নতুন ইতিহাস গড়ল তাহরির স্কয়ার by সুভাষ সাহা

তিউনিসিয়ায় তখন গণরোষে পুড়ছে এক স্বৈরাচারের সিংহাসন। নির্যাতন-হত্যা, বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়া, মিথ্যা প্রচার ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ঢালাও প্রতিশ্রুতিতেও মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করা যায়নি। অবশেষে দেশ ছেড়ে সৌদি আরব পালাতে বাধ্য হলেন তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলী।


তিউনিসিয়ায় গণআন্দোলনের প্রজ্বলিত অগি্নশিখায় নিজেদের চিনে নিতে চাইল মিসরবাসী। তারা ভাবল, আমরা কম কিসে! তাই কায়রোর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত তাহরির স্কয়ার ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে হয়ে উঠতে লাগল স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গমস্থলে। কে বাম, কে ডান বা কে মধ্যপন্থি_ এসব ভেদরেখা মুছে গিয়ে তাহরির স্কয়ারে সমবেত জনসমুদ্রের স্বৈরাচারী হোসনি মোবারক সরকারের পতন এবং মুক্তি হয়ে দাঁড়াল আরাধ্য। তারা গণতন্ত্রকে তাদের মুক্তির সোপান করতে চাইল। কিন্তু জনতার এই উদগ্র ইচ্ছার মূল্য দিতে রাজি ছিল না মোবারক ও তাকে শিখণ্ডী করে বেড়ে ওঠা সেখানকার লুটেরা-হারমাদের দল। আন্দোলনের প্রথম আট দিনেই নিহত হলো ৩০০ আন্দোলনকারী। এরপর আরও কত মানুষকে জীবন বিলিয়ে দিতে হয়েছে তার হিসাব করা সত্যিই কঠিন। সে সময় আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে ২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম সেনাবাহিনীকে নামতে দেখা গেল। আর প্রাইভেট বাহিনী ও সাদা পোশাকের নিরাপত্তা কর্মীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী তো ছিলই।
৩০ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা মোবারক প্রথমে অত্যাচার-নির্যাতনের সনাতনী পন্থায় আন্দোলন দমনের চেষ্টা করলেন। এতে আন্দোলনের দীপশিখা আরও লাল হলো। লাখ লাখ মানুষ জমায়েত হতে লাগল তাহরির স্কয়ার ছাড়িয়ে আলেকজান্দ্রিয়াসহ প্রতিটি শহরে। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন পুরুষদের পাশাপাশি সন্তান কোলে মহিলাদেরও দেখা গেল মুক্তির মিছিলে। তাহরির স্কয়ারে অনেক নারী সংসার নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। আরব দুনিয়ায় সেটা ছিল অবিশ্বাস্য এক মহামমিলন। একই আন্দোলনে নারীরাও তাদের মুক্তির দিশা খুঁজছিলেন।
মোবারক ২০১১ সালের অক্টোবরে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া এবং আগামী নির্বাচনে তিনি বা তার ছেলে কেউ প্রার্থী হবেন না বলে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দ্বিতীয় দফার ভাষণে (২ ফেব্রুয়ারি) ঘোষণা করলেন। কিন্তু ততদিনে আন্দোলন এক দফায় পরিণত হয়েছে। মোবারককে ক্ষমতায় রেখে আন্দোলনকারীরা কোনো অবস্থাতেই ঘরে ফিরতে রাজি ছিলেন না। আন্দোলনের তেজ দেখে জাতিসংঘ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান এল বারাদি পর্যন্ত হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনিও শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তবে প্রচণ্ড মার্কিনঘেঁষা বলে তাকে মিসরের সাধারণ মানুষ কখনও তেমন আস্থায় নিতে পারেনি।
বস্তুত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দা তিউনিসিয়া, মিসর ও ইয়েমেনের মতো আরব দেশগুলোকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছিল। তার ওপর এসব দেশে দশকের পর দশক ধরে চলা স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে মানুষ অস্থির হয়ে উঠেছিল। কোথাও গণতন্ত্রের লেশমাত্রও ছিল না। অন্যদিকে শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ কর্মসংস্থানের অভাবে শাসন-প্রশাসনের প্রতি মারাত্মক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। আবার এরাই রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার ব্যবহারকারী। তাই প্রতিনিয়ত তাদের সঙ্গে স্বদেশীয় ও বিদেশি তরুণ সমাজের সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল এবং হচ্ছিল বিদ্যুৎগতিতে। এতে ভীত হয়ে মোবারক সরকার এসব ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়ার সমালোচনার মুখে এসব ব্যবহার তাকে অবারিত রাখতে হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৯ সালেই মিসরে এক লাখ ৬০ হাজার ব্লগার ছিলেন। এই ব্লগাররা বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান। এভাবেই তিউনিসিয়ার গণজাগরণ তাহরির স্কয়ার হয়ে মিসরকেও একসময় উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত করল।
