'কর্তব্য পালন করাটা অন্যদের ব্যাপার' by ডা. ওয়াহিদ নবী
অস্কার ওয়াইল্ডের উক্তিগুলো আমার বেশ লাগে। শোনামাত্র হাসি আসে। একটু পরই খোঁচাটা অনুভব করি। তার পরই বুঝি, মানুষের মনের দুর্বলতাগুলো কী সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। এর পরের দায়িত্ব আমাদের। কী করে এই দুর্বলতা দূর করে আমরা ভালো মানুষ হব, তা আমাদের ভাবতে হবে এবং সঠিক কাজ করতে হবে।
কিন্তু আমরা আমাদের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করি কি? তার চেয়ে বড় কথা, আমাদের যে কিছু কর্তব্য রয়েছে_এ নিয়ে আমরা কিছু ভাবি কি? অস্কার ওয়াইল্ড স্বভাবসুলভ তির্যকভাবে বলেছেন, 'কর্তব্য পালন করাটা অন্যের ব্যাপার।' আমরা আসলেই অন্যের কর্তব্য কী এটা স্থির নিশ্চিতভাবে জানি। আরো নিশ্চিতভাবে জানি যে, অন্যে তাঁদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছেন না। ১৪ মার্চের কালের কণ্ঠে অধ্যাপক আবু আহমেদ সাহেব একটি সুন্দর প্রবন্ধ লিখেছেন। চিকিৎসকদের কাছে আশানুরূপ আচরণ পাচ্ছেন না জনসাধারণ। সুচিকিৎসাও পাচ্ছেন না। আবু আহমেদ তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের নৈরাশ্যজনক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে প্রায় সব রোগীর অভিজ্ঞতা এ রকমের। সবাই মোটামুটি নিরাশ। আমরা কয়েকটি অভিযোগের কথা উল্লেখ করব। একজন বিখ্যাত হৃদরোগবিশারদ ল্যাবরেটরি রিপোর্ট না দেখেই ওষুধ লিখে দিয়েছেন। তিনি একটি ওষুধ বদলে দিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুই ব্যাখ্যা করেননি। অর্থাৎ পরিবর্তিত ওষুধটি কেন বেশি প্রযোজ্য, এটা ব্যাখ্যা করেননি। আবু আহমেদ সাহেব উল্লেখ করেছেন যে ব্যাংককের একটি 'বিখ্যাত হাসপাতালে' তাঁর বন্ধুকে কোনো ওষুধ দেওয়া হয়নি। আহমেদ সাহেব আরো উল্লেখ করেছেন, বিশেষজ্ঞ ব্যাংকক হাসপাতালের রিপোর্ট দেখতে অনীহা প্রদর্শন করেছেন এবং রিপোর্ট না দেখেই ওষুধ লিখে দিয়েছেন।
অধ্যাপক আহমেদ সাহেবের অন্য একজন বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত বড় সরকারি কর্মকর্তা। এই বন্ধুর অভিযোগ, ডাক্তাররা রোগীদের সময় দেন না। তাঁরা সময় অনুপাতে বেশি রোগী দেখেন। তাঁর আর একটি অভিযোগ, ডাক্তারের দেওয়া ওষুধে কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে ডাক্তারকে তা বলার সুযোগ নেই। ডাক্তারদের সম্পর্কে আর একটি অভিযোগ, তাঁরা অধিক সংখ্যায় ওষুধ লেখেন। অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখেন। ইঙ্গিত করা হয়েছে যে ওষুধ কম্পানির প্রভাবে ডাক্তাররা বেশি ওষুধ লেখেন। আহমেদ সাহেবের বন্ধু ইসলাম সাহেব বলেছেন যে তিনি বেশি টাকা দিতে রাজি আছেন, যদি ডাক্তার বেশি সময় ধরে তাঁকে দেখেন। আমি একজন চিকিৎসক, যদিও প্রবাসী। আমার বন্ধু-বান্ধব অনেকেই এ দেশে কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে কথা হয়। আমার আত্মীয়-বন্ধুরা এ দেশে বাস করেন। তাঁরা আমার ডাক্তার বন্ধুদের কাছে চিকিৎসা নেন। আমি নিয়মিত দেশে আসি। বাংলা বই লিখেছি মনোরোগ বিষয়ে অর্ধডজন। সেমিনারে সুযোগ পেলে অংশ নিই। মেডিক্যাল এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রবন্ধ লিখি নিয়মিত। অনেকেই বলেন, 'দেশে থাকলে বুঝতেন।' আমি দেশের সংস্পর্শে আছি বলে মনে করেন। এসব কারণে আবু আহমেদ সাহেবের বক্তব্য সম্পর্কে কিছু বলা কর্তব্য বলে মনে করি। বাংলাদেশের ডাক্তারদের পক্ষ অবলম্বন করা আমার ইচ্ছা নয়।
