আরব বসন্ত- অতঃপর বিভেদ, সহিংসতা, অর্থনীতির ধস by কামাল গাবালা
সারা পৃথিবীর মানুষ নববর্ষকে স্বাগত জানায় আশা ও আনন্দ নিয়ে। কিন্তু যেসব দেশে আরব বসন্ত এসেছিল, সেসব দেশের মানুষের জন্য এ বছর নববর্ষ হয়তো সে রকম নয়। আরব বসন্ত, যেটাকে আমরা বিপ্লব বলছি, তার দুই বছর পূর্ণ হলো এবার।
তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন ও লিবিয়ায় বিপ্লবের ফলে স্বৈরশাসকদের পতন ঘটেছে বটে, কিন্তু হতাশা ও শঙ্কা গ্রাস করেছে এই দেশগুলোর জনসাধারণের মন। রাজনৈতিক বিভেদ, সংঘাত ও সহিংসতা বাড়ার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ধস নেমেছে। কয়েকটি দেশের প্রায় দেউলিয়া দশা। এই পরিস্থিতিতে এসব দেশের মানুষ প্রবেশ করছে নতুন বছরে: ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে।
এই দেশগুলোর প্রতিটি অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা আলাদা; তাদের সমস্যাগুলো নিজস্ব ধরনের। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে মিল আছে সব দেশের, তা হলো হতাশা, আশাভঙ্গের বেদনা আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে শঙ্কা। আরব বসন্তের দেশগুলোর এখনকার প্রধান বিষয়বস্তু হলো হতাশা। এর কারণ এই সময়ের মধ্যে তেমন কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিবর্তন ঘটেনি। শঙ্কা দেখা দিয়েছে ইসলামতন্ত্রের উত্থানের সম্ভাবনা আর নাগরিক সমাজ ও উদার চিন্তাভাবনা মানুষের বিরুদ্ধে গোঁড়া, মৌলবাদী চিন্তাধারার গোষ্ঠীগুলোর হুমকির কারণে।
মিসরের দিকে তাকালে দেখা যাবে, গত দুই বছরে এ দেশে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন ঘটে গেছে এবং যে সহিংসতা চলেছে, তার ফলে কার্যত রাজনৈতিক জোট গঠনের সহায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং সম্ভবত ২০১৩ সালে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। আরও একটি হতাশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থীরা ‘সাংবিধানিক বিজয়’ অর্জনের পর থেকে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদগুলোতে উঠে যাচ্ছে; পুরো দেশের ওপর আধিপত্য কায়েমের আগ পর্যন্ত হয়তো তারা এভাবেই এগোবে।
অবশ্য ইসলামপন্থীদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে এখন যখন মুসলিম ব্রাদারহুড একাই জিতেছে, বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। তা যদি হয়, তাহলে বিশেষভাবে ইতিমধ্যে বিপদগ্রস্ত অর্থনীতির জন্য আরও বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
তিউনিসিয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যে একটা সফল বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে স্বৈরশাসকের পতন ঘটেছে; ইসলামিক রেনেসাঁ আন্দোলন ও আরও দুটি ধর্মনিরপেক্ষ দল নিয়ে গঠিত হয়েছে শাসক জোট; রাজনৈতিক রূপান্তর তত্ত্বাবধান ও নতুন সংবিধান গ্রহণের জন্য নির্বাচিত হয়েছে গণপরিষদ। নতুন সংবিধান গৃহীত হলে আরব বসন্তের দেশগুলোর মধ্যে তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা হতে পারত সর্বোত্তম। কিন্তু দেশটি বিপ্লবের পর তৃতীয় বছর শুরু করল নতুন সংবিধান ছাড়াই—এখনো কোনো সংবিধান গৃহীত হয়নি। এ কারণে ২০১৩ সালের নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক বৈরিতা বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। যখন এই পরিস্থিতি, তখন তিউনিসিয়া অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের একদম কিনারায়, যখন দেশটির এক-চতুর্থাংশ মানুষ বাস করছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে তিউনিসিয়ায় দারিদ্র্যের মাত্রা এখন সবচেয়ে বেশি। সহিংসতা ও আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার এটিও একটি কারণ।
তিউনিসিয়া বা লিবিয়া, ইয়েমেন বা মিসর—যে দেশের কথাই বলি না কেন, স্থিতিশীলতা অর্জন করতে হলে সবকিছুর আগে প্রয়োজন নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। এই দেশগুলোর কোনো কোনোটিতে অব্যাহতভাবে আগ্নেয়াস্ত্র আসছে সীমান্ত পেরিয়ে। সেই সঙ্গে বাড়ছে সালাফি ও অন্য চরম উগ্রপন্থী জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব।
এর মধ্যে গত গ্রীষ্মে লিবিয়ায় ‘ন্যাশনাল কংগ্রেস জেনারেলের’ নির্বাচন হয়েছে; দেশটিতে তেল উৎপাদনও আবার শুরু হতে পেরেছে। কিন্তু দেশটিতে এখনো অস্ত্রের ছড়াছড়ি, প্রচুরসংখ্যক অবৈধ মিলিশিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে; বিচ্ছিন্নতাবাদ ও নিরাপত্তা-হুমকি বেড়ে চলেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে; এটা এমন আভাস বয়ে আনছে যে লিবিয়া যে আরেকটি ইরাক বা আরেকটি সোমালিয়ায় পরিণত হতে যাচ্ছে।
ইয়েমেন থেকে নিশ্চিত খবর এসেছে যে ২০১৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে দেশটির জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রস্তাবিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু দেশটিতে জাতিগত মিলন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা পায়নি, দেশটির দক্ষিণ অংশের বিচ্ছিন্নতা ঠেকাতে নতুন নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছে এবং সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বেড়েই চলেছে বলে জনসাধারণ বেশ হতাশ।
আরব বসন্তের সুফল ফলেনি; বিশেষত মিসর, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় জনসাধারণ যে স্বপ্ন দেখেছিল, যে আশায় উজ্জীবিত হয়েছিল, তা ঘটেনি। তাই তারা হতাশ। সাধারণ মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, উদ্বিগ্ন। এখন তাদের মনে হচ্ছে, আগের সরকারগুলোই যেন ভালো ছিল। বিপ্লবের জন্য তারা সারা জীবন অপেক্ষা করেছে এবং বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যেসব স্বৈরশাসককে উৎখাত করেছে, এখন তাদেরই বিপ্লবের চেয়ে ভালো মনে করছে।
এ পর্যন্ত আরব বসন্তের ফল হলো: এক প্রেসিডেন্টের পলায়ন, আরেকজনের কারাবাস, আরেকজন নিহত এবং এক সিংহের (সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ) দিশেহারা দশা। ২০১১ সালে মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়, তাতে অংশগ্রহণকারী অহিংস বিক্ষোভকারীদের হত্যার দায়ে গত বছরের জুনে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর পতন ঘটে। আরব বসন্তের দেশগুলোর মধ্যে মোবারকই একমাত্র সাবেক প্রেসিডেন্ট, যাঁকে নিজের দেশেই কিছুটা সভ্য উপায়ে বিচার করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
বিপুল গণবিক্ষোভের মুখে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বেন আলী ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি পালিয়ে সৌদি আরব চলে যান। তাঁর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটেছিল মোহাম্মদ বুআজিজি নামের এক সবজি বিক্রেতা পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করার পর। রাস্তার সবজি বিক্রেতা বুআজিজির সবজির গাড়ি পুলিশ রাস্তা থেকে উৎখাত করেছিল বলে তিনি এর প্রতিবাদে আত্মহত্যা করেন। বেন আলী তাঁর ২৩ বছরের শাসনকালে দুর্নীতিসহ নানা অপরাধে লিপ্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।
বেন আলীর পতনের ঘটনার ব্যাপক প্রভাব সঞ্চারিত হয় আরব দেশগুলোয়, শুরু হয় বিপুল জনবিক্ষোভ, আজকে আমরা যাকে বলছি আরব বসন্ত। তারপর অনেক নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। সেসবের মধ্যে একটি ঘটনা: তিউনিসিয়ার বর্তমান সরকারই হলো দেশটির সমগ্র ইতিহাসে একমাত্র সরকার, যাতে জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। আরেকটি বিষয় হলো, তিউনিসিয়ার ইতিহাসে এর আগে কখনো কোনো সরকারের বিপরীতে এমন শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ ছিল না। দেশকে সরকারহীন করে একটা সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বিরোধী দল একটি জোট সরকার গঠনে বাধা দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। তিউনিসীয় গণবিক্ষোভের সবচেয়ে বড় বিজয়ী দল যেহেতু রেনেসাঁ পার্টি, তাই এই দলের নেতৃত্বে সরকার গঠনে বাধা দিতে অন্যান্য দলের সঙ্গে জোট বাঁধার বিরোধিতা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে যখন ফল হয়নি, তখন রেনেসাঁ পার্টির সঙ্গে জোটবদ্ধ দলগুলোকে বলা হলো বেইমান।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কামাল গাবালা: মিসরের দৈনিক আল-আহরাম-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