আন্দোলনের গতিবেগ এত দ্রুত ছিল যে, বিশ্বের প্রধান মোড়লের পক্ষেও তার পরিমাপ করা তখন সম্ভব হয়নি। সে কারণে আন্দোলনের প্রথম দিকে মার্কিন প্রশাসনের কাউকে কাউকে বিশেষ করে ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারিকে মেবারক সরকারের পক্ষেই অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত জনগণের শক্তির তোড় দেখে ওবামা নিজে এবং ইউরোপীয় দেশগুলোকে মোবারককে ট্রানজিশনের পরামর্শ দিতে দেখা গেছে। তাদের এ দোটানা মনোভাবের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি আরবের আন্দোলনকারী জনতার সন্দেহ-অবিশ্বাস আরও ঘনীভূত হয়, যার রেশ এখনও বিদ্যমান।
আসলে পশ্চিমা দুনিয়ার এহেন মনোভাবের কারণও ছিল। তারা চেয়েছিলেন সেখানে নিয়ন্ত্রিত আন্দোলনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত সংস্কার। নির্বাচনের ধারায় আস্তে আস্তে আরবের লৌহযবনিকাকে একটু একটু করে সরানো। কিন্তু জনতার আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের কোনো বাঁধন মানেনি। গণআন্দোলনের তোড়ে তাদের পরিকল্পনাকে তাই অদল-বদল করতে হয়েছে। তবে বছরে ২০০ কোটি ডলার নগদ মার্কিন ঋণ ও মঞ্জুরির বিরাট অংশ ভোগকারী মোটাসোটা মিসরীয় সেনাবাহিনী চরম মুহূর্তেও মার্কিন ডিক্টেশনকে অমান্য করেনি। আন্দোলনের ভয়ে যখন পর্যটন শহর শার্ম-আল শেখে মোবারক লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান, তখনও এই সেনাবাহিনী একটার পর একটা বিকল্প হাজির করে জনমতকে বিভ্রান্তের চেষ্টা করেছে। তারা শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না বলে তাদের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতায় থাকা আর সম্ভব হবে না বিবেচনা করেই তারা নির্বাচনে কারসাজির মাধ্যমে সেখানে প্রগতিশীল শক্তির উত্থানকে আটকাতে চেষ্টা করছে। তারা তাদের ও পশ্চিমা সমর্থিত শক্তি এবং ইসলামী শাসনে বিশ্বাসী ইসলামী ব্রাদারহুডের মধ্যে দেশকে বিভাজিত করার চেষ্টা করছে।
আবার মিসরের বিপ্লবের দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া যাক। মানুষের সুদীর্ঘকালের অর্থনৈতিক প্রবঞ্চনা ও স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া ক্ষোভ বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার অভিঘাতের সঙ্গে মিলে মহবিদ্রোহের তরঙ্গমালায় রূপান্তরিত হয়েছিল, যাকে এককথায় 'আরব বসন্ত' অভিধায় অভিহিত করা হয়। মিসরে এ বিপ্লব ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি শুরু হয়ে মাত্র ১৮ দিনের মাথায় হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের শাসনের যবনিকাপাত ঘটাল। সে এক অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক ঘটনা। ১১ ফেব্রুয়ারি মোবারকের ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা যখন আসে, তখন তাহরির স্কয়ারে বিনিদ্র রাত কাটানো মানুষের সে কী বিজয় উল্লাস!
আর সে বিজয়কে গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারে পরিণত করার জন্য এরপর সামরিক বাহিনীর একের পর এক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষের লড়ে যাওয়া এবং বারবার তাহরির স্কয়ারে জড়ো হওয়া মিসরের জনগণের বিরাট অংশের সচেতনতার মান এক লাফে অনেক ওপরে উঠে যাওয়ার সাক্ষ্য বহন করে।
মিসর-বিপ্লব বস্তুত জনতার সম্মিলিত শক্তি যে অপরাজেয় তাই প্রমাণ করে। তবে বিপ্লবে বিজয়ী হওয়া আর ওই বিজয়কে ধরে রাখতে পারাটার মধ্যে যে যোজন যোজন ব্যবধান রয়েছে সে সম্পর্কেও আমাদের রাজনৈতিক জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনে সাহায্য করবে এটা।

স সুভাষ সাহা :সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.