প্রতিক্রিয়া-৫০ বছর পর আবার কেন গোল্ডেন রাইস? by পাভেল পার্থ
বাংলাদেশসহ দুনিয়ার নানা প্রান্তে চরম ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, খাদ্যহীনতা আর খাদ্যসংকটের ভেতর আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইরি) নির্লজ্জভাবে পাড়ি দিচ্ছে ‘সাফল্যময় ৫০ বছর’। আর এই সময়টাতে ক্ষুধার বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘সবুজ বিপ্লব’ আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘শান্তির যুদ্ধ’ দেখতে দেখতে দুনিয়া কাহিল।
এসব বিপ্লব আর শান্তির মানে বুঝতে অসুবিধা হয় না। এ কেবল দখল, বাণিজ্য বিস্তার আর ক্ষমতার ইতিহাস। ইরির মহাপরিচালক রবার্ট এস জিগলার প্রতিষ্ঠানটির ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশে ইরির আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা ও অতীতের অর্জন নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। ১৬ জুলাই প্রকাশিত জিগলারের আলোচনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা জরুরি মনে করছি। কেননা, এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত বাংলাদেশের কৃষি ও জুম পরিসরের জীবন-মরণের গতি ও ঠিকানা।
পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ইরির তথাকথিত উচ্চফলনশীল (উফশী) ধানজাত প্রকল্পগুলোর প্রসঙ্গ টেনেছেন জিগলার। কিন্তু চরম খাদ্যসংকটে টালমাটাল পৃথিবীর খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কোনোভাবেই উচ্চমাত্রার রাসায়নিক সার, বিষ ও সেচ গ্রহণশীল উফশী ধানের ফলন বৃদ্ধি যে সমাধান নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের বাংলাদেশেই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের থেকে চলতি সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ, কিন্তু ধান উৎপাদন বেড়েছে আড়াই গুণ। তবু কেন বাংলাদেশে খাদ্যসংকট? ‘খাদ্য’ আপাদমস্তক এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যাপার। খাদ্য উৎপাদন বাড়লেই খাদ্যসংকট কমে না বা খাদ্যের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয় না। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে উৎপাদন-সম্পর্ক, নিয়ন্ত্রণ, বাজার এবং বণ্টন ব্যবস্থাপনার রাজনীতি। ইরির মতো আন্তর্জাতিক কৃষিবিষয়ক গবেষণা এজেন্সিগুলো গড়ে তোলার পেছনে আছে ক্ষমতাধর বিশ্ব-রাজনীতি, যা বরাবর ক্ষুধার বিরুদ্ধে সবুজ বিপ্লব আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তির যুদ্ধের কথা বলে নিপীড়িত দুনিয়ায় নানা সময়ে নানা কৃষি-প্রকল্প নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ইরির পরামর্শ ও সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের কৃষি ইতিহাস ও কৃষি-মনস্তত্ত্ব বদলে যেতে বাধ্য হয়েছে। খাদ্য বণ্টন ব্যবস্থাপনার সব রাজনীতিকে আড়াল করে কেবল ‘অধিক ফসল’ ফলানোর নাম করে দেশের ভিন্ন ভিন্ন কৃষি-প্রতিবেশ অঞ্চলের জলবায়ুসহিষ্ণু ধানজাতের বৈচিত্র্যকে হত্যা করা হয়েছে। উফশী ফসল চাষের নামে বাংলাদেশের মাটিতেও টেনে আনা হয়েছে করপোরেট সার-বিষ আর পানির অনিবার্য বাণিজ্য। আজ বাংলাদেশের কৃষক কেবল ধানই ফলাচ্ছেন না, তাঁর রক্ত-ঘামেই টিকে আছে সিনজেন্টা, মনসান্টো, ডুপন্ট, কারগিল, বায়ার