রবার্ট ফিস্ক-পশ্চিমাদের প্রথম টার্গেট সাদ্দাম, অতঃপর গাদ্দাফি, এরপর কে?
অতঃপর আমরা লিবিয়ার সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। আমরা যে কেন ৪২ অথবা ৪১ বছর আগে চিন্তা করলাম না সেটিই বিষয়। জাতিসংঘের রেজ্যুলেশনে যেন এমনই বলা হলো। আর এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, শাসক পরিবর্তন হচ্ছে মাত্র, ঠিক যেমনি ইরাকের ক্ষেত্রে হয়েছে।
কে বলতে পারে শেষ স্বৈরশাসকের বিদায় হলে তার স্থলাভিষিক্ত কে হবে? তিউনিসিয়ার পর মিসরে পরিবর্তন হলো। তারপর হলো লিবিয়া। তাই নয়কি? উত্তর আফ্রিকার আরব দেশগুলোর মানুষ স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিল। হ্যাঁ, এটা সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে বলা যায়। আবার এই দেশগুলোর নিকট-অতীতও তো ছিল একইরকম। পশ্চিমারাই তো সেদেশগুলোতে কর্তৃত্ব করেছিল। বেন আলীকে ফ্রান্স সহযোগিতা করেছিল, আমেরিকা বসিয়েছিল মুবারককে, ইতালির প্রত্যক্ষ সহযোগী ছিল গাদ্দাফি। আর সেই গাদ্দাফিরই রাজনৈতিক মৃত্যু হলো অতিসম্প্রতি।
চলুন এই অন্ধকারের পেছনের পর্দাটা সরিয়ে দেখি কী আছে সেখানে। হ্যাঁ, গাদ্দাফি ইরানের আহমাদিনেজাদ এবং ইসরায়েলের লিবারম্যানের মতোই ব্যক্তি, যিনি মোবারকের মতোই নরকে যেতে বসেছেন। তবে কম্পন একটা দেখা দিয়েছে সবখানে। কারণ মোবারকের সমর্থনকারী লোকের সংখ্যাও কিন্তু খুব একটা কম ছিল না। মধ্যপ্রাচ্য মনে হয় বড় রকমের একটা হৈ-হুল্লোড়ের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই হুল্লোড়টা যে অবশ্যই ইউরোপের দেশগুলো পছন্দ করবে না, তাও স্বাভাবিক। তাদের ভূমিকা দেখা গেছে গত ১০০ বছর ধরে। যেমনি মুসোলিনি, স্ট্যালিনরা দেখিয়েছেন। এখন আমরা মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে পরিষ্কার মিশনে নেমেছি। আমরা কি ঔপনিবেশিক আচরণ করিনি? কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছেম আমরা আমাদের অতীতকে বেমালুম ভুলে গেছি। কিন্তু যে মুহূর্তে গাদ্দাফি বেনগাজির ঘরে ঘরে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তখন কেন এ ধরনের প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? যদি এই বিদ্রোহটা মৌরিতানিয়া থেকে আমদানি হতো কিংবা আইভরিকোস্টের কথাও চিন্তা করা যায়, তাহলে কী হতো পরিস্থিতি। তখন হয়তো নো ফ্লাই জোনের বিষয়টি ভাবতে হতো না। এই অবস্থাটি কী তেল নেই এমন কোনো দেশে হতো? এমনটি আফ্রিকা কিংবা অন্য যেকোনো দেশেই হতে পারে।
ধরা যাক, গাদ্দাফি ত্রিপোলিতে ঘাপটি মেরে বসে রইলেন। ব্রিটিশ, ফরাসি এবং আমেরিকান যুদ্ধবিমানগুলো সেখানে আঘাত হানতে শুরু করল। তার সাঁজোয়া বাহিনীকে ধ্বংস করে দেওয়া হলো। মিসাইল ব্যাটারিগুলোও ধ্বংস হয়ে গেল। তখন কি হবে? আমি মনে করি, তখনো গাদ্দাফি ফ্যাকাশে হয়ে যাবেন না। আমি গত বৃহস্পতিবারও বলেছি, যেভাবে জাতিসংঘে ভোটাভুটি হলো সঙ্গে সঙ্গে পেন্টাগন থেকে সাংবাদিকদের সামনে বিবৃতি দেওয়া হলো তা কিন্তু হলো নো ফ্লাই জোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরদিনই। তবে গাদ্দাফির একটা চালাকি কিন্তু আমাদের চোখে পড়ে। আমরা দেখলাম, গতকাল গাদ্দাফির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিলেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো। একইসঙ্গে সামরিক অভিযান বন্ধের ঘোষণাও দিলেন তিনি। এটা নিশ্চয়ই ভালো একটি উদ্যোগ। আর ন্যাটো বাহিনী শাসক পরিবর্তনের যে স্বপ্ন দেখছে তা বাস্তবায়নের জন্য এটা মোটেও সুবিধাজনক কিছু না। ওমর মোখতার কিন্তু বলে দিয়েছেন পশ্চিমের আগ্রাসনের শিকার হলেন গাদ্দাফি।