এই দেশগুলোর প্রতিটি অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা আলাদা; তাদের সমস্যাগুলো নিজস্ব ধরনের। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে মিল আছে সব দেশের, তা হলো হতাশা, আশাভঙ্গের বেদনা আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে শঙ্কা। আরব বসন্তের দেশগুলোর এখনকার প্রধান বিষয়বস্তু হলো হতাশা। এর কারণ এই সময়ের মধ্যে তেমন কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিবর্তন ঘটেনি। শঙ্কা দেখা দিয়েছে ইসলামতন্ত্রের উত্থানের সম্ভাবনা আর নাগরিক সমাজ ও উদার চিন্তাভাবনা মানুষের বিরুদ্ধে গোঁড়া, মৌলবাদী চিন্তাধারার গোষ্ঠীগুলোর হুমকির কারণে।
মিসরের দিকে তাকালে দেখা যাবে, গত দুই বছরে এ দেশে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন ঘটে গেছে এবং যে সহিংসতা চলেছে, তার ফলে কার্যত রাজনৈতিক জোট গঠনের সহায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং সম্ভবত ২০১৩ সালে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। আরও একটি হতাশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থীরা ‘সাংবিধানিক বিজয়’ অর্জনের পর থেকে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদগুলোতে উঠে যাচ্ছে; পুরো দেশের ওপর আধিপত্য কায়েমের আগ পর্যন্ত হয়তো তারা এভাবেই এগোবে।
অবশ্য ইসলামপন্থীদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে এখন যখন মুসলিম ব্রাদারহুড একাই জিতেছে, বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। তা যদি হয়, তাহলে বিশেষভাবে ইতিমধ্যে বিপদগ্রস্ত অর্থনীতির জন্য আরও বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
তিউনিসিয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যে একটা সফল বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে স্বৈরশাসকের পতন ঘটেছে; ইসলামিক রেনেসাঁ আন্দোলন ও আরও দুটি ধর্মনিরপেক্ষ দল নিয়ে গঠিত হয়েছে শাসক জোট; রাজনৈতিক রূপান্তর তত্ত্বাবধান ও নতুন সংবিধান গ্রহণের জন্য নির্বাচিত হয়েছে গণপরিষদ। নতুন সংবিধান গৃহীত হলে আরব বসন্তের দেশগুলোর মধ্যে তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা হতে পারত সর্বোত্তম। কিন্তু দেশটি বিপ্লবের পর তৃতীয় বছর শুরু করল নতুন সংবিধান ছাড়াই—এখনো কোনো সংবিধান গৃহীত হয়নি। এ কারণে ২০১৩ সালের নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক বৈরিতা বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। যখন এই পরিস্থিতি, তখন তিউনিসিয়া অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের একদম কিনারায়, যখন দেশটির এক-চতুর্থাংশ মানুষ বাস করছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে তিউনিসিয়ায় দারিদ্র্যের মাত্রা এখন সবচেয়ে বেশি। সহিংসতা ও আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার এটিও একটি কারণ।
তিউনিসিয়া বা লিবিয়া, ইয়েমেন বা মিসর—যে দেশের কথাই বলি না কেন, স্থিতিশীলতা অর্জন করতে হলে সবকিছুর আগে প্রয়োজন নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। এই দেশগুলোর কোনো কোনোটিতে অব্যাহতভাবে আগ্নেয়াস্ত্র আসছে সীমান্ত পেরিয়ে। সেই সঙ্গে বাড়ছে সালাফি ও অন্য চরম উগ্রপন্থী জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব।
এর মধ্যে গত গ্রীষ্মে লিবিয়ায় ‘ন্যাশনাল কংগ্রেস জেনারেলের’ নির্বাচন হয়েছে; দেশটিতে তেল উৎপাদনও আবার শুরু হতে পেরেছে। কিন্তু দেশটিতে এখনো অস্ত্রের ছড়াছড়ি, প্রচুরসংখ্যক অবৈধ মিলিশিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে; বিচ্ছিন্নতাবাদ ও নিরাপত্তা-হুমকি বেড়ে চলেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে; এটা এমন আভাস বয়ে আনছে যে লিবিয়া যে আরেকটি ইরাক বা আরেকটি সোমালিয়ায় পরিণত হতে যাচ্ছে।
