তথ্যপ্রযুক্তি-শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি ও আমাদের উদ্ভাবন by মো. নজরুল ইসলাম খান

শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্বব্যাপী আরেক বিপ্লবের নাম ই-লার্নিং। বিশ্বব্যাপী ই-লার্নিংয়ের বর্তমান বাজার এখন ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপর। উন্নত দেশগুলোতে অনেক আগেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাস, ডিজিটাল কনটেন্ট ও টেক্সটবুক ডিজিটাল করা হয়েছে। ওই সব দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণীকক্ষগুলোও পূর্ণমাত্রায় ডিজিটাল। চালু হয়েছে ভার্চুয়াল ক্লাসরুম।


বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন খাতে ডিজিটাইজেশনের যাত্রা শুরু হয়েছে। শিক্ষার মতো মানুষের মৌলিক একটি চাহিদা পূরণে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ডিজিটাইজেশনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা খাতে ই-বুক এবং মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা হয়েছে। আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ই-বুক এবং মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে পাঠ গ্রহণ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণকে সহজ করে দিয়েছে।
মুখস্থবিদ্যা থেকে বেরিয়ে এসে প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষা গ্রহণকে উৎসাহিত করছে সরকার। এটা এক ধরনের সৃজনশীল পদ্ধতি, যার মাধ্যমে নিজের মেধাকে শাণিত করা যায়। সে লক্ষ্যেই সরকার ই-লার্নিংয়ের ওপর জোর দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের জন্য এক হাজারটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করেছে এবং শিক্ষকদের ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই উদ্ভাবন দুটি স্বল্প খরচে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন এবং শিক্ষকদের ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এই মডেল অনুসরণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছরের মধ্যে সারা দেশে ২০ হাজার ৫০০ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কাজ করছে।
শিক্ষায় ই-লার্নিং প্রবর্তনের অংশ হিসেবে আমাদের সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। এ ক্ষেত্রে দুটি বড় বাধার একটি হলো কম্পিউটার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের উচ্চ ব্যয়। আমাদের দেশের ৮১ হাজার প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৩০ হাজার মাধ্যমিক ও প্রায় ছয় হাজার উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমানের ট্রেন্ড অনুযায়ী কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রতিটিতে ২০ লাখ টাকা করে ২৮ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। একটি ল্যাবে প্রতিদিন পাঁচ-ছয়টি ক্লাস নেওয়া সম্ভব। এসব ল্যাবে শিক্ষার্থীদের কেবল কম্পিউটার লিটারেসি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এভাবে ল্যাব করতে চাইলে আমরা কত বছরে ল্যাব তৈরির কাজ শেষ করতে পারব? কম্পিউটার চালানো শেখানোই কি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য, নাকি কম্পিউটার ব্যবহার করে অধিকতর শিক্ষা এবং শিক্ষার মান উন্নত করা আমাদের উদ্দেশ্য? আমরা কেবল শহরের স্কুলগুলোতে ল্যাব করতে আগ্রহী। এতে গ্রাম ও শহরের বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে কি না, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়টি হলো, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম শিক্ষক গড়ে তোলা। আমাদের অধিকাংশ স্কুলে এক বা একাধিক কম্পিউটার থাকলেও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়া হয়নি। শিক্ষকদের কনটেন্ট তৈরির প্রশিক্ষণও নেই। তাই কম্পিউটার বা প্রজেক্টর থাকলেও তা ক্লাসে ব্যবহারে সক্ষম না।
