ভারত-উপেক্ষিত কাশ্মীর by তারিক আলি
এক কাশ্মীরি উকিল সেদিন উত্তেজিত হয়ে আমাকে ফোন করে বললেন, কাশ্মীরের সাম্প্রতিক দুঃখজনক ঘটনাগুলো আমি জানি কি না। আমি জানতাম না। তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। ব্রিটিশ গণমাধ্যমে গত তিন সপ্তাহে এ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। একমাত্র খবরটি প্রকাশ করেছে গার্ডিয়ান।
ভারতের এক এক মডেলের আত্মহত্যা নিয়ে অর্ধপৃষ্ঠাজুড়ে খবর। অথচ সেই সময়েই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১৫ থেকে ২৭ বছর বয়সী ১১ জন কাশ্মীরি তরুণ নিহত হয়েছে। গত ২৮ জুন নিউইয়র্ক টাইমস-এ ছোট্ট একটি সংবাদ প্রকাশিত হলেও তার কোনো ফলোআপ পরে আর দেখিনি। মনে হয় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অপরাধকে পশ্চিমারা ততটা গুরুত্ব দেয় না। ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে যদিও কিছু ছাপা হয়, তাও আরেকটি ‘মুসলিম ঝামেলা’ বলে গণ্য হয়। আর ভারতীয় বাহিনীগুলোর অপকর্মকে দেখা হয় দায়িত্ব পালন হিসেবে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে কাশ্মীরের এতগুলো মৃত্যুর উপেক্ষা থেকে মনে হয়, এ ঘটনা তিব্বত বা তেহরানে ঘটলে দুনিয়াব্যাপী হুলুস্থূল লেগে যেত।
কাশ্মীরিদের ওপর নৃশংস দমন-পীড়নের সংবাদ ভারতীয় গণমাধ্যমেও তেমন একটা আসে না। অথচ এ মুহূর্তে কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরসহ কয়েকটি শহরে কঠোর সেনা কারফিউ চলছে। অল্প সময়ের জন্য তা শিথিল হওয়ামাত্রই দলে দলে তরুণ রাস্তায় নেমে টিয়ারগ্যাস মোকাবিলা করেন। তিন সপ্তাহেরও বেশি সময়জুড়ে কাশ্মীরের বেশির ভাগ এলাকায় সর্বাত্মক ধর্মঘট চলছে।
ভারতে সহিংসতার সঙ্গী হলো জঘন্য মুসলিম-বিদ্বেষ। টুইন টাওয়ারের ঘটনার পর মুসলমানদের গালি দেওয়া যেন জায়েজ হয়ে গেছে। কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এখন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নিশানার অধীন। এরই অংশ হিসেবে ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তারা কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা ঘাঁটি পরিদর্শন করে সন্ত্রাসবিরোধী কার্যকলাপের শিক্ষা দিয়ে আসছেন। ইন্ডিয়া ডিফেন্স ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল আভি মিজরাহি অনির্ধারিত সফরে কাশ্মীরের ভারতীয় সেনাবাহিনীকে হাতে-কলমে ইসলামী বিদ্রোহ দমনের কলাকৌশল বিষয়ে ধারণা দেন। ভারতে থাকার তিন দিন সময়ে মিজরাহি ঊর্ধ্বতন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দ্বারা ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী কমান্ডোদের প্রশিক্ষণের খসড়া নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের সোজাসাপটা পরামর্শ হলো, আমরা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যা করছি, তোমরাও কাশ্মীরিদের সঙ্গে সেটাই করো। ২০০২-০৮ পর্যন্ত ইসরায়েলের কাছ থেকে ভারত পাঁচ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে।
এ বছরের জুন মাসে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের হাতে তিন কাশ্মীরি নিহত হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হলে সেখানকার ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। তারা প্রথমে দাবি করেছিল, নিহত ব্যক্তিরা সবাই জঙ্গি। কিন্তু পরে স্থানীয় পুলিশের ভাষ্যে এই দাবি বানোয়াট বলে প্রমাণিত হয়।