ইয়েমেন থেকে নিশ্চিত খবর এসেছে যে ২০১৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে দেশটির জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রস্তাবিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু দেশটিতে জাতিগত মিলন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা পায়নি, দেশটির দক্ষিণ অংশের বিচ্ছিন্নতা ঠেকাতে নতুন নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছে এবং সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বেড়েই চলেছে বলে জনসাধারণ বেশ হতাশ।
আরব বসন্তের সুফল ফলেনি; বিশেষত মিসর, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় জনসাধারণ যে স্বপ্ন দেখেছিল, যে আশায় উজ্জীবিত হয়েছিল, তা ঘটেনি। তাই তারা হতাশ। সাধারণ মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, উদ্বিগ্ন। এখন তাদের মনে হচ্ছে, আগের সরকারগুলোই যেন ভালো ছিল। বিপ্লবের জন্য তারা সারা জীবন অপেক্ষা করেছে এবং বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যেসব স্বৈরশাসককে উৎখাত করেছে, এখন তাদেরই বিপ্লবের চেয়ে ভালো মনে করছে।
এ পর্যন্ত আরব বসন্তের ফল হলো: এক প্রেসিডেন্টের পলায়ন, আরেকজনের কারাবাস, আরেকজন নিহত এবং এক সিংহের (সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ) দিশেহারা দশা। ২০১১ সালে মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়, তাতে অংশগ্রহণকারী অহিংস বিক্ষোভকারীদের হত্যার দায়ে গত বছরের জুনে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর পতন ঘটে। আরব বসন্তের দেশগুলোর মধ্যে মোবারকই একমাত্র সাবেক প্রেসিডেন্ট, যাঁকে নিজের দেশেই কিছুটা সভ্য উপায়ে বিচার করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
বিপুল গণবিক্ষোভের মুখে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বেন আলী ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি পালিয়ে সৌদি আরব চলে যান। তাঁর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটেছিল মোহাম্মদ বুআজিজি নামের এক সবজি বিক্রেতা পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করার পর। রাস্তার সবজি বিক্রেতা বুআজিজির সবজির গাড়ি পুলিশ রাস্তা থেকে উৎখাত করেছিল বলে তিনি এর প্রতিবাদে আত্মহত্যা করেন। বেন আলী তাঁর ২৩ বছরের শাসনকালে দুর্নীতিসহ নানা অপরাধে লিপ্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।
বেন আলীর পতনের ঘটনার ব্যাপক প্রভাব সঞ্চারিত হয় আরব দেশগুলোয়, শুরু হয় বিপুল জনবিক্ষোভ, আজকে আমরা যাকে বলছি আরব বসন্ত। তারপর অনেক নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। সেসবের মধ্যে একটি ঘটনা: তিউনিসিয়ার বর্তমান সরকারই হলো দেশটির সমগ্র ইতিহাসে একমাত্র সরকার, যাতে জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। আরেকটি বিষয় হলো, তিউনিসিয়ার ইতিহাসে এর আগে কখনো কোনো সরকারের বিপরীতে এমন শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ ছিল না। দেশকে সরকারহীন করে একটা সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বিরোধী দল একটি জোট সরকার গঠনে বাধা দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। তিউনিসীয় গণবিক্ষোভের সবচেয়ে বড় বিজয়ী দল যেহেতু রেনেসাঁ পার্টি, তাই এই দলের নেতৃত্বে সরকার গঠনে বাধা দিতে অন্যান্য দলের সঙ্গে জোট বাঁধার বিরোধিতা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে যখন ফল হয়নি, তখন রেনেসাঁ পার্টির সঙ্গে জোটবদ্ধ দলগুলোকে বলা হলো বেইমান।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কামাল গাবালা: মিসরের দৈনিক আল-আহরাম-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
No comments