স্বাস্থ্য বিভাগের সার্বিক মানোন্নয়ন হোক আমাদের লক্ষ্য। বহু কিছু জড়িত এর সঙ্গে। একটি প্রবন্ধে এর সব কিছু আলোচনা করা সম্ভব নয়, মাত্র দু-একটি বিষয়ের উল্লেখ করব এখানে। অন্যরা এ আলোচনায় যোগ দেবেন_এটাই। কোনো একজন রোগীর সঙ্গে কোনো একজন ডাক্তার কেমন ব্যবহার করেছিলেন, সেসব আলোচনা আমরা অনেক করেছি। আমাদের শুরু করা উচিত, ভালো স্বাস্থ্য বিভাগ কেমন হওয়া উচিত_তা নিয়ে আলোচনা করা।
প্রথমে বোঝার চেষ্টা করা যাক, একজন 'বড় ডাক্তারের' কর্তব্য কী? আবু আহমেদ সাহেব শুধু রোগী দেখার কথা বলেছেন। এর চেয়েও বড় কাজ রয়েছে 'বড় ডাক্তারের'। নিজের বিভাগের সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য সাংগঠনিক উন্নতি করা তাঁর দায়িত্ব। এ জন্য অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার দায়িত্ব তাঁর। তাঁর পরবর্তী দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দান করা। প্রশিক্ষণের আধুনিকীকরণ ও মানোন্নয়নের দায়িত্বটিও তাঁর। অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞ ডাক্তারদের অনুরোধে তিনি কেবল জটিল রোগীগুলো দেখবেন। চিকিৎসার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য গবেষণা করবেন এবং বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নালে তিনি সেগুলো প্রকাশ করবেন_সাধারণত এমনটি 'বড়' ডাক্তারদের কাছে আশা করা হয়। জুনিয়র ডাক্তারদের গবেষণায় উৎসাহী করা এবং তাঁদের তদারক করার দায়িত্ব সিনিয়র ডাক্তারদের। দুর্ভাগ্যবশত এমনটা খুব কম ঘটে। প্র্যাকটিস নিয়ে বড় ডাক্তারদের ব্যস্ত থাকা এর কারণ। এর ফলটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুব দুঃখের। গবেষণা করতে হলে জুনিয়র ডাক্তারদের লাল ফিতার সম্মুখীন হতে হয়। একট গবেষণা প্রস্তাব নিয়ে সিনিয়র ডাক্তারের অনুমতি নিতে গেলে বলা হয়, 'এসব বাজে কাজ করে সরকারের টাকা আর সময় তুমি নষ্ট করবে, তা আমি হতে দিতে পারি না।' একজন ডাক্তার সারা বছর কী কাজ করেছেন তার হিসাব দিতে হয়। এটি এখানেও চালু করা উচিত। অন্যান্য বিভাগের রোগী তাঁর বিভাগের ডাক্তাররা দেখবেন এবং তাঁর বিভাগের রোগীদের দরকার হলে অন্য বিভাগের ডাক্তাররা দেখবেন। অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে মিলিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা তাঁর দায়িত্ব। আন্তবিভাগীয় বন্ধুসুলভ পরিবেশ বজায় রাখা তাঁর দায়িত্ব। যে কাজগুলো 'বড় ডাক্তারের' করা উচিত সেগুলো করলে এবং সরকারি তদারকি থাকলে তাঁরা শুধু প্র্যাকটিস করা ডাক্তার হতে পারতেন না। ডাক্তারদের চাকরির কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। কী যোগ্যতার ভিত্তিতে একজন মেডিক্যাল কলেজে বদলি হবেন এবং একজন পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট কলেজে বদলি হবেন তার কোনো বিধি নেই। তদবির এখানে একমাত্র নীতি। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউটে বদলি ও বিতাড়নের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তাকে শুধু ন্যক্কারজনক বলে বর্ণনা করা চলে না। মনে রাখতে হবে, ডিপ্লোমা পাস করা শিক্ষক ফেলোশিপ ছাত্রছাত্রীকে পড়াতে পারেন না। আর একটি অনিয়ম হচ্ছে 'কারেন্ট চার্জ'।
