স্মরণ-তাজউদ্দীন আহমদ ও জনগণের রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা by সোহরাব হাসান
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই যে তরুণ পাকিস্তানি ধ্যানধারণার বিপরীতে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন, তিনি তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখকে নিয়ে পিপলস ফ্রিডম লীগ বা গণআজাদী লীগ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে তাঁরা ‘আশু দাবি কর্মসূচি আদর্শ’ শিরোনামে একটি ইশতেহার লিখে বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে দেন। যার লক্ষ্য ছিল মানুষের মুক্তি, ন্যায্য ভূমি সংস্কার, নাগরিক অধিকার এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার। তখনো শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায়।
সেই থেকে তৎকালীন পূর্ববাংলার মুসলিম লীগবিরোধী যেকোনো উদ্যোগ-আয়োজন ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। সহযাত্রীদের চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ হয়েও নিরন্তর সাধনা ও প্রজ্ঞাবলে নেতৃত্বের আসনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। যার উজ্জ্বল স্বাক্ষর আমরা লক্ষ করি আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে, ঊনপঞ্চাশে আওয়ামী মুসলিম লীগ, একান্নতে যুবলীগ এবং অন্যান্য প্রগতিশীল সংগঠন প্রতিষ্ঠায়। ‘জনগণের রাষ্ট্র’ গঠন ছিল তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন।
১৯৪৭-এ ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমি পর্যায়ক্রমে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে কথা বললাম। আমাদের জনগণের রাষ্ট্র গঠন করা উচিত। দুর্নীতি ও ঘুষ শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনে সহযোগিতা করার জন্য সকলকে আবেদন জানালাম।’
কিশোর বয়স থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ জনগণের রাষ্ট্র গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর রাজনীতির সার কথা ছিল গণমানুষের মুক্তি। অন্যদের সঙ্গে তিনিও উপলব্ধি করেছিলেন, পাকিস্তানি কাঠামোয় সেই মুক্তি আসবে না। প্রথমে তাঁরা মাতৃভাষা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে নিয়ে আসেন, তারপর পর্যায়ক্রমে তা স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়।
তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত। তার আগে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দলের ছিলেন নিশ্চয়ই; কিন্তু একই সঙ্গে দলকে ছাড়িয়েও গিয়েছিলেন। তিনি দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে এক সূত্রে গাঁথতে পারতেন। দলীয় নেতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটিই তার প্রমাণ। শেখ মুজিবুর রহমান যদি হন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, তাজউদ্দীন আহমদ তার রূপকার। একাত্তরে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের যুব নেতারা তাঁর বিরুদ্ধে ছিলেন, ডানপন্থীরা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন। তা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন আহমদ ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকারটির নেতৃত্ব দিয়েছেন।
যখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী, আওয়ামী লীগের নেতারা ছত্রভঙ্গ, তিনি বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়ে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন, ‘আমরা যুদ্ধে আছি। হাজার হাজার লাশের স্তূপের নিচে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কবর রচিত হয়েছে।’ মুজিবনগর সরকারের অনেকে দোদুল্যমান ছিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমদ তো মার্কিন দূতিয়ালিতে পাকিস্তানের সঙ্গে আপসরফার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ কত দিন চলবে কেউ জানে না, কোন কোন দেশ আমাদের পক্ষে তাও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এসব সংশয়-সন্দেহ নীরবে কাজ করে যাওয়া এই মানুষটিকে স্পর্শ করতে পারেনি। সেই যুদ্ধাবস্থায়ও তিনি পরিকল্পনা সেল গঠন করেছিলেন, পরিকল্পনা নিয়েছিলেন—যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে কী কৌশল নিতে হবে, কীভাবে মুক্তাঞ্চলে শাসনকাঠামো গড়ে তোলা হবে। তাজউদ্দীন আহমদ সরকার পরিচালনার গুরুদায়িত্বের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন মুক্তিযোদ্ধা শিবিরগুলোতে, তাদের সঙ্গে কথা বলতেন, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। বিদেশি রাষ্ট্রনেতা, কূটনীতিক, লেখক-শিল্পী-সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগের কাজটিও তিনি করতেন প্রায় এককভাবে। তাঁর টেবিলে সব সময় একটি ডায়েরি থাকত, তাতে বৈঠকের সময়সূচি টুকে রাখতেন, কাকে কী নির্দেশ দিতে হবে তাও নোট করতেন। এমনকি অনেক সময় মন্ত্রিসভার বৈঠকের কার্যবিবরণও লিখতেন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল, যখন মুজিবনগর সরকার গঠিত হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেয়নি, সবার সঙ্গে যোগাযোগও সম্ভব হয়নি, জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-জনতা, তাদের সাহস, তাদের দেশপ্রেম, তাদের বিশ্বাস, সাধনা, বাংলাদেশের চিন্তায় তাদের নিমগ্ন প্রাণ, তাদের আত্মাহুতি, তাদের ত্যাগতিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নিরক্ষর মানুষের জন্য রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি।’
১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়। এরপর দিন-রাত তিনি কাজ করেছেন লক্ষ্যে পৌঁছাতে। তিনি জানতেন, আমাদের সম্পদ সীমিত, সামর্থ্য অপ্রতুল। কিন্তু বিজয় কেউ রুখতে পারবে না।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। তাদের অস্ত্র ও রসদ জোগানোর পাশাপাশি সেক্টর কমান্ডারদের বিরোধ মীমাংসাও করতে হয়েছে তাঁকে। একজন বিশ্লেষকের মতে, ‘সামরিক ক্ষেত্রে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নিশ্চিতভাবে শত্রুপক্ষ এর সুযোগ গ্রহণ করত এবং মুক্তিযুদ্ধকে আরও জটিল করে তুলত।’
বিজয়ের পর ১৭ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখনো শত্রুর কারাগারে।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্য নেতারা পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকলেও তাজউদ্দীন আহমদ কাজের সুবিধার জন্য আলাদা থাকতেন। অফিসঘরের পাশের একটি কক্ষে ঘুমাতেন। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, ‘অনেক মুক্তিযোদ্ধা শত্রুবাহিনীর হামলায় পা হারিয়েছেন, হাত হারিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। কেউ গুলির আতঙ্কে যন্ত্রণা চেপে ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। এঁদেরও তো অনুভূতি আছে। তাঁদের মা বোন স্ত্রী ছেলেমেয়ে স্বজন রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের কথা চিন্তা করার সময় কোথায়?’
