আমদানি মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে- ডাল চিনি আটা ভোজ্যতেল by মিজান চৌধুরী
তুরস্ক থেকে এক কেজি মসুর ডাল আমদানি করা হয়েছে ৬৩.২০ টাকায়। পরিবহন, গুদাম ভাড়াসহ ৫ শতাংশ মুনাফা যোগ হয়ে ওই ডালের মূল্য দাঁড়ায় ৬৭.২৫ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকা।
প্রতিকেজিতে ব্যবসায়ীরা ৫ শতাংশ মুনাফা ছাড়াও অতিমুনাফার নামে লুটে নিচ্ছে ২৮ টাকা। তুরস্কের ডাল ছাড়াও আনত্মর্জাতিক বাজার মূল্যের চেয়ে অভ্যনত্মরীণ বাজারে নেপালের ডালে ৫ শতাংশ মুনাফা ব্যতীত ক্রেতার কাছ থেকে প্রতিকেজি অতিরিক্তি মূল্য আদায় করা হচ্ছে ২৪ টাকা, সয়াবিন তেলে ৬ টাকা, আটায় ১০.৫০ টাকা ও চিনিতে ৮ টাকা। আমদানি, পাইকারি ও খুচরা_ এই তিন পর্যায়ে অতিমূল্যের টাকা আদায় করা হচ্ছে। সম্প্রতি সরকারের বাজারদর ও গবেষণা সেলে ব্যবসায়ীদের এই কারসাজির ঘটনাটি ধরা পড়েছে। এই ঘটনায় সরকারের প্রশাসনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।জানা গেছে, অতিমুনাফা আদায়কারী ব্যবসায়ীদের বিরম্নদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আজ বরিবার জরম্নরী বৈঠক ডেকেছে। ওই বৈঠকে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, আটা ও ময়দাসহ নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বৈঠকে ব্যবসায়ীদের কাছে সম্প্রতি বাজারে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির ব্যাখা চাওয়া হবে। কারণ, সরকারের হাতে প্রমাণ রয়েছে_ এই সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণ নেই। দাম বৃদ্ধি করছে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো।
বাজারদর অনুসন্ধান ও গবেষণা সেল সূত্রে জানা গেছে, আমদানি, পাইকারি ও খুচরা_ এই তিন পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা কোন কারণ ছাড়াই জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে। বর্তমান বাজারে যেসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে তার আমদানি ব্যয়, শুল্ক, পরিবহন ব্যয়, গুদাম ভাড়া, রিফাইনারি ব্যয়সহ আনুষঙ্গিক ব্যয় বের করে সরকার একটি সম্ভাব্য ব্যয় বের করেছে। ওই ব্যয়ের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের ৫ শতাংশ মুনাফা যোগ করার পরও দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা তারও কয়েকগুণ বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছে। বিষয়টি সরকারের মনিটরিং সেলে ধরার পর জরম্নরী বৈঠক ডাকা হয়েছে।
তুরস্কের মসুর ডাল- ডালের আমদানির ব্যাপারে সরকারের মনিটরিং সেল দেখেছে, তুরস্ক থেকে আনা ডালের চট্টগ্রাম বন্দর পর্যনত্ম এক মেট্রিক টনের সিআরএফ মূল্য হচ্ছে ৯১০ মার্কিন ডলার। প্রতিটনে ফ্রেইট হচ্ছে ৪৫ মার্কিন ডলার। অভ্যনত্মরীণ ভ্যাট ও শুল্ক না থাকায় টাকার অঙ্কে প্রতিমেট্রিক টন মসুর ডালের আমদানি ব্যয় দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ২শ' টাকা। একজন ব্যবসায়ীর মুনাফা ৫ শতাংশ ধরা হলে ওই ব্যয় দাঁড়াবে ৬৬ হাজার ৩৫৯ টাকা। এর সঙ্গে পরিবহন, গুদাম ভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচ হচ্ছে টনপ্রতি ৯শ' টাকা। সব মিলে প্রতিটনের মূল্য দাঁড়াবে ৬৭ হাজার ২৫৯ টাকা। ওই হিসেবে প্রতিকেজি মসুর ডালের মূল্য হবে ৬৭.২৫ টাকা। কিন্তু পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা ও খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ ৯৫ টাকা।