মেডিক্যাল শিক্ষায় অনেক ডাক্তার জড়িত আছেন, যাঁরা রোগী দেখেন না। এঁদের 'বেসিক সাবজেক্ট'-এর শিক্ষক বলা হয়। এঁরা প্র্যাকটিস করেন না। এঁরা শুধু বেতনের ওপর জীবিকা নির্বাহ করেন। এঁদের এই ত্যাগকে কেউ প্রশংসা করেন না। যখন কেউ ডাক্তারদের 'অর্থলোলুপতার' সমালোচনা করেন, তখন এঁরাও সেই সমালোচনার শিকার হন। এঁদের কথা জনগণ ও সরকারকে অবশ্যই ভাবতে হবে। একই সরকারের একই বিভাগে চাকরি করে কেউ শুধু বেতনের ওপর বেঁচে থাকবেন আর কেউ কেউ প্রধানত নিয়োগের কারণে প্রচুর অর্থের মালিক হবেন_এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এবার রোগীদের কিছু কিছু মনোভাব নিয়ে আলোচনা করা যাক। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সাবেক পিজিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তারদেরই তাঁরা সবচেয়ে বড় ডাক্তার বলে মনে করেন। তাঁদের পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, মিটফোর্ড ইত্যাদি হাসপাতালের ডাক্তারদের 'বড় ডাক্তার' মনে করেন। তদবিরের জোরে বড় ডাক্তার বনে যাওয়া এসব ডাক্তারের কাছেই তাঁরা ভিড় জমান। বহু দিন তদবির করার পর এই অবস্থানে গেলে এসব বড় ডাক্তার রোগীর সংখ্যা সীমিত করতে চান না। কাজেই বড় ডাক্তাররা অসংখ্য রোগী দেখেন, আর রোগীরা 'বিখ্যাত ডাক্তার' দেখিয়ে খুশি থাকেন। এত সব অভিযোগ-অনুযোগ শুনে আমার কিছু আত্মীয়-বন্ধুকে আমি বরাবরই 'যথেষ্ট শিক্ষিত ও কম ব্যস্ত' ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিই। প্রসঙ্গত বলছি, খনিজীবীর সন্তান এনুইরিন বিভান সব সময়ই দরিদ্র মানুষের পক্ষে ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে বিলেতে 'ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস' স্থাপন করে শুধু বিলেতের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। আমাদের দেশে একজন বিভানের জন্ম হোক।
যাঁরা ইঞ্জিনিয়ার নন তাঁরা বলেন, ইঞ্জিনিয়াররা তাঁদের কর্তব্য পালন করেন না।
যাঁরা পুলিশ নন তাঁরা বলেন, পুলিশ ঘুষ খেয়ে তাদের কর্তব্য পালেন করে না। যাঁরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নন তাঁরা অভিযোগ করেন, অধ্যাপকরা নিজের ছাত্রদের ঠিকমতো না পড়িয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম শিক্ষকতায় বা কনসালটেন্সিতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন। এমনি আরো আছে। ১৩ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠের একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ চাকরিতে আসেন না। তাঁরা ছুটি নিয়ে অন্য জায়গায় কাজ করেন। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আজ ৫৫৩১ নম্বরে। যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন তাঁরা বলবেন যে এখানকার শিক্ষকরা তাঁদের কর্তব্য পালন করছেন না। এই না হলে অস্কার ওয়াইল্ড নিশ্চয়ই বলতেন না, 'কর্তব্য পালন করাটা অন্যদের দায়িত্ব'। তবে নিজের দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করার পর যদি কেউ বলেন অন্যরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন না, তবে নৈতিক দিক দিয়ে তাঁর মন্তব্য অধিকতর গ্রহণযোগ্য হতো এবং সম্মান অর্জন করত।
লেখক : প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক
অধ্যাপক আহমেদ সাহেবের অন্য একজন বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত বড় সরকারি কর্মকর্তা। এই বন্ধুর অভিযোগ, ডাক্তাররা রোগীদের সময় দেন না। তাঁরা সময় অনুপাতে বেশি রোগী দেখেন। তাঁর আর একটি অভিযোগ, ডাক্তারের দেওয়া ওষুধে কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে ডাক্তারকে তা বলার সুযোগ নেই। ডাক্তারদের সম্পর্কে আর একটি অভিযোগ, তাঁরা অধিক সংখ্যায় ওষুধ লেখেন। অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখেন। ইঙ্গিত করা হয়েছে যে ওষুধ কম্পানির প্রভাবে ডাক্তাররা বেশি ওষুধ লেখেন। আহমেদ সাহেবের বন্ধু ইসলাম সাহেব বলেছেন যে তিনি বেশি টাকা দিতে রাজি আছেন, যদি ডাক্তার বেশি সময় ধরে তাঁকে দেখেন। আমি একজন চিকিৎসক, যদিও প্রবাসী। আমার বন্ধু-বান্ধব