লেখালেখির জগত by আসমা আক্তার
একটি দেশ একটি সমাজ আর একটি ঘরসংসার সবখানে যেমনি রয়েছে পুরম্নষের পদযাত্রা তেমনি রয়েছে নারীর। আমরা বলি নারীর সাফল্য তার মাতৃত্বে। প্রশ্ন থেকে যায় শুধু কি মাতৃত্বে? আমরা দেখে এসেছি আধুনিক যুগ তার পর কম্পিউটার যুগ আর এখন বলছি ডিজিটাল যুগ। এভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সমাজ, দেশ তার সঙ্গে সমাজের মানুষগুলো।
তাই বলে নারী কি পিছিয়ে আছে তার মাতৃত্বে সাফল্যে আবেগে আর তার কর্মে। সেই রকম এগিয়ে যাওয়া নারীদের নিয়ে এই পদযাত্রা। এখানেও একটা কথা প্রতিটা এ নারী চরিত্রের সঙ্গে আমার কথা হয়। সমাজের দ্বায়বদ্ধতার কারণে উনাদের অনুরোধে প্রতিটি নামে ছদ্ম নাম ব্যবহার করতে হয়েছে। তবে এখানে দেয়া নারীরা তাদের ঘটনা পড়লে বুঝতে পারবেন কোনটা কার চরিত্র। তার পরও কোন ভুল কিছু হয়ে গেলে আমি মা চেয়ে নিচ্ছি তাদের কাছে।১) জান্নাতুল ফেরদৌস_ স্বপ্ন দেখতে কেনা চায়। সবার মতো তিনিও স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেন। সব সময় মন চায় স্বপ্নের মাঝে হারিয়ে গিয়ে বাসত্মবে ফিরে আসতে। তাও কি সম্ভব। ছোট বয়স থেকে কবিতা ভালবাসেন। সেই থেকে শুরম্ন হয় কবিতা পড়া। সেই ছোট বেলায় দু'-একটা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়ও অংশ নেন। মাঝে মধ্যে লিখতে চাইলে ও কলেজ জীবনে লিখেন ক'টি কবিতা। তবে সেগুলো মনঃপুত হয় না। জীবনের চাকা ঘুরাতে গিয়ে বিয়ে করেন ভালবাসার মানুষকে। ভালবাসার রূপ ক্রমে বদলে যায়। এই বদলে যাওয়া কষ্টগুলোকে ভুলে থাকতে চেয়েছেন অনেকভাবে কিন্তু পারেননি। কষ্ট ভুলার পথ খুঁজতে খুঁজতে একদিন হাতে তুলে নেয় কালির এক কলমকে। শুরম্ন হয় তার লেখা। প্রথম লেখা প্রকাশের আনন্দ ধরে রাখতে না পেরে ভালবাসার মানুষকে খবর দেয়। সব আনন্দ যেন হারিয়ে যায় তার সেই মিথ্যে ভালবাসার কণ্ঠে। আজও ছাড়েনি কলম। দিনের আলোকে না ভালবাসার আলোকে ফাঁকি দিয়ে চালিয়ে যান তার কলম। অথচ এখনও ভাবেন সরে যাবেন না এক মুহূর্তের জন্যও তার দায়িত্ব থেকে। ঘরসংসার আর কলম সবই এখন তার আপন নিজের জীবনের আনন্দ বেদনার অনেক ছবিই তুলে ধরেন তার লেখার মাঝে।
২) নূরনাহার_ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, মা-বাবার কথার খুব একটা অবজ্ঞা করতে শিখেননি কখনও। লেখাপড়ায় খুব একটা ভাল না হলেও কয়েকটা পাস করেন। চেষ্টা করলে একটা যোগ্যতা সম্পূর্ণ চাকরি করতে পারতেন। মেয়ের আসল ঘর, স্বামীর সংসারে যা চলে আসছে আমাদের সমাজে। এ নিয়মকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মা-বাবার পছন্দে বিয়ে করেন। স্বামী আর সংসারের পিছনে সময় দিয়ে বাকি সময় কাটানোর পথ খুঁজতে থাকেন। বাইরে চাকরির আবদার করে হেরে যায়। অবসর সময় যেন তাকে কুরে কুরে খায়। পত্রিকার খবরগুলো তাকে খুব নাড়া দিতে থাকে। হঠাৎ মনে আসে অবসর সময়ে সেও এই রকম কিছু করতে পারে যেখানে কোন বাধ্যবাধকতা থাকবে না। সেভাবে পত্রিকার অফিসে কথা বলে। মনে মনে ভাবে, এবার সে তার অবসর সময় কাজে লাগাতে পারবে। নিজের জীবনের আনন্দ বেদনাকে না সমাজের ভালমন্দের ভাবনাগুলোকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে হাতে নেয় কলম। লেখা প্রকাশের অনুমতি চাইতে যায় স্বামীর কাছে, অনুমতি না পেয়ে সত্মব্ধ হয়ে যায়। সরিয়ে দিতে চায় কলমকে। কিন্তু নিজের বিবেকের কাছে হার মানায়। সমাজের অনিয়মগুলো তাকে বার বার টেনে নেয় কলমের কাছে। রাতের অবসরে খোলা আকাশের তারার মাঝে খোঁজে তার আপন জগতকে আর দিনের একাকিত্বটাকে সময় দেন কলম দিয়ে। সংসারের কম ব্যসত্মতার মাঝে ছুটে যেতে মন চায় কলমের পাশে। গোপনে গোপনে তুলে ধরেন সমাজের অহিংসার অন্যায় আর অত্যাচারী কিছু স্মৃতিকে। এখন আনন্দ পান লিখে। লেখা প্রকাশ পাওয়া যেন আকাশ ছুঁতে পাওয়া। তার ভাবনা এদেশ তার, এই মাটি তার, যেমনটি ঘর আর সংসার তার। সে পারবে না কাউকে ছেড়ে দিতে। জীবনের জেতার জন্য নয় আনন্দের জন্যই হাতে তার পছন্দের কলমটা।
৩) আইরিন আক্তার_ ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়। যা হচ্ছে বাল্যবিবাহ। বিয়ের মেহেদি হাতে দিয়েই ছুটতে মন চাইত তার বৌচি আর কানামাছি খেলার প্রাঙ্গণে। বাসত্মবের সব দায়িত্ব যেন তাকে ডেকে নিয়ে যায় সংসারের রান্না ঘরে। সেই অল্প বয়সেই রান্নার হাতটা যেন তাকে আড়ি দিতে চায়। লেখাপড়া না করতে পারলেও মন বার বার টেবিলে যেতে চায়। বিয়ের পর ঘর সংসার তার পর সনত্মান যা ছিল আমাদের নারীর জীবন কাহিনী। অল্প বয়সে বার বার মা হওয়া পরিবারের সেবা দায়িত্ব পালন করে মন হয় করে চলা এটাই যেন ছিল তার কাজ। একদিন নিজের কষ্টগুলোকে ডায়রির পাতায় লিখতে গিয়ে হারিয়ে যায় সেই শৈশবে। তখন ভাবে, কেন আমি বড় হলাম, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোক জনতার হাতে ডায়রি দেখে স্বাভাবিকভাবে নেয় না। ওদের কথা, তোমার বিয়ে হয়েছে সংসার হয়েছে আর কি চাও। তোমার হাতে এখন থাকবে দা-বঁটি ঝাড়ু আর সনত্মানের প্রস্রাবের কথা। অনেক যুদ্ধ করেছেন জীবনের ১১টি বছর। কেউ তার পাশে আসেনি। মনের ভাষাগুলোকে পারেননি কলম দিয়ে লিখতে। সাদা কাগজ আর কলম যেন বাসত্মবের না স্বপ্নের সাথী হয়েছে। ইচ্ছার আর কষ্টের এগারো বছর পর নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে পুনরায় হাতে নেন কলম। নিরিবিলিতে সনত্মানের পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে লিখতেন যা তার সঙ্গে করা হয়েছে। এই লেখার কাগজগুলো তার জীবনের চাইতে আপন হয়ে যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে সনত্মানরা বড় হয় এখন আর তেমন মাকে কারও প্রয়োজন হয় না। পরিবারের চাপে অল্প বয়সে সনত্মানদের বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব পার করতে চান। হঠাৎ একটা ঝড় তার সব স্বপ্নকে স্থির করে দেয়। আইরিন আক্তার ভাবতেন সনত্মানদের দায়িত্ব তাদের বুঝে দিতে পারলেই তিনি মুক্ত পাখির মতো উড়তে পারবেন। কিন্তু ঝড়ের কবলে তার স্বপ্নগুলো উলট-পালট হতে থাকে। মাঝ বয়সে স্বামী হারিয়ে বিধবা হন। তার পরও হাল ছাড়েননি জীবনযুদ্ধের। সনত্মানদের সব দায়িত্ব তার কাছে নিজে যেন আর বসতে পারেন না শানত্মির কোন ছাদে। আজ সব সনত্মানরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আর আইরিন আক্তার শক্ত মাটি খুঁজে পেয়েছেন তার সেই পুরনো ডায়রি আর কলমের মাঝে। এখন সভা-সেমিনার লেখাসব যেন শুধুই তার।
৪) ইয়াসমিন আক্তার_ লেখাপড়ার পাঠ শেষ কারে বিয়ে হয় যোগ্যতাসম্পূর্ণ এক জনের সঙ্গে। নিজের মন জ্ঞান আর দতা ধরে রাখতে চান না ঘরে। কাজ করতে চান দেশের জন্য। জনগণের জন্য। ভাবেন নিজেও একদিন জয় করতে পারেন সোনার মেডেল। একটা যোগ্যতাসম্পূর্ণ স্থান। কিন্তু সমাজ যেন তাঁকে ইঙ্গিত দিয়ে বলছে তোমার সোনার মেডেল তোমার সনত্মান। তোমার সাফল্যের স্থান আপন গৃহ। এই নিয়মগুলো মেনে নিতে তার যেন কষ্ট হচ্ছে। অনেক অনুরোধ আর মিনতির পর একটা কিন্ডার গার্ডেনে স্থান করে নেয় ইয়াসমিন। নারীর মাতৃত্বাটাই যেন তার আসল রূপ। একজন মা শিতি হলে শিতি হবে একটা পরিবার। সেই সেস্নাগানের সঙ্গে সনত্মানের মঙ্গল কামনায় ছেড়ে দেন সেই যোগ্যতার স্থানটি। সনত্মানরা আজ বড় হয়েছে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। ইয়াসমিনের এখন হাতে অনেক সময়। ছোটবেলা থেকে গল্প-কবিতা পড়া পছন্দ করলেও তা আর করতে পারেন না। এখন লিখতে বসেন সেই কল্পনায় অাঁকা কবিতাগুলো। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পাঠায়, কিন্তু এই সময়ে স্বামী তা মেনে নেয় না। তার পরও চুপে চুপে পাঠায়, লেখা প্রকাশও হয়, তবে সব থাকে নীরবে। কোন মোবাইল নম্বর ব্যবহার করতে পারেন না লেখায়। নিজের লেখার দোষগুণ কেউ শোনায় না তাকে। লেখক নিজেই তার লেখার বিচারক। আজও ভাবেন আমরা পিছিয়ে থাকব না। আমরা এগিয়ে যাব আমাদের আত্মবিশ্বাস দিয়ে বিজয়ের মালা নয়, আত্ম প্রকাশ ঘটাবেন নিজের একদিন।