২০০৮ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়ে বলেছিল, ১৯৮৯ সাল থেকে কাশ্মীরে দমন-পীড়ন, হত্যা, অপহরণের ঘটনা ঘটলেও কেউ নজর দিচ্ছে না। তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত করার আহ্বান জানায়। বেআইনিভাবে হত্যার শিকারদের দেহাবশেষ পাওয়া যাচ্ছে গণকবরগুলোতে। কেবল উরি জেলার ১৮টি গ্রামের গণকবরে ৯৪০ ব্যক্তির দেহাবশেষ মিলেছে। আইপিটিকে নামের এক স্থানীয় এনজিও জানিয়েছে, কাশ্মীরে প্রতিদিনই বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। তাহলেও পাশ্চাত্যের সংস্থাগুলো নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ভয়ে এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করছে না। আইপিটিকের দেওয়া পরিসংখ্যান দেখলে হতভম্ব হয়ে যেতে হয়। তাদের দাবি, ১৯৮৯-২০০৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বের ফসল হলো ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু। এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং দখল কায়েম রাখার প্রক্রিয়ারই অংশ। সেনাবাহিনীর ভেতরে এসব হত্যাকাণ্ডকে ‘কর্তব্য পালন’ বলে বিবেচনা করা হয় এবং এ ধরনের হত্যকাণ্ডের জন্য তাদের আর্থিক পুরস্কার ও পদোন্নতির বিধানও রয়েছে। কাশ্মীরে এখন প্রায় আড়াই লাখ ভারতীয় সেনাসদস্য নিয়োজিত আছেন। ইরাক ও আফগানিস্তান মিলিয়েও এত ন্যাটো সেনা সদস্যের উপস্থিতি নেই। আন্দোলন দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এই সেনা সদস্যদের কোনো কাজের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। তাঁরা পরিপূর্ণ দায়মুক্তি উপভোগ করছেন।
ভারতের জনমতও এ বিষয়ে নির্বাক। বামপন্থীরাও তাঁদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বলে এ বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। কাশ্মীর হলো এক নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর ভারত না পাকিস্তান, কার সঙ্গে থাকবে—সে বিষয়ে গণভোট হতে দেওয়া হয়নি। ১৯৮৪ সালে আমি তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের সময়কার সুবর্ণ সুযোগ (যখন কাশ্মীরিরা দেখছিল কীভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে তাদের ধর্মেরই লোকদের সঙ্গে কী নৃশংসতা চালাচ্ছে) তিনি কেন কাজে লাগাননি? সে সময় গণভোট হলে তো কাশ্মীরিরা পাকিস্তানের বিপক্ষেই ভোট দিত। ইন্দিরা এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। আমি বললাম, এমনকি কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহও মনে করতেন, তাতে ভারতই জয়ী হতো। এ কথায় তাঁর মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘আমি তাঁকে একদম বিশ্বাস করি না।’ ইন্দিরা তাঁর পিতা জওহরলাল নেহরুর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কাশ্মীরিদের তাদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ না দেওয়ার ব্যাপারে খুবই কঠোর ছিলেন।
আবদুল্লাহ পরিবারই রাজতান্ত্রিক কায়দায় কাশ্মীরের ক্ষমতায় বসে দিল্লির দালালি করে লাভবান হচ্ছে। কাশ্মীরের এক সাংবাদিক বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সম্পর্কে বলেন, ‘দুর্নীতির বিচারে তিনি হলেন আমাদের জারদারি (পাকিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট)। ছেলেকে মুখ্যমন্ত্রী বানিয়ে তিনি এখন তাঁর বিভিন্ন রকম ব্যবসা দেখাশোনায় ব্যস্ত। ওদিকে বিরোধী দলের প্রধান নেতা একসঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের হয়ে কাজ করে আখের গোছাচ্ছেন। তিনি হলেন কাশ্মীরের স্বঘোষিত আধ্যাত্মিক নেতা। ভারতের দেওয়া প্রহরীরা তাঁর বাড়ি পাহারা দেয়। কোনো রোজগার না থাকলেও তাঁর পরিবার বিলাসিতার মধ্যে দিন কাটায়। গোপনে তিনি ভারতের সঙ্গে আলাপ চালান এবং প্রায়ই সেই সংবাদ ফাঁস হয়ে যায়। আবার প্রতিবছর একবার ধর্মীয় সফরে পাকিস্তানে গিয়ে সেদিকের লাইনঘাটও ঠিক রাখেন। ভারত তাই আমাদের আন্দোলনকে ভয় পায় না। কারণ তারা জানে, আমাদের নেতারা বেঈমান। এটাই হলো ভারতের সুবিধা।’
