রাজনীতি-দলের গণতন্ত্রই রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ by ইমতিয়াজ আহমেদ

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়। ক্ষমতায় আসার পর দলটি দ্বিতীয়বারের মতো কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অধিবেশনে মিলিত হয়েছে।
তবে এ আয়োজনে কতটা অভ্যন্তরীণ তাগিদ এবং কতটাই-বা নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা সে প্রশ্ন থেকেই যায়। যে কোনো রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ কাউন্সিল অধিবেশনের আগে জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ে সম্মেলন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা থাকে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবারে ৭৩টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ৮টিতে সম্মেলন অনুষ্ঠান করেছে এবং সেটাও নামকাওয়াস্তে বলে জানা যায়। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। গতবারের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গঠনে কোনো ভোট হয়নি। সভাপতি পদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাদে অন্য কোনো প্রার্থী ছিলেন না। সাধারণ সম্পাদক প্রকৃতপক্ষে তিনিই মনোনয়ন দেন। এটা ঠিক যে, কাউন্সিলররাই তাকে এ ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দলের কাউন্সিলররা সর্বোচ্চ নেতাকে কতটা ক্ষমতা দিতে পারে, সেটা বড় প্রশ্ন। মৌলিক বিষয়ে এক ব্যক্তির হাতে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া যায় কি-না, সেটাও আলোচনার বিষয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে কোনো দলের জাতীয় সম্মেলনে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বিষয় ছাড়াও তহবিল সংগ্রহ ও পরিচালনা এজেন্ডায় থাকার কথা। এসবের ভিত্তি থাকে সাধারণ সম্পাদকের পঠিত প্রতিবেদন। কিন্তু অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি থাকার পরও ৭৩টি জেলার মধ্যে মাত্র ৮টিতে সম্মেলন অনুষ্ঠান করতে পারার কী ব্যাখ্যা দেবেন তিনি? দলের তৃণমূল পর্যায়ে সদস্য সংগ্রহ, সম্মেলন অনুষ্ঠান, নিয়মিত সাংগঠনিক কাজ পরিচালনা_ এসব ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র অনুসরণ না করার কোনো ব্যাখ্যাও থাকার কথা নয়। নির্বাচনের পর দলটি জনপ্রিয়তা কতটা ধরে রাখতে পেরেছে সেটাও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেবল ৬৩ বছরের পুরনো রাজনৈতিক দল নয়, তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র যখন বিপন্ন হয়েছে তখন তারা রাজপথের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে তারা বারবার সক্রিয় হয়েছে এবং জনসমর্থন সংগঠিত করে সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে। ফের যেন তৃতীয় কোনো শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে না পারে সে জন্য সংবিধানে পরিবর্তন এনেছে তারা। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও রয়েছে। অনেকের বিবেচনায় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভিত গভীরে প্রোথিত করতে হলে আওয়ামী লীগের অগ্রণী ভূমিকার বিকল্প নেই। এমন একটি দলের অভ্যন্তরে কেন গণতন্ত্র চর্চা হবে না? আর এটা না হলে গণতন্ত্র রক্ষার কাজেই-বা তারা কী করে সফল হবে?
দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধিত হতে হবে, এমন আইন রয়েছে। কিন্তু কোনো দল যদি এর ব্যত্যয় ঘটায়, তাহলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটা স্পষ্ট নয়। প্রকৃতপক্ষে প্রধান দলগুলোকে কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানে বাধ্য করা ছাড়া এ পর্যন্ত অন্য কোনো ভূমিকা গ্রহণে তাদের উদ্যোগী দেখা যায় না। তাহলে এ দায়িত্ব কে পালন করবে? দলের গঠনতান্ত্রিক বিধান অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয় না। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন হাত গুটিয়ে কেন বসে থাকবে? কখনও কখনও দেখা যায়, দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করা হয় এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা কিংবা ঊর্ধ্বতন কমিটি নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কাউন্সিলররা অনেক সময় প্রধান নেতাকে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করেন এবং তার প্রয়োগও করা হয়। আমরা এমনটি প্রাইভেট ক্লাবে দেখি। সেখানে কমিটি ড্রেস কোড তৈরি করে কিংবা বিভিন্ন বিষয়ে বিধি প্রণয়ন করে। কিন্তু রাজনৈতিক দল তো এ ধরনের ক্লাব নয়। তারা কেবল দলের সদস্য ও নেতাদের জন্য কাজ করে না। তারা যখন ক্ষমতায় যায় তখন তাদের সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড কেবল দলের নেতাকর্মী-সদস্য নয়, বিরোধী দল এমনকি দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদেরও প্রভাবিত করে। তারা আইন প্রণয়ন করে, যার প্রয়োগ হয় সবার জন্য। এ অবস্থায় তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা অবশ্যই থাকা চাই। অন্যথায় তারা প্রাইভেট ক্লাবের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু একটা ক্লাব তো দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারে না। তাদের হাতে দেশের গণতন্ত্র নিরাপদ করার দায়িত্বও কেউ দিতে চাইবে না।
প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশ যে প্রায়শই গণতন্ত্রের পথ থেকে বিচ্যুত হয়, গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতার পালাবদলের পরও যে গণতন্ত্র দৃঢ় ভিত পায় না, তার মূলে রয়েছে প্রধান দলগুলোতে গণতন্ত্র না থাকা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ ক্ষেত্রে অভিন্ন মনোভাব প্রদর্শন করছে। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালেও ছিল এক ব্যক্তিনির্ভর দল, এখন বিরোধী দলে থেকেও তাই।