ক্রপ সায়েন্সের মতো করপোরেট কোম্পানির মুনাফার মেদ। কৃষক-জুমিয়া উদ্ভাবিত ও নিরন্তর বিকাশমান জাতগুলোর ভেতর কিছু ‘অদলবদল’ ঘটিয়ে ইরি-প্রবর্তিত ধানগুলোকেই ‘আধুনিক’ নাম দেওয়া হয়েছে। ইরির কৃষিবিষয়ক গবেষণা ও বাণিজ্যে রাষ্ট্রীয় ও জনবরাদ্দ কমে যাওয়ায় ইরি দিনে দিনে করপোরেট কোম্পানি-নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। ২০০৭ সালে ইরি ‘হাইব্রিড ধান গবেষণা কনসোর্টিয়াম’ গঠন করে এবং বার্ষিক ফির মাধ্যমে ইরিতে সংরক্ষিত জাতগুলোকে করপোরেট কোম্পানির গবেষণার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়।
ইরি পরিচালিত তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের ফলেই বাংলাদেশসহ এশিয়ায় বাদামি ঘাসফড়িংসহ ধানের নিত্যনতুন রোগবালাই দেখা দিয়েছে। সবুজ বিপ্লব ধানসহ শস্য ফসলের বৈচিত্র্য কমিয়ে দেশের কৃষি ও জুম-জীবনকে ঠেলে দিয়েছে বৈচিত্র্যহীন ‘একক চাষের’ দিকে। ইরির গরিষ্ঠভাগ গবেষণাই বিজ্ঞানীকেন্দ্রিক এবং যেখানে মূলত ব্যবহূত হয়েছে হাজার বছর ধরে কৃষক-জুমিয়া উদ্ভাবিত স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী ধানের এক বিশাল ভান্ডার। ইরি এখনো পর্যন্ত কৃষিকে কৃষকের ঐতিহাসিক বিজ্ঞান ও যাপিত জীবনের ইতিহাস থেকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেনি।
জিগলার তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) জিনব্যাংকে রক্ষিত দেশীয় ধানজাতের ‘জিন মানচিত্র’ বের করে তা নথিবদ্ধ ও সংরক্ষণে ইরির সহযোগিতার কথা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এখানেই রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে দেশের জিনসম্পদের প্রতি দায়িত্বশীল ও রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। এভাবে নানা অছিলায় গবেষণা আর কৃষি উন্নয়নের নামেই আমরা যথেষ্ট পরিমাণে জাত ও জাতের ওপর কৃষকের অধিকার হারিয়েছি।
বাংলাদেশে ‘গোল্ডেন রাইস’ নিয়ে আসাকেই ইরির সামনের দিনের বড় পরিকল্পনা বলে উল্লেখ করেছেন জিগলার। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের গরিব মানুষের ভিটামিন-এর চাহিদা পূরণের জন্যই গোল্ডেন রাইস নিয়ে আসা হবে। কিন্তু ৫০ বছর ধরে উফশী ও হাইব্রিড বীজের মাধ্যমে দেশের কৃষিকে জখম করে কেন আবার গোল্ডেন রাইসের মতো ‘জেনিটিক্যালি ইনজিনিয়ার্ড’ ধানজাত আনতে হবে ইরিকে?
প্রকৃতিতে ও কৃষকের চাষের ভেতর দিয়ে প্রতিটি ধানজাতেরই নিরন্তর পরিবর্তন, বিকাশ ও নিজস্ব কায়দায় রূপান্তর ঘটে চলেছে। প্রতিটি ধানেরই একটি নিজস্ব জিন-স্বরলিপি আছে, প্রতিটি জাতই তার চারপাশের বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে গড়ে তুলেছে এক জটিল প্রতিবেশীয় মিতালি। যখন সে রকম একটি জাতে জোর করে একটি ভিন্ন জিন ঢুকিয়ে গোল্ডেন রাইস নামে তাকে প্রাকৃতিক কৃষি-বাস্তুসংস্থানে ছাড়া হবে তখন সেই জাত স্থানীয় বাস্তুসংস্থানে ‘জৈব-বিশৃঙ্খলা’ তৈরি করবে। গোল্ডেন রাইসের জিন-স্বরলিপি পাঠ করার জন্য বাংলাদেশের ত্রিশটি কৃষি-প্রতিবেশ অঞ্চল প্রস্তুত নয়। আমরা গোল্ডেন রাইস চাই না। কারণ জেনিটিক্যালি ইনজিনিয়ার্ড ফসলের স্বাস্থ্য, প্রতিবেশ ও কৃষি-অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব তৈরির যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গোল্ডেন রাইস চাষের জন্য আবারও প্রয়োজন হবে কৃত্রিম সেচ, রাসায়নিক সার ও নিত্যনতুন বিষ। এটি আমাদের মাটি ও পানিকে আবারও রাসায়নিক বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত করবে।
২০০০ সাল থেকে ইরি দুনিয়ার বড় বড় করপোরেট কোম্পানির সঙ্গে মিলে জেনিটিক্যালি ইনজিনিয়ার্ড (জিই) বা জিনপ্রযুক্তিতে বিকৃত জাত গবেষণা নিয়ে নয়া বীজ-রাজনীতি শুরু করেছে। বাংলাদেশে ব্রি-ধান ২৯ নিয়ে গোল্ডেন রাইসের ওপর গবেষণা করছে ব্রি। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সবুজ বিপ্লবের ধাক্কা প্রথম দিকে ধরতে না পারলেও, বাংলাদেশের জনগণ এতটা ‘দিন বা রাতকানা’ নয় যে গোল্ডেন রাইসের মাধ্যমে করপোরেট বীজ-বাণিজ্য বিস্তারকে ধরতে পারবে না। বাংলাদেশের নানা প্রান্তে কেবল কুড়িয়ে পাওয়া শাকের মাধ্যমেই ঐতিহাসিকভাবে ভিটামিন এ-এর চাহিদা পূরণ করে গ্রামীণ জনগণ। জিগলার যদি বাংলাদেশের জমিগুলোতে সিনজেন্টা, মনসান্টো ও বায়ারের মতো করপোরেট কোম্পানির ‘ঘাস মারার বিষ (হার্বিসাইড)’ বাণিজ্যকে বন্ধ করতে পারেন, তবে গ্রামীণ জনগণ নিজেরাই নিজেদের ভিটামিন ঘাটতি পূরণ করতে পারবে।
জিগলার জিই, জিএমও এবং হাইব্রিডকে পরিবেশবান্ধব বলেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভিন্নমত আছে। প্রায় ১০ হাজার বছর আগে, কৃষক ও জুমিয়ারাই ভিন্ন জলবায়ু ও সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের বীজকে আবাদি জাতে পরিণত করেছিলেন। আসুন, কৃষক-জুমিয়ার সেই জিনসম্পদকে আপন শক্তি ও মহিমায় বিকশিত হতে সবাই সহযোগিতা করি।
পঞ্চাশ বছর যথেষ্ট সময়। উফশী ও হাইব্রিডের পর আর কোনো ভোগান্তি বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণ ইরির কাছ থেকে প্রত্যাশা করে না। বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের লড়াকু ইতিহাস নিজেদের ‘অনুন্নত’ বীজবৈচিত্র্য দিয়েই তথাকথিত ‘আধুনিক’ গোল্ডেন রাইসের নয়া বীজ উপনিবেশ রুখতে প্রস্তুত।
পাভেল পার্থ: প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক।
animistbangla@yahoo.com
পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ইরির তথাকথিত উচ্চফলনশীল (উফশী) ধানজাত প্রকল্পগুলোর প্রসঙ্গ টেনেছেন জিগলার। কিন্তু চরম খাদ্যসংকটে টালমাটাল পৃথিবীর খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কোনোভাবেই উচ্চমাত্রার রাসায়নিক সার, বিষ ও সেচ গ্রহণশীল উফশী ধানের ফলন বৃদ্ধি যে সমাধান নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের বাংলাদেশেই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের থেকে চলতি সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ, কিন্তু ধান উৎপাদন বেড়েছে আড়াই গুণ। তবু কেন বাংলাদেশে খাদ্যসংকট? ‘খাদ্য’ আপাদমস্তক এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যাপার। খাদ্য উৎপাদন বাড়লেই খাদ্যসংকট কমে না বা খাদ্যের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয় না। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে উৎপাদন-সম্পর্ক, নিয়ন্ত্রণ, বাজার এবং বণ্টন ব্যবস্থাপনার রাজনীতি। ইরির মতো আন্তর্জাতিক কৃষিবিষয়ক গবেষণা এজেন্সিগুলো গড়ে তোলার পেছনে আছে ক্ষমতাধর বিশ্ব-রাজনীতি, যা বরাবর ক্ষুধার বিরুদ্ধে সবুজ বিপ্লব আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তির যুদ্ধের কথা বলে নিপীড়িত দুনিয়ায় নানা সময়ে নানা কৃষি-প্রকল্প নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ইরির পরামর্শ ও সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের কৃষি ইতিহাস ও কৃষি-মনস্তত্ত্ব বদলে যেতে বাধ্য হয়েছে। খাদ্য বণ্টন ব্যবস্থাপনার সব রাজনীতিকে আড়াল করে কেবল ‘অধিক ফসল’ ফলানোর নাম করে দেশের ভিন্ন ভিন্ন কৃষি-প্রতিবেশ অঞ্চলের জলবায়ুসহিষ্ণু ধানজাতের বৈচিত্র্যকে হত্যা করা হয়েছে। উফশী ফসল চাষের নামে বাংলাদেশের মাটিতেও টেনে আনা হয়েছে করপোরেট সার-বিষ আর পানির অনিবার্য বাণিজ্য। আজ বাংলাদেশের কৃষক কেবল ধানই ফলাচ্ছেন না, তাঁর রক্ত-ঘামেই টিকে আছে সিনজেন্টা, মনসান্টো, ডুপন্ট, কারগিল, বায়ার ক্রপ সায়েন্সের মতো করপোরেট কোম্পানির মুনাফার মেদ। কৃষক-জুমিয়া উদ্ভাবিত ও নিরন্তর বিকাশমান জাতগুলোর ভেতর কিছু ‘অদলবদল’ ঘটিয়ে ইরি-প্রবর্তিত ধানগুলোকেই ‘আধুনিক’ নাম দেওয়া হয়েছে। ইরির কৃষিবিষয়ক গবেষণা ও বাণিজ্যে রাষ্ট্রীয় ও জনবরাদ্দ কমে যাওয়ায় ইরি দিনে দিনে করপোরেট কোম্পানি-নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। ২০০৭ সালে ইরি ‘হাইব্রিড ধান গবেষণা কনসোর্টিয়াম’ গঠন করে এবং বার্ষিক ফির মাধ্যমে ইরিতে সংরক্ষিত জাতগুলোকে করপোরেট কোম্পানির গবেষণার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়।
ইরি পরিচালিত তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের ফলেই বাংলাদেশসহ এশিয়ায় বাদামি ঘাসফড়িংসহ ধানের নিত্যনতুন রোগবালাই দেখা দিয়েছে। সবুজ বিপ্লব ধানসহ শস্য ফসলের বৈচিত্র্য কমিয়ে দেশের কৃষি ও জুম-জীবনকে ঠেলে দিয়েছে বৈচিত্র্যহীন ‘একক চাষের’ দিকে। ইরির গরিষ্ঠভাগ গবেষণাই বিজ্ঞানীকেন্দ্রিক এবং যেখানে মূলত ব্যবহূত হয়েছে হাজার বছর ধরে কৃষক-জুমিয়া উদ্ভাবিত স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী ধানের এক বিশাল ভান্ডার। ইরি এখনো পর্যন্ত কৃষিকে কৃষকের ঐতিহাসিক বিজ্ঞান ও যাপিত জীবনের ইতিহাস থেকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেনি।
জিগলার তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) জিনব্যাংকে রক্ষিত দেশীয় ধানজাতের ‘জিন মানচিত্র’ বের করে তা নথিবদ্ধ ও সংরক্ষণে ইরির সহযোগিতার কথা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এখানেই রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে দেশের জিনসম্পদের প্রতি দায়িত্বশীল ও রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। এভাবে নানা অছিলায় গবেষণা আর কৃষি উন্নয়নের নামেই আমরা যথেষ্ট পরিমাণে জাত ও জাতের ওপর কৃষকের অধিকার হারিয়েছি।
বাংলাদেশে ‘গোল্ডেন রাইস’ নিয়ে আসাকেই ইরির সামনের দিনের বড় পরিকল্পনা বলে উল্লেখ করেছেন জিগলার। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের গরিব মানুষের ভিটামিন-এর চাহিদা পূরণের জন্যই গোল্ডেন রাইস নিয়ে আসা হবে। কিন্তু ৫০ বছর ধরে উফশী ও হাইব্রিড বীজের মাধ্যমে দেশের কৃষিকে জখম করে কেন আবার গোল্ডেন রাইসের মতো ‘জেনিটিক্যালি ইনজিনিয়ার্ড’ ধানজাত আনতে হবে ইরিকে?
প্রকৃতিতে ও কৃষকের চাষের ভেতর দিয়ে প্রতিটি ধানজাতেরই নিরন্তর পরিবর্তন, বিকাশ ও নিজস্ব কায়দায় রূপান্তর ঘটে চলেছে। প্রতিটি ধানেরই একটি নিজস্ব জিন-স্বরলিপি আছে, প্রতিটি জাতই তার চারপাশের বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে গড়ে তুলেছে এক জটিল প্রতিবেশীয় মিতালি। যখন সে রকম একটি জাতে জোর করে একটি ভিন্ন জিন ঢুকিয়ে গোল্ডেন রাইস নামে তাকে প্রাকৃতিক কৃষি-বাস্তুসংস্থানে ছাড়া হবে তখন সেই জাত স্থানীয় বাস্তুসংস্থানে ‘জৈব-বিশৃঙ্খলা’ তৈরি করবে। গোল্ডেন রাইসের জিন-স্বরলিপি পাঠ করার জন্য বাংলাদেশের ত্রিশটি কৃষি-প্রতিবেশ অঞ্চল প্রস্তুত নয়। আমরা গোল্ডেন রাইস চাই না। কারণ জেনিটিক্যালি ইনজিনিয়ার্ড ফসলের স্বাস্থ্য, প্রতিবেশ ও কৃষি-অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব তৈরির যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গোল্ডেন রাইস চাষের জন্য আবারও প্রয়োজন হবে কৃত্রিম সেচ, রাসায়নিক সার ও নিত্যনতুন বিষ। এটি আমাদের মাটি ও পানিকে আবারও রাসায়নিক বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত করবে।
২০০০ সাল থেকে ইরি দুনিয়ার বড় বড় করপোরেট কোম্পানির সঙ্গে মিলে জেনিটিক্যালি ইনজিনিয়ার্ড (জিই) বা জিনপ্রযুক্তিতে বিকৃত জাত গবেষণা নিয়ে নয়া বীজ-রাজনীতি শুরু করেছে। বাংলাদেশে ব্রি-ধান ২৯ নিয়ে গোল্ডেন রাইসের ওপর গবেষণা করছে ব্রি। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সবুজ বিপ্লবের ধাক্কা প্রথম দিকে ধরতে না পারলেও, বাংলাদেশের জনগণ এতটা ‘দিন বা রাতকানা’ নয় যে গোল্ডেন রাইসের মাধ্যমে করপোরেট বীজ-বাণিজ্য বিস্তারকে ধরতে পারবে না। বাংলাদেশের নানা প্রান্তে কেবল কুড়িয়ে পাওয়া শাকের মাধ্যমেই ঐতিহাসিকভাবে ভিটামিন এ-এর চাহিদা পূরণ করে গ্রামীণ জনগণ। জিগলার যদি বাংলাদেশের জমিগুলোতে সিনজেন্টা, মনসান্টো ও বায়ারের মতো করপোরেট কোম্পানির ‘ঘাস মারার বিষ (হার্বিসাইড)’ বাণিজ্যকে বন্ধ করতে পারেন, তবে গ্রামীণ জনগণ নিজেরাই নিজেদের ভিটামিন ঘাটতি পূরণ করতে পারবে।
জিগলার জিই, জিএমও এবং হাইব্রিডকে পরিবেশবান্ধব বলেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভিন্নমত আছে। প্রায় ১০ হাজার বছর আগে, কৃষক ও জুমিয়ারাই ভিন্ন জলবায়ু ও সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের বীজকে আবাদি জাতে পরিণত করেছিলেন। আসুন, কৃষক-জুমিয়ার সেই জিনসম্পদকে আপন শক্তি ও মহিমায় বিকশিত হতে সবাই সহযোগিতা করি।
পঞ্চাশ বছর যথেষ্ট সময়। উফশী ও হাইব্রিডের পর আর কোনো ভোগান্তি বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণ ইরির কাছ থেকে প্রত্যাশা করে না। বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের লড়াকু ইতিহাস নিজেদের ‘অনুন্নত’ বীজবৈচিত্র্য দিয়েই তথাকথিত ‘আধুনিক’ গোল্ডেন রাইসের নয়া বীজ উপনিবেশ রুখতে প্রস্তুত।
পাভেল পার্থ: প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক।
animistbangla@yahoo.com
No comments