ঘুড়িরা উড়িছে বন মাথায় হলুদে সবুজে মন মাতায় by রাশেদ, রাবি্ব
পেটকাটি, চাদিয়াল, মোমবাতি, ডাউস-এর চঞ্চলতায় এক সময় মুখোরিত ছিল বাংলার আকাশ বাতাস। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশের বর্ষা ঋতু শেষ হবার পরেই এখানে- সেখানে শুরম্ন হয়ে যেত ঘুড়ি উড়ানোর আয়োজন।
শরতের সি্নগ্ধ আকাশে দেখা যেত লাল, নীল, সবুজ বা হলুদ রংয়ের একটি বা দুটি ঘুড়ি উড়ছে স্বাধীন আমেজে। কিন্তু এই আমেজ আর বেশিদিন স্থায়ী থাকে না কারণ প্রতিদিনই বাড়তে থাকে ঘুড়ির সংখ্যা। ধীরে ধীরে এপাড়া, ওপাড়া, সে পাড়ার সবাই ওড়ায় ঘুড়ি। আকাশে বর্ণিল ঘুড়ির মাতামাতি। তারপর শুরম্ন হয় কাটাকাটির উৎসব। ঘুড়িয়ালরা হয়ে পড়েন দারম্নণ ব্যসত্ম। নতুন ঘুড়ি বানানো, সুতায় মাঞ্জা দেয়া। মাঞ্জার জন্য সে এক বিশাল আয়োজন। ভাঙ্গা কাঁচের বোতল যোগাড় করা, গুঁড়া করা, আটা জ্বাল দেয়া, তুতে মেশানো। ঘুড়িয়ালদের ব্যসত্মতার কোন শেষ নেই যেন। ওপাড়ার লাল ঘুড়িটাকে কাল কাটতেই হবে। তাই তো নাওয়া খাওয়া ভুলে এত কিছু।গ্রামের দিকটাতে অবশ্য এ আয়োজন আরও কিছুটা ভিন্ন। শহরের মতো ছোট নাটাই, ছোট ঘুড়িতে তারা অব্যসত্ম নয়। হেমনত্মের ধানকাটা শেষ হলে দিগনত্ম বিসত্মৃত মাঠে আয়োজন করে ঢাউস আর চীলা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবের। ঢাউস ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য প্রয়োজন শক্ত সুতা। অনেকেই আবার ঘুড়ির সঙ্গে ঝুলিয়ে দিত লণ্ঠন। বিকেল থেকে অনেক রাত পর্যনত্ম চলত এ আয়োজন।
এখন অবশ্য নগরে বা গ্রামে কোথাও এই উৎসবের চাকচিক্য তেমন চোখে পড়ে না।
নাগরিক
যান্ত্রিকতা, আর বিদেশী নকল কৃষ্টিতে অনেকটা ম্রিয়মাণ আমাদের বর্ণিল ঘুড়ি। বাঙালীদের ঘুড়ি ওড়ানোর ইতিহাস একেবারে কম সময়ের নয়। আমাদের সকল আনন্দ আয়োজনে ঘুড়ির ছিল সুদৃঢ় অবস্থান। ধমর্ীয় সামাজিক সকল আচার অনুষ্ঠানেই ঘুড়ির ছিল সুস্পষ্ট উপস্থিতি। পালা, পূজা, পার্বণে, সংক্রানত্মি, মেলাতে ঘুড়ি ওড়ানো ছিল অবিচ্ছেদ্য আনন্দ আয়োজন। ধারণা করা হয়, প্রায় আট শ' বছর পরনো আমাদের ঘুড়ির সংস্কৃতি। সিলেটের কুলাউড়ায় প্রাচীন মন্দিরকে কেন্দ্র করেই প্রায় পৌনে চার শ' বছর ধরে চলছে ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব।
পৃথিবীতে ঘুড়ির ইতিহাস বহু পরনো। ধারণা করা হয়, দু' হাজার আট শ' বছর আগে থেকেই পৃথিবীর মানুষ ঘুড়ি ওড়াতে শুরম্ন করে। প্রথম ঘুড়ির ইতিহাসটা অবশ্য চীনারাই দাবি করে। তবে পৃথিবীর প্রথম কাগজ আবিষ্কারক হিসেবে তাদের এই দাবি একেবারে অমূলক নয়। এখান থেকেই ঘুড়ি ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। তবে ইউরোপে ঘুড়ির ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। পনেরো শ' শতকের মাঝামাঝিতে ইতালিতে ঘুড়ির প্রচলন শুরম্ন হয়। ১৭শ' শতকের দিকে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডের অধিবাসীরা। ঘুড়ি ওড়ানো এখন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