আওয়ামী লীগে এখন আমরা চার ধরনের লোককে সক্রিয় দেখি। প্রথম দলে রয়েছেন একদল উপদেষ্টা। তারা জনপ্রতিনিধি নন, দলের প্রাথমিক সদস্যও সম্ভবত নন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। অথচ এ দলটিই বলছে, অনির্বাচিত লোকদের হাতে দেশের ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। এসব উপদেষ্টা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিরোধী পক্ষের সঙ্গে সমঝোতায় আদৌ উৎসাহী নন বলেই ধারণা করা হয়।
দ্বিতীয় দলে রয়েছেন ক্ষমতার শীর্ষে থাকা মহলের আশীর্বাদপুষ্টরা। তাদের শক্তির উৎস যে অন্যত্র, সেটা তারা ভালো করেই জানেন। কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু দলের নীতি ও কৌশল নির্ধারণে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গত চার বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অদক্ষতা কিংবা অন্য কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েও তারা দল কিংবা সরকারে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারছেন।
তৃতীয় দলে রয়েছেন এমন একদল, যারা অনেক বছর ধরে দলে রয়েছেন। নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসার মতো জনপ্রিয়তাও তারা রাখেন। এ অংশের ধারণা, সব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসার জন্য সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে দলে তাদের অবস্থান দুর্বল। ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে তাদের কেউ কেউ সংস্কারপন্থি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন এবং এখনও সে 'অপবাদ' ঘোচেনি। তারা শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ সমর্থন দিতে চান না। তবে আমার ধারণা, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, দলে তাদের গুরুত্ব বাড়বে। অনির্বাচিত উপদেষ্টাদের অবস্থান দুর্বল হলেও তাদের কদর বাড়তে পারে। প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা স্থাপনের বিষয়ে তাদের অবস্থান ইতিবাচক।
চতুর্থ অংশ অনেকটা নেপথ্যে চলে গেছেন, তবে তারা ঠিক সংস্কারপন্থি নন। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাদের এক ধরনের সমর্থন ছিল। দলে গণতন্ত্র বাড়ূক, সেটা তারা চাইছেন। নির্বাচনের আগে তাদের তৎপরতা বাড়তে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগের মতো পোড়-খাওয়া রাজনৈতিক দলে তৃতীয় ও চতুর্থ অংশ কেন পেছনে পড়ে রয়েছে? অন্যদিকে, যাদের গণভিত্তি দুর্বল কিংবা আদৌ নেই এবং অদক্ষতা ও অন্য কারণে যারা সমালোচিত তারা কেন এত শক্তিশালী? এর উত্তরে বলা যায়, দলের মধ্যে পেশাদারিত্ব না থাকার কারণেই এমনটি হয়েছে। দলে পরিবারতন্ত্র প্রবল। উপমহাদেশের অন্যত্রও আমরা এমনটি দেখি। শ্রীলংকা ও ভারতে দীর্ঘ কয়েক দশক অব্যাহত গণতন্ত্র চর্চার পরও প্রধান দলগুলো এ ধারা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশসহ সব দেশেই সমাজের প্রভাবশালী বিভিন্ন অংশে আমরা দেখছি পেশাদারিত্ব। সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র, এনজিও ও ব্যবসায়ী-শিল্পপতি সমাজের কথা আমরা বলতে পারি। তারা করপোরেট সংস্কৃতির চর্চা করছে এবং সুফলও মিলছে। এ বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্র না থাকলে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হবেই। দলে নতুন সদস্য কীভাবে আসবে, মেধা ও দক্ষতার স্বীকৃতি কীভাবে দেওয়া হবে, বিভিন্ন পদে কীভাবে দায়িত্ব বণ্টন করা হবে, নতুন প্রজন্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে_ এসব বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করা না গেলে এবং গণতন্ত্রের চর্চা না হলে যেসব সংগঠনে পেশাদারিত্ব রয়েছে তাদের তুলনায় দলটি পিছিয়ে পড়বে। আরও স্পষ্টভাবে বলা যায়, যারা পেশাদারিত্বের চর্চা করছে তারা আপারহ্যান্ড পেয়ে যাবে। এমনকি এসব দলকে তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারেও সচেষ্ট থাকবে।
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে এসব বিষয়ে ভাবতেই হবে। এটা করতে হবে দেশের স্বার্থে এবং নিজেদের অস্তিত্বেরও স্বার্থে। দেশের উন্নয়ন কতটা দ্রুত হবে, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও কর্মকৌশলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আওয়ামী লীগের পরিণতি মুসলিম লীগের মতো হবে, এটা বলার সময় আসেনি। এক সময় ওই দলটি মুসলিমদের মধ্যে প্রচণ্ড জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক পথে না চলায় তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আমরা আশা করব, কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে দলটি শক্তিশালী হবে। যারা শীর্ষ পদগুলোতে রয়েছেন তাদের ভাবতে হবে কী করে এ দলটিকে শতবর্ষ কিংবা তারও বেশি সময় ধরে প্রভাবশালী রাখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশে অনেক নেতা এমন পথ অনুসরণ করেই স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তারা দলকে শক্তিশালী করেছেন এবং তার সুফল দল ও দেশ ভোগ করছে। বিশ্বসমাজেও তার প্রভাব থাকছে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, আওয়ামী লীগ এ পথে চললে অন্যান্য দলেও তার প্রভাব পড়বে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দলটি ট্রেন্ডসেটার হয়ে উঠবে, এটাই আশা থাকবে।

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.