অভিমত- প্রশাসনিক এলাকার পুনর্বিন্যাস ও মতার বিকেন্দ্রীকরণ by মোহাম্মদ আফজাল হোসেন খোকা
মতার বিকেন্দ্রীকরণ বা ডিসেন্ট্রালাইজেশন অব পাওয়ার বাক্যটির উদ্ভব ষাট দশকের শুরম্নতেই, তৎকালীন পাকিসত্মানে। যখন বাঙালীদের প থেকে জোর দাবি উঠতে থাকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি-নির্ধারণী ও বাসত্মবায়ন পর্যায়ে উচ্চতর পদসমূহে অধিক সংখ্যায় পূর্ব পাকিসত্মানীদের নিয়োগের জন্য।
আর এই প্রেেিতই এক সাবেক আইসিএস কর্মকর্তা, তৎকালীন পশ্চিম পাকিসত্মানের গবর্নর আখতার হোসেনের নেতৃত্বে একটি প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই ঢাকা বিভাগের বরিশাল এবং রাজশাহী বিভাগের কুষ্টিয়া, যশোহর ও খুলনা জেলাসমূহ সমন্বয়ে খুলনা শহরে সদর দফতর স্থাপনপূর্বক খুলনা নামে একটি নতুন বিভাগ গঠিত হয়। সেই সাথে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলাকে বিভক্ত করে তৎকালীন নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ মহকুমাসমূহ সমন্বয়ে 'কায়েদাবাদ' নামে একটি নতুন জেলা এবং টাঙ্গাইলকে পৃথক একটি জেলায় রূপানত্মরের সুপারিশ করা হয়েছিল। টাঙ্গাইলে জেলা স্থাপিত হলেও প্রসত্মাবিত 'কায়েদাবাদ' জেলাটি বাসত্মবায়িত হয়নি কিশোরগঞ্জবাসীর বাধার মুখে। এর মূল কারণ ছিল প্রসত্মাবিত এই জেলাটির সদর দফতর স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছিল নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানাস্থিত একটি জায়গায় (নামটি আজ আর মনে পড়ছে না), যদিও ভৌগোলিক দিক দিয়ে ঐ স্থানটি ছিল কিশোরগঞ্জের লাগোয়া এবং মধ্যবতর্ী। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালের শেষদিকে টাঙ্গাইল এবং বরিশালের পটুয়াখালী মহকুমাকেও জেলায় রূপানত্মর করা হয়। পূর্ব পাকিসত্মানের তৎকালীন গবর্নর ভাইস এডমিরাল এসএম আহসান জেলা দু'টির উদ্বোধন করেছিলেন।গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে মতা বিকেন্দ্রীকরণের সূচনা করেন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫-এর মধ্যভাগে দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে। কিন্তু ঐ বছর ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পরই তা বাতিল করা হয় বেআইনীভাবে মতা দখলকারী খন্দকার মোশতাকের স্বল্পকাল স্থায়ী সরকারের সময়। তবে পরবতর্ীকালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমাকে জেলায় রূপানত্মর করা হয়। এছাড়াও জামালপুরের শেরপুর, বগুড়ার জয়পুরহাট, চট্টগ্রামের পটিয়া এবং ঢাকার নরসিংদীকে মহকুমায় উন্নীত করা হয়।
প্রশাসনিক এলাকা পুনর্গঠন এবং তৃণমূল পর্যায়ে মতা বিকেন্দ্রীকরণের েেত্র বাংলাদেশে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন লে. জে. এরশাদ উপজেলা পদ্ধতি চালু করে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান স্থানীয় অধিবাসীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচনের ফলে প্রশাসনের সর্বনিম্ন পর্যায়ে জনগণের সম্পৃক্ততা লাভ করে। এছাড়াও 'নেশন বিল্ডিং' ডিপার্টমেন্টগুলোর উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মকা-ের তত্ত্বাবধান ও জবাবদিহিতা উপজেলা পরিষদের ওপর ন্যসত্ম হবার ফলে স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন কর্মকা-ে গতি সঞ্চার হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার মতায় আসার পর পরই উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। ফলে মতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে বাংলার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নিমিত্তে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটিকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করে দেয়া হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী দলটিও মতায় থাকাকালে (১৯৯৬-২০০১) এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন পদপে গ্রহণ করেনি। অপরদিকে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের 'গুড অফিস ইউজ'-এর কল্যাণে বিএনপি তাদের শাসনামলে বৃহত্তর বরিশাল এবং সিলেটে নতুন দু'টি বিভাগ স্থাপন করলেও সেই পাকিসত্মানী আমল থেকে দাবিকৃত বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও রংপুরকে বিভাগে উন্নীত করা হয়নি। ময়মনসিংহ ও রংপুর জেলাসমূহে দলটি বরাবরই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাঙ্তি আসন লাভ থেকে পেছনে থেকেছে। তবে আনন্দের বিষয় জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকার রংপুরকে বিভাগে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবে আমিও আশা করব অচিরেই বর্তমান সরকার একে বিভাগে রূপানত্মর করবে। মনে রাখতে হবে, বিগত জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচার অভিযানের শেষ পর্যায়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁর দল মতায় গেলে ময়মনসিংহকে বিভাগে উন্নীত করবেন। এর পরেও বৃহত্তর ময়মনসিংহের জনগণ বিপুল সংখ্যায় আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ঐ অঞ্চলে অতীতের ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছে দলটিকে বিপুলভাবে জয়ী করে।