গাদ্দাফির ট্যাংকগুলো যদি চলতে থাকে, তাহলে আমরা কি বিদ্রোহীদের সহায়তার জন্য অস্ত্রসহ বিভিন্ন সহযোগিতার জন্য হাত বাড়িয়ে দেব? আমরা কি বেনগাজিতে উপদেষ্টা, এনজিও ইত্যাদি নিয়ে অফিস খুলে বসব? লক্ষ করুন এই সময়ও কিন্তু আমরা লিবিয়ার বেদুইন উপজাতিদের কথা মোটেও উচ্চারণ করছি না। তারা কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরেই অনেক সাহসের সঙ্গে লড়াই করে আসছে। বেনগাজিতে উপজাতিদের অন্যতম হচ্ছে সিনোসি। কিং ইদ্রিস ছিলেন সেই উপজাতির লোক; যাঁকে বিতাড়ন করে গাদ্দাফি ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৬৯ সালে। লাল, সবুজ ও কালো রং দিয়ে তৈরি হয়েছে বিদ্রোহীদের পতাকা। আর এই পতাকা ছিল রাজা ইদ্রিসের প্রতীক। ধরা যাক এই বিদ্রোহীরাই ত্রিপোলিতে দখল নিয়ে নিল। তাহলে তাদেরকে কী স্বাগতম জানানো হবে? রাজধানীতে যে বিদ্রোহের ছবি দেখা গেছে সেখানে কিন্তু ওই গোত্রকেই দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি। তারা ত্রিপোলির দখল নিয়ে নিলে তখন কী হবে? গাদ্দাফির সমর্থকগোষ্ঠী কি যুদ্ধে লিপ্ত হবে না? তার মানে, গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে সেখানে। ধরা যাক সাইফ আল ইসলামকে শাস্তি প্রদান করা হলো। তখন কি এটা সহজেই মেনে নেবে তাঁর সমর্থকরা?
পুরনো সেই যুক্তিও আমার জানা আছে। আমাদের অতীতের স্বভাবটা ভালো ছিল না। এখন আমরা কি করব? আমরা কিন্তু ১৯৬৯ সালের গাদ্দাফিকে খুব পছন্দ করেছিলাম। আমরা তাঁকে ঘৃণা করেছি আবার ভালোও বেসেছিলাম। আমরা আবার তাঁকে অপছন্দ করতে শুরু করেছি। আরাফাতের ব্যাপারেও কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা এমনই। তাঁকে আমরা সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। তারপর একসময় তাঁকে বিশাল মাপের মানুষ হিসেবে দেখতে শুরু করেছি। গাদ্দাফির অবস্থা কি হতে যাচ্ছে তারপর? আর পশ্চিমাদের টার্গেটই বা কে?
লেখক : মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক
দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
চলুন এই অন্ধকারের পেছনের পর্দাটা সরিয়ে দেখি কী আছে সেখানে। হ্যাঁ, গাদ্দাফি ইরানের আহমাদিনেজাদ এবং ইসরায়েলের লিবারম্যানের মতোই ব্যক্তি, যিনি মোবারকের মতোই নরকে যেতে বসেছেন। তবে কম্পন একটা দেখা দিয়েছে সবখানে। কারণ মোবারকের সমর্থনকারী লোকের সংখ্যাও কিন্তু খুব একটা কম ছিল না। মধ্যপ্রাচ্য মনে হয় বড় রকমের একটা হৈ-হুল্লোড়ের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই হুল্লোড়টা যে অবশ্যই ইউরোপের দেশগুলো পছন্দ করবে না, তাও স্বাভাবিক। তাদের ভূমিকা দেখা গেছে গত ১০০ বছর ধরে। যেমনি মুসোলিনি, স্ট্যালিনরা দেখিয়েছেন। এখন আমরা মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে পরিষ্কার মিশনে নেমেছি। আমরা কি ঔপনিবেশিক আচরণ করিনি? কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছেম আমরা আমাদের অতীতকে বেমালুম ভুলে গেছি। কিন্তু যে মুহূর্তে গাদ্দাফি বেনগাজির ঘরে ঘরে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তখন কেন এ ধরনের প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? যদি এই বিদ্রোহটা মৌরিতানিয়া থেকে আমদানি হতো কিংবা আইভরিকোস্টের কথাও চিন্তা করা যায়, তাহলে কী হতো পরিস্থিতি। তখন হয়তো নো ফ্লাই জোনের বিষয়টি ভাবতে হতো না। এই অবস্থাটি কী তেল নেই এমন কোনো দেশে হতো? এমনটি আফ্রিকা কিংবা অন্য যেকোনো দেশেই হতে পারে।