জারদারির সরকারও কাশ্মীর নিয়ে চুপচাপ। পাকিস্তানের গণমাধ্যমও সাম্প্রতিক হত্যকাণ্ডগুলো নিয়ে তেমন সোচ্চার নয়। পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর কাছে কাশ্মীর হলো ভারতের সঙ্গে দরকষাকষির বিষয়। তাদের মনোভাব এমন: ‘আমাদের আফগানিস্তান দাও, তোমরা কাশ্মীর নাও’। জারদারি হলেন একমাত্র পাকিস্তানি নেতা, ভারতীয় কাশ্মীরে যাঁর কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়েছে। পাকিস্তানি নেতৃত্ব ও মন্ত্রীদের কাশ্মীরের মুক্তির থেকে বেশি আগ্রহ ব্যবসায়িক লেনাদেনায়। এ অবস্থা ওয়াশিংটনেরও মনঃপুত। ভারত এখন তাদের প্রধানতম মিত্র। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের অনীহায় প্রমাণ হয়, কাশ্মীরের বর্তমান অসন্তোষের পেছনে পাকিস্তানের হাত থাকার অভিযোগ ভিত্তিহীন। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পরে পাকিস্তান কাশ্মীরে যে জেহাদি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল, ৯/১১ ঘটনার পরপর তা ভেঙে দেওয়া হয়। কাবুলে বিজয়লাভের সুবাদে পাকিস্তান ভেবেছিল, একই কৌশলে তারা কাশ্মীরেও জয়ী হবে। কিন্তু তাদের পাঠানো জঙ্গি তৎপরতা বরং কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষতিই করেছে। অন্যদিকে, নেতৃত্বের আপসকামিতায় হতাশ কিছু যুবকও চরমপন্থার আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের পথ ছিল ভুল।
২০০৮ সালের আগস্ট মাসে ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা যখন দিল্লির লাল কিল্লায় স্বাধীনতা দিবস পালন করছিলেন, সে সময় কাশ্মীরে গণঅসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। লাখো মানুষ সেদিন শান্তিপূর্ণভাবে শ্রীনগরের জাতিসংঘের দপ্তরের দিকে মিছিল করে যায়। তারা কুশপুত্তলিকা পোড়াতে পোড়াতে স্লোগান দেয়, ‘আজাদি, আজাদি’। তাদের দাবি, ভারত কাশ্মীর ছেড়ে যাক। সেই আন্দোলন দমন না করে বরং উপেক্ষা করা হয়েছিল। এখন তরুণ প্রজন্ম আবার আজাদির দাবিতে মিছিল করছে। তারা লড়াই করছে ফিলিস্তিনি তরুণদের মতো হাতে পাথর নিয়ে। অনেকেই মৃত্যুর ভয় অতিক্রম করেছে এবং তারা আত্মসমর্পণও করবে না। স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা তাদের উপেক্ষা করছেন, পাকিস্তান তাদের ত্যাগ করেছে। কিন্তু ভারতীয় সেনা সদস্যরা যতই শ্রীনগরের রাস্তায় অস্ত্র হাতে কুচকাওয়াজ করুন না কেন, এই চেতনা তাদের নিজস্ব এবং শিগগিরই তা স্তিমিত হবে না।
লন্ডন রিভিউ অব বুকস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
তারিক আলি: পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক ও বুদ্ধিজীবী।
কাশ্মীরিদের ওপর নৃশংস দমন-পীড়নের সংবাদ ভারতীয় গণমাধ্যমেও তেমন একটা আসে না। অথচ এ মুহূর্তে কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরসহ কয়েকটি শহরে কঠোর সেনা কারফিউ চলছে। অল্প সময়ের জন্য তা শিথিল হওয়ামাত্রই দলে দলে তরুণ রাস্তায় নেমে টিয়ারগ্যাস মোকাবিলা করেন। তিন সপ্তাহেরও বেশি সময়জুড়ে কাশ্মীরের বেশির ভাগ এলাকায় সর্বাত্মক ধর্মঘট চলছে।
ভারতে সহিংসতার সঙ্গী হলো জঘন্য মুসলিম-বিদ্বেষ। টুইন টাওয়ারের ঘটনার পর মুসলমানদের গালি দেওয়া যেন জায়েজ হয়ে গেছে। কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এখন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নিশানার অধীন। এরই অংশ হিসেবে ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তারা কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা ঘাঁটি পরিদর্শন করে সন্ত্রাসবিরোধী কার্যকলাপের শিক্ষা দিয়ে আসছেন। ইন্ডিয়া ডিফেন্স ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল আভি মিজরাহি অনির্ধারিত সফরে কাশ্মীরের ভারতীয় সেনাবাহিনীকে হাতে-কলমে ইসলামী বিদ্রোহ দমনের কলাকৌশল বিষয়ে ধারণা দেন। ভারতে থাকার তিন দিন সময়ে মিজরাহি ঊর্ধ্বতন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দ্বারা ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী কমান্ডোদের প্রশিক্ষণের খসড়া নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের সোজাসাপটা পরামর্শ হলো, আমরা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যা করছি, তোমরাও কাশ্মীরিদের সঙ্গে সেটাই করো। ২০০২-০৮ পর্যন্ত ইসরায়েলের কাছ থেকে ভারত পাঁচ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে।
