ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে-সংবিধান সংশোধন

পঞ্চম সংশোধনী মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধন এবং বিদ্যমান সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর কিংবা একে অধিকতর কার্যকর করা—দুটো আলাদা বিষয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, বাংলাদেশ সংবিধানের ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার দরকার। একটি উপযুক্ত সংবিধান সংস্কার কমিশন বা কমিটির মাধ্যমেই কাজটি করা সম্ভব।


সরকারি দলের উদ্যোগে বুধবার সংবিধান সংশোধনে ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা সংবিধানের যে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার প্রত্যাশা করে আসছি, তা এ কমিটির আওতাভুক্ত কি না, স্পষ্ট নয়।
দেশের প্রধান দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও মতৈক্যের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন হবে—সেটাই প্রত্যাশিত। বিএনপি এই কমিটিতে যোগ না দেওয়ায় সে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আমরা মনে করি, প্রধান বিরোধী দল এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি। তাদের উচিত ছিল, সরকারি দলের সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগে নিজেদের মতামত ও অবস্থান তুলে ধরা। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি সে দায়িত্ব কার্যত উপেক্ষা করল। তবে বুধবার সংসদে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেখানে ভবিষ্যতে বিএনপির সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির পথ খোলা রাখার সুযোগ রাখা উচিত।
আমরা মনে করি, বিশেষ সংসদীয় কমিটির কার্যপরিধি শুধু আদালতের রায় বাস্তবায়নের মধ্যে সীমিত রাখা ঠিক হবে না। এখানে ব্যাপকতার সুযোগ রাখা উচিত। অন্যদিকে পঞ্চম সংশোধনী মামলার বিষয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো পাওয়া যায়নি। ফলে এই রায় না পাওয়া পর্যন্ত সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত আলোচনা ধোঁয়াচ্ছন্ন থেকে যাবে।
ক্ষমতাসীন দলের চিন্তাচেতনায় যে ‘বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরা’র বিষয়টি সবচেয়ে ক্রিয়াশীল, তা স্পষ্ট। আক্ষরিক অর্থে বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার সুযোগ সীমিত। হাইকোর্ট বিভাগের রায়েও কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার মতো কোনো ঢালাও নির্দেশনা নেই। ওই রায়ে নির্দিষ্টভাবে অবৈধ ক্ষমতা দখল ও সামরিক ফরমান দিয়ে সংবিধান সংশোধনকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। আবার কতিপয় অনুচ্ছেদ বাহাত্তরের মূল সংবিধানে যেমনটা ছিল, সেভাবে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলা হয়েছে। এখন আপিল বিভাগের রায় হাতে পেলে বোঝা যাবে, হাইকোর্টের মার্জনা বা নির্দেশনার কোথায় কতটা হেরফের হয়েছে, কি হয়নি।
সাংবিধানিক রিভিউ কমিশন বা কমিটি গঠনের রেওয়াজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত। এটা সাধারণত দুভাবে হয়ে থাকে। সংসদভিত্তিক হয়, সংসদের বাইরের বিশেষজ্ঞদের দিয়েও হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ১১ সদস্যের ভারতীয় রিভিউ কমিশনে কোনো সাংসদ ছিলেন না। আবার পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ২৭ সদস্যের সর্বদলীয় কমিটির সবাই সাংসদ।
আমরা মনে করি, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বিকেন্দ্রীকরণ, জবাবদিহি, সংসদ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুসংহতকরণে সংবিধানের অধিকতর সংশোধনের কোনো বিকল্প নেই। সেসব বিষয় আদালতের রায় থেকে মিলবে না। সে কারণে আমরা ব্যাপকভিত্তিক সংবিধান সংশোধনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। সংসদের মনোযোগ যেন কোনোক্রমেই শুধু আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সীমিত না থাকে। শুধু পঞ্চম সংশোধনীর নিরিখে সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নটি বিচার না করে আরও বৃহত্তর পরিসরে বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করি।

No comments

Powered by Blogger.