শত্রু নয়, বন্ধু বাড়াতে হবে by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

বাংলাদেশের রাজনীতি মোটা দাগে দুই শিবির তথা জোট বনাম মহাজোটে বিভক্ত হয়ে আছে। যদিও দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অনেক। কিন্তু প্রত্যেকেই এখন তাদের আদর্শিক বৃহত্তর বলয়কে নিয়ে এক একটি জোট বা মহাজোট গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছেন।


কেউ কেউ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলে আখ্যায়িত করেন, কেউ কেউ আবার দুই দল ও দুই জোটের দুই নেত্রীকেই একই মানদণ্ডে উপস্থাপন করে থাকেন। এসব অতীব সরলীকরণকৃত কথা, কোনো যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা নয় কিছুতেই। কেননা, আওয়ামী লীগ আদর্শগতভাবে যা ধারণ করে বিএনপি তা করে না, অন্যদিকে যা বিশ্বাস করে তা আওয়ামী লীগ করে না। পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উভয় দল, জোট বা মহাজোট দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় আছে এটিই রাজনৈতিক বাস্তবতা।
এক সময় সব রাজনৈতিক দলই আলাদা নাম ও অবস্থান থেকে রাজনৈতিক ময়দানে সক্রিয় ছিল। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের সময় কিছু কিছু জোট গঠিত হলেও সেই সব ঐক্যজোট খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোটের উদ্যোগে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একটি ইশতেহারে তাঁরা স্বাক্ষরও করেন। অবশ্য নির্বাচনের আগেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ওই চারদলীয় জোট থেকে বের হয়ে এলেও জোট কিন্তু টিকে থাকে। ওই জোট নির্বাচনী ঐক্য প্রতিষ্ঠা করায় দেশে তখন এক ধরনের ধারণা তৈরি হয়, এবার দেশ থেকে সন্ত্রাসী, গডফাদারের রাজত্ব এবং দুর্নীতির উচ্ছেদ হবে, দেশ অন্যরকম হয়ে যাবে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর দিন থেকে ২০০৭ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে ওই চারদলীয় জোটের রাষ্ট্রপরিচালনা, নির্বাচন ইঞ্জিনিয়ারিং, হামলা-মামলা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড মানুষের সেইসব বিশ্বাস ও কল্পনাকে ধূলিসাৎ করে দেয়। বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের চারণভূমিতে পরিণত করা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াসহ নানা পরিস্থিতি দেশের মানুষকে চারদলীয় জোটের রাজনীতির চরিত্রকে বুঝতে দারুণভাবে সাহায্য করেছে।
চারদলীয় জোটের শাসন দেশে এর বিপরীত ধারার রাজনৈতিক সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে। প্রথমে ১৪ দলীয় জোট, পরে মহাজোট গঠন অবশ্যাম্ভাবী হয়ে ওঠে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে একদিকে মহাজোট, অন্যদিকে চারদলীয় জোট লড়াইয়ে নামে। জনগণ ২০০১-উত্তরকালের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উচ্চারিত পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশ্বস্ত রাজনৈতিক শক্তির ওপর আস্থা স্থাপন করেছে, বাংলাদেশে অবিস্মরণীয় বিজয়ও ঘটেছে উদারবাদী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির। যদিও মহাজোটের সব রাজনৈতিক দল উদারবাদী গণতন্ত্রকে আদর্শগত দিক থেকে সমানভাবে ধারণ করে না। তারপরও দেশি-বিদেশি সব বাস্তবতা বিবেচনায় বৃহত্তর ক্যানভাসে উদারবাদী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠায় সুযোগ করে দিয়েছে।
মহাজোট দিনবদলের স্লোগান, আধুনিক বাংলাদেশ গড়া, ভিশন ২০১১, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানা কর্মসূচির এক রূপকল্প উপস্থাপন করে। সরকার গঠনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে। চারদলীয় জোটের মতো ক্ষমতা গ্রহণের আগেই মহাজোট ২০০৯ প্রতিপক্ষের ওপর সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, প্রতিশোধ নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি, বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার তাণ্ডবও চালায়নি। কারো কারো আশঙ্কা ছিল চারদল যে ধরনের আচরণ করেছিল, শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল ২০০১ সালের পর, মহাজোট হয়তো এর চেয়েও ভয়াবহ কোনো অপশক্তিরূপে আবির্ভূত হয় কি না। সেটি ঘটেনি মহাজোটের ক্ষেত্রে বিগত ২ বছরে গুটিকয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কিছু অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া দেশের বেশির ভাগ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ শান্ত আছে। চাঁদাবাজির কথা কিছু কিছু বলা হলেও এর প্রকোপ ২০০১-উত্তরকালে মহামারির মতো এবার ছড়াতে পারেনি। বিভিন্ন স্থানীয় সরকার এবং উপনির্বাচন কোনো ধরনের প্রভাব ছাড়া অনুষ্ঠিত করে অনেক সন্দেহ থেকেই জাতিকে দুশ্চিন্তামুক্ত রেখেছে। দেশে কৃষি উৎপাদন এ সময় যেভাবে বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে তাতে সামান্যতম অবহেলা ঘটলে দেশ এ সময় বড় ধরনের খাদ্য সংকটে পড়ত, আমদানি করেও দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ করা কঠিন হতো। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপ্লবী পরিবর্তন ঘটেছে। পররাষ্ট্র নীতিতেও দেশ গর্ব করার অবস্থানে প্রবেশ করেছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে দেশে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। ডিজিটাল কথাটি বিরোধী দল পরিহাসছলে ব্যবহার করলেও ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠী বুঝতে পারছে দেশটা আধুনিক হওয়ার জন্য প্রযুক্তির দিক থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার পর্যায়ে আসছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কিছু সমালোচনা থাকলেও বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড ও লুটপাটের হোতাই এখন ধরা পড়ছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংকট থেকে মুক্তির জন্য সরকারের প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখা গেলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি এখনো ধরা দেয়নি। এতে দেশের অর্থনীতি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, জনজীবনে হতাশা এবং ক্ষোভও রয়েছে। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, জঙ্গিদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। এসব সাফল্যকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। তবে জনমানস সব সময় এসব কর্মকাণ্ডে আটকেও থাকে না। সরকারের কোনো কোনো কর্মকাণ্ড যখনই স্বাভাবিকের রাস্তা অতিক্রম করে হাটে তখনই সে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। যেমন আড়িয়াল বিল নিয়ে সরকারের উদ্যোগকে অনেকেই ঠিক মনে করেনি। সরকারও বুঝতে পেরে তাৎক্ষণিকভাবে তা থেকে সরে এসেছে।
দেশে বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডকে রাজনৈতিকভাবে পছন্দ করে না_এমন মানুষের সংখ্যা মোটেও কম নয়। গত নির্বাচনের ফলের দুটি দিক আছে। এক, আসন সংখ্যা, দুই ভোটপ্রাপ্তি। মহাজোট আসন বেশি পেলেও চারদলীয় জোটের ভোট কম নয়। এ ছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনের ফলও বলে দেয় সরকারের বিরুদ্ধমত মোটেও দুর্বল নয়। ঘরে বিদ্যুৎ চলে গেল, বাজারে দোকানিকে বেশি দাম দিয়ে কোনো পণ্য কিনেছে_তা থেকেও সরকারের বিরুদ্ধে মত বা সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটাতে দেরি করে না। শহুরে জনগোষ্ঠী ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগকে গ্রহণ করেনি, এর প্রভাব গ্রামেগঞ্জেও পড়েছিল, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ফিফটি ফিফটি ছাড় দিয়েছিল, আওয়ামী লীগ তাতে কোনো প্রকারে ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল, কয়জন সন্ত্রাসী গডফাদার নিয়ে মিডিয়ায় সমালোচনা এবং টিআইবির রিপোর্টে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে শীর্ষে ওঠার খবরে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ধরাশায়ী হয়। একইভাবে চারদলীয় জোটের বাড়াবাড়ি থেকে ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মহাজোটকে নিরঙ্কুশভাবে সমর্থন প্রদান করে। এখন সেই মধ্যবিত্তের সিদ্ধান্ত কী তা বোঝা বেশ কঠিন। আওয়ামী লীগের প্রতি তারা এখন সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছে এটি লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে এখনই মানুষ বিএনপির কথায় সরকার পতনের আন্দোলনে মাঠে নামবে সেই পর্যায়ে যায়নি। কিন্তু তাই বলে জনমতকে অবহেলা করারও উপায় নেই। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করছে। এটি যেমন অনেক মানুষের প্রাণের দাবি, আবার অনেকেই আছেন যাঁরা তা চান না। সরকারের অনেক ভালো কর্মকাণ্ডেও মনেপ্রাণে খুশি হতে পারেন না এমন মানুষের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। সরকার ২৩ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিনা মূল্যে বিতরণ করছে। তাই বলে কি সব পরিবারই মহাজোটকে এর জন্য ভোট দেবে এমনটি ভাবা যায়? না, ভাবা যায় না। দেশে অনেক ধরনের পশ্চাৎপদ চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, প্রচারণা-অপপ্রচার রয়েছে।
বাংলাদেশকে একটি আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রাম পশ্চাৎপদতাকে কাটিয়ে ওঠা খুবই কঠিন সংগ্রামের বিষয়। সেই সংগ্রামে জয়ী হতে অনেকের সমর্থন, সহযোগিতার প্রয়োজন। মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে সতর্ক থাকছে না, বন্ধু বাড়ানোর চেয়ে শত্রু সৃষ্টির মতো অবস্থানে চলে যায়। আওয়ামী লীগকে মহাজোটের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধির মাধ্যমে যেমনি বন্ধু বাড়াতে হবে, দলীয় রাজনীতির বাইরেও যাঁরা অবস্থান করছেন তাঁদের মধ্যেও বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে হবে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সেই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই বাংলাদেশকে ২০১১ সালের মিশন-ভিশনে এগিয়ে নেওয়ার যাত্রা অব্যাহত সফল হবে। আওয়ামী লীগের শত্রুরা কত নিষ্ঠুর, শক্তিধর, অযৌক্তিক, বিবেকহীন হতে পারে তা ১৯৭৫-এ প্রথম দেখা যায়, এর পরও দেখা গেছে। সুতরাং ভেবে-চিন্তে চলা, বলা, করা ও দেখার বিষয়ে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক ও ইতিহাসতত্ত্ববিদ
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.