নেপালের মসুর ডাল_ নেপাল থেকে এক কেজি মসুর ডাল আমদানি করা হয় ৯৭.২৩ টাকা। পরিবহন, গুদাম ভাড়াসহ ৫ শতাংশ মুনাফা ধরে ওই ডালের মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ১০৪ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২৮ টাকা। প্রতিকেজি ডালে অতিমুনাফা হিসেবে লুটে নিচ্ছে ২৪ টাকা।
আটা- অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা থেকে চট্টগ্রাম পর্যনত্ম এক মেট্রিক টন গমের সিআরএফ মূল্য হচ্ছে ২শ' মার্কিন ডলার। ফ্রেইট হচ্ছে প্রতিটনে ৫০ থেকে ৬০ ডলার। অভ্যনত্মরীণ কোন শুল্ক আরোপ না থাকায় টাকার অঙ্কে এক টন গমের মূল্য হচ্ছে ১৩ হাজার ৮৯০ টাকা। এর সঙ্গে ৫ শতাংশ মুনাফা যোগ হয়ে মোট মূল্য দাঁড়াবে ১৪ হাজার ৫৮৫ টাকা। পরিবহন, গুদাম ভাড়া ও আনুষঙ্গিক ব্যয় হচ্ছে ৯শ' টাকা। এক টন গমের সম্ভাব্য মূল্য হচ্ছে ১৫ হাজার ৪৮৪ টাকা এবং কেজি ১৫.৪৮ টাকা। কিন্তু স্থানীয় পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২০.৬০ টাকা এবং খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৬ টাকা।
ব্রাজিল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যনত্ম গত নবেম্বর মাসে এক মেট্রিক টন সয়াবিনের (ক্রুড) সিআরএফ মূল্য পড়েছে সাড়ে আট শ' মার্কিন ডলার। ভ্যাট ও অন্যান্য ব্যয় হচ্ছে ৮ হাজার ৮৫৫ টাকা। শুল্ক পরিশোধে টাকার অঙ্কে প্রতিটন সয়াবিনের মূল্য হবে ৬৭ হাজার ৮৮৭ টাকা। ৫ শতাংশ মুনাফা যোগ হয়ে দাঁড়াবে ৭১ হাজার ২৮৩ টাকা। পরিবহন, গুদাম ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় হচ্ছে ৯শ' টাকা। ওই মূল্য যোগ হয়ে টনপ্রতি সয়াবিনের মূল্য হবে ৭২ হাজার ১৮২ টাকা। প্রতিকেজির মূল্য হবে ৭২.১৮ টাকা। এক কেজি রিফানারি খরচ হচ্ছে সাড়ে তিন টাকা। সর্বশেষ মূল্য হচ্ছে প্রায় ৭৬ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ এক কেজি সয়াবিনের মূল্য হচ্ছে ৮২ টাকা।
চিনি- গত নবেম্বর মাসের এলসির হিসেবে প্রতি মেট্রিক টন সাদা চিনির চট্টগ্রাম বন্দর পর্যনত্ম এফওবির মূল্য হচ্ছে ৫৫৫.৩০ মার্কিন ডলার। ফ্রেইট হচ্ছে ৬০ মার্কিন ডলার। টনপ্রতি ৩ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। শুল্কসহ আমদানি ব্যয় টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ৭১২ টাকা। ৫ শতাংশ ব্যবসায়িক মুনাফা যোগ হয়ে ওই মূল্য দাঁড়াবে ৪৭ হাজার ৯৭৭ টাকা। সম্ভাব্য পরিবহন ব্যয়, গুদাম ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ টনপ্রতি ৯শ' টাকা যোগ হয়ে মূল্য দাঁড়াবে ৪৮ হাজার ৮৯৭ টাকা এবং কেজি ৪৮.৯০ টাকা। কিন্তু পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৫২ টাকা এবং খুচরা বাজারে প্রতিকেজি চিনির মূল্য হচ্ছে ৫৬ টাকা।
ডালের মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে ডাল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি শফিক মাহমুদ জনকণ্ঠকে জানান, সরকার ডাল আমদানি ঘোষণা দেয়ায় অনেক ব্যবসায়ী আমদানি বন্ধ রেখেছে। এ ছাড়া সামনে নতুন ডাল উঠবে এই আশা থেকে ডাল আমদানি হচ্ছে না। ফলে বাজারে ডালের সঙ্কট থেকে মূল্য বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনেক সময় ঘোষণা দিয়ে আমদানি করে না। এতেও বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ে। এেেত্র সরকার টিসিবির মাধ্যমে ডাল আমদানি করে বিক্রি করলে দাম কমবে। তিনি আরও বলেন, নতুন ডাল উঠলে আগামী মাসে ডালের দাম কমবে।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আজকের বৈঠক থেকে সরকার বাজারে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় রাখার েেত্র বড় ধরনের পদপে নেবে। বিশেষ করে অহেতুক মূল্য বৃদ্ধির ঘটনায় জড়িতদের বিরম্নদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধানত্মের কথা ভাবছে।
No comments