গণমাধ্যম-পেশাদারিত্ব মানে কেবল নিরপেক্ষতা নয় by সাখাওয়াত আলী খান

সংবাদপত্র জগতে গত দুই দশক ধরে যে বৃহৎ পুঁজি প্রবেশ করছে, সেটাকেও কেউ কেউ নেতিবাচক হিসেবে চিত্রিত করেন। আমি এটাকে ইতিবাচক অর্থেই দেখতে চাই। ভুলে যাওয়া চলবে না যে, আমরা এখন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বসবাস করছি। সরকার থেকে সাধারণ মানুষ এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
সংবাদপত্র এই ব্যবস্থার বাইরে থাকবে কীভাবে? বড় পুঁজি বিনিয়োগ হওয়ার কারণে বরং সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বেড়েছে। আমি সংবাদপত্রে পুঁজির আগমনকে স্বাগত জানাই। তবে সংবাদপত্র যে এখনও উৎপাদন অর্থে 'শিল্প' হয়ে উঠতে পারেনি, তাও বলতে হবে। এ জন্য সাংবাদিক ও মালিকদের একযোগে কাজ করতে হবে

দেখতে দেখতে আট বছরে পা দিয়েছে দৈনিক সমকাল। কেবল বয়স বাড়েনি, 'ভালো পত্রিকা' হিসেবে ভাবমূর্তিও অর্জন করতে পেরেছে। অস্বীকার করা যাবে না, সংবাদপত্র সম্পর্কে আজকাল সমাজে নেতিবাচক কথাই বেশি শোনা যায়। আমার কিন্তু মনে হয়, এর ইতিবাচকতাই প্রধান। সরাসরি সাংবাদিক না হলেও আমার যেহেতু সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে, কেউ কেউ বলতে পারেন যে আমার পক্ষে এমন সাফাই গাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমি আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করি, সংবাদপত্র শিল্পে গত ছয় দশকের বেশি সময়ে প্রভূত উন্নয়ন ও ইতিবাচকতার সমন্বয় ঘটেছে।
আমি দেশ বিভাগের সময় থেকেই ঢাকার বাসিন্দা। চোখের সামনে দেখছি ঢাকা কীভাবে বড় হয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে। একই সঙ্গে এই শহরে সংবাদপত্রের বিস্তৃতিও আমার চোখের সামনে ঘটেছে। এটা ঠিক, ঢাকায় যেভাবে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা ঋদ্ধ হয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে, সেই নজির দেশের অন্যান্য অংশে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এখনও মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। আমাদের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক বিষয়াবলিও কি রাজধানীকেন্দ্রিক নয়?
বস্তুত ঢাকা শহরের সঙ্গে বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের একটা মিল আমি খুঁজে পাই। ঢাকার মতোই আমাদের সংবাদপত্র জগৎ বিশাল হয়েছে। 'বিশাল' শব্দটি আমি সচেতনভাবেই বলছি। কারণ ১৯৪৭ সালে ঢাকা শহর থেকে একটি দৈনিক সংবাদপত্রও প্রকাশ হতো না। যে কারণে দৈনিক আজাদকে রাতারাতি কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তর হতে হয়েছিল। এখন তো ঢাকা থেকেই কত দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ হয়! কিন্তু এই বৃদ্ধি ঢাকা শহরের মতোই অপরিকল্পিত। পরিকল্পিত প্রসার হলে নিঃসন্দেহে ভালো হতো। কিন্তু যা হয়েছে, তাও কম শ্লাঘার নয়।
ছাপা মাধ্যমের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা উঠেছে অনেক আগে। বলা হচ্ছে, সংবাদপত্রের দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনাযোগ্য। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি, এখানকার সংবাদমাধ্যম আরও অনেক দিন, বলা চলে সামনের শতকজুড়েই সংবাদপত্রের শাসনাধীনে থাকবে। এটা ঠিক, পশ্চিমা বিশ্বে কোনো কোনো সংবাদপত্র বিপর্যয়ে পড়েছে। কিন্তু সেটা যে ছাপা মাধ্যমেরই ব্যর্থতা, কে নিশ্চিত করে বলতে পারে? সেখানে কি ব্যাংক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না? আর আমাদের দেশে সংবাদপত্র আরও বহু বছর দাপটের সঙ্গে টিকে থাকবে অনেক কারণে। প্রথমত, আমাদের সাক্ষরতার হার এখনও কম। এটা যত বাড়বে, সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা তত বাড়বে। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের জনমানসে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের চেয়ে সংবাদপত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা এখনও বেশি। এই আস্থা পুঁজি করেই সংবাদপত্র আরও বহুদিন অগ্রগতি ধরে রাখতে পারবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি।
অস্বীকার করব না যে, সংবাদপত্রের প্রভাব ও অবকাঠামোগত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিছু নেতিবাচক উপাদানও বাড়ছে। যেমন দুর্নীতির অভিযোগ। আগে যারা সংবাদপত্রে কাজ করতে আসতেন, তাদের সামনে একটা মিশন থাকত। সাংবাদিকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করার মানসিকতা থাকত। এখন সেটা কম দেখা যায়। সংবাদপত্রের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস অটুট রাখতে হলে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বের হয়ে আসা জরুরি।
