বাংলাদেশেরই লাভ হবে by ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, কাওসার রহমান
ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার নতুন চুক্তিতে বাংলাদেশেরই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সার্বিক অর্থনীতির বিবেচনায় ভারতের লাভের পরিমাণ সীমিত। প্রতিবেশী দেশগুলো চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেলে বাংলাদেশের শুধু বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে রাজস্ব আয়ই বাড়বে না, বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানও হবে।
দেশে এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্যসমাপ্ত ভারত সফরের পোস্টমর্টেম চলছে। সরকার ও বিরোধী দল এবং ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা নানাভাবে এর চুলচেরা বিশেস্নষণ করে চলেছেন। এ বিশেস্নষণ থেকে বেরিয়ে আসছে এ সুবিধা থেকে কে কতটা লাভবান হবে। অর্থনৈতিক বিশেস্নষকরা বলছেন, সার্বিক অর্থনীতির বিচারে এখান থেকে ভারতে লাভবান হওয়ার সুযোগ কম। তারা শুধু তাদের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। কিন্তু ওই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের শুধু রাজস্ব আদায়ই বাড়বে না, বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সচল হবে মৃতপ্রায় মংলা বন্দর। সর্বোপরি এ অঞ্চলের আঞ্চলিক বাণিজ্য নতুন মাত্রা পাবে। বিশ্ব এখন 'গেস্নাবাল ভিলেজে' পরিণত হয়েছে। বাণিজ্য এখন সীমানত্মের বেড়াজাল ছিন্ন করে পুরো বিশ্বকে একটি গতিতে নিয়ে আসছে। উন্নত দেশগুলো একে অন্যের বন্দর ও ভূখ- ব্যবহার করে বাণিজ্যিক সুবিধা বাড়াতে মরিয়া। এই অবস্থায় বাংলাদেশ তার পুরনো ধ্যান ধারণা অাঁকড়ে বসে থাকলে বিপুল সম্ভাবনা শুধু নষ্টই হয়ে যাবে না, ক্রমেই দেশ পিছিয়ে পড়বে।বিশেস্নষকরা প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক সফর উলেস্নখ করে বলছেন, রাজনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি ছাড়া বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন খুব কমই দেখা যায়। ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য রাজনৈতিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রয়োজন। আমাদের এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সেই সম্পর্ক ভাল নয়। ভারত বাংলাদেশের শুধু প্রতিবেশীই নয় বড় প্রতিবেশী। বর্তমান বিশ্বের উদীয়মান উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্যতম। তাছাড়া ভৌগোলিকভাবে ভারত সুবিধজনক অবস্থায়ও রয়েছে। বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত। একদিকে বঙ্গোপসাগর। আবার সেই সাগরের সীমানা নিয়েও দুই দেশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদসহ নানা ইসু্যতে দীর্ঘদিন যাবত দুই দেশে বিরাজ করছে অনাস্থা ও অবিশ্বাস। কেবলমাত্র রাজনৈতিক সুসম্পর্কই এই অনাস্থা অবিশ্বাস ও বিরোধ দূর করতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের মাধ্যমে সেই সম্পর্কেরই উন্নয়ন হবে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর। এ সফরের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। ব্যবসাবাণিজ্যে নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যকার সহযোগিতা চুক্তি থেকে সার্বিক অর্থনৈতিক বিবেচনায় ভারতের লাভের পরিমাণ হবে সীমিত। তারপরও ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধার বিষয়কে খুবই গুরম্নত্ব দিচ্ছে। কারণ তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে দেশটির বাকি অংশের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও কৌশলগত একীভূতকরণের জন্য এ সুবিধা তার জরম্নরী। এ কারণে সব সময়ই ভারত চেয়েছে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য আলোচনায় এ ট্রানজিট ইসু্যকে যুক্ত রাখতে। আর বাংলাদেশের মূল ইসু্য হচ্ছে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ব্যবস্থাপনা এবং ভারতের সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস। বাংলাদেশ যাতে সেদেশের বাজারে তার পণ্যের আরও বেশি প্রবেশাধিকার পায়। অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে দরকষাকষির ত্রে হচ্ছে বহুমাত্রিক। ফলে এই আলোচনার সফলতা নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সদিচ্ছা ও পারস্পরিক লাভালাভের ওপর।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, এ ধরনের বহুমুখী সম্পর্কের েেত্র উভয় পরে প্রয়োজন একে অন্যের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন। এেেত্র বেশি সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে ভারত একতরফা সুবিধা দিয়ে বেশি আগ্রহী হতে পারত। এটা শুরম্ন করতে পারত ভারতের বাজারে বাংলাদেশের যে সকল পণ্য প্রবেশের সম্ভাবনা আছে সেগুলোর শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূরীকরণের মাধ্যমে। ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পৃক্তকরণের সুফল স্পষ্ট হয়ে উঠলে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য চট্টগ্রাম বন্দর খুলে দেয়ার প্রশ্নে জনমত আরও ইতিবাচক হতে পারে।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশকে উলেস্নখযোগ্য পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চাইলে আগে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদেরকেই আকৃষ্ট করতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের যেভাবে দ্রম্নত উত্থান ঘটছে, একে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ যদি ভারতের সঙ্গে নিজেদের ভৌগোলিক নৈকট্যের সুবিধা কাজে লাগাতে না পারে, সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক।
সমঝোতা চুক্তি থেকে বাংলাদেশের বড় সুবিধা হবে বন্দর ব্যবহারের কারণে। বাংলাদেশর মংলা বন্দর মৃতপ্রায়। দীর্ঘদিন ধরে এটি অকার্যকর হয়ে আছে। কিন্তুু এটিকে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েও আমাদের বাড়তি যে আয়ের সুযোগ আছে তা কাজে লাগাতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে ভারতকে এই দুই বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেয়ার ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। এতে বাংলাদেশের অভ্যনত্মরীণ ব্যবসাবাণিজ্যের নতুন দুয়ার খুলে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক বাণিজ্যিক যোগাযোগ সৃষ্টিতে বড় অবদান রাখবে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর প্রতিবেশী দেশগুলো ব্যবহারের সুযোগ পেলে বাংলাদেশের শুধু বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে রাজস্ব আদায়ই বাড়বে না, বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান হবে। যা বাংলাদেশের জন্য খুবই জরম্নরী।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ডক্টর এম রহমতউলস্নাহ বলেছেন, 'বহু বছর ধরে মংলা বন্দর অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। ভারত-নেপাল-ভুটান এ বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেলে মৃতপ্রায় বন্দরটি নতুন জীবন ফিরে পাবে'।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরও প্রকৃত মতার চেয়ে অনেক কম ব্যবহার হচ্ছে। বিদ্যমান মতা ও সম্পদ দিয়েই প্রতিবেশী দেশের অতিরিক্ত চাপ সমলাতে সম হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের মতা বার্ষিক ৩১ লাখ টিইইউ। গত বছর (২০০৯ সালে) এ বন্দর দিয়ে ১১ লাখ টিইইউ কন্টেইনার ওঠানামা হয়েছে। ফলে এখনও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মতা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রতিবেশী তিন দেশকে এ বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দেয়া হলে বড়জোর বছরে অতিরিক্ত আরও এক লাখ কন্টেইনার ওঠানামা বাড়বে। ফলে প্রতি বছর সাড়ে আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়েও চাপ সামলানো কোন সমস্যা হবে না। বরং ২০১৫ সাল পর্যনত্ম বিদ্যমান অবকাঠামো দিয়েই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের পণ্য আমদানির সুবিধা দিতে সম হবে। ওই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ২০ লাখ টিইইউ। আর ২০২০ সাল নাগাদা এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ লাখ টিইইউ। এ সময়ে যন্ত্রপাতি স্থাপন ও সুবিধা উন্নয়ন এবং প্রসত্মাবিত কর্ণফুলী কন্টেইনার টার্মিনালের বাসত্মবায়নের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের হ্যান্ডেলিং মতা ৪০ লাখ টিইইউতে উন্নীত হবে। বন্দর কর্তৃপ বলছেন, ভারত নেপাল ও ভুটানের জন্য বন্দর খুলে দেয়ার ব্যাপারে সরকারের নির্দেশ পেলেই তারা বন্দরের অবকাঠামো সুবিধা উন্নয়নের কাজ শুরম্ন করে দেবে। এেেত্র শুধু প্রয়োজন হবে সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন। অর্থাৎ দ্রম্নত যাতে বেশি সংখ্যক গাড়ি বন্দরে প্রবেশ ও বের হতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
উলেস্নখ্য, বর্তমানে দণি এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল আঞ্চলিক বাণিজ্যের অঞ্চল। এ অঞ্চলের আনত্মঃবাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র তিন শতাংশ। অথচ নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (নাফটা) এলাকায় এ বাণিজ্যের পরিমাণ ৫৮ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নে এ বাণিজ্য ৬২ শতাংশ এবং আসিয়ানে ৩০ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে দণি এশিয়ার মধ্যে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য সহযোগিতা বাড়ানোর ব্যাপারে কাজ করে আসছে।
No comments