ে মেয়েরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দিকে এগুবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি নারীর মতায়ন প্রশ্নে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী।
প্রকৃত অর্থে নারীর মতায়ন একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। তবে আমাদের জন্য আশার আলো এই যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী অধিকার বিষয়ে সচেতন। তিনি সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে নতুন আইন প্রণয়নের কথা বলেছেন। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে আইন প্রণয়নের কথা সংসদে পেশ করা হবে বলেছেন। বৈষম্যমূলক আইন সংশোধন করা হবে। ইতোমধ্যে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী সনত্মান তার মায়ের নাগরিকত্ব লাভ করতে পারবে। বর্তমান সরকারের গৃহীত পদপে কিছুটা প্রত্যাশা জাগালেও আমাদের নারীদের বেগম রোকেয়া, নবাব ফয়জুন্নেসা আর প্রীতিলতার মতো সংগ্রামী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবে হয়ত একদিন বিজয় সুনিশ্চিত হবে।
No comments