এ বছরের জুন মাসে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের হাতে তিন কাশ্মীরি নিহত হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হলে সেখানকার ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। তারা প্রথমে দাবি করেছিল, নিহত ব্যক্তিরা সবাই জঙ্গি। কিন্তু পরে স্থানীয় পুলিশের ভাষ্যে এই দাবি বানোয়াট বলে প্রমাণিত হয়।
২০০৮ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়ে বলেছিল, ১৯৮৯ সাল থেকে কাশ্মীরে দমন-পীড়ন, হত্যা, অপহরণের ঘটনা ঘটলেও কেউ নজর দিচ্ছে না। তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত করার আহ্বান জানায়। বেআইনিভাবে হত্যার শিকারদের দেহাবশেষ পাওয়া যাচ্ছে গণকবরগুলোতে। কেবল উরি জেলার ১৮টি গ্রামের গণকবরে ৯৪০ ব্যক্তির দেহাবশেষ মিলেছে। আইপিটিকে নামের এক স্থানীয় এনজিও জানিয়েছে, কাশ্মীরে প্রতিদিনই বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। তাহলেও পাশ্চাত্যের সংস্থাগুলো নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ভয়ে এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করছে না। আইপিটিকের দেওয়া পরিসংখ্যান দেখলে হতভম্ব হয়ে যেতে হয়। তাদের দাবি, ১৯৮৯-২০০৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বের ফসল হলো ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু। এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং দখল কায়েম রাখার প্রক্রিয়ারই অংশ। সেনাবাহিনীর ভেতরে এসব হত্যাকাণ্ডকে ‘কর্তব্য পালন’ বলে বিবেচনা করা হয় এবং এ ধরনের হত্যকাণ্ডের জন্য তাদের আর্থিক পুরস্কার ও পদোন্নতির বিধানও রয়েছে। কাশ্মীরে এখন প্রায় আড়াই লাখ ভারতীয় সেনাসদস্য নিয়োজিত আছেন। ইরাক ও আফগানিস্তান মিলিয়েও এত ন্যাটো সেনা সদস্যের উপস্থিতি নেই। আন্দোলন দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এই সেনা সদস্যদের কোনো কাজের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। তাঁরা পরিপূর্ণ দায়মুক্তি উপভোগ করছেন।
ভারতের জনমতও এ বিষয়ে নির্বাক। বামপন্থীরাও তাঁদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বলে এ বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। কাশ্মীর হলো এক নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর ভারত না পাকিস্তান, কার সঙ্গে থাকবে—সে বিষয়ে গণভোট হতে দেওয়া হয়নি। ১৯৮৪ সালে আমি তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের সময়কার সুবর্ণ সুযোগ (যখন কাশ্মীরিরা দেখছিল কীভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে তাদের ধর্মেরই লোকদের সঙ্গে কী নৃশংসতা চালাচ্ছে) তিনি কেন কাজে লাগাননি? সে সময় গণভোট হলে তো কাশ্মীরিরা পাকিস্তানের বিপক্ষেই ভোট দিত। ইন্দিরা এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। আমি বললাম, এমনকি কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহও মনে করতেন, তাতে ভারতই জয়ী হতো। এ কথায় তাঁর মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘আমি তাঁকে একদম বিশ্বাস করি না।’ ইন্দিরা তাঁর পিতা জওহরলাল নেহরুর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কাশ্মীরিদের তাদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ না দেওয়ার ব্যাপারে খুবই কঠোর ছিলেন।