বিগত সরকারগুলোর আমলে নতুন কোন জেলা স্থাপিত না হলেও প্রশাসনিক ও উন্নয়নের প্রয়োজনে, বিশেষ করে স্থানীয় জনগণের সুবিধার্থে 'নিকার' (ন্যাশনাল ইমপিস্নমেনটেশন কমিটি ফর এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিঅর্গানাইজেশন)-এর সুপারিশ মোতাবেক বেশ কয়েকটি উপজেলাকে বিভক্ত করে নতুন-নতুন থানা/উপজেলায় পরিণত করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে দেখেছি।
সংবিধান মোতাবেক আমাদের দেশ পরিচালিত হচ্ছে এককেন্দ্রিক (ইউনিটারি) পদ্ধতির সরকার দ্বারা এবং এটি খুবই যুক্তিযুক্ত। তবে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ দেশটির ভাষা, সংস্কৃতি, জনগণের মন-মানসিকতা, খাদ্যাভ্যাস, চাষবাস, প্রভৃতির প্রকৃতি এক হলেও সব এলাকার স্থানীয় সমস্যাদি কিনত্মু এক নয়। এেেত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা, আর্থ-সামাজিক অবস্থায় যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। এছাড়াও দেশের সব ক'টি এলাকা বা অঞ্চলসমূহকে আমরা আজও উন্নয়নের সুষম পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারিনি। ফলে ঐ সকল এলাকার অধিবাসীদের কাছ থেকে নতুন নতুন জেলা বা উপজেলা স্থাপনের দাবি উত্থাপিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে সে দাবির যৌক্তিকতা কতটুকু তাও খতিয়ে দেখতে হবে সরকারকেই। কারণ যে দলই রাষ্ট্র পরিচালনা করম্নণ না কেন তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই। আর তা হলো দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি করে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করা।
মতা বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একটা কথা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যেহেতু আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার 'ইউনিটারি' পদ্ধতির সেহেতু দেশে বিরাজমান স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান বা সত্মম্ভগুলোকেই করে তুলতে হবে প্রশাসন ও উন্নয়নের মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। স্থানীয় পর্যায়ে শুধুমাত্র ইউনিয়ন পরিষদ ব্যতীত অপর দু'টি সত্মম্ভ অর্থাৎ উপজেলা এবং জেলা পরিষদসমূহকে অকার্যকর করে রাখার ফলে মতা বিকেন্দ্রীকরণ তথা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতি আমরা শুধু 'অশ্রদ্ধাই' প্রদর্শন করিনি, জনপ্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় সরকারের চাইতে আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনকেই প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছি। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে জেলা পরিষদের মতো সর্বোচ্চ পর্যায়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানটির দায়-দায়িত্ব জনপ্রতিনিধিকে না দিয়ে চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার নামক উপসচিব পর্যায়ের একজন আমলাকে দিয়ে রাখা হয়েছে এর দায়িত্ব। এ পর্যায়ে এসে আমি একটি উদাহরণ তুলে ধরতে চাই; যা হলো জিয়াউর রহমান সাহেব কিনত্মু আশির দশকের শুরম্নতে সে সময়ের প্রতিটি জেলায় একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা দিয়ে ডিস্ট্রিক্ট ডেভেলপমেন্ট কো-অর্ডিনেটর (ডিডিসি) পদে নিয়োগ দিয়ে তাঁকে জেলার সার্বিক প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্মকা- তদারকির দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। আর কিছু না হোক নিজের 'পলিটিক্যাল বেজ' তৈরির জন্য ডিস্ট্রিক্ট ডেভেলপমেন্ট কো-অর্ডিনেটরবৃন্দ অনত্মতঃপ েবছরের বেশির ভাগ সময় জেলাতেই থাকতেন। ফলে স্থানীয়ভাবে 'ইন্টার অফিসিয়াল-ডিপার্টমেন্টাল রাইভ্যালরি' বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছিল। কিনত্মু পরবতর্ীকালে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো 'জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী' পদ্ধতি চালু করে জেলাসমূহের কো-অর্ডিনেশন ও উন্নয়ন কর্মকা-ে কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে সে সম্পর্কে কোন মনত্মব্য করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয় মনে করি।
বর্তমান সরকার মতা গ্রহণ করার পরপরই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যান পদসমূহের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকার পদ্ধতির কার্যকারিতার বিষয়ে একটি গুরম্নত্বপূর্ণ পদপে গ্রহণ করেছে। আর এই প্রোপটেই সরকারের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, অবিলম্বে জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শতাব্দী প্রাচীন এই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে জেলাসমূহে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ও উন্নয়ন কর্মকা-ের 'কেন্দ্রবিন্দু' হিসেবে পুনর্বহাল করা হোক। মনে রাখতে হবে, অবিভক্ত বাংলায় এই প্রতিষ্ঠানটির বদৌলতেই মধ্যবিত্ত-মিধ্যবিত্ত পরিবারের শিতি সদস্যরা পর্যায়ক্রমে প্রাদেশিক ও জাতীয় রাজনীতিতে উঠে আসতে পেরেছিলেন।
No comments