আমরা দুটি মডেল উদ্ভাবন করেছি। প্রথমটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। যেখানে একটি ল্যাপটপ, একটি প্রজেক্টর, ইন্টারনেট সংযোগ ও কনটেন্ট তৈরির শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়। এতে সর্বসাকল্যে এক লাখ টাকা খরচ হতে পারে। যেকোনো বিষয়ে শিক্ষক এটি ব্যবহার করতে পারেন এবং দিনে পাঁচ-ছয়টি ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। অথচ কম্পিউটার ল্যাব অ্যাপ্রোচে গেলে প্রতিটি ল্যাবের জন্য ২০ লাখ টাকা খরচ হতে পারে, তবে প্রতিদিন পাঁচ-ছয়টির বেশি ক্লাস নেওয়া যায় না। কম্পিউটার ল্যাব সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করতে হলে ২৮ হাজার কোটি টাকা দরকার হবে এবং এতে ১৫-২০ বছর সময় লাগতে পারে। আমাদের মডেল One Laptop, one projector, connectivity এবং Content training approach উদ্ভাবন করা হয়েছে। তবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করার পর কম্পিউটার ল্যাব ও ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব একত্রে করা যেতে পারে। এখানে বর্তমানের Listening এবং Speaking শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হবে। শিক্ষার মান উন্নত হবে।
দ্বিতীয় উদ্ভাবনটি হলো, ‘শিক্ষক কর্তৃক ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি’ (Teacher Led Content Development)। আমরা প্রথম মডেল ব্যবহার করলেও প্রশ্ন থেকে যায়, শিক্ষকেরা কি নিজেরাই তাঁদের কনটেন্ট (পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি) তৈরি করতে পারবেন? উন্নত দেশে প্রাইভেট কোম্পানি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কনটেন্ট তৈরি করে থাকে। শিক্ষা বিভাগ তা কিনে ব্যবহার করে। আমরা উদ্যোগী হয়ে শিক্ষকদের মাত্র সাত দিনের ‘কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট’ প্রশিক্ষণ দিয়ে দেখেছি, যাঁদের কোনো কম্পিউটার লিটারেসি ছিল না, তাঁরাই নিজেদের কনটেন্ট ‘পাওয়ার পয়েন্ট’ তৈরি করতে পারেন।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, শিক্ষকেরা কি মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি করতে পারবেন? কিংবা শিক্ষকদের তৈরি কনটেন্টের উত্তরোত্তর উৎকর্ষসাধনের উপায় কী? এ ক্ষেত্রে আমরা সবার সমবেত সহায়তা নিচ্ছি। সে লক্ষ্যে একটি ব্লগ (www.ictinedubd.ning.com) বা লেখালাপ উদ্ভাবন করা হয়েছে। বর্তমানে এই সাইটে দুই হাজারের বেশি শিক্ষকের তৈরি কনটেন্ট রয়েছে। শিক্ষকেরা কনটেন্ট তৈরি করে এখানে আপলোড করে রাখতে পারেন। যেকোনো শিক্ষক তা ডাউনলোড করে ব্যবহার করতে পারেন। আরও সংযোজন, বিয়োজন করে, উন্নত করে আপলোড করতে পারেন এবং করছেন। এতে শিক্ষকদের সময় বাঁচবে এবং কনটেন্টের মান উন্নত হবে। এখানে Two head is better than one অর্থাৎ co-create পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। ক্রমে ক্রমে কনটেন্ট উন্নত হচ্ছে। এসব শিক্ষকের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বমানের কনটেন্ট স্থানীয়ভাবে বাংলায় তৈরি করার ক্ষেত্র তৈরি হবে।
একটি সুন্দর আগামী তৈরিতে ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহরের সব শিক্ষার্থীকে নিয়ে একত্রে আমাদের এগোতে হবে। শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার যাতে নতুন করে তথ্যপ্রযুক্তি বিভেদ তৈরি না করে, সে বিষয়ে আমরা সচেতন থেকে কৌশলগত অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছি। তাই প্রথম ধাপে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে।
দ্বিতীয় ধাপে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ক্লাসে Thin Client (যেখানে শুধু একটি কম্পিউটার ব্যবহার করে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ১০-২০টি শ্রেণীকক্ষে মাল্টিমিডিয়া স্থাপন করা সম্ভব) প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ নিশ্চিত করা হবে।
তৃতীয় ধাপে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব কাম ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব স্থাপন করা হবে। ভবিষ্যতে কয়েক হাজার টাকায় ইন্টারনেট ব্রাউজ করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস দিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের সুযোগ নিয়ে মাসে কয়েক শ টাকা দিয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা যাবে।
শুধু সরকারি উদ্যোগ নয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদেরও এগিয়ে আসা জরুরি। নিজেদের উদ্ভাবন নিজেদের চেষ্টায় যদি সফল হয়, এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে? একবার সেই কবিতার কথা স্মরণ করুন তো—‘নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা’।
মো. নজরুল ইসলাম খান: প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ ও জাতীয় প্রকল্প পরিচালক, অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম।

No comments

Powered by Blogger.