আবদুল্লাহ পরিবারই রাজতান্ত্রিক কায়দায় কাশ্মীরের ক্ষমতায় বসে দিল্লির দালালি করে লাভবান হচ্ছে। কাশ্মীরের এক সাংবাদিক বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সম্পর্কে বলেন, ‘দুর্নীতির বিচারে তিনি হলেন আমাদের জারদারি (পাকিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট)। ছেলেকে মুখ্যমন্ত্রী বানিয়ে তিনি এখন তাঁর বিভিন্ন রকম ব্যবসা দেখাশোনায় ব্যস্ত। ওদিকে বিরোধী দলের প্রধান নেতা একসঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের হয়ে কাজ করে আখের গোছাচ্ছেন। তিনি হলেন কাশ্মীরের স্বঘোষিত আধ্যাত্মিক নেতা। ভারতের দেওয়া প্রহরীরা তাঁর বাড়ি পাহারা দেয়। কোনো রোজগার না থাকলেও তাঁর পরিবার বিলাসিতার মধ্যে দিন কাটায়। গোপনে তিনি ভারতের সঙ্গে আলাপ চালান এবং প্রায়ই সেই সংবাদ ফাঁস হয়ে যায়। আবার প্রতিবছর একবার ধর্মীয় সফরে পাকিস্তানে গিয়ে সেদিকের লাইনঘাটও ঠিক রাখেন। ভারত তাই আমাদের আন্দোলনকে ভয় পায় না। কারণ তারা জানে, আমাদের নেতারা বেঈমান। এটাই হলো ভারতের সুবিধা।’
জারদারির সরকারও কাশ্মীর নিয়ে চুপচাপ। পাকিস্তানের গণমাধ্যমও সাম্প্রতিক হত্যকাণ্ডগুলো নিয়ে তেমন সোচ্চার নয়। পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর কাছে কাশ্মীর হলো ভারতের সঙ্গে দরকষাকষির বিষয়। তাদের মনোভাব এমন: ‘আমাদের আফগানিস্তান দাও, তোমরা কাশ্মীর নাও’। জারদারি হলেন একমাত্র পাকিস্তানি নেতা, ভারতীয় কাশ্মীরে যাঁর কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়েছে। পাকিস্তানি নেতৃত্ব ও মন্ত্রীদের কাশ্মীরের মুক্তির থেকে বেশি আগ্রহ ব্যবসায়িক লেনাদেনায়। এ অবস্থা ওয়াশিংটনেরও মনঃপুত। ভারত এখন তাদের প্রধানতম মিত্র। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের অনীহায় প্রমাণ হয়, কাশ্মীরের বর্তমান অসন্তোষের পেছনে পাকিস্তানের হাত থাকার অভিযোগ ভিত্তিহীন। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পরে পাকিস্তান কাশ্মীরে যে জেহাদি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল, ৯/১১ ঘটনার পরপর তা ভেঙে দেওয়া হয়। কাবুলে বিজয়লাভের সুবাদে পাকিস্তান ভেবেছিল, একই কৌশলে তারা কাশ্মীরেও জয়ী হবে। কিন্তু তাদের পাঠানো জঙ্গি তৎপরতা বরং কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষতিই করেছে। অন্যদিকে, নেতৃত্বের আপসকামিতায় হতাশ কিছু যুবকও চরমপন্থার আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের পথ ছিল ভুল।
২০০৮ সালের আগস্ট মাসে ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা যখন দিল্লির লাল কিল্লায় স্বাধীনতা দিবস পালন করছিলেন, সে সময় কাশ্মীরে গণঅসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। লাখো মানুষ সেদিন শান্তিপূর্ণভাবে শ্রীনগরের জাতিসংঘের দপ্তরের দিকে মিছিল করে যায়। তারা কুশপুত্তলিকা পোড়াতে পোড়াতে স্লোগান দেয়, ‘আজাদি, আজাদি’। তাদের দাবি, ভারত কাশ্মীর ছেড়ে যাক। সেই আন্দোলন দমন না করে বরং উপেক্ষা করা হয়েছিল। এখন তরুণ প্রজন্ম আবার আজাদির দাবিতে মিছিল করছে। তারা লড়াই করছে ফিলিস্তিনি তরুণদের মতো হাতে পাথর নিয়ে। অনেকেই মৃত্যুর ভয় অতিক্রম করেছে এবং তারা আত্মসমর্পণও করবে না। স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা তাদের উপেক্ষা করছেন, পাকিস্তান তাদের ত্যাগ করেছে। কিন্তু ভারতীয় সেনা সদস্যরা যতই শ্রীনগরের রাস্তায় অস্ত্র হাতে কুচকাওয়াজ করুন না কেন, এই চেতনা তাদের নিজস্ব এবং শিগগিরই তা স্তিমিত হবে না।
লন্ডন রিভিউ অব বুকস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
তারিক আলি: পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক ও বুদ্ধিজীবী।
No comments