৫) উপমা হক_ ছোটবেলা থেকে খুব আদরে বড় হন। লেখাপড়ায় খুবই ভাল। মা-বাবা সব সময় সনত্মানের সুফল কামনায় সনত্মানের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়ে এসেছেন। এই সমাজে তাও ণস্থায়ী। ছোট থেকেই গান নাচ কবিতা সবই করতেন। কলেজ জীবনে এসে দেশকে দেশের মানুষকে বুঝতে চেষ্টা করে আর সমাজের বিভিন্ন সমস্যাগুলো উপমাকে খুবই নাড়া দিত। তার চিনত্মা-চেতনাকে উৎসাহ দিতেন আপনজনরা। সনত্মান উচ্চাবিলাসী না সনত্মান সামাজিক_এটা ছিল তাদের অহঙ্কার। আসত্মে আসত্মে নিজেকে ঢুকিয়ে ফেলেন লেখালেখিতে। সব দিক থেকে অনেক আনন্দ জীবন আর থেমে থাকতে চায় না। মা-বাবার নতুন ভাবনা মেয়ের বিজয়ের বয়স হয়েছে। কিন্তু মেয়ে এখন আর তা ভাবতে চায় না। অনেক বুঝিয়েছেন আপনজনরা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে চায়, দেশ ও জনগণের জন্য কিছু করতে চান, চিহ্নমূল মানুষের পাশে গিয়ে আত্ম প্রকাশ ঘটাতে চান নিজের অসত্মিত্বের। বিয়েটা জীবনের শেষ ঠিকানা হতে পারে না। সংসারে একবার ঢুকলে আর বেরম্নতে পারবেন না। কে এমন আছে যে সে তার জীবন চলায় বাধা না দিয়ে সাহস দেবে। কিন্তু এখন আর মা-বাবা তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে চান না। উনাদের কথা তোমাকে আসল ঠিকানায় যেতে হবে। এখন দিক হারা পাখির মতো ঠিকানা খুঁজে পায় না উপমা।
প্রতিটি মানুষই অনেক সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অথচ অশিা কুসংস্কার এবং নানা বঞ্চনায় নারীকে পিছিয়ে রেখেছে। এটা সভ্য সমাজে ডিজিটাল যুগে নারীর বর্তমান অবস্থা মোটেও কাম্য নয়। নারীর প্রতি আমাদের প্রাচীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অবিলম্বে ত্যাগ করে তাকে সমাজমূলক কাজে অংশ গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। অনেকের ধারণা, নারীরা বহুরূপী, কথাটি আমরা মিথ্যা বলব না, তবে কেন রূপ পরিবর্তন করে এর পিছনে বা এর সঙ্গে কারা জড়িত। এখানকার এই পাঁচজন নারী ছাড়া ও আমাদের দেশে রয়েছে অনেক নারী যারা বিভিন্নরূপে নিজের দতা দেখাতে চান। এই পাঁচজনের ঘটনা গল্প নয়। এইগুলো সত্যিকারের নারীর লেখার জগত। এক সাাতকারে কবি খন্দোকার, আশরাফ হোসেন বলেছেন নারী লেখকদের সম্পর্কে। তিনি বলেছেন, আমাদের দেশে নারী লেখকদের সংখ্যা খুবই কম হাতে গোনা ৪/৫ জন তিনি আরও বলেছেন কেন নারীরা লেখার জগতে আসতে পারে না। আজ আমাদের একটা দাবি, নারী কখন আসবে লেখার জগতে বিয়ের আগে না পরে। নারীর জন্য সব দরজা যেন বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। যেখানে নেই তার মত প্রকাশের কোন স্বাধীনতা। না আছে বাবার ঘরে না আছে স্বামীর ঘরে। তাহলে নারীর নিজের ঘর কোথায়? সমাজ যদি চায় নারী এগিয়ে আসুক তাহলে দিনদিন সমাজ পাবে নতুন যোগ্যতাসম্পূর্ণ নারী লেখিকা, শিতি মা। যারা পড়ে আছে শুধু আমাদের মাতৃত্বে, যারা আছে চার দেয়ালের মাঝে আর শূন্য ছাদের নিচে। এেেত্র আমাদের দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকাগুলো বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে।
No comments