ঢাকার ঘুড়ি উৎসব ব্য by তৌফিক অপু
হুররে!!! বাকাটা! সমস্বরে উলস্নাস করে ওঠে তরম্নণের দল। চারদিকে ঢাক-ঢোলের বাদ্যবাজনা। উৎসবমুখর পরিবেশ। এরই মধ্যে চলছে পুরনো ঢাকার প্রতিটি বাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়ানোর তোড়জোড়।
চিরাচরিত বাঙালীর উৎসবগুলোতে বাঙালীরা যেন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একাকার হয়ে উৎসবের আকাশকে রঙিন করে তোলে। জাতিগত ভেদাভেদ, হানাহানি ভুলে সবাই এক হয়ে উৎসবের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। তেমনি এক উৎসব পৌষসংক্রানত্মির ঘুড়ি উৎসব। পৌষমাসের শেষ তারিখে দিনব্যাপী ঘুড়ি ওড়ানোর রীতি বহুকালের। যতদূর জানা যায়, নবাব সলিমুলস্নার আমল থেকে পৌষসংক্রানত্মিতে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন শুরম্ন হয় এবং সেবার সাহেব নিজেই ঘুড়ি উড়িয়ে নাকি এ উৎসবের সূচনা করেন। ঘুড়ি ওড়ানো বাংলার এক অনন্য ঐতিহ্য। আর এ ঐতিহ্য যখন উৎসবে পরিণত হয়, তখন যেন খুশির বাঁধ ভেঙ্গে যায়। আগে ঢাকাসহ সারা বাংলার পৌষসংক্রানত্মিতে সবাই ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবে মেতে উঠত। কালের ধারায় এ উৎসব এখন অনেকটাই পুরনো ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। তবে পুরনো ঢাকা ছাড়াও ঢাকার বাইরের কিছু কিছু অঞ্চলে এখনও বেশ ধুমধামের সঙ্গে পৌষসংক্রানত্মি পালিত হয়। পুরনো ঢাকার প্রতিটি বাড়ির ছাদে এই দিনে বাজানো হয় মাইক, ঢোল, ডেকসেট ইত্যাদি। ছেলে-বুড়ো সবাই দল বেঁধে বাড়ির ছাদে ওঠে ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য। সারাদিন চলে ঘুড়ি ওড়ানো। মজার বিষয় হলো, পুরো ছাদে দু' থেকে তিনজন ঘুড়ি ওড়ালেও তাদের উৎসাহ দিতে হাজির থাকে গোটা ত্রিশজন। এরা সবাই ঢাকঢোল বাজিয়ে গান গেয়ে উৎসাহ যোগায় খেলোয়াড়দের। আশপাশের প্রতিটি বাড়ির দৃশ্য একই রকম। ঘুড়ি ওড়ানো নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়_ কার ঘুড়ি কত উঁচুতে উঠবে, কাটাকাটির মাধ্যমে কার ঘুড়ি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে এই নিয়ে। প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হচ্ছে ঘুড়ি কাটাকাটি। বিভিন্ন রঙের এবং নামের ঘুড়ি আকাশে উড়তে থাকে। একে অপরের সঙ্গে কাটাকাটির ইচ্ছা প্রকাশ করলে দেড়ি দেড়ি বলে চিৎকার করতে থাকে। অর্থাৎ যে ঘুড়ির সঙ্গে কাটাকাটি করার ইচ্ছা সে ঘুড়ির নাম ধরে দেড়ি দেড়ি বলে হাঁক ছাড়ার মানেই হচ্ছে ঐ ঘুড়ির সঙ্গে কাটাকাটি করার ইচ্ছা পোষণ করা, অপরপ্রানত্মের প্রতিযোগী যদি এই ডাক শুনে দেড়ি দেড়ি বলে হাঁক ছাড়ে তাহলে উভয়ের সম্মতি প্রকাশ পায়। এরপর শুরম্ন হয় দুই ঘুড়ির কাটাকাটির যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যে জয়ী হয়, সেই দল উলস্নাসে বাকাটা বাকাটা বলে চিৎকার করতে থাকে। এভাবে সারা পুরনো ঢাকা ঐ দিন দেড়ি দেড়ি আর বাকাটা বাকাটা শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। ঘুড়ি কাটাকাটির সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে ধারালো সুতা। যার সুতা যত ধারালো তার ঘুড়িই রাজত্ব করে সেই দিন। এেেত্র অবশ্য খেলোয়াড়েরও দতার প্রয়োজন। সুতা ধারালো করার প্রক্রিয়াকে স্থানীয় ভাষায় মাঞ্জা বলা হয়। সাধারণ সুতাকে বিভিন্ন উপকরণে মিশ্রিত করে ধারালো করা হয়। উপকরণগুলো হচ্ছে সিরিস, মসৃণ কাঁচের চুর্ণ বা চুর, রং ইত্যাদি। সিরিস হচ্ছে এক প্রকার আঠা। চামড়ার একটি অংশ দিয়ে সিরিস তৈরি করা হয়। সিরিস ও সাগুদানা পানিতে জাল দিয়ে আঠা তৈরি করা হয়। সেই আঠাতে রং মিশ্রণ করে সুতাগুলোকে চুবিয়ে রাখতে হয় আধঘণ্টার মতো। এর পর সুতাগুলোকে ঘুড়ি উড়ানো নাটাইতে পেঁচিয়ে নিতে হয়। এরপর সুতায় চুর লাগানোর জন্য এক নাটাই থেকে অন্য নাটাইয়ে পেঁচানো হয় এবং সুতা পেঁচানোর ফাঁকে একজন হাতে চুর নিয়ে সুতায় মিশ্রণ করে দেয়। অর্থাৎ চুরভর্তি হাত মুঠ করে তার ভেতর দিয়ে সুতা এক নাটাই থেকে অন্য নাটাইয়ে টেনে নেয়া হয়। এরপর সুতাকে রোদে শুকানো হয়। সুতা শুকিয়ে ঝরঝরে হয়ে যাওয়ার পর তা ঘুড়ি ওড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। ঘুড়ি কাটাকাটি খেলায় যেসব ঘুড়ি ব্যবহৃত হয় তার নামগুলোও বেশ অদ্ভুত। প্যাটার্ন আর সাইজ অনুযায়ী একেক ঘুড়ির একেক নাম। যেমন_ চোখদ্বার, মালাদ্বার, পঙ্খীরাজ, চশমাদ্বার, কাউঠাদ্বার, চাপালিশ, চানদ্বার, বক্সঘুড়ি, চিলঘুড়ি, এক রঙা ইত্যাদি। এমনকি জাতীয় পতাকার রঙেও ঘুড়ি তৈরি করা হয়। ঘুড়ির সঙ্গে সঙ্গে নাটাইগুলোর নামও বেশ মজাদার। বাটিওয়ালা, মুখবান্ধা, মুখছাড়া ইত্যাদি। পৌষসংক্রানত্মিকে সামনে রেখে শাঁখারিবাজারের দোকানগুলোতে ঘুড়ি নাটাইয়ের বেচা বিক্রির ধুম পড়ে।
No comments