চীনাদের ঘুড়ি ওড়ানোটা শুধু আনন্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে ঘুড়ির ব্যবহার করত। বিশেষ করে যুদ্ধবিগ্রহে তাদের ঘুড়ির ব্যবহারটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। মঙ্গলয়েড এবং জাপানীদের দ্বারা চীনারা বেশিরভাগ সময় আক্রানত্ম হতো, তাই তারা ঘুড়ির সঙ্গে মানুষ বেঁধে ওপরে ওঠাত শত্রম্নদের অবস্থান নির্ণয় করার জন্য। এ ছাড়া ছোট ছোট পাহাড়ের ওপর থেকে ওপারে মালামাল পেঁৗছানোর জন্যও তারা ঘুড়ির ব্যবহার করত। বেনজামিন ফ্র্যাংলিন তার লেখায় উলেস্নখ করেছিলেন, বজ্রপাত থেকে বিদু্যৎ প্রবাহিত করার জন্য বিদু্যত পরিবাহী তন্তুর ঘুড়ি ব্যবহার করা হতো। ১৭৫২ সালে থমাস ফ্রানকস ফ্র্যাংলিনের তথ্যের ভিত্তিতে চলিস্নশ ফিট লম্বা লোহার দ- দিয়ে এমন ঘুড়ি তৈরি করেছিলেন।
অবশ্য পরবতর্ীতে সেটা দিয়ে কতটা কাজ হয়েছিল তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ঘুড়ির ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, প্রথম থেকেই ঘুড়ি তৈরি হতো কাগজ দিয়ে।
কাগজ আর বাঁশই ছিল ঘুড়ির প্রধান
উপকরণ। ধীরে ধীরে উপকরণে আসে পরিবর্তন। রঙে, রূপে, আকারে, আয়তনে পালটে যেতে থাকে ঘুড়ি। এখন আধুনিক বিশ্বে কাগজের ঘুড়ির প্রচলন নেই বললেই চলে। ঘুড়ি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ১৮৬০ সাল থেকে ১৯১০ সালের ভেতরকার সময়টা ছিল ঘুড়ির স্বর্ণযুগ। এ সময়ই ঘুড়ি নিয়ে বৈজ্ঞানিক চিনত্মা শুরম্ন হয়। এর পর থেকেই ঘুড়ি তৈরিতে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও মাপজোক ব্যবহার হতে থাকে। এ সময় ঘুড়ি অবিস্মরণীয় সাফল্য অর্জনে সৰম হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন গোয়েন্দা তৎপরতায় ঘুড়ির ব্যবহার লৰ্য করা যায়।
বর্তমানে আধুনিক ঘুড়ি তৈরিতে খুব হাল্কা কাপড় ব্যবহৃত হয় কাগজের পরিবর্তে। মধ্যদ- হিসেবে বাঁশের পরিবর্তে অপটিক্যাল রড, কার্বন রড ব্যবহার করা হয়। বাঁশের কাঠিতে গিঁট থাকায় ঘুড়ির ভারসাম্যে সমস্যা হতো। কিন্তু এ ধরনের রড ওজনে হাল্কা এবং আগাগোড়া এক হবার কারণে ভারসাম্যে কোন সমস্যা থাকে না। রিবস্টপ বা সিল্ক কাপড়ের তৈরি ঘুড়ি ব্যবহারও অনেক সহজ। কারণ এই ধরনের ঘুড়ি ইচ্ছামতো ব্যাগে ভরে বহন করা সম্ভব। এমনকি মেঘের ছোঁয়াকে বা বৃষ্টির জলের ছাঁটেও ঘুড়ি ছিঁড়ে যাবার বা নষ্ট হবার কোন সম্ভাবনা নেই।
একটা সময় ঘুড়ি বলতেই আমাদের চোখে ভেসে উঠত আয়তাকৃত বা বর্গাকৃত এক টুকরো রঙিন কাগজ। কিন্তু এখন আর ঘুড়ি সেখানে সীমাবদ্ধ নেই। কাপড় ও অপটিক্যাল রড দ্বারা যে কোন আকারের আয়তনের ঘুড়ি তৈরি সম্ভব। এমনকি কোন কাঠি বা দ- ব্যবহার না করেও শুধু বাতাস ও গ্যাস ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য ঘুড়ি। বাঘ, সিংহ, চিল, ড্রাগন, মানুষ, হুতুমপেঁচাসহ সকল প্রকারের অবয়বেই শোভা পায় ঘুড়ি আকৃতি। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহারে ঘুড়িতে শোভা পায় ত্রিমাত্রিক কারম্নকাজ।