অনেকেই এ দেশে কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে কথা হয়। আমার আত্মীয়-বন্ধুরা এ দেশে বাস করেন। তাঁরা আমার ডাক্তার বন্ধুদের কাছে চিকিৎসা নেন। আমি নিয়মিত দেশে আসি। বাংলা বই লিখেছি মনোরোগ বিষয়ে অর্ধডজন। সেমিনারে সুযোগ পেলে অংশ নিই। মেডিক্যাল এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রবন্ধ লিখি নিয়মিত। অনেকেই বলেন, 'দেশে থাকলে বুঝতেন।' আমি দেশের সংস্পর্শে আছি বলে মনে করেন। এসব কারণে আবু আহমেদ সাহেবের বক্তব্য সম্পর্কে কিছু বলা কর্তব্য বলে মনে করি। বাংলাদেশের ডাক্তারদের পক্ষ অবলম্বন করা আমার ইচ্ছা নয়।
স্বাস্থ্য বিভাগের সার্বিক মানোন্নয়ন হোক আমাদের লক্ষ্য। বহু কিছু জড়িত এর সঙ্গে। একটি প্রবন্ধে এর সব কিছু আলোচনা করা সম্ভব নয়, মাত্র দু-একটি বিষয়ের উল্লেখ করব এখানে। অন্যরা এ আলোচনায় যোগ দেবেন_এটাই। কোনো একজন রোগীর সঙ্গে কোনো একজন ডাক্তার কেমন ব্যবহার করেছিলেন, সেসব আলোচনা আমরা অনেক করেছি। আমাদের শুরু করা উচিত, ভালো স্বাস্থ্য বিভাগ কেমন হওয়া উচিত_তা নিয়ে আলোচনা করা।
প্রথমে বোঝার চেষ্টা করা যাক, একজন 'বড় ডাক্তারের' কর্তব্য কী? আবু আহমেদ সাহেব শুধু রোগী দেখার কথা বলেছেন। এর চেয়েও বড় কাজ রয়েছে 'বড় ডাক্তারের'। নিজের বিভাগের সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য সাংগঠনিক উন্নতি করা তাঁর দায়িত্ব। এ জন্য অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার দায়িত্ব তাঁর। তাঁর পরবর্তী দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দান করা। প্রশিক্ষণের আধুনিকীকরণ ও মানোন্নয়নের দায়িত্বটিও তাঁর। অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞ ডাক্তারদের অনুরোধে তিনি কেবল জটিল রোগীগুলো দেখবেন। চিকিৎসার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য গবেষণা করবেন এবং বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নালে তিনি সেগুলো প্রকাশ করবেন_সাধারণত এমনটি 'বড়' ডাক্তারদের কাছে আশা করা হয়। জুনিয়র ডাক্তারদের গবেষণায় উৎসাহী করা এবং তাঁদের তদারক করার দায়িত্ব সিনিয়র ডাক্তারদের। দুর্ভাগ্যবশত এমনটা খুব কম ঘটে। প্র্যাকটিস নিয়ে বড় ডাক্তারদের ব্যস্ত থাকা এর কারণ। এর ফলটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুব দুঃখের। গবেষণা করতে হলে জুনিয়র ডাক্তারদের লাল ফিতার সম্মুখীন হতে হয়। একট গবেষণা প্রস্তাব নিয়ে সিনিয়র ডাক্তারের অনুমতি নিতে গেলে বলা হয়, 'এসব বাজে কাজ করে সরকারের টাকা আর সময় তুমি নষ্ট করবে, তা আমি হতে দিতে পারি না।' একজন ডাক্তার সারা বছর কী কাজ করেছেন তার হিসাব দিতে হয়। এটি এখানেও চালু করা উচিত। অন্যান্য বিভাগের রোগী তাঁর বিভাগের ডাক্তাররা দেখবেন এবং তাঁর বিভাগের রোগীদের দরকার হলে অন্য বিভাগের ডাক্তাররা দেখবেন। অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে মিলিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা তাঁর দায়িত্ব। আন্তবিভাগীয় বন্ধুসুলভ পরিবেশ বজায় রাখা তাঁর দায়িত্ব। যে কাজগুলো 'বড় ডাক্তারের' করা উচিত সেগুলো করলে এবং সরকারি তদারকি থাকলে তাঁরা শুধু প্র্যাকটিস করা ডাক্তার হতে পারতেন না। ডাক্তারদের চাকরির কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। কী যোগ্যতার ভিত্তিতে একজন মেডিক্যাল কলেজে বদলি হবেন এবং একজন পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট কলেজে বদলি হবেন তার কোনো বিধি নেই। তদবির এখানে একমাত্র নীতি। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউটে বদলি ও বিতাড়নের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তাকে শুধু ন্যক্কারজনক বলে বর্ণনা করা চলে না। মনে রাখতে হবে, ডিপ্লোমা পাস করা শিক্ষক ফেলোশিপ ছাত্রছাত্রীকে পড়াতে পারেন না। আর একটি অনিয়ম হচ্ছে 'কারেন্ট চার্জ'।