ধরা যাক, গাদ্দাফি ত্রিপোলিতে ঘাপটি মেরে বসে রইলেন। ব্রিটিশ, ফরাসি এবং আমেরিকান যুদ্ধবিমানগুলো সেখানে আঘাত হানতে শুরু করল। তার সাঁজোয়া বাহিনীকে ধ্বংস করে দেওয়া হলো। মিসাইল ব্যাটারিগুলোও ধ্বংস হয়ে গেল। তখন কি হবে? আমি মনে করি, তখনো গাদ্দাফি ফ্যাকাশে হয়ে যাবেন না। আমি গত বৃহস্পতিবারও বলেছি, যেভাবে জাতিসংঘে ভোটাভুটি হলো সঙ্গে সঙ্গে পেন্টাগন থেকে সাংবাদিকদের সামনে বিবৃতি দেওয়া হলো তা কিন্তু হলো নো ফ্লাই জোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরদিনই। তবে গাদ্দাফির একটা চালাকি কিন্তু আমাদের চোখে পড়ে। আমরা দেখলাম, গতকাল গাদ্দাফির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিলেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো। একইসঙ্গে সামরিক অভিযান বন্ধের ঘোষণাও দিলেন তিনি। এটা নিশ্চয়ই ভালো একটি উদ্যোগ। আর ন্যাটো বাহিনী শাসক পরিবর্তনের যে স্বপ্ন দেখছে তা বাস্তবায়নের জন্য এটা মোটেও সুবিধাজনক কিছু না। ওমর মোখতার কিন্তু বলে দিয়েছেন পশ্চিমের আগ্রাসনের শিকার হলেন গাদ্দাফি।
গাদ্দাফির ট্যাংকগুলো যদি চলতে থাকে, তাহলে আমরা কি বিদ্রোহীদের সহায়তার জন্য অস্ত্রসহ বিভিন্ন সহযোগিতার জন্য হাত বাড়িয়ে দেব? আমরা কি বেনগাজিতে উপদেষ্টা, এনজিও ইত্যাদি নিয়ে অফিস খুলে বসব? লক্ষ করুন এই সময়ও কিন্তু আমরা লিবিয়ার বেদুইন উপজাতিদের কথা মোটেও উচ্চারণ করছি না। তারা কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরেই অনেক সাহসের সঙ্গে লড়াই করে আসছে। বেনগাজিতে উপজাতিদের অন্যতম হচ্ছে সিনোসি। কিং ইদ্রিস ছিলেন সেই উপজাতির লোক; যাঁকে বিতাড়ন করে গাদ্দাফি ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৬৯ সালে। লাল, সবুজ ও কালো রং দিয়ে তৈরি হয়েছে বিদ্রোহীদের পতাকা। আর এই পতাকা ছিল রাজা ইদ্রিসের প্রতীক। ধরা যাক এই বিদ্রোহীরাই ত্রিপোলিতে দখল নিয়ে নিল। তাহলে তাদেরকে কী স্বাগতম জানানো হবে? রাজধানীতে যে বিদ্রোহের ছবি দেখা গেছে সেখানে কিন্তু ওই গোত্রকেই দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি। তারা ত্রিপোলির দখল নিয়ে নিলে তখন কী হবে? গাদ্দাফির সমর্থকগোষ্ঠী কি যুদ্ধে লিপ্ত হবে না? তার মানে, গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে সেখানে। ধরা যাক সাইফ আল ইসলামকে শাস্তি প্রদান করা হলো। তখন কি এটা সহজেই মেনে নেবে তাঁর সমর্থকরা?
পুরনো সেই যুক্তিও আমার জানা আছে। আমাদের অতীতের স্বভাবটা ভালো ছিল না। এখন আমরা কি করব? আমরা কিন্তু ১৯৬৯ সালের গাদ্দাফিকে খুব পছন্দ করেছিলাম। আমরা তাঁকে ঘৃণা করেছি আবার ভালোও বেসেছিলাম। আমরা আবার তাঁকে অপছন্দ করতে শুরু করেছি। আরাফাতের ব্যাপারেও কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা এমনই। তাঁকে আমরা সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। তারপর একসময় তাঁকে বিশাল মাপের মানুষ হিসেবে দেখতে শুরু করেছি। গাদ্দাফির অবস্থা কি হতে যাচ্ছে তারপর? আর পশ্চিমাদের টার্গেটই বা কে?
লেখক : মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক
দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
No comments