ঘুড়ি এখন সারা বিশ্বে একটি জনপ্রিয় বিনোদন হিসেবে পরিচিত। ঘুড়ির জন্য রয়েছে আনত্মর্জাতিক ঘুড়ি ফেডারেশন। ফেডারেশনের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ৬৭টি। ফেডারেশনের সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের ভেতর আদান-প্রদান করে নিত্যনতুন ভাবনা। প্রতিবছর তারা আয়োজন করে ঘুড়ি উৎসবের। উৎসবে থাকে নিত্যনতুন ঘুড়ির প্রদর্শনের ব্যবস্থা। এ রকমই এক উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল ৯০ ফুট লম্বা এক অক্টোপাসের। সবাইকে অবাক করে বর্ণিল সেই অক্টোপাস উঠে গেল অনেক ওপরে। আনত্মর্জাতিক ঘুড়ি ফেডারেশনের কার্যালয় চীনের ওয়েফাং শহরে। চায়নার এই শহরকে বলা হয় ঘুড়ির রাজধানী। এই শহরেই রয়েছে ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য ৮ হাজার ১ শ' স্কয়ার মিটারের মাঠ। প্রতিবছর ১৯ থেকে ২৩ এপ্রিল এখানেই পালিত হয় আনত্মর্জাতিক ঘুড়ি উৎসব।
ওয়েফাং শহরের তিয়েনআনম্যান স্কয়ারে অবস্থিত বিশ্ব ঘুড়ি জাদুঘর। এটি পৃথিবীর একমাত্র ঘুড়ি জাদুঘর। যেখানে পাওয়া যাবে হাজার বছরের পুরনো ঘুড়ি। ঘুড়ির যত কিংবদনত্মি ও ইতিহাস। জাদুঘরে প্রবেশের পর মন হারিয়ে যাবে ঘুড়ির ওপর ভর করে মেঘের ওপরে, দেশ হতে দেশানত্মরে।
আধুনিক নানা রঙের বর্ণিল ঘুড়িগুলোর দাম কিন্তু একেবারে কম নয়। আনত্মর্জাতিক মানের এ সকল ঘুড়ির নূ্যনতম মূল্য ৪শ' থেকে ৫শ' টাকা। তবে আমাদের দেশী প্রযুক্তিতে এ সকল ঘুড়ি ২শ' থেকে ২৫০ টাকায় তৈরি করা সম্ভব। আকার আকৃতি ও সার্বিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে ঘুড়ির মূল্য। বর্তমানে ঘুড়ির বিশ্বে লাখ টাকা মূল্যমানের ঘুড়ির সংখ্যাও একেবারে কম নয়।
আনত্মর্জাতিক ঘুড়ি বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আমাদের দেশেও গড়ে উঠেছে ঘুড়ি ফেডারেশন। বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন এখন আনত্মর্জাতিক ঘুড়ি ফেডারেশনে সদস্য। প্রতিবছর আনত্মর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবে অংশ নেয় আমাদের দেশের প্রতিনিধি দল। ঘুড়ি ফেডারেশন দেশের হারিয়ে যেতে বসা ঘুড়ির ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে তুলেছে ঘুড়ি তৈরির কারখানা। প্রতিবছরই কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিন দ্বীপে আয়োজন করছে ঘুড়ি উৎসবের। দেশের সকলকে সম্পৃক্ত করার জন্য জেলাগুলোতে করা হচ্ছে জেলা ফেডারেশন। এলাকায় এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে ঘুড়ি কাব।
মোহময় মন ভোলানো রংধনু তোরণ পেরিয়ে মন হারানোর প্রানত্মর ইকারম্নসের আকাশের সকল বয়সের মানুষের কাছেই রোমঞ্চকর। ছিল আকাশ জয়ের স্বপ্ন। স্বপ্নকে পুঁজি করে মানুষের ছুটে চলা। স্বপ্ন বিভোর মানুষ আকাশ জয়ের নেশায় যুগ থেকে যুগে হট এয়ার বেলুন তথা ফানুস, জ্যাপলিন, গ্যাস বেলুন, বাই পেস্নন, পেস্নন, গাইরো পেস্নন, গস্নাইডার, হেলিকপ্টার, রকেট ইত্যাদি তৈরি করে চলেছে। কিন্তু ইতিহাস সাৰী, আকাশ জয়ের প্রাচীনতম আবিষ্কার ঘুড়ি। ঘুড়ির ওপর ভর করেই মানুষ আকাশের উপরের আকাশ জয় করে চলেছে। বাসত্মবের ঘুড়ির মতো আমাদের মন ঘুড়িও ছুটে চলে এখান থেকে সেখানে।
No comments