সংবাদপত্রে দুর্নীতি প্রবেশের একটি কারণ এর সঙ্গে রাজনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা। রাজনীতিকরা সংবাদপত্রকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। ফলে দূষিত রাজনীতির দূষণ সংবাদপত্রেও কখনও কখনও সংক্রমিত হতে দেখি আমরা। রাজনীতিতে যেমন মতলববাজ মানুষের ভিড় বেড়েছে, সংবাদপত্রেও মতলববাজদের দেখা যাচ্ছে কখনও কখনও। ব্রিটিশ শাসনামলে, পাকিস্তান শাসনামলে আমরা 'আন্ডারগ্রাউন্ড' রাজনীতিকদের সমীহ করতাম, শ্রদ্ধা করতাম। এখন রাজনীতিতে যে 'আন্ডারওয়ার্ল্ডে'র যোগসাজশের কথা শোনা যায়, তা স্বস্তিকর নয়। আরও অস্বস্তিকর হচ্ছে, সংবাদপত্র জগতেও এখন 'আন্ডারগ্রাউন্ড' কথাটা যুক্ত হয়েছে। এ থেকে মুক্ত হতেই হবে।
পেশাদারিত্বের অভাবও এখন চোখে পড়ে। পেশাদারিত্ব মানে কেবল নিরপেক্ষতা নয়। তার চেয়ে বেশি কিছু। যেমন যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে আমরা কি তথাকথিত নিরপেক্ষতা দেখাব? আমি মনে করি, পেশাদারিত্ব হচ্ছে নিজের পেশার প্রতি সততা ও নিষ্ঠা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজের বিবেকের ডাককে প্রাধান্য দেওয়া।
এ ক্ষেত্রে নীতিমালার কথা বলা হয়ে থাকে। বর্তমান সরকারও কিছুদিন আগে সংবাদমাধ্যমের নীতিমালার প্রতি জোর দেওয়ার কথা বলেছে। আমি মনে করি, সেটা বাইরে থেকে চাপিয়ে দিলে চলবে না। আমরা প্রেস কাউন্সিল গঠন করেছি। আমিও তার সদস্য। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, প্রেস কাউন্সিল কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। এর একটি কারণ হচ্ছে, এটা সরকার গঠন করে দিয়েছে। সাংবাদিক সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই এমন একটি প্রতিষ্ঠান হতে হবে। নীতিমালা প্রণীত হতে হবে সাংবাদিকদের মত নিয়েই। সারাবিশ্বেই এই চর্চা চলে আসছে।
সংবাদপত্র জগতে গত দুই দশক ধরে যে বৃহৎ পুঁজি প্রবেশ করছে, সেটাকেও কেউ কেউ নেতিবাচক হিসেবে চিত্রিত করেন। আমি এটাকে ইতিবাচক অর্থেই দেখতে চাই। ভুলে যাওয়া চলবে না যে, আমরা এখন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বসবাস করছি। সরকার থেকে সাধারণ মানুষ এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সংবাদপত্র এই ব্যবস্থার বাইরে থাকবে কীভাবে? বড় পুঁজি বিনিয়োগ হওয়ার কারণে বরং সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বেড়েছে। আমি সংবাদপত্রে পুঁজির আগমনকে স্বাগত জানাই। তবে সংবাদপত্র যে এখনও উৎপাদন অর্থে 'শিল্প' হয়ে উঠতে পারেনি, তাও বলতে হবে। এ জন্য সাংবাদিক ও মালিকদের একযোগে কাজ করতে হবে।
সে জন্য সবার আগে দরকার স্থিতিশীলতা। সাধারণভাবে প্রত্যাশা করা হয়ে থাকে যে, সংবাদপত্রে বিনিয়োগকারী কেবল বিনিয়োগই করবেন। এর নীতিগত ও ব্যবহারিক দিক দেখভাল করবেন সাংবাদিক সম্প্রদায়ের কেউ। তিনি যেমন সাংবাদিকতায় দক্ষ হবেন, তেমনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আস্থা থাকবে তার ওপর। সংবাদপত্র নিছক প্রচারপত্র নয়, আবার শতভাগ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও নয়। সংবাদপত্রের প্রতি সমাজের প্রত্যাশা থাকে। যে কারণে সংবাদপত্র হচ্ছে রাষ্ট্রের 'চতুর্থ স্তম্ভ'। তিনটি স্তম্ভ যখন প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না, তখন মানুষ চতুর্থ স্তম্ভের কাছে যায়।
আমরা প্রত্যাশা করে থাকি, একজন যোগ্য সাংবাদিক সংবাদপত্রটির সম্পাদক হিসেবে সর্বময় দায়িত্ব পালন করবেন। মালিক নয়, সম্পাদকই সংবাদপত্রের ব্যবসা ও নীতির সমন্বয় করবেন। মালিকের কাজ হচ্ছে, সম্পাদককে স্বস্তিতে রাখা। সম্পাদক যদি তার কাজে স্বস্তিবোধ না করেন, সে সংবাদপত্র যে স্থিতিশীল হয় না, সে উদাহরণ আমাদের দেশেই রয়েছে। বস্তুত করপোরেট ব্যবস্থাপনারও এটাই নিয়ম। প্রধান নির্বাহীকে স্বস্তি দিতে হবে।
এসব ভেতরের কথা। বাইরের সমাজেও সংবাদপত্র নিয়ে একটি মহল 'অসন্তুষ্ট' থাকে। সাংবাদিকরা যে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের স্বার্থে আঘাত হানতে চান, সেই শক্তিকে বারবার প্রত্যাঘাত করতে চায় ওই মহল। এর একটিই জবাব। সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যই পারে সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষা করতে এবং সমাজের অপশক্তিগুলোকে দুর্বল করে দিতে।
সমকালের আট বছরে পদার্পণ উপলক্ষে সাংবাদিক সম্প্রদায়ের ঐক্য, সংহতি ও সমৃদ্ধিই কামনা করি।

অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী
খান :গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.