কেন ডাকসু-রাকসু নির্বাচন প্রয়োজন by এস এম আব্রাহাম লিংকন
দুই দশক থেকে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পাশাপাশি ছাত্রদের নিজস্ব সমস্যা সমাধান এবং ছাত্র নেতৃত্ব বিকাশের জন্য ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এসব ছাত্র সংসদ ছাত্রদের সমস্যা নিরসনের জন্য যেমন প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা রেখেছে, তেমনি ছাত্রদের বিভিন্নমুখী প্রতিভাসহ সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে বিশেষ অবদান রাখত।
ছাত্র সংসদ শুধু একদল ছাত্রকে অফিশিয়ালি নেতা তৈরি করত তা-ই নয়, বরং সাধারণ ছাত্রদের কাছে নির্বাচিতদের দায়বদ্ধ হতে তথা অনুগত থাকার শিক্ষা দিত। একজন ছাত্রনেতা যদি ভালো করতেন, তাহলে দেখতাম, তিনি পরের বার আরো বিপুল ভোটে নির্বাচিত হতেন। আমরা এ ক্ষেত্রে ডাকসুর ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামানের কথা বলতে পারি। মাহমুদুর রহমান মান্না তো চাকসুরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ শুধু নেতাই তৈরি করে না, বরং বহুমাত্রিক অবদান রাখে ছাত্রদের কল্যাণে। আমরা যদি ছাত্র সংসদগুলোর কাজের পরিধি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাই এর বহুমাত্রিকতা। ছাত্র সংসদের নির্বাচিত কর্তাদের পদবি দেখলে বোঝা যায়, কী কী কাজ একটি ছাত্র সংসদে হয়। ডাকসু-রাকসু এ দুটি প্রতিষ্ঠানের পদগুলো যদি দেখি, সেখানে সাহিত্য সম্পাদক, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, মহিলা সম্পাদক, পত্রিকা সম্পাদকের মতো পদগুলোর অস্তিত্ব পাই। এ পদে যাঁরা নির্বাচিত হতেন তাঁদের দায়িত্ব ছিল প্রতিষ্ঠানজুড়ে প্রতিবছর বিভিন্ন কার্যক্রম করা। আমরা ডাকসু, রাকসু, চাকসুর নির্বাচিত কর্মকর্তাদের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, সে সময় প্রতিবছর পত্রিকা প্রকাশিত হতো। পত্রিকার জন্য লেখা আহ্বান হতো। হতো প্রতিবছর সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সপ্তাহ। যার ভেতর দিয়ে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হতো উৎসবমুখর পরিবেশ। আবার প্রতিযোগিতাগুলোকে ছাত্র সংগঠনগুলো দেখত নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সুযোগ হিসেবে। যে সংগঠনের সদস্যরা বেশি পুরস্কার অর্জন করত, সে সংগঠনকে ছাত্ররা বেশি সমীহ করত। ডাকসু-রাকসু ছাত্রসমাজের প্রতিভা বিকাশে মূল ভূমিকা রাখত। একটি ছাত্র সংসদ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে অফিশিয়াল নেতা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রই নয়, বরং ছাত্রদের গণতান্ত্রিক ধারায় প্রবাহিত করারও এটি পরীক্ষিত পথ। এসব প্রতিষ্ঠান ছাত্রদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তৈরির সোপান। এখানে যেসব নেতৃত্ব তৈরি হন তাঁরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। নাম উল্লেখ না করে নির্দ্বিধায় বলা যায়, যাঁরা রাকসু, ডাকসুর নেতা থেকেছেন তাঁরা সবাই দেশের উজ্জ্বল নাগরিক হিসেবে পরিচিত।
আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতি সেশনে নির্বাচন আশা করি। কারণ একজন ছাত্র যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত অন্যান্য ফির সঙ্গে ছাত্র সংসদ ফি নামের ফি দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া সাহিত্য-সংস্কৃতি খাতে ছাত্রদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যদি ছাত্ররা ছাত্র সংসদ ফি দিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অধিকার থেকে কোন অজুহাতে দুই দশককাল রহিত করা হয়েছে? যিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি যোগ দেওয়ার প্রাক্কালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্বর নির্বাচন করবেন; কিন্তু প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেন না। কী কারণে পারেন না, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আর যেসব কারণ আমাদের সামনে উপস্থাপিত হতে দেখি তা হাস্যকর। ছাত্ররা চায় না, সংগঠনগুলো প্রস্তুত নয় বা পরিবেশ নেই প্রভৃতি কথা কোনো অজুহাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। ছাত্ররা ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দলগতভাবে অংশ নিলেও প্রকৃত অর্থে সংগঠনগতভাবে একজন ছাত্রের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যিনি মনোনয়ন দাখিল করেন তিনি এক প্রস্তাবক, এক সমর্থক এবং নিজে কোন বিভাগের কোন বর্ষের ছাত্র তাঁর রোল কত তা মনোনয়নপত্রে উল্লেখ করেন। সেখানে প্রার্থী ছাত্রলীগ না ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য তার উল্লেখ থাকে না। যদি না থাকে তাহলে ছাত্র সংগঠন প্রস্তুত নয় বা সরকার রাজি নয় প্রভৃতি কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায় থেকে পরিত্রাণের অজুহাত হিসেবে উপস্থাপন করেন। কথা হচ্ছে, রাষ্ট্র যদি সংসদ নির্বাচন, পৌর নির্বাচন, বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বা মেট্রোপলিটন নির্বাচন করতে পারেন তাহলে কেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন নয়?
দুই দশকে কয়জন ছাত্রকেও বলতে শুনেছি তাঁরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন চান না? একটি নির্বাচন হওয়ার জন্য ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষাই যথেষ্ট। এ রকম আকাঙ্ক্ষার ঘাটতি, কমতি ছাত্রদের মধ্যে পরিলক্ষিত নয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচন অব্যাহত রাখা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রক্ত সঞ্চালনের মতো অত্যাবশ্যকীয়। আজকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গে যে অসহিষ্ণুতা, অগণতান্ত্রিক মনোভাব তার কারণও কিন্তু এটি।
নব্বইয়ের দশকের পর যেসব শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন তাঁরা আজ অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। তাঁদের অনেকের ভাবনা ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় চলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের ভোট হচ্ছে না; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। তাঁরা মনে করেন, নির্বাচন করতে যেসব ঝক্কি-ঝামেলা তার চেয়ে না হওয়াই ভালো। এ ধরনের নেতিবাচক ভাবনা সাময়িক পরিত্রাণ হয়তো কর্তাদের দেয়; কিন্তু এর কুফল অনেক সুদূরপ্রসারী। নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কোনো প্রতিষ্ঠানে সচল না থাকা মানে সেই প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের মধ্যে গণতন্ত্রবিরোধী মানসিকতার বিকাশ লাভ করা। আজকে যার শিকার শিক্ষক, আমলা বা রাষ্ট্রের প্রায় সব শাখা। যে অফিসেই যাবেন সেখানেই রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। যেন সব দোষ রাজনীতিবিদদের। অন্য আর কারোরই কোনো ভূমিকা। তাঁরা সবাই ফেরেশতা। সেসব আলোচনার বিষয় নয়, কথা হচ্ছে দেশের ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক ধারা চালু করা না যায়, তবে নতুন প্রজন্মের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কেতাবি থাকবে। আজকে প্রজন্মের ভেতরে যে রাজনীতিবিরোধী মনোভাব ও অসহিষ্ণুতা বিদ্যমান, তার কারণও কিন্তু ছাত্রদের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব। যে ছাত্র গণতন্ত্রহীন পরিবেশে তার শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেছেন তিনি অসহিষ্ণু হলে সে দায় কিন্তু তার ওপর দেওয়া যাবে না_এর জন্য দায়ী কর্তারা। গণতন্ত্র কায়েম এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতা সৃষ্টির জন্য ছাত্রদের মধ্যে নির্বাচনের বিকল্প নেই। একটি নির্বাচন তা ছাত্র সংসদই হোক আর জাতীয় নির্বাচনই হোক, সেটি গণতন্ত্রের চূড়ান্ত রূপ। যদি প্রকৃত অর্থে একটি গণতান্ত্রিক প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাই, তবে ছাত্র সমাজের মধ্যে গণতান্ত্রিক ধারার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এ জন্য চাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
ছাত্র সংসদ চালু হলে দীর্ঘমেয়াদে ছাত্ররাজনীতিতে যে দস্যুবৃত্তি তৈরি হয়েছে তার দ্রুত অবসান হবে। ছাত্ররা অসুস্থ ধারা থেকে সুস্থ প্রতিযোগিতায় ফিরে আসবে। ঢাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব। নির্বাচিত ডাকসু-রাকসু মতিয়া, মেনন, তোফায়েল, রব, সেলিম, মান্না, আখতার, আবু সাঈদ, বাদশা, টুকু, ঠাণ্ডু, মুন্না বাবু রিজভীর মতো চৌকস নেতা তৈরি করতে পারবে, যে নেতৃত্ব দেশের দুর্দিনে রাজগৃহ ত্যাগ করে রাজপথের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে দ্বিধা করবে না। আশা করব, সংশ্লিষ্টরা নিজেদের বিজয়ের জন্য নয়, বরং গণতন্ত্রের বিজয়ের জন্য দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দ্রুত ব্যবস্থা করবেন।
লেখক : আইনজীবী, সাবেক এজিএস-রাকসু ও
রাবির সাবেক সিনেটর
lncoln_bd@yahoo.com
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ শুধু নেতাই তৈরি করে না, বরং বহুমাত্রিক অবদান রাখে ছাত্রদের কল্যাণে। আমরা যদি ছাত্র সংসদগুলোর কাজের পরিধি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাই এর বহুমাত্রিকতা। ছাত্র সংসদের নির্বাচিত কর্তাদের পদবি দেখলে বোঝা যায়, কী কী কাজ একটি ছাত্র সংসদে হয়। ডাকসু-রাকসু এ দুটি প্রতিষ্ঠানের পদগুলো যদি দেখি, সেখানে সাহিত্য সম্পাদক, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, মহিলা সম্পাদক, পত্রিকা সম্পাদকের মতো পদগুলোর অস্তিত্ব পাই। এ পদে যাঁরা নির্বাচিত হতেন তাঁদের দায়িত্ব ছিল প্রতিষ্ঠানজুড়ে প্রতিবছর বিভিন্ন কার্যক্রম করা। আমরা ডাকসু, রাকসু, চাকসুর নির্বাচিত কর্মকর্তাদের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, সে সময় প্রতিবছর পত্রিকা প্রকাশিত হতো। পত্রিকার জন্য লেখা আহ্বান হতো। হতো প্রতিবছর সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সপ্তাহ। যার ভেতর দিয়ে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হতো উৎসবমুখর পরিবেশ। আবার প্রতিযোগিতাগুলোকে ছাত্র সংগঠনগুলো দেখত নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সুযোগ হিসেবে। যে সংগঠনের সদস্যরা বেশি পুরস্কার অর্জন করত, সে সংগঠনকে ছাত্ররা বেশি সমীহ করত। ডাকসু-রাকসু ছাত্রসমাজের প্রতিভা বিকাশে মূল ভূমিকা রাখত। একটি ছাত্র সংসদ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে অফিশিয়াল নেতা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রই নয়, বরং ছাত্রদের গণতান্ত্রিক ধারায় প্রবাহিত করারও এটি পরীক্ষিত পথ। এসব প্রতিষ্ঠান ছাত্রদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তৈরির সোপান। এখানে যেসব নেতৃত্ব তৈরি হন তাঁরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। নাম উল্লেখ না করে নির্দ্বিধায় বলা যায়, যাঁরা রাকসু, ডাকসুর নেতা থেকেছেন তাঁরা সবাই দেশের উজ্জ্বল নাগরিক হিসেবে পরিচিত।
আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতি সেশনে নির্বাচন আশা করি। কারণ একজন ছাত্র যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত অন্যান্য ফির সঙ্গে ছাত্র সংসদ ফি নামের ফি দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া সাহিত্য-সংস্কৃতি খাতে ছাত্রদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যদি ছাত্ররা ছাত্র সংসদ ফি দিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অধিকার থেকে কোন অজুহাতে দুই দশককাল রহিত করা হয়েছে? যিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি যোগ দেওয়ার প্রাক্কালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্বর নির্বাচন করবেন; কিন্তু প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেন না। কী কারণে পারেন না, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আর যেসব কারণ আমাদের সামনে উপস্থাপিত হতে দেখি তা হাস্যকর। ছাত্ররা চায় না, সংগঠনগুলো প্রস্তুত নয় বা পরিবেশ নেই প্রভৃতি কথা কোনো অজুহাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। ছাত্ররা ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দলগতভাবে অংশ নিলেও প্রকৃত অর্থে সংগঠনগতভাবে একজন ছাত্রের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যিনি মনোনয়ন দাখিল করেন তিনি এক প্রস্তাবক, এক সমর্থক এবং নিজে কোন বিভাগের কোন বর্ষের ছাত্র তাঁর রোল কত তা মনোনয়নপত্রে উল্লেখ করেন। সেখানে প্রার্থী ছাত্রলীগ না ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য তার উল্লেখ থাকে না। যদি না থাকে তাহলে ছাত্র সংগঠন প্রস্তুত নয় বা সরকার রাজি নয় প্রভৃতি কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায় থেকে পরিত্রাণের অজুহাত হিসেবে উপস্থাপন করেন। কথা হচ্ছে, রাষ্ট্র যদি সংসদ নির্বাচন, পৌর নির্বাচন, বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বা মেট্রোপলিটন নির্বাচন করতে পারেন তাহলে কেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন নয়?
দুই দশকে কয়জন ছাত্রকেও বলতে শুনেছি তাঁরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন চান না? একটি নির্বাচন হওয়ার জন্য ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষাই যথেষ্ট। এ রকম আকাঙ্ক্ষার ঘাটতি, কমতি ছাত্রদের মধ্যে পরিলক্ষিত নয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচন অব্যাহত রাখা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রক্ত সঞ্চালনের মতো অত্যাবশ্যকীয়। আজকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গে যে অসহিষ্ণুতা, অগণতান্ত্রিক মনোভাব তার কারণও কিন্তু এটি।
নব্বইয়ের দশকের পর যেসব শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন তাঁরা আজ অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। তাঁদের অনেকের ভাবনা ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় চলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের ভোট হচ্ছে না; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। তাঁরা মনে করেন, নির্বাচন করতে যেসব ঝক্কি-ঝামেলা তার চেয়ে না হওয়াই ভালো। এ ধরনের নেতিবাচক ভাবনা সাময়িক পরিত্রাণ হয়তো কর্তাদের দেয়; কিন্তু এর কুফল অনেক সুদূরপ্রসারী। নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কোনো প্রতিষ্ঠানে সচল না থাকা মানে সেই প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের মধ্যে গণতন্ত্রবিরোধী মানসিকতার বিকাশ লাভ করা। আজকে যার শিকার শিক্ষক, আমলা বা রাষ্ট্রের প্রায় সব শাখা। যে অফিসেই যাবেন সেখানেই রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। যেন সব দোষ রাজনীতিবিদদের। অন্য আর কারোরই কোনো ভূমিকা। তাঁরা সবাই ফেরেশতা। সেসব আলোচনার বিষয় নয়, কথা হচ্ছে দেশের ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক ধারা চালু করা না যায়, তবে নতুন প্রজন্মের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কেতাবি থাকবে। আজকে প্রজন্মের ভেতরে যে রাজনীতিবিরোধী মনোভাব ও অসহিষ্ণুতা বিদ্যমান, তার কারণও কিন্তু ছাত্রদের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব। যে ছাত্র গণতন্ত্রহীন পরিবেশে তার শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেছেন তিনি অসহিষ্ণু হলে সে দায় কিন্তু তার ওপর দেওয়া যাবে না_এর জন্য দায়ী কর্তারা। গণতন্ত্র কায়েম এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতা সৃষ্টির জন্য ছাত্রদের মধ্যে নির্বাচনের বিকল্প নেই। একটি নির্বাচন তা ছাত্র সংসদই হোক আর জাতীয় নির্বাচনই হোক, সেটি গণতন্ত্রের চূড়ান্ত রূপ। যদি প্রকৃত অর্থে একটি গণতান্ত্রিক প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাই, তবে ছাত্র সমাজের মধ্যে গণতান্ত্রিক ধারার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এ জন্য চাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
ছাত্র সংসদ চালু হলে দীর্ঘমেয়াদে ছাত্ররাজনীতিতে যে দস্যুবৃত্তি তৈরি হয়েছে তার দ্রুত অবসান হবে। ছাত্ররা অসুস্থ ধারা থেকে সুস্থ প্রতিযোগিতায় ফিরে আসবে। ঢাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব। নির্বাচিত ডাকসু-রাকসু মতিয়া, মেনন, তোফায়েল, রব, সেলিম, মান্না, আখতার, আবু সাঈদ, বাদশা, টুকু, ঠাণ্ডু, মুন্না বাবু রিজভীর মতো চৌকস নেতা তৈরি করতে পারবে, যে নেতৃত্ব দেশের দুর্দিনে রাজগৃহ ত্যাগ করে রাজপথের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে দ্বিধা করবে না। আশা করব, সংশ্লিষ্টরা নিজেদের বিজয়ের জন্য নয়, বরং গণতন্ত্রের বিজয়ের জন্য দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দ্রুত ব্যবস্থা করবেন।
লেখক : আইনজীবী, সাবেক এজিএস-রাকসু ও
রাবির সাবেক সিনেটর
lncoln_bd@yahoo.com
No comments