মেডিক্যাল শিক্ষায় অনেক ডাক্তার জড়িত আছেন, যাঁরা রোগী দেখেন না। এঁদের 'বেসিক সাবজেক্ট'-এর শিক্ষক বলা হয়। এঁরা প্র্যাকটিস করেন না। এঁরা শুধু বেতনের ওপর জীবিকা নির্বাহ করেন। এঁদের এই ত্যাগকে কেউ প্রশংসা করেন না। যখন কেউ ডাক্তারদের 'অর্থলোলুপতার' সমালোচনা করেন, তখন এঁরাও সেই সমালোচনার শিকার হন। এঁদের কথা জনগণ ও সরকারকে অবশ্যই ভাবতে হবে। একই সরকারের একই বিভাগে চাকরি করে কেউ শুধু বেতনের ওপর বেঁচে থাকবেন আর কেউ কেউ প্রধানত নিয়োগের কারণে প্রচুর অর্থের মালিক হবেন_এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এবার রোগীদের কিছু কিছু মনোভাব নিয়ে আলোচনা করা যাক। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সাবেক পিজিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তারদেরই তাঁরা সবচেয়ে বড় ডাক্তার বলে মনে করেন। তাঁদের পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, মিটফোর্ড ইত্যাদি হাসপাতালের ডাক্তারদের 'বড় ডাক্তার' মনে করেন। তদবিরের জোরে বড় ডাক্তার বনে যাওয়া এসব ডাক্তারের কাছেই তাঁরা ভিড় জমান। বহু দিন তদবির করার পর এই অবস্থানে গেলে এসব বড় ডাক্তার রোগীর সংখ্যা সীমিত করতে চান না। কাজেই বড় ডাক্তাররা অসংখ্য রোগী দেখেন, আর রোগীরা 'বিখ্যাত ডাক্তার' দেখিয়ে খুশি থাকেন। এত সব অভিযোগ-অনুযোগ শুনে আমার কিছু আত্মীয়-বন্ধুকে আমি বরাবরই 'যথেষ্ট শিক্ষিত ও কম ব্যস্ত' ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিই। প্রসঙ্গত বলছি, খনিজীবীর সন্তান এনুইরিন বিভান সব সময়ই দরিদ্র মানুষের পক্ষে ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে বিলেতে 'ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস' স্থাপন করে শুধু বিলেতের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। আমাদের দেশে একজন বিভানের জন্ম হোক।
যাঁরা ইঞ্জিনিয়ার নন তাঁরা বলেন, ইঞ্জিনিয়াররা তাঁদের কর্তব্য পালন করেন না।
যাঁরা পুলিশ নন তাঁরা বলেন, পুলিশ ঘুষ খেয়ে তাদের কর্তব্য পালেন করে না। যাঁরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নন তাঁরা অভিযোগ করেন, অধ্যাপকরা নিজের ছাত্রদের ঠিকমতো না পড়িয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম শিক্ষকতায় বা কনসালটেন্সিতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন। এমনি আরো আছে। ১৩ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠের একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ চাকরিতে আসেন না। তাঁরা ছুটি নিয়ে অন্য জায়গায় কাজ করেন। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আজ ৫৫৩১ নম্বরে। যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন তাঁরা বলবেন যে এখানকার শিক্ষকরা তাঁদের কর্তব্য পালন করছেন না। এই না হলে অস্কার ওয়াইল্ড নিশ্চয়ই বলতেন না, 'কর্তব্য পালন করাটা অন্যদের দায়িত্ব'। তবে নিজের দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করার পর যদি কেউ বলেন অন্যরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন না, তবে নৈতিক দিক দিয়ে তাঁর মন্তব্য অধিকতর গ্রহণযোগ্য হতো এবং সম্মান অর্জন করত।
লেখক : প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক
No comments