তাজউদ্দীন আহমদকে অন্যায়ভাবে ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আসলে তিনি সর্বান্তকরণে ছিলেন বাংলাদেশপন্থী। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে, এ যুদ্ধের ধরন কী হবে? কার নেতৃত্বে হবে? ভারতীয় কর্মকর্তারা বললেন, ভারত যদি যুদ্ধে রাজি হয় তাহলে তা ভারতের নেতৃত্বেই হবে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘সেটি হবে না। কারণ, এটি আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। রাজনৈতিকভাবে আপনারা বলছেন যে আপনারা আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন। আর এখন আপনারা নেতৃত্ব দিতে চাইছেন। সেনাবাহিনী অবশ্যই যৌথ নেতৃত্বের অধীনে থাকবে।’
তাজউদ্দীন আহমদ কখনো নেতা হতে চাননি। রামের জুতা সিংহাসনে রেখে ভরত বারো বছর দেশ শাসন করেছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদও মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সরকার পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধুর নামে। নেতা ফিরে এলে দেশের দায়িত্বভার তাঁর হাতে ছেড়ে দিয়ে দায়মুক্ত হন। ক্ষমতালিপ্সু মানুষের এই দেশে এ রকম দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি নেই। তিনি যে জনগণের রাষ্ট্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন, তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
৮৫তম জন্মদিনে এই মহান নেতার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
সেই থেকে তৎকালীন পূর্ববাংলার মুসলিম লীগবিরোধী যেকোনো উদ্যোগ-আয়োজন ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। সহযাত্রীদের চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ হয়েও নিরন্তর সাধনা ও প্রজ্ঞাবলে নেতৃত্বের আসনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। যার উজ্জ্বল স্বাক্ষর আমরা লক্ষ করি আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে, ঊনপঞ্চাশে আওয়ামী মুসলিম লীগ, একান্নতে যুবলীগ এবং অন্যান্য প্রগতিশীল সংগঠন প্রতিষ্ঠায়। ‘জনগণের রাষ্ট্র’ গঠন ছিল তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন।
১৯৪৭-এ ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমি পর্যায়ক্রমে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে কথা বললাম। আমাদের জনগণের রাষ্ট্র গঠন করা উচিত। দুর্নীতি ও ঘুষ শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনে সহযোগিতা করার জন্য সকলকে আবেদন জানালাম।’
কিশোর বয়স থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ জনগণের রাষ্ট্র গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর রাজনীতির সার কথা ছিল গণমানুষের মুক্তি। অন্যদের সঙ্গে তিনিও উপলব্ধি করেছিলেন, পাকিস্তানি কাঠামোয় সেই মুক্তি আসবে না। প্রথমে তাঁরা মাতৃভাষা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে নিয়ে আসেন, তারপর পর্যায়ক্রমে তা স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়।
তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত। তার আগে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দলের ছিলেন নিশ্চয়ই; কিন্তু একই সঙ্গে দলকে ছাড়িয়েও গিয়েছিলেন। তিনি দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে এক সূত্রে গাঁথতে পারতেন। দলীয় নেতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটিই তার প্রমাণ। শেখ মুজিবুর রহমান যদি হন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, তাজউদ্দীন আহমদ তার রূপকার। একাত্তরে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের যুব নেতারা তাঁর বিরুদ্ধে ছিলেন, ডানপন্থীরা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন। তা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন আহমদ ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকারটির নেতৃত্ব দিয়েছেন।
যখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী, আওয়ামী লীগের নেতারা ছত্রভঙ্গ, তিনি বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়ে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন, ‘আমরা যুদ্ধে আছি। হাজার হাজার লাশের স্তূপের নিচে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কবর রচিত হয়েছে।’ মুজিবনগর সরকারের অনেকে দোদুল্যমান ছিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমদ তো মার্কিন দূতিয়ালিতে পাকিস্তানের সঙ্গে আপসরফার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ কত দিন চলবে কেউ জানে না, কোন কোন দেশ আমাদের পক্ষে তাও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এসব সংশয়-সন্দেহ নীরবে কাজ করে যাওয়া এই মানুষটিকে স্পর্শ করতে পারেনি। সেই যুদ্ধাবস্থায়ও তিনি পরিকল্পনা সেল গঠন করেছিলেন, পরিকল্পনা নিয়েছিলেন—যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে কী কৌশল নিতে হবে, কীভাবে মুক্তাঞ্চলে শাসনকাঠামো গড়ে তোলা হবে। তাজউদ্দীন আহমদ সরকার পরিচালনার গুরুদায়িত্বের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন মুক্তিযোদ্ধা শিবিরগুলোতে, তাদের সঙ্গে কথা বলতেন, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। বিদেশি রাষ্ট্রনেতা, কূটনীতিক, লেখক-শিল্পী-সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগের কাজটিও তিনি করতেন প্রায় এককভাবে। তাঁর টেবিলে সব সময় একটি ডায়েরি থাকত, তাতে বৈঠকের সময়সূচি টুকে রাখতেন, কাকে কী নির্দেশ দিতে হবে তাও নোট করতেন। এমনকি অনেক সময় মন্ত্রিসভার বৈঠকের কার্যবিবরণও লিখতেন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল, যখন মুজিবনগর সরকার গঠিত হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেয়নি, সবার সঙ্গে যোগাযোগও সম্ভব হয়নি, জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-জনতা, তাদের সাহস, তাদের দেশপ্রেম, তাদের বিশ্বাস, সাধনা, বাংলাদেশের চিন্তায় তাদের নিমগ্ন প্রাণ, তাদের আত্মাহুতি, তাদের ত্যাগতিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নিরক্ষর মানুষের জন্য রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি।’
১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়। এরপর দিন-রাত তিনি কাজ করেছেন লক্ষ্যে পৌঁছাতে। তিনি জানতেন, আমাদের সম্পদ সীমিত, সামর্থ্য অপ্রতুল। কিন্তু বিজয় কেউ রুখতে পারবে না।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। তাদের অস্ত্র ও রসদ জোগানোর পাশাপাশি সেক্টর কমান্ডারদের বিরোধ মীমাংসাও করতে হয়েছে তাঁকে। একজন বিশ্লেষকের মতে, ‘সামরিক ক্ষেত্রে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নিশ্চিতভাবে শত্রুপক্ষ এর সুযোগ গ্রহণ করত এবং মুক্তিযুদ্ধকে আরও জটিল করে তুলত।’
বিজয়ের পর ১৭ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখনো শত্রুর কারাগারে।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্য নেতারা পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকলেও তাজউদ্দীন আহমদ কাজের সুবিধার জন্য আলাদা থাকতেন। অফিসঘরের পাশের একটি কক্ষে ঘুমাতেন। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, ‘অনেক মুক্তিযোদ্ধা শত্রুবাহিনীর হামলায় পা হারিয়েছেন, হাত হারিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। কেউ গুলির আতঙ্কে যন্ত্রণা চেপে ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। এঁদেরও তো অনুভূতি আছে। তাঁদের মা বোন স্ত্রী ছেলেমেয়ে স্বজন রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের কথা চিন্তা করার সময় কোথায়?’
তাজউদ্দীন আহমদকে অন্যায়ভাবে ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আসলে তিনি সর্বান্তকরণে ছিলেন বাংলাদেশপন্থী। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে, এ যুদ্ধের ধরন কী হবে? কার নেতৃত্বে হবে? ভারতীয় কর্মকর্তারা বললেন, ভারত যদি যুদ্ধে রাজি হয় তাহলে তা ভারতের নেতৃত্বেই হবে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘সেটি হবে না। কারণ, এটি আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। রাজনৈতিকভাবে আপনারা বলছেন যে আপনারা আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন। আর এখন আপনারা নেতৃত্ব দিতে চাইছেন। সেনাবাহিনী অবশ্যই যৌথ নেতৃত্বের অধীনে থাকবে।’
তাজউদ্দীন আহমদ কখনো নেতা হতে চাননি। রামের জুতা সিংহাসনে রেখে ভরত বারো বছর দেশ শাসন করেছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদও মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সরকার পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধুর নামে। নেতা ফিরে এলে দেশের দায়িত্বভার তাঁর হাতে ছেড়ে দিয়ে দায়মুক্ত হন। ক্ষমতালিপ্সু মানুষের এই দেশে এ রকম দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি নেই। তিনি যে জনগণের রাষ্ট্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন, তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
৮৫তম জন্মদিনে এই মহান নেতার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments