চারদিক-ঘোড়ার গাড়ির কথা by কিঙ্কর আহ্সান
বকশীবাজার মোড়। নোংরা, স্যাঁতসেঁতে পথ। হাজারো রিকশার আনাগোনা এখানে। পথ ধরে একটু এগোলেই টংমতো দোকান। দিনমান এ জায়গায় চা, বিড়ি, পান দেদার বিক্রি হয়। পাশেই সার বেঁধে দাঁড় করানো রিকশার ওপর শুয়েবসে জিরিয়ে নিচ্ছেন রিকশাওয়ালারা।
বিকেলের শেষভাগ তবুও রোদ্দুর খুব। মস্ত সূর্যটা যেন গাছের মগডালে নেমে এসে থিতু হতে চায়। এর মাঝেই দেখতে পাই হাড় জিরজিরে কিছু ঘোড়া। ময়লার রাজত্ব চারপাশটায়। ভনভন করে উড়ছে মাছি। ঢুলুঢুলু চোখ ঘোড়াগুলোর। ধীরে ধীরে চিবিয়ে খাচ্ছে কী যেন। বোঝাই যায়, খুব অসুস্থ। এমন ঘোড়া দেখে হতাশ হই। কল্পনার সঙ্গে মেলে না কিছুই। কোথায় সেই রূপকথার বইয়ে ঠাঁই পাওয়া রাজসিক ঘোড়া, যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতিকে পিঠে নিয়ে বাধাহীনভাবে ছুটে চলা তাদের, সেনাদের তলোয়ার তলোয়ারে ঠোকাঠুকি, ঝনাৎ ঝনাৎ আওয়াজ আর কোথায় এই ম্যাড়মেড়ে রোগা ঘোড়া! বীরত্বের লেশমাত্র নেই এই এদের মধ্যে। নেই কোনো তেজ। নিজেকে জানান দেওয়ার জন্য নেই অযথা ডাকাডাকি করার অভ্যাস।
রোগা ঘোড়াগুলো বড্ড শান্ত। সাত চড়েও রা নেই এদের। হুট করে ঘোড়ার মালিককে পেয়ে কথা বলা শুরু করি। মুখে পান তাঁর। লোকটা বুড়ো। তার পরও দাদু বলে সম্বোধন করায় কিছুটা বিরক্ত হন। শুরু হয় আলাপচারিতা।
—দাদু ঘোড়াগুলোর এই অবস্থা কেন?
—গরিব মানু আমরা। নিজেরই ঠিক নাই, ঘোড়ার দিকে নজর দিমু ক্যামনে।
—আস্তাবল নেই কোনো?
—না। ঘোড়া দিয়া আয় নাই অখন আর। ঘোড়ার গাড়িরও কদর নাই। রাস্তার লগে দেয়ালে সবগুলারে ঠেস দিয়া বাইন্ধা থুই। হাবিজাবি খাইতে দেই।
—আয় নেই কেন?
—ক্যামনে থাকব। মানু অখন ইঞ্জিন ছাড়া চলে না। চাইর চাক্কার গাড়িই ভরসা। পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলে লোকটি।
—বাড়িতে বউ আর ছেলেপুলে নিয়ে চলতে পারেন ঠিকমতো?—ঘোড়ার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে পরিবারের কথা তুলি।
—অই চলে আরকি। বড়লুকগো বিয়ায় দুই-একটা খ্যাপ পাই। ঘোড়ার গাড়িতে চইরা বউ-জামাই যায়। তহন আয় ভালো। বকশিশও আছে। তয় বারো মাইস তো আর বিয়া-শাদি হয় না। কথা শেষ করেই উঠে পড়ে লোকটি। কী নিয়ে যেন ব্যস্ত হয়ে ওঠে আরেকজনের সঙ্গে। বুঝতে পারি, আলাপ জমানোর ইচ্ছা নেই। আমি আর কথা বাড়াই না। ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়ানো ঘোড়াগুলো দেখতে থাকি এক এক করে।
গলায় দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা তাদের। জোরাজুরির কারণে দড়ির নিচের চামড়ায় পড়েছে দাগ। শরীরজুড়ে ক্ষতচিহ্ন। চর্মরোগের শিকার সবগুলো ঘোড়া। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এদের বাস। আগে এমনটা ছিল না। শৌখিন মানুষ ঘোড়ার গাড়ি পছন্দ করায় এর চাহিদা ছিল বেশ। যত্ন নেওয়া হতো ঘোড়াগুলোর। অনেকেই জড়িত ছিল ঘোড়ার গাড়ি চালানোর মতো আনন্দদায়ক পেশায়। এর পরিমাণটা কমে গিয়ে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। পুরান ঢাকার কিছু কিছু মানুষ এখনো ছুটির দিনে পুরো পরিবার নিয়ে ঠেসেঠুসে চরে বসেন ঘোড়ার গাড়িতে। অনেক কম খরচে উসুল হয় ষোলআনা আনন্দ। বাস-গাড়ির পাশেই সমান ছন্দ নিয়ে চলতে দেখা যায় ঘোড়াগুলোকে। নবাবি হালে ঘুরে বেড়ায় তারা। চালক বেত ঘুড়িয়ে সপাং সপাং মারে এদের শরীরে। বেড়ে যায় গতি। এসব দৃশ্য পরিচিত হলেও এখন আর হরহামেশা চোখে পড়ে না। আয় কমার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ির চালকেরাও বদলান পেশা। কমে যায় ঘোড়ার সংখ্যা। তবুও নিজ নিজ ঘোড়া আর পুরোনো পেশার প্রতি ভালোবাসার টানে থেকে যান কেউ কেউ। টিঙটিঙে ঘোড়া নিয়ে নেমে পড়েন পথে।
ঘোড়া নিয়ে এলেবেলে ভাবনা ভাবতে ভাবতে কেটে যায় সময়। ওদের দুরবস্থা দেখে খারাপ হয় মন। জানা নেই কীভাবে ঘোড়াগুলোকে তরতাজা করে তোলা যায়। গাড়ির ভিড় সরিয়ে আবার নিয়ে আসা যায় পথে। বিকেল আর সন্ধ্যা শেষ হয়ে অবশেষে নামে রাত। সূর্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আকাশের দখল নিয়ে নেয় চাঁদ। ডজনখানেক তারাও উঠি উঠি করে। আমি ঘোড়াগুলোকে পেছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করি। একটা সময় সবকিছু দৃষ্টির বাইরে চলে যেতেই পিছু নেয় চাঁদটা। মন খারাপ করা আস্ত একটা চাঁদ আসতে থাকে পেছন পেছন। শরীরভর্তি আলো নিয়ে। বড্ড আপন এ আলো...।
রোগা ঘোড়াগুলো বড্ড শান্ত। সাত চড়েও রা নেই এদের। হুট করে ঘোড়ার মালিককে পেয়ে কথা বলা শুরু করি। মুখে পান তাঁর। লোকটা বুড়ো। তার পরও দাদু বলে সম্বোধন করায় কিছুটা বিরক্ত হন। শুরু হয় আলাপচারিতা।
—দাদু ঘোড়াগুলোর এই অবস্থা কেন?
—গরিব মানু আমরা। নিজেরই ঠিক নাই, ঘোড়ার দিকে নজর দিমু ক্যামনে।
—আস্তাবল নেই কোনো?
—না। ঘোড়া দিয়া আয় নাই অখন আর। ঘোড়ার গাড়িরও কদর নাই। রাস্তার লগে দেয়ালে সবগুলারে ঠেস দিয়া বাইন্ধা থুই। হাবিজাবি খাইতে দেই।
—আয় নেই কেন?
—ক্যামনে থাকব। মানু অখন ইঞ্জিন ছাড়া চলে না। চাইর চাক্কার গাড়িই ভরসা। পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলে লোকটি।
—বাড়িতে বউ আর ছেলেপুলে নিয়ে চলতে পারেন ঠিকমতো?—ঘোড়ার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে পরিবারের কথা তুলি।
—অই চলে আরকি। বড়লুকগো বিয়ায় দুই-একটা খ্যাপ পাই। ঘোড়ার গাড়িতে চইরা বউ-জামাই যায়। তহন আয় ভালো। বকশিশও আছে। তয় বারো মাইস তো আর বিয়া-শাদি হয় না। কথা শেষ করেই উঠে পড়ে লোকটি। কী নিয়ে যেন ব্যস্ত হয়ে ওঠে আরেকজনের সঙ্গে। বুঝতে পারি, আলাপ জমানোর ইচ্ছা নেই। আমি আর কথা বাড়াই না। ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়ানো ঘোড়াগুলো দেখতে থাকি এক এক করে।
গলায় দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা তাদের। জোরাজুরির কারণে দড়ির নিচের চামড়ায় পড়েছে দাগ। শরীরজুড়ে ক্ষতচিহ্ন। চর্মরোগের শিকার সবগুলো ঘোড়া। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এদের বাস। আগে এমনটা ছিল না। শৌখিন মানুষ ঘোড়ার গাড়ি পছন্দ করায় এর চাহিদা ছিল বেশ। যত্ন নেওয়া হতো ঘোড়াগুলোর। অনেকেই জড়িত ছিল ঘোড়ার গাড়ি চালানোর মতো আনন্দদায়ক পেশায়। এর পরিমাণটা কমে গিয়ে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। পুরান ঢাকার কিছু কিছু মানুষ এখনো ছুটির দিনে পুরো পরিবার নিয়ে ঠেসেঠুসে চরে বসেন ঘোড়ার গাড়িতে। অনেক কম খরচে উসুল হয় ষোলআনা আনন্দ। বাস-গাড়ির পাশেই সমান ছন্দ নিয়ে চলতে দেখা যায় ঘোড়াগুলোকে। নবাবি হালে ঘুরে বেড়ায় তারা। চালক বেত ঘুড়িয়ে সপাং সপাং মারে এদের শরীরে। বেড়ে যায় গতি। এসব দৃশ্য পরিচিত হলেও এখন আর হরহামেশা চোখে পড়ে না। আয় কমার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ির চালকেরাও বদলান পেশা। কমে যায় ঘোড়ার সংখ্যা। তবুও নিজ নিজ ঘোড়া আর পুরোনো পেশার প্রতি ভালোবাসার টানে থেকে যান কেউ কেউ। টিঙটিঙে ঘোড়া নিয়ে নেমে পড়েন পথে।
ঘোড়া নিয়ে এলেবেলে ভাবনা ভাবতে ভাবতে কেটে যায় সময়। ওদের দুরবস্থা দেখে খারাপ হয় মন। জানা নেই কীভাবে ঘোড়াগুলোকে তরতাজা করে তোলা যায়। গাড়ির ভিড় সরিয়ে আবার নিয়ে আসা যায় পথে। বিকেল আর সন্ধ্যা শেষ হয়ে অবশেষে নামে রাত। সূর্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আকাশের দখল নিয়ে নেয় চাঁদ। ডজনখানেক তারাও উঠি উঠি করে। আমি ঘোড়াগুলোকে পেছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করি। একটা সময় সবকিছু দৃষ্টির বাইরে চলে যেতেই পিছু নেয় চাঁদটা। মন খারাপ করা আস্ত একটা চাঁদ আসতে থাকে পেছন পেছন। শরীরভর্তি আলো নিয়ে। বড্ড আপন এ আলো...।
No comments