সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-পুলিশ কি দুষ্টচক্রে? by শেখ হাফিজুর রহমান

পুলিশ নিয়ে আমরা যে দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়েছি, তা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। আমরা চাই না পুলিশ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হোক। যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশ পরিচালিত হয়, সেই জনগণের ওপর পুলিশ নির্মম নির্যাতন চালাক_ আমরা তা চাই না। আমরা একটি আধুনিক, পেশাদার ও 'জনবান্ধব' পুলিশ বাহিনী চাই।


সেজন্য যা যা করা দরকার, নীতিনির্ধারকরা সে উদ্যোগগুলো নেবেন বলে প্রত্যাশা রইল




পুলিশের পোশাক পরলেই কি মানুষের মানবিক মূল্যবোধ লুপ্ত হয়ে যায়? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরেই কি শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন মনে করেন, যে কাউকে লাঠিপেটা করার অধিকার তারা পেয়ে গেছেন? যে কাউকে কিল, চড়-থাপ্পড় দেওয়া, কাউকে পদপিষ্ট করা বা কারও গলাটিপে ধরার অধিকার কোন্ আইন পুলিশকে দিয়েছে? কোথায় পুলিশ জননিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখবে; তা না করে পুলিশ বরং উল্টো আদালত চত্বরে বিচারপ্রার্থী বাবা-মাকে পেটাচ্ছে, আর মেয়ের শ্লীলতাহানি করছে! এ ঘটনার তিন দিন আগে প্রকাশ্যে তিন সাংবাদিককে পিটিয়েছে পুলিশ। পুলিশের 'উগ্রতা', 'পাশবিকতা' ও 'নিষ্ঠুরতা' দেখে দেখে আমরা বিরক্ত হয়ে পড়েছি। বিরক্ত হতে হতে হয়তো অধিকাংশ মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। অভ্যস্ত হতে হতে হয়তো আমরা পুলিশের নিষ্ঠুরতাকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছি। নইলে সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু পুলিশের চরিত্র কেন বদলায় না? নইলে পুলিশের 'পাশবিক আচরণ' ও 'নিষ্ঠুরতা' কেন দিন দিন বেড়েই চলে?
জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় কোন পুলিশ বাহিনীকে আমরা পুষছি? তিনটি ঘটনা এখনও আমাদের দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে ফিরছে। এক. ঢাকার অদূরে আমিনবাজারে পুলিশের সামনে শত শত গ্রামবাসী কর্তৃক ৬ কলেজছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা। দুই. খিলগাঁও থানার ওসি কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরকে থানার অভ্যন্তরে চাপাতি দিয়ে কোপানো। তিন. নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশ ভ্যান থেকে নামিয়ে পুলিশের নির্দেশে শামসুদ্দিন মিলনকে গণপ্রহারে হত্যা করে আবার পুলিশ ভ্যানে তুলে দেওয়া। ঘটনাগুলো ভাবলে এখনও আমাদের গা শিউরে ওঠে। কাদের হাতে আমরা বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দিয়েছি? কোন পুলিশকে দেওয়া হয়েছে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব? যে পুলিশ আদালত চত্বরে নারীর শ্লীলতাহানি করে? যে পুলিশ সাংবাদিক পেটায়? যে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে চাপাতি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে? যে পুলিশ পিটিয়ে মানুষ খুনে প্ররোচনা দেয়?
পুলিশের এই 'পাশবিকতা', 'নিষ্ঠুরতা' ও 'ইমেজ সংকট'-এর জন্য কে দায়ী? অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পুলিশকেই এর সিংহভাগ দায় নিতে হবে। তবে আমাদের নীতিনির্ধারকদের কি কোনোই দায় নেই? বিভিন্ন সময় আমরা যে সরকার পেয়েছি; তারা কি চেয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশে একটি আধুনিক, পেশাদার ও 'জনবান্ধব' পুলিশ বাহিনী গড়ে উঠুক? ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের পর ব্রিটিশরাজ যে পুলিশ আইন তৈরি করেছিল, যে ছাঁচের মধ্যে কাঠামোবদ্ধ করেছিল পুলিশকে, ওই আইন ও কাঠামো অনুযায়ী এখনও বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী পরিচালিত হচ্ছে। ব্রিটিশরাজ পুলিশ বাহিনী গঠন করেছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দমন করতে এবং এ উপমহাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়া দাবিয়ে রাখতে। ব্রিটিশরাজের হাতেগড়া পুলিশের চরিত্র ছিল 'অ্যান্টি-পিপল' বা গণবিরোধী। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, এখনও বাংলাদেশের পুলিশ 'অ্যান্টি-পিপল' বা 'গণবিরোধী'; 'প্রো-পিপল' নয়।
আফসোসের বিষয়, আমরা দেশটা স্বাধীন করলাম, কিন্তু একটি সুখী, সুন্দর ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান দরকার, তা আমরা গড়ে তুলতে পারলাম না। আমরা শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন করতে পারলাম না, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিকাশ ঘটাতে পারলাম না, একটি পেশাদার পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে পারলাম না। অথচ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রথম আক্রমণ করেছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন বিধ্বস্ত হয়েছিল। শহীদ হয়েছিলেন পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য। আবার বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্যও পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। আজও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। কিন্তু দেশের মধ্যে পুলিশের এই 'উগ্রতা', 'পাশবিকতা' ও 'নিষ্ঠুরতা' কেন?
এর প্রথম কারণ, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ও ব্রিটিশরাজ প্রণীত পুলিশ কাঠামো। ব্রিটিশরাজের আইন ও কাঠামোর মধ্যে 'জনবান্ধব' পুলিশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, পুলিশের 'রাজনৈতিক ব্যবহার'। প্রতিটি সরকারই পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে এবং করছে। সরকারের 'স্বার্থ' হাসিল হলেই সরকার খুশি। পুলিশ যদি নারীর শ্লীলতাহানি করে, জননিরাপত্তা বিঘি্নত করে বা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়; তাতে সরকারের কিছুই যায়-আসে না। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে পুলিশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্মম নির্যাতন করেছিল। নির্যাতনের শিকার অনেক নেতাই এখন মন্ত্রী। এখনও পুলিশ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে বিরোধী দল যদি ক্ষমতায় যায় এবং বর্তমানের সরকারি দল যদি বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করে, তাহলে এই পুলিশকে আমরা আবারও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখব।
মুশকিল হচ্ছে, এক দুষ্টচক্রে আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। যে দল বা জোটই ক্ষমতায় আসছে, তারা পুলিশকে রাজনৈতিকভাব ব্যবহার করছে। আবার তারা বিরোধী দলে গেলে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিছুটা সময় নেতারা সুবিধা ভোগ করছেন, আবার কিছুটা সময় তারা শিকার হচ্ছেন নির্যাতনের। এভাবেই চলছে। এই দুষ্টচক্রে আবর্তিত হতে হতে দল, জোট, নীতিনির্ধারকরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এ দুষ্টচক্র এবং নানামুখী ও মাত্রার হৈচৈয়ের নিচে চাপা পড়ে গেছে পুলিশের সংস্কারের কথাটি। আর সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হচ্ছে জনগণের; যে জনগণের জন্য রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে; যে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে।
তৃতীয় কারণ হচ্ছে, মাঠ পর্যায়ের পুলিশের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব। শ্লীলতাহানিসহ পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুতর যেসব অভিযোগ রয়েছে, তার সিংহভাগই মাঠপর্যায়ের পুলিশের বিরুদ্ধে। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে উঁঁচু পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ হওয়ায় পুলিশের এ পর্যায়ে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পুলিশ কর্মকর্তাদের সুনামের সঙ্গে কর্মকাণ্ড পরিচালনায়। পুলিশকে 'জনবান্ধব' করতে হলে, নীতিনির্ধারকদের গুরুত্ব প্রদান করতে হবে মাঠ পর্যায়ের পুলিশের ওপর। এক বছর বা তারও কিছু সময় আগে বর্তমান সরকার বিসিএস উত্তীর্ণ এএসপিদের থানার ওসির স্থলাভিষিক্ত করতে চেয়েছিল। থানা পর্যায়ে সেবার মান বাড়ানোর জন্যই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোন অজানা কারণে বা কোন গোষ্ঠীর চাপে সরকার এটা করতে পারেনি, তা জানি না। তবে থানার ওসিরা যে কতটা শক্তিশালী, সে বিষয়ে দু'একটা তথ্য দিতে চাই। আমার বিসিএস উত্তীর্ণ কয়েক পুলিশ অফিসার ছাত্র কথা প্রসঙ্গে আমাকে জানিয়েছে, থানার ওসিরা বিসিএস অফিসারদের তোয়াক্কা করেন না। কেননা, থানার ওসিরা সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করেন মন্ত্রী ও সাংসদদের সঙ্গে। মন্ত্রী ও সাংসদদের 'স্বার্থ' রক্ষা করতেই তারা ব্যস্ত। ফলে তাদের পুলিশ কর্মকর্তাদেরও তোয়াক্কা করতে হয় না বা জননিরাপত্তার জন্যও কর্মনিষ্ঠ হতে হয় না।
পুলিশ নিয়ে আমরা যে দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়েছি, তা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। আমরা চাই না পুলিশ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হোক। যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশ পরিচালিত হয়, সেই জনগণের ওপর পুলিশ নির্মম নির্যাতন চালাক_ আমরা তা চাই না। আমরা একটি আধুনিক, পেশাদার ও 'জনবান্ধব' পুলিশ বাহিনী চাই। সেজন্য যা যা করা দরকার, নীতিনির্ধারকরা সে উদ্যোগগুলো নেবেন বলে প্রত্যাশা রইল।

শেখ হাফিজুